পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভালোমানুষ ছিলেন, সামান্য দুঃখ, কষ্ট বা উত্তেজনায় বিচলিত হইয়া পড়িতেন, কিন্তু অপরদিকে তাঁহার মনের এমন অসাধারণ বল হিল, ঘোর বিপদের মধ্যে ও রোগের যাতনার মধ্যে তিনি শান্তভাবে কাজ করিয়া যাইতেন। সমস্ত জীবন তিনি বোমা ও বারুদের মশলা লইয়া নানারকম পরীক্ষা করিয়াছেন। এই পরীক্ষায় যে সকল সময়ে প্রাণটি হাতে করিয়া চলিতে হয়, তাহা তিনি জানিতেন; ইহাতে যে অনেক লোকের প্রাণ গিয়াছে তাহাও তাঁহার জানা ছিল, কিন্তু সে চিন্তা তাঁহাকে নিরস্ত করিতে পারে নাই।

 আলফ্রেড নোবেলের পিতা রুশিয়ার যুদ্ধ কারখানার কারিকর ছিলেন। গোলাবারুদ লইয়া তাঁহার করিবার, এবং সেই কাজে বালক নোবেলও তাঁহার সহায় ছিল। কেবল যে যুদ্ধের কাজেই বারুদের ব্যবহার হয় তা নয়। তার একটি মস্ত কাজ পাহাড় ভাঙা। রেলপথ বসাইবার জন্য এবং রাস্তাঘাট বা সুড়ঙ্গ খুঁড়িবার জন্য অনেক সময়ে পাহাড় ভাঙিয়া সমান করিতে হয়। কোদাল ঠুকিয়া এই কাজ করিতে গেলে অসম্ভবরকম পরিশ্রম ও সময় নষ্ট করিতে হয়। সাধারণ বারুদের সাহায্যে এ কাজ অনেকটা সহজ হয়, কিন্তু বারুদের তেজও সব সময়ে এ কাজের পক্ষে যথেষ্ট নয়। নোবেলের সময়েও অনেক জিনিসের কথা লোকে জানিত, যাহার তেজ বারুদের চাইতেও ভয়ানক কিন্তু এই-সমস্ত জিনিস এত সামান্য কারণে ফাটিয়া যায় যে তাহাকে কাজে লাগাইতে কেহ সাহস পাইত না। কাজ করিতে গিয়া সামান্য একটু গরম বা সামান্য একটু আঁচড় অথবা ধাক্কা লাগিলেই ঘরবাড়ি উড়িয়া এক প্রলয়কাণ্ড বাধিয়া যাইত। নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করিয়া সে অসুবিধা দূর করেন। ডিনামাইটের শক্তি সাধারণ বারুদের চাইতে আটগুণ বেশি অথচ তাহাকে লইয়া সাবধানে নাড়াচাড়া করিলে কোনো ভয়ের কারণ নাই।

 ডিনামাইট ছাড়াও তিনি আরো অনেকরকম বারুদের মশলা আবিষ্কার করেন। আজকাল কামানের গোলা ছুঁড়িবার জন্য যে-সকল প্রচণ্ড বারুদ ব্যবহার হয় তাহাও নোবেলের আবিষ্কারের ফল। এই-সমস্ত সাংঘাতিক জিনিসের কারবারের জন্য নোবেল বড়ো-বড়ো কারখানা বসাইয়া পৃথিবী জুড়িয়া প্রকাণ্ড ব্যবসা চালাইয়া, তাহাতে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিয়াছিলেন। একবার একটি কারিকরের অসাবধানতায় সমস্ত কারখানাটি উড়িয়া যায় এবং অনেক লোক মারা পড়ে ও অনেক লক্ষ টাকা নষ্ট হয়। তাহাতেও নোবেলের উৎসাহ দমে নাই—তিনি অবাির নূতন করিয়া কারখানা করাইলেন এবং এরূপ দুর্ঘটনা যাহাতে আর না হয়, তাহার জন্য অনেক সুন্দর বন্দোবস্ত করিলেন। সে কারখানা আজও চলিতেছে।

 কারখানার ভিতরে যদি ঢুকিয়া দেখ, তাহা হইলে বুঝিবে ‘সাবধান হওয়া' কাহাকে বলে। যে-সকল স্থানে বিপদের সম্ভাবনা সেখানে প্রত্যেক ঘরের চারিদিকে মাটি উঁচু করিয়া পাহাড়ের মতো দেওয়াল দেওয়া হইয়াছে। ঘরগুলি খুব হালকা করিয়া তৈয়ারি, তাহার মেজের উপর পুরু করিয়া চট মোড়া। যাহারা কাজ করে, তাহাদের পায়ে কাপড়ের জুতা—কোথাও কোনো শব্দ করিবার নিয়ম নাই। সেখানে আগুন জ্বালানো দূরে থাকুক, কারখানার ত্রিসীমানার মধ্যে দিয়াশলাই আনিতে দেওয়া হয় না। কোনো-

জীবনী
৮৫