পাতা:স্বামী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
স্বামী

 নাস্তিক বই কি? —মামা মুখে বলতেন বটে, তিনি ‘Agnostic” কিন্তু সেও তো একটা মস্ত ফাঁকি! কথাটা যিনি প্রথম আবিষ্কার ক’রেছিলেন, তিনি ত শুধু লোকের চোখে ধূলো দিবার জন্যেই নিজেদের আগাগোড়া ফাঁকির পিছনে আর একটা আকাশ-পাতাল-জোড়া ফাঁকি জুড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা ক’রেছিলেন! কিন্তু তখন কি ছাই এ সব বুঝেছিলুম! আসল কথা হ’চ্চে, সুয্যির চেয়ে বালির তাতেই গায়ে বেশি ফোস্কা পড়ে। আমার মামারও হ’য়েছিল ঠিক সেই দশা!

 শুধু আমার মা বোধ করি যেন লুকিয়ে ব’সে কি সব ক’রতেন। সে কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ জানতে পেত না। তা’ মা যা খুসি করুন, আমি কিন্তু মামার বিদ্যে ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা শিখে নিয়েছিলুম।

 আমার বেশ মনে পড়ে, দোরগোড়ায় সাধু-সন্ন্যাসীরা এসে দাঁড়ালে সঙ দেখবার জন্যে ছুটে গিয়ে মামাকে ডেকে আনতুম। তিনি তাদের সঙ্গে এমনি ঠাট্টা সুরু ক’রে দিতেন যে, বেচারারা পালাবার পথ পেত না। আমি হেসে হাততালি দিয়ে গড়িয়ে লুটিয়ে পড়তুম্। এমনি করেই আমার দিন কাট্ছিল।

 শুধু মা এক-একদিন ভারি গোল বাধাতেন। মুখ ভার ক’রে এসে ব’লতেন, “দাদা, সদুর তা দিন দিন বয়স হ’চ্চে, এখন থেকে একটু খোঁজা-খুঁজি না করলে, সময়ে বিয়ে দেবে কি ক’রে?”  মামা আশ্চর্য্য হ’য়ে বলতেন— “বলিস কি গিরি, তোর মেয়ে ত এখনো বারো পেরোয়নি—এর মধ্যেই তোর—সাহেবদের মেয়েরা ত এ বয়সে—”

 মা কাঁদ-কাঁদ গলায় জবাব দিতেন, “সাহেবদের কথা কেন তুল্চ দাদা, আমরা ত সত্যিই আর সাহেব নই! ঠাকুর-দেবতা না মানো, তাঁরা কিছু আর ঝগড়া করতে আস্চেন না, কিন্তু পাড়াগাঁয়ের সমাজ ত আছে? তাকে উড়িয়ে দেবে কি ক’রে?”