পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বৎসর বয়সে এক গর্তের মধ্যে পড়িয়া তাহার উরু ভাঙিয়া যায়। সেই অবধি সে খোড়া হইয়াই থাকে এবং কোনো ভারী কাজ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়ে। গরিবের ছেলে, তাহার তো অলস হইয়াও পড়িয়া থাকিলে চলে না—কাজেই জন অনেক ভাবিয়াচিন্তিয়া এক বুড়া মুচির কাছে জুতা সেলাইয়ের কাজ শিখিতে গেল। তার পর শহরের একটা গলির ভিতরে ছোটো একটি পুরাতন ঘর ভাড়া করিয়া সে একটা মুচির দোকান খুলিল।

 জনের রোজগার বেশি ছিল না, কিন্তু সে মানুষটি ছিল নিতান্তই সাদাসিধা: সামান্যরকম খাইয়া-পরিয়াই স্বচ্ছন্দে তাহার দিন কাটিয়া যাইত। এমন-কি, কয়েক বৎসরের মধ্যে সে কিছু টাকাও জমাইয়া ফেলিল। তখন সে ভাবিল, “এখন আমার উচিত আমার ভাইদের কিছু সাহায্য করা।” তাহার দাদার এক ছেলে ছিল, সে ছেলেটি জন্মকাল হইতেই খোড়া মতন, তাহার পা দুইটা বাকা। জন দাদাকে বলিল, “এই ছেলেটির ভার আমি লইলাম।” ছেলেটিকে লইয়া জন ডাক্তারকে দেখাইল। ডাক্তার বলিলেন, “এখন উহার হাড় নরম আছে, এখন হইতে যদি পায়ে “লাস্’ বাধিয়া রাখ, তবে হয়তো সারিতেও পারে।” সামান্য মুচি, লাস্ কিনিবার পয়সা সে কোথায় পাইবে? সে রাত জাগিয়া পরিশ্রম করিয়া নিজের হাতে লাস্ বানাইল, এবং সেই লাস্ পরাইয়া, যত্ন ও শুশ্রষার জোরে অসহায় শিশুটিকে ক্রমে সবল করিয়া তাহার খোড়ামি দূর করিল।

 ততদিনে ছেলের লেখাপড়া শিখিবার বয়স হইয়াছে। পাউণ্ডস নিজেই তাহাকে শিক্ষা দিবার আয়োজন করিতে লাগিল। তাহার প্রথম ভাবনা হইল এই যে, একা একা লেখাপড়া শিখিলে শিশুর মনে হয়তো ফুতি আসিবে না, তাহার দু-একজন সঙ্গী দরকার। এই ভাবিয়া সে পাড়ার দু-একটি ছেলেমেয়েকে আনিয়া তাহার ক্লাশে ভতি করিয়া দিল। দুটি একটি হইতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দেখিতে দেখিতে পাঁচ-সাতটি হইয়া উঠিল। কিন্তু তাহাতেও খোড়া মুচির মন উঠিল না—সে ভাবিতে লাগিল, “আহা, ইহারা কেমন আনন্দে উৎসাহে লেখাপড়া শিখিতেছে; কিন্তু এই শহরের মধ্যে এমন কতশত শিশু আছে, যাহাদের কথা কেহ ভাবিয়াও দেখে না।” তখন সে আরো ছাত্র আনিয়া তাহার ছোট্টো ক্লাশটিকে একটি রীতিমতো পাঠশালা করিয়া তুলিল।

 যেদিন তাহার একটু অবসর জুটিত, সেইদিনই দেখা যাইত জন পাউণ্ডস খোড়াইতে খোড়াইতে রাস্তায় রাস্তায় ছেলে খুজিয়া বেড়াইতেছে। যত রাজ্যের অসহায় শিশু, যাদের বাপ নাই, মা নাই, যত্ন করিবার কেহ নাই, তাহাদের ধরিয়া ধরিয়া সে তাহার পাঠশালায় ভতি করিত। ছেলে ধরিবার জন্য তাহার প্রধান অস্ত্র ছিল আলুভাজা! প্রথমে এই আলুভাজা খাওয়াইয়া পাউণ্ডস রাস্তার শিশুদের ভুলাইয়া আনিত। আলুভাজার লোভে তাহারা পাঠশালায় আসিত, কিন্তু যে আসিত সে আর ফিরিত না। মাস্টারমহাশয়ের কী যে আকর্ষণশক্তি ছিল, আর ঐ অন্ধকার পাঠশালার মধ্যে কী যে মধু ছেলেরা পাইত, তাহা কেহই বঝিত না, কিন্তু ছায়ের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিল।

 চারহাত চওড়া, বারোহাত লম্বা, সরু বারান্দার মতো ঘর; তাহার মাঝখানে

৮০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী -