পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/১১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র আফিসের গেটও বন্ধ হইয় গেল। সেদিন শনিবার। —দরজা বন্ধের আওয়াজটা এমন জোরে শরতের বুকে ধাক্কা দিল যে, ক্ষণকাল জ্ঞানশূন্তের মতই সে সেই ফুটপাথের উপর বদ্ধপদ হইয়া দাড়াইয়া রহিল। শরতের এতটা নৈরাশু শ্ৰীধরের নিকট ভারী হাস্ত্যজনক বলিয়া মনে হইল। তথাপি হাসিটা চাপিয়া লইয়া সাত্ত্বনার স্বরে সে বলিল,—“এত মুষড়ে পড়লে ক্লেন হে? ক্যাবিনু আজ এন্‌গেজ করা হোল না তাতে আর ক্ষতিটা কি এমনই ? জাহাজ ত আর আজই ছাড়ছে না—ছাড়বে সেই ১৫ই, আর আজ মাসের ছ-তারিখ । চল চল আজ রেসের দিন, সেখানে যাওয়া যাকৃ, মন-টন সব ভাল হয়ে যাবে ।” ঠিক! গাড়ীর গাড়োজান শরতের চেন লোক, জিনিষ-পত্র সহ তাছাকে বিদায় করিয়া দিয়া জুই বন্ধুতে পদব্রজে রেস-কোসের দিকে চলিল। গেটের নিকট পৌছিয়া, দুখান টিকিট কিনিয়া লইয়া তাহার একটা প্রাঙ্গণে আসিয়া পড়িল । ভিতরে ঢুকিয়াই শ্ৰীধর মুহূৰ্বমধ্যে কোথায় যে অদৃগু হইয়া গেল, তাহার টিকি পৰ্য্যস্ত আর দেথা গেল না । এই জনাকীর্ণ অপরিচিত রাজ্যে একাকী পড়িয়া প্রথমটা শরৎ কেমন একটা বিজনতা উপলব্ধি করিল। ক্রমশঃ সে ভাবটা কাটাইয়। উঠিয়া চারিদিকে ঘূরয়া ফিরিয়া বেড়াইতে লাগিল। এই স্ববিস্তৃত প্রাঙ্গণে “বুকমেকারীগণ স্থানে স্থানে দীড়াইয়া বাজি-খেলার টিকিট বিক্রয় করিতেছিল। তাহাদের সম্মুখে টাঙ্গান বোর্ডে যে যে ঘোড়া এ যাত্র দৌড়িবে, তাহীদের নাম লেখা । সেখানে ভিড় করিয়া দাড়াইয়া ব্যক্তিদারগণ তাহা পড়িতেছে, পড়িয়া ঘোড়া বাছিয়া সাধ্যমত বা অসাধ্যমত কোন একটা বা ততোষিক ঘোড়ার নামে বাজির টাকা জমা দিতেছে । শরৎকুমার এইরূপ দু-একটা ভিড়ের পাশ কাটাইয়া দৌড়চক্রের নিকটে বেড়ার ধীরে আসিয়া দাড়াইল । এই স্থান—বিশেষতঃ এরূপ দৃপ্ত তাহার নিকট সম্পূর্ণই নুতন —শরৎ যে বিকাল বেলাটাও ঘরে বসিয়া কাটায় এমন নহে, তত দুর ভাল ছেলে সে নয়। গড়ের মাঠের বেঙ্গলী ব্যtয়াম ক্লবের সে এক জন মেম্বর । প্রায়ই বিকালবেল। সে মাঠে আসিয়া কোনদিন খেলিত, কোনদিন বা খেলা দেখিত ; কিন্তু ইহার পর আর কোন স্থানে যাইবার তাহার সময় হইত না ; সখও ছিল না । ইতিপূৰ্ব্বে অনেকগুলা দৌড় হইয়া গিয়াছে। আর একটা আরম্ভের এখনো কিছু সময় আছে, ه د-ـــ-ۀنه SSల তবুও বেড়ার ধারে ইতিমধ্যে লোক জমিতে আরম্ভ হইয়াছিল । দেখিতে দেখিতে আরোহী- ( জকি ) পরিচালিত বহু অশ্ব চক্ৰ-মধ্যে সারি দিয়া দাড়াইল । সঙ্কেতকার ( Starter) সাঙ্কেতিক যন্ত্র খুলিয়া দিয়া সঙ্কেত করিবামাত্র মুহূৰ্ত্তে সেই সকল অশ্ব একই সঙ্গে চক্রপথ আলোড়িত কৰিয়া ক্ষিপ্ত বেগে ছুটিল। দর্শকগণ মাতিয়া উঠিল, অশ্বের প্রতিপদক্ষেপে বাজিখেলোয়াড়দিগের হৃৎপিওে রক্তস্রোত দারুণ বেগে উঠিতে পড়িতে লাগিল ; জকিগণ নিজ নিজ ঘোড়াকে সৰ্ব্বাগ্রে চালাইবার চেষ্টায় প্রাণের প্রতি মায়ামমতা ভুলিয়া গেল ! কি এ বিকট উত্তেজনা । সৰ্ব্বগ্রাসী উন্মাদন ! বিরাট বিশ্বের ঝটিকা-আবৰ্ত্তন যেন এই ক্ষুদ্র বেষ্টনীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হইয়া অন্তভুক্ত নরনারীকে উন্মত্ত দোলায় দোল দিতেছে । এক জন জকি মধ্য-পথে ঘোড়া হইতে পড়িয়া গেল। মাথা ফাটিয়া তাহার সর্বশরীর রক্তাক্ত হইয়া উঠিল । কিন্তু তাহার প্রতি মায়ামমতা দেখাইবার সময় ইহা নহে। একটা বেগবান অশ্ব জকির গা ধেসিয়া চলিয়া গেল । মনে হইল, তাহার জামুর উপর যেন ঘোড়াটার পায়ের আঘাত পড়িল । দু'চারিজন কোমলহৃদয় দর্শক অtহা অহা করিয়া উঠিল, শরৎকুমার দুই হাতে আপনার চক্ষু ঢাকিয়া ফেলিল । যখন হাত সরাইয়া পুনরায় চক্রের দিকে চাহিল, তখন আর সেই হতভাগ্য জকিকে সেখানে দেখিল না, -- তখন ঘোড়া ৮ নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া পড়িয়ছে । সহসা অণকাশভেদী রবে সম্মান-জয়ধ্বনি উঠিল । রণজির নাসিক সৰ্ব্বাগ্রে দেখা গিয়াছে, তাহারই জিং । আহলাদে গৰ্ব্বে তাহার জকির মাথাটা যেন অধি হাত উচ্চ হইয়া উঠিল । ‘বেটি’ ও ‘মুইটি রণজির প্রায় কাছাকাছি আসিয়া দাড়াইয়াছিল। এ ক্ষেপ দৌড় এইরূপে শেষ হইয়া গেলে, রণজির অমৃবৰ্ত্তা ভাবে অশ্বগণ জয়ধ্বনির মধ্যে স্বস্থানে ফিরিয়া চলিল । আর সকলে বেড়ার ধার হইতে সরিয়া যাইবার পুৰ্ব্বেই শরৎকুমার সেই আহত জকির সন্ধানে যাত্রা করিয়াছিল ! আপনাকে ডাক্তার রূপে পরিচয় দিয়া সে অবিলম্বে আহতের শুশ্ৰুষার স্থানে আসিয়া দেখিল, তাহার কলেজেরই এক জন পরিচিত ডাক্তার জকির মাথা বাধিয়া দিতেছেন । শরৎ সাহায্য করিতে চাহিলে তিনি প্রফুল্লচিত্তে তাহীকে ধন্যবাদ দানপুৰ্ব্বক জকির জামু পরীক্ষা কয়িতে বলিলেন । সাতিশয় তৎপরভাবে পরীক্ষাপুৰ্ব্বক শরৎ জানাইল যে, যত দূর মন্দ হইয়াছে বলিয়া মনে করিয়াছিল,