মিলন-রাত্রি ইহারা পুলিসের লোক। তিনি আত্মগোপন-মানসে একটা ঝোপের মধ্যে সরিয়া দাড়াইয়া সেখান হইতে উহাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। এক জন মনুস্থ অঙ্গুলিসঙ্কেতে উঠাদিগকে কি কথা বলিয়া সখীন হইতে চলিয়া আসিল । যে ঝোপের মধ্যে তিনি দাড়াইয়া ছিলেন, তাহার কাছ দিয়াই সে সরিয়া পডিল ; তবুও স্পষ্টরূপে তাহীকে তিনি চিনিতে পারিলেন না ; কিন্তু দেহগঠনে এবং চলিবার ভঙ্গীতে তাহীকে বিজনকুমার বলিয়াই তাহার মনে হইল । বিজু মিঞা গোয়েন্দাগিরি করিয়া তাঁহাদের দলবলকে ধরাইয়া দিল না কি ! তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ ঘৃণায় কুষ্ঠিত হইয়া উঠিল । এখন তিনি কি করিবেন ? তাহার ত আর কোন কৰ্ত্তব্য এখানে নাই । অলক্ষ্যে তিনি ত স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতে পারেন । কিন্তু প্রতারিত সেবাধারীদিগের প্রতি তাহার কেমন একটা অনুকম্প জাগিয়া উঠিল। হায় ৱে ভ্রান্ত বালকগণ যাহাদের বিশ্বাস করিয়া পাপকে পুণ্যকাৰ্য্য বলিয়া তোমরা বরণ করিয়াছ, তাহারাই তোমাদের গলায় ফাসী বধিতেছে । হে দেশোদ্ধারী পুরোহিত, তোমাকে ধন্ত ! খৃষ্টান পাদরীর ন্যায় র্তাহার মনে হইল, তিনি যদি ইহাদের রক্ষণ করিতে পারেন, তবে তাহারা ন্যায়ুপথে ফিরিবেই ফিরিবে । কিন্তু তাহার শুভ ইচ্ছা কার্যে পরিণত করিবার অবসর কই । পুলিসদল যখন জঙ্গলপথে প্রবেশ করিল তখন সেবাধারী ডাকাতগণ মন্দির ৬ইতে ফিরিয়া আসিতেছে । তাহাদিগকে দেখিবণমাত্র পুলিস বিক্ষিপ্তভাবে বত্র তত্র বন্দুক চালাইতে আরম্ভ করিল ; সন্মুখসমরে স্বৰ্গারোহণের আশা দুরাশা জানিয়া ডাকাতরাও বন্দুক চালাইতে চালাইতে বনপথে অদৃপ্ত হষ্টয়া পড়িল, বনপথ পুলিসের অপেক্ষ তাহাদেরই জান। ছিল ভাল । পুলিস তাহদের অনুসরণ করিল না। এই স্বল্পক্ষণস্থায়ী যুদ্ধবিপ্লবে দুই জন পুলিস আহত হইয়া ভূমি-শায়ী হইল। ডাকাতদিগের সম্ভবতঃ কেহই আহত হয় নাই ; কারণ, তাঙ্গদের কাছাকেও এখানে পাওয়া গেল না । আহতের আর্তনাদ শুনিয়া শরৎকুমার স্থির থাকিতে পারিলেন না। রাজাকে যে কথা দিয়াছিলেন, তাহ একেবারেই ভুলিয়া গেলেন, ডাক্তারের কৰ্ত্তব্যই একমাত্র তাছার মনে পরিপূর্ণভাবে জাগিয়া উঠিল, তিনি দ্রুত্তপদে তাহীদের নিকট আসিয়া দাড়াইলেন । HI দারোগ মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন--"কে তুমি ?” উত্তর হইল—“আমি ডাক্তার।” পদোন্নতির আশায় পুলিস-সদ্ধার আহলাদে অlটখানা হইয়া উঠিলেন। এক জন বন্দীও ত ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজির করিতে পরিবেন। তিনি মুখভবা হাসি হাসিয়া বলিলেন—“পথ ভুলে বুঝি এসে পড়েছ ? বেশ বেশ ! চল হে থানায় গিয়ে ডাক্তারী পরীক্ষা দেবে ।” শরৎকুমার বন্দীরূপে পুলিসদলেব সহযাত্রী হইলেন । চতুবিবংশ পরিচ্ছেদ অকুলের তরী দুইখানা ঈর্ষাদ্বন্দ্বে মাতিয়া তরঙ্গে তরঙ্গে উঠিয়া পডিয়া কুলের দিকে চলিয়াছে ; কর্ণধার দুই জন বাচ খেলিতেছেন। উভয়েই সমান শক্তিশালী, তাহাদের সুদক্ষ চালনায় উভয় তরীই সমান বেগে ধাবিত। একথান। যদি বা ক্ষণতরে অগ্রসর হইয়া যায়, অন্তখান তৎক্ষণাৎ তীয়বেগে তাহার পাশ্বদেশ অধিকার করিয়া লয় । রহস্যময় নিম্নতির এ কি খেলা ! এ খেলার শেষ কোথায়,-— জয়-পরাজয় কখন এবং কিরূপে,—দর্শক আমি উচ্চ চূড়ায় বসিয়া কৌতূহলাত্ৰণগুচিত্তে নিনিমেষ কৌতুকব্যগ্র দৃষ্টিতে তাহাই লক্ষ্য করিতেছি । শরৎকুমার বন্দী হইয়াছেন, তাঙ্গ পাঠক জানেন এবং বিজন রায়ের কৰ্ম্মচক্র ও যে তাহীকে কোথায় আনিয়া ফেলিয়াছে—তাহার ও ইঙ্গিত তিনি পাষ্টয়াছেন। বিজন সত্যই এখন গুপ্তদলের গোয়েন্দা । তবে এই সত্য হইতে পাঠক যদি সাব্যস্ত করিয়া বসেন যে, একান্ত স্বার্থসাধন উদ্বেগুই এই ঘটনামূলে নিহিত, তাহা হইলে শরৎকুমারের ন্যায় তিনিও ভুল করিবেন। প্রকৃতপক্ষে সে অতদূর হীনপ্রকৃতির লোক নহে। দেশত্রত যে গ্রহণ করে— তাহার মধ্যে উচ্চভাব যে কতক পরিমাণে থাকিবেই, ইহা ধরা কথা । কিন্তু অবস্থাচক্রে শেষ রক্ষা করিতে না পরিলেই এ ভাব ক্রমশঃ প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি-পঙ্কিলতায় মিশিয়া যায়। মানুষ সাধাবণভঃ ভালমন্দের মিশ্রণ। অসাধারণ যাহারা, তাহারাই মাত্র অবস্থার নিগ্রহ বা অনুগ্রহের উপর নির্ভর না করিয়া আঞ্চম অণপন ভাগ্য-রচনায়—দেল বা দানব-শক্তির প্রকাশে বিশ্ব-সংসারকে বিক্ষিক, মুগ্ধ করিয়া তুলে ।