পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মিলন-রাত্রি 약 তৃতীয় পরিচ্ছেদ ময়দানে ছোটখাট বেশ একটি ভিড় জমিয়া গিয়া, ছিল । রাজকুমারীকে এদিকে আসিতে দেখিয়া সকলেই - এমন কি, পাহারাওয়ালারাও- তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিয়া সরিয়া দাড়াইল । তখন বালকের গান থামিয়াছে। শরৎকুমার দুই এক জন লোক সহ তাহার ক্ষতস্থান বাধিয়া দিতেছেন ; সে মাঝে মাঝে ফোপাইয়া ফোপাইয়া উঠিতেছে । রাজকুমারীকে দেখিয়া সে অস্পষ্ট ক্রনীনের স্বরে আবার ‘বন্দে মাতরম্ বলিয়া উঠিল । জ্যোতিৰ্ম্ময়ী সাশ্র-নয়নে তাছার দিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া নিকটে দণ্ডায়মান পুলিস দুই জনের দিকে ফিরিয়া দাড়াইয়া বলিলেন, “দেখ, বীরপুরুষ তোমরা, ভাল ক’রে এর দিকে চেয়ে দেপ । ছেলেটির ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত চেহারা দেখে কৃতাৰ্থ হও, আনন্দ অনুভব কর । তোমাদের এই কীৰ্ত্তি ইতিহাস-গাথায় অমর অক্ষরে লিখিত থাকৃবে।” জ্যোতিৰ্ম্মল্পীর ক্রোধ-উত্তেজিত শ্লেযপুর্ণ এই তিরস্কার বাক্য অক্ষরে অক্ষরে না বুঝিলেও ইহার মৰ্ম্ম তাহীদের হৃদয়ে পৌছিল । এক জন পাহারাওয়াল তাহার লজ্জীবনত দৃষ্টি হাতের লাঠির উপর স্থাপিত করিল, অন্ত জন উদ্ধত ক্রোধে বালকের দিকে চাহিল। জ্যোতিৰ্ম্মী আবার বলিলেন,—“ষাকে তোমরা এমন ক’রে জখম করেছ --সে কি তোমাদের শক্র ? না, তোমাদেরই এক জন ভাই ?” "ভাই"-কথাটা খুব জোরের সহিতই জ্যোতিৰ্ম্ময়ী উচ্চারণ করিলেন । “ভাই হয়ে ভাইয়ের প্রতি এমন নিৰ্য্যাতন ? কেন - কি জন্ত ? সে আমাদের অন্নপুর্ণ দেশমাতাকে ভক্তিভরে বন্দনা করেছিল, তার এই অপরাধে ? হায় রে দুভাগিনী মাতৃভূমির হতভাগ্য সস্তান তোমরা ! তোমাদের শত ধিক্ !” রাজকুমারী অতঃপর বালকের সেই পঢ়ি-বাধা মুখের দিকে কিছুক্ষণ করুণ কাতর নয়নে চাহিয়৷ থাকিয়া, মৰ্ম্মভেদী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সহসা সেই অমৃতপ্ত পাহারাওয়লাকে সম্বোধনপূর্বক বলিলেন, — “বল ত ভাই, একটি কথা তোমায় জিজ্ঞাসা করি ; ঘরে কি তোমার মা আছেন ?” সে সবিস্ময়ে উত্তর করিল,—“আছেন মা-জি।” জ্যোতিৰ্ম্ময়ী বলিলেন,—তোমার লাঠির ঘায়ে ছেলেটির দেহে যে রক্তধারা ছুটিয়েছ, ঘরে গিয়ে দেখ গে তোমার মায়ের বক্ষ-পাজরার মধ্যে ঐ রক্ত জ’মে গিয়েছে, বেদনায় তিনি ছটফট করছেন।” পাহারাওয়ালার মাত বহুদিন হইতে শুলরোগে পীড়িত, জ্যোতিৰ্ম্ময়ীর কথায় সে শিহরিয়া উঠিল । জ্যোতিৰ্ম্ময়ী বলিতে লাগিলেন,--“এই ক্ষতবেদন থেকে তখনি মাত্র তিনি শান্তিলাভ করবেন— যখন তুমি ভক্তিভরে "বন্দে মাতরম্ ব'লে উঠবে।" সহসা ভিড়ের মধ্য হইতে অস্পষ্ট গুঞ্জন-ধ্বনি উঠিল,—“এ গীত কি অন্নপূর্ণ মাতজির বন্দন ! তা ত নয় -বাঙ্গালী লোকের এ রাজ-বিরোধ ঘোষণা ।” জ্যোতিৰ্ম্ময়ী সচকিতে সেই দিকে দৃষ্টিপাতপূর্বক বলিলেন,—“ভুল কথা ! বাঙ্গালী লোক রাজবিরোধী নয়। বৃটিশ সরকারের মঙ্গলাকাজী অমুগত প্রজ। তাহারা ।” এই কথায় একাধিক পাহারাওয়াল অগ্রসর হইয়া দাড়াইয়া কহিল,—“তবে বাঙ্গালী লোক ম্যাজিষ্ট্ররের হুকুম মানছে না কেন ?” উত্তর হইল, “সরকার কি ম্যাজিষ্ট্রেটকে আমাদের ধৰ্ম্মে হাত দিতে হুকুম দিয়েছেন ? মাতৃ-বন্দনা মাতৃ-পুজা আমাদের ধৰ্ম্ম । রাজ-অনুরোধে কি ধৰ্ম্ম ত্যাগ করা যায়, তোমরাই বল ভাইয়া ।” প্রশ্নকারী পুলিস হতবুদ্ধি, নিরুত্তর হইয়া পড়িল । আকাশে আবার ‘বন্দে মাতরম্ ধ্বনি উঠিল । পূৰ্ব্বোক্ত অমুতাং পাহারাওয়ালার ইচ্ছা হইতে লাগিল— এই বন্দন গানে সে-ও যোগদান করে— কিন্তু বাক্য ফুৰ্ত্তি হইল না । অশ্বের গ্যালপ শব্দ শ্রত হইল—অদূরে অশ্বারোহী পুলিসকৰ্ত্তীর মূৰ্ত্তি দেখিয়া পাহারাওয়ালার মনের গতির দোলা অদ্যদিকে ফিরিল । যখন অশ্বরোহী নিকটে আসিয়া থামিলেন, তখন অন্তান্ত পুলিসদলের মত সে-ও সমতেজে উন্নতমস্তকে সৈনিক-প্রথায় প্রভুবন্দনা করিল। “পুলিস-সাহেব" জ্যোতিৰ্ম্ময়ীর পরিচিত ;–কত সময়ে তাহার পিতার ভোজ-নিমন্ত্রণ-টেবিলে অতিথি হইয়া একত্র আহার করিয়াছেন। তিনি টুপী খুলিয়। রাজকুমারীকে সন্মান প্রদর্শন করিলেন, রাজকুমারী প্রতিব্যবহারে মাথা নোয়াইয়া ভদ্রত। রক্ষণপুৰ্ব্বক বালককে দেখাইয়া বলিলেন—“দেখুন দেপি, আপনার লোকের এই নিরীহ বাচ্ছাটির কি অবস্থা করেছে । আপনার আজ্ঞাতেই অবশ্য এরূপ ঘটেছে ।” পুলিস-কৰ্ত্তা দেখিলেন—সত্যই বড় বাড়াবাড়ি পীড়ন হুইয়া পড়িয়াছে। অার এরূপ মারপিটে যে র্তাহীদের অভীষ্টসিদ্ধি হইবে না, জনসঙ্ঘের ব্যবহার হইতে ইতিপূৰ্ব্বেই তাহা বুঝিয়। তিনি ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত এ সম্বন্ধে পরামর্শ করিতে