পাতা:সে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 অদ্ভুত হাঁড়িগলায় এই জীবটা বললে, কী দাদা চিনতে পারছ না। আমি যে তোমার পুপেদিদির সে। এখানে যে আমার নেমন্তন্ন ছিল।

 আমি বললুম, বাজে কথা বলছ, এ কী চেহারা তোমার।

 সে বললে, চেহারাখানা হারিয়ে ফেলেছি।

 হারিয়ে ফেলেছ। মানে কী হোলো।

 মানেটা বলি। পুপেদিদির ঘরে ভোজ, সকাল সকাল নাইতে গেলেম। বেলা তখন সবেমাত্র দেড়টা। তেলেনিপাড়ার ঘাটে বসে ঝামা দিয়ে ক’সে মুখ মাজ্‌ছিলুম; মাজার চোটে আরামে এমনি ঘুম এল যে, ঢুলতে ঢুলতে ঝুপ্‌ ক’রে পড়লুম জলে। তারপরে কী হোলে জানিনে। উপরে এসেছি, কি নিচে কি কোথায় আছি জানিনে, পষ্ট দেখা গেল, আমি নেই।

 নেই।

 তোমার গা ছুঁয়ে বলছি-

 আরে আরে গা ছুঁতে হবে না, বলে যাও।

 চুলকুনি ছিল গায়ে, চুলকতে গিয়ে দেখি, না আছে নখ, না আছে চুলকনি। ভয়ানক দুঃখ হোলো। হাউহাউ ক’রে কাঁদতে লাগলুম, কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে হাউহাউটা বিনামূল্যে পেয়েছিলুম, সে গেল কোথায়। যত চেঁচাই চেঁচানোও হয় না কান্নাও শোনা যায় না। ইচ্ছে হোলো মাথা ঠুকি বটগাছটাতে, মাথাটার টিকি খুঁজে পাইনে কোথাও। সব চেয়ে দুঃখ, বারোটা বাজল, ক্ষিদে কই ক্ষিদে কই ব’লে পুকুর ধারে পাক খেয়ে বেড়াই, ক্ষিদে বাঁদরটার চিহ্ন মেলে না।

 কী বক্‌ছ তুমি, একটু থামো।

 ও দাদা, দোহাই তোমার থামতে বোলো না। থামবার দুঃখ যে কী অ-থামা মানুষ সে তুমি কী বুঝবে। থামব না, আমি থামব না, কিছুতেই থামব না, যতক্ষণ পারি থামব না।

৬৯