পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র ১২৩ প্রায় দুই বৎসরকাল ভট্টচার্য, মহাশয় বালিকার সংস্কৃত শিক্ষকতায় নিযুক্ত হইয়াছেন, বাড়ীর সকলে প্রত্যাশা করিয়া আছে—এইবার অচিরাৎ ভারতে দ্বিতীয় গার্গা’ বা উভয় ভারতীর অভু্যদয় তাহার দেখিবে। পণ্ডিত মহাশয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা আরও অধিক,—দ্বিতীয় কেন, ছাত্রীকে অদ্বিতীয় পণ্ডিত করিয়া তোলাই তাহার অভিপ্রায় । কেন না, এইজন্যই তিনি বেতনভোগী. অধিকন্তু এই কাৰ্য্য সাধন করিতে পারিলে – পরলোকের অপেক্ষায় অণর তাহাকে থাকিতে হয় .না, ইহলোকেই হাতে-হাতে পুরস্কৃত হইতে পারেন। কিন্তু সকলের এত বাসনা-কামনা ব্যর্থ করিয়া জ্যোতিৰ্ম্মী সংস্কৃত-শিক্ষার উপলক্ষে দীক্ষিত হইল কিসে ? না দেশামুরাগে । রাজকুমারীর সংবাদপত্র পডিবার নেশা কখনও ছিল না—এখনও নাই, কিন্তু জ্যোতিৰ্ম্ময়ী শুনিতে চাক্ বা নাই চাকৃ, তাহাতে কিছুষ্ট আসে-যায় না, —যত রাজ্যের সংবাদ বহন করিয়া অনিয়া পণ্ডিত মশায় ছাত্রীকে শুনাইয়। পরিতৃপ্তি লাভ করেন । কোন ইংরাজের পদাঘাতে কোন কুলীর প্লীহা ফাটিয়াছে, ট্রেণের গাড়ীতে ইংরাজ ফিরিঙ্গি কর্তৃক কোন দিন কোন ভারতবাসী লাঞ্ছিত , অপমানিত হুইয়াছে, কোটে ইংরজি ভারতবাসীর মকদ্দমায় কখন কিরূপ অবিচার হইতেছে, এই সব খবরক্ট প্রধানতঃ পণ্ডিত মশায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিয়া বলেন । শুনিয়া ক্রোধে বেদনায় জ্যোতিৰ্ম্ময়ীর গোলাপী বর্ণ আগুনের মত রাঙ্গা হইয় উঠে, তাহা দেখিয়া পণ্ডিত মহাশয়েব দেশপীড়নজনিত মনের জ্বালা অনেকটা প্রশমিত হইয়া আসে । এখন পণ্ডিত মশ}ম বলিতেছেন, “মফঃস্বলের একজন ইংরাজ ম্যাজিষ্ট্রেট অশ্বারোহণে ভ্রমণ করিবার সময় পার্শ্ববৰ্ত্তী এক জন ভদ্রলোককে চাবুক মারিয়াছে. ভদ্রলোকটির অপরাপ, অন্তমনাবশত র্তাহীকে সেলাম করিতে ভুলিয়া গিয়াছিল।” এই সংবাদে জ্যোতিৰ্ম্ময়ী যেন নিজের অঙ্গেই কষাঘাত অনুভব করিয়া উদ্দীপ্ত কাতরস্বরে কহিল— “আমি অণর শুনিতে পারি না।” পণ্ডিত মশায় এত সহজে যদিও দমিবীর পfত্র নহেন, কেন ন মুখ বন্ধ রাথিতে হক্টলে দম ফাটিয়া তাহার প্রাণবায় বাছিব হইয়। যাইবার সম্ভবনা, তথাপি তিনি একটু হতাশার স্বরে কহিলেন - “তবে থাকু, এ সব কথা তোমার মত বালিকার না শোনাই ভাল । পড়।” “না, এখন আমার পড়তেও ইচ্ছা করছে না।” পণ্ডিত মহাশয় ঠাঙ্গার হাঙ্গের অমৃতবাজাৱ পত্রিকাথানির পাতা উটাইয় তাহার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করিয়া অন্তমনে বলিলেন, “তবে অন্বয় কর ? কস্মিংশ্চিদবনে ভামুরকে নাম সিংহঃ প্রতিবসতি স্ম।” প্রথম পাঠ বালিকার অনেক দিন শেষ হইয়াছে ---এখন সে পড়ে রঘুবংশ মুগ্ধবোধ ইত্যাদি। কিন্তু পণ্ডিতের কথায় প্রতিবাদ না করিয়া বালিকা অন্বয় করিল –কস্মিংশ্চিৎ প্রদেশে অসুরকে নাম সিংহস্বাসয়তি জনগণন । পণ্ডিতমহাশয় বুঝিলেন, একটা গলদ করিয়া ফেলিয়াছেন, বালিকার দিকে চাহিয়া একটু উত্তেজিত স্বরে বলিলেন—“দেখ রাজকুমারি, হাসিতামাসার কাল এ নয় ।” “আমি হাসি-তামাসা করি নি—প্রাণ থেকে যা অমুভব করছি তাই বলছি । পড়তে পারব না এখন পণ্ডিতমশায় ।" বলিয়া হাতের বইখানা জ্যোতিস্ময়ী ছুড়িয়া নীচে ফেলিয়া দিল । গৃহের একপাশ্বে তাহার শিক্ষয়িত্রী কুন্দবাল! চৌকিতে বসিয়া নীরবে সেলাই করিতেছিল। বইখান উঠাইয়া টেবিলে রাখিয়া সে কহিল, “রাজকুমারি, সংবাদপত্ৰে ক’টা পীড়নের কথাই বা প্রকাশ হয়--! আপনি তাই শুনেই এত অধীর হয়ে ওঠেন, সব কথা কানে গেলে না জানি কি করতেন ! দেখুন দুৰ্ব্বল হ’লেই সহ করতে হয়, এটা জগতের নিয়ম, ইংরাজ-বাঙ্গাৰ্গীর কথা ছেড়ে দিন, আমাদের দেশে দুৰ্ব্বলা অসহায়া নারীজাতির যে কিরূপ কষ্ট, কত লাঞ্ছন ভোগ করতে হয়, একটু বড় হ’লে তথন বুঝবেন ।” পণ্ডিতমহাশয় দেখিলেন বেগতিক, কিছুদিন পূৰ্ব্বে তাহার স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে, আর তাহার অযত্নঅনাদর যে কতক পরিমাণে ইহার কারণ নয়, তাহা ত তিনি মনে কংিতে পারেন না । একটু তাড়াতাড়ি তিনি বলিলেন,--"তবে আমি আজ উঠি, আজ ত দেখছি তোমার পড়া তবেই না ।” “না পণ্ডিতমশায় বলুন, আর কিছু খবর থাকে ত বলুন। আমি ভেবে দেখছি—কষ্ট হয় ব'লে কষ্টকর কথাগুলিকে তফাতে রাখাটা ঠিক নয় । তাতে ত পীড়ন বন্ধ হবে না !" জ্যোন্তিৰ্ম্মল্পীর অনুজ্ঞায় পণ্ডিতমশায় পরিত্যক্ত চেয়ার পুনগ্রহণ করিলেন । কুন বালা বলিল—- “আমি প্রত্যক্ষ ঘটনা দু-একটা জানি, শুনবেন রাজকুমারি ? আমার একটি খুড়তুত ভাই ভাগলপুরের ষ্টেশন-মাষ্টার, তিনি স্বচক্ষে ঘটনাটি দেখেছেন।” “বল না কুনীবালা ?” বালিকা কিছু বলিবার