পাতা:স্মৃতিকথা (জ্ঞানদানন্দিনী দেবী).djvu/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৩
পুরাতনী  

কালীর সামনে হাতে ধুনো পোড়াবেন আর বুক চিরে রুধির দেবেন। যেদিন এই ক্রিয়া হবে সেদিন মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে কালীমন্দিরে গিয়েছিলেন। পুরুতের কথামত মা কালী-প্রতিমার সামনে আসন হয়ে বসলেন। বুক চিরে রুধির দেওয়ার ব্যাপারটা আমি আর নজর করে দেখিনি, তেমন মনে নেই। দেখলাম, আমার মায়ের দুই হাতের তেলোয় আর মাথার তেলোয় তিনটে বিড়ে রেখে তার উপর পুরুত ঠাকুর তিনটি আগুন-ভরা মালসা রাখলেন। মা স্থির ও আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলেন আর পুরুত সেই আগুনের উপর ধুনো দিতে লাগলেন। আমি প্রথমে কিছুক্ষণ ভীত চকিত হয়ে দেখতে লাগলুম। তারপর এমন কান্না জুড়ে দিলুম যে কেউ আমাকে থামাতে পারল না। তখন পুরুত ঠাকুর বাধ্য হয়ে বোধ হয় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তিনটি মালসা নাবিয়ে নিলেন। আমিও মায়ের কোলে গিয়ে খুশি হয়ে গেলুম।

 একবার পাড়ার এক সধবা গৃহিণী আমাকে কুমারী পুজো করেছিলেন। তিনি আমাকে স্নান করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে একখানা জলচৌকিতে বসিয়ে দিলেন। তারপর ফুল চন্দন এইসব নিয়ে কি পুজোর মত করলেন তা আমার বিশেষ কিছু মনে নেই। বড় বয়সে আমার এই কুমারী পুজোর কথা একজন খ্রীস্টান ভদ্রলোকের কাছে গল্প করেছিলুম। তিনি শুনে বেশ খুশি হয়ে বল্লেন, এইরকম আমাদের দেশেও পুজো করে।

 আমি খুবই আদরের মেয়ে ছিলুম। আমি যেন এই ক্ষুদ্র সংসারটির কেন্দ্রস্থল ছিলুম। আমার জন্যই সংসারের খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি সকল কাজের ব্যবস্থা হত। আমার ভালমন্দ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সকলেই ব্যস্ত থাকতেন। পিসিমা সকালে উঠে বাসী কাপড় ছেড়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে প্রথম আমার খাবার ভাত রাঁধতে যেতেন, তাকে যশোরে ‘আনালে’ ভাত বলত—বোধ হয় স্নান না করে রাঁধা হত বলে। আমাদের দেশ থেকে গঙ্গা দূর বলে এক বোতল গঙ্গাজল রান্নাঘরে টাঙ্গানো থাকত। তাড়াতাড়ি ছেলেপিলের খাবার বা রোগীর পথ্য