পাতা:স্মৃতির রেখা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গিবনের পাতায় ফিরে এল। হাজার যুগ আগের কত অশ্রুন্নয়ন নিষ্কলঙ্কা তরুণী, কত আশাভরা বুক নিয়ে কত মা-বাপ কোথায় সব চলে গিয়েছে। অনন্ত কাল-মহাসমুদ্রে কোন অতীতকালে ছায়া হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে-কবে।-- কোথায় । এই গভীর রাত্রে তারা ফিরে এল । পড়ছিলাম গিলডো, রুফাইলাস, থোজা ইউটোপিয়াসের অথলিপসার কথা অর্থের জন্য তারা কি না করেছিল। বিশ্বস্ত বন্ধুর গুপ্ত কথা প্ৰকাশ করে তাকে ঘাতকের কুঠারের মুখে দিতে দ্বিধা করেনি। নানা ষড়যন্ত্র, নানা বিশ্বাসঘাতকতা —কোথায় তাদের অর্থের সার্থকতা-কোথায় তাদের সে বৃথা শ্রমের পুরস্কার ? এই দেড় হাজার বছর পরে দাড়িযে এদের সে মুর্থতা দেখে আমি ইতিহাসের পাঠক-আমাকে করুণা প্ৰকাশ করবার জন্যেই কি রুফাইলাস কাউণ্ট জনকে অত করে নির্দয়ভাবে উৎপীড়ন করেছিল ! সে করুণা কাউণ্ট জনের জন্য নয়, উৎপীড়ক রুফাইলাস ও তার ধনলিন্সার জন্যে। কারণ আমি জানি তার পরিণাম । বাইজাণ্টাইন সম্রাজ্যের ইতিহাস গিবন ভ্রমশূন্য লিখেছিলেন কি বিউরি ঠিক লিখেছিলেন-সে বিষয়ে আমি তত কৌতুহল দেখাচ্ছি না-আমি শুধু কৌতুহলক্রান্ত এই মহাকালের মিছিলে । এই সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, খোজা তৃত্য সৈন্য সেনাপতি --তৃণের মত স্রোতের মুখে ভেসে যাওয়ার দিকটা আমায় মুগ্ধ করে । দুহাজার বছর আগের সে সব মানুষের মত—তাদের ইতিহাস লেখকও ছায়। হয়ে গিয়েছেন। ইংলণ্ডের কোন প্ৰাচীন সমাধিক্ষেত্রে জাৰ্ণ, তার সমাধি দীর্ঘ তৃণে৷ আচ্ছন্ন হয়ে আছে জানিনা । আর একশত বছর পরে এই আমিও স্বপ্ন হয়ে যাবে { সন্ধ্যায় শাস্ত বাশবনে দেবদারু পাতার মাথায় রাঙা রোদে, বৈকালের মান আলোয়, মাঠের ধারের কাশবনে, নদীর ধারে আমি কতদিন এই গতিচ্ছন্দের সত্যকে মনে মনে চিনেছি। এর স্বপ্ন আমাকে বড় মুগ্ধ করে । হাজার যুগ আগের এই ঐতিহাসিক ছায়ামূৰ্ত্তিদের মত সব মিলিয়ে স্বপ্ন হয়ে যাবে। যা কিছু বৰ্ত্তমান, সব। এই অপূৰ্ব্ব গতিভঙ্গি, মহাকালের এই তাণ্ডবনৃত্য ছন্দ যুগ যুগ ধরে রাজা, মহারাজা, সাম্রাজ্য, কাহিনীকে উড়িয়ে ফেলে দিয়ে আপন মনে কোন বিশাল.অস্তয়ের মৃদঙ্গের গম্ভীর বোলের সঙ্গে তাল রেখে চলছে।--দিকে দিকে, যুগে যুগে, ইউট্রোপিয়াস, গিলডো, রুফাইলাসের দল ও তাদের কড়ির পুটুলি ফেনার ফুলের কত মিলিয়ে যাচ্ছে-জাতি, মহাদেশ মথিত হয়ে যাচ্ছে