পাতা:হারানো খাতা - অনুরূপা দেবী.pdf/৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
হারানো খাতা।
৭১

ঘটা সম্ভব নয়? প্রাণপণে নিজের সকল সঙ্কোচকে সে মনের মধ্যেই চাপিয়া ফেলিল, আবেগরুদ্ধ কণ্ঠের কম্পনকে যথাসাধ্য নিরোধ-চেষ্টার সহিত সসম্ভ্রমে উত্তর করিল, “তা’হলে লাইব্রেরি থেকে কোন বই বেছে দেবেন চলুন; এখানে তো কোনই বই নেই।”

 পরিমলের পায়ের তলা হইতে মাথার চুলের গোড়া পর্য্যন্ত প্রবলবেগে একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ বহিয়া চলিয়া গেল। সে আবার বৃথাই দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সেই ভস্মস্তুপবৎ ভীষণদর্শন দগ্ধমুখের রহস্য-জটিলতা যেন উলটিয়া উলটিয়া দেখিতে চেষ্টা করিল। কিছু না, কোন নিদর্শনই ত নাই। তবে কোথা হইতে, কেমন করিয়া সেই পরিচিত,—বড় পরিচিত কণ্ঠের শব্দটুকু, আজ বারেবারেই সুদূর অতীত, করুণ কঠিন ভয়াবহ অতীতের—মধ্য হইতে তার সমস্ত বিস্মৃতির ধূলি জঞ্জাল ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া বাহির হইয়া আসিতে চাহিতেছে? একি তবে পরিমলের কল্পনা মাত্র? একি সত্য নয়? একি তার মনের মধ্যের স্মৃতির তারে যে অবিস্মৃত অতীত আজিও দিনে রাত্রে সকল সময় সকল সুখ-সম্পদের মধ্য দিয়াও করুণ ও কাতর মূর্চ্ছনায় ঝঙ্কার দিয়া উঠিতে থাকে, তারই একটা রেস, আর কিছুই নয়? আবার একটা দীর্ঘতর নিশ্বাস সে মোচন করিল এবং তারপর নিজের মনকে শান্ত করিবার জন্যই ইহার সান্নিধ্য ছাড়াইতে চাহিয়া বলিয়া ফেলিল, “আজ থাক, কাল বই নিয়ে আসবো,”—এই বলিয়াই সে তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া ফিরিয়া চলিয়া গেল।

 তখন প্রায় রুদ্ধশ্বাসে নিজের পরিত্যক্ত আসন খানার উপর সবেগে বসিয়া পড়িয়া ঊর্দ্ধমুখে শ্বাসগ্রহণ পূর্ব্বক নিরঞ্জন আর্ত্তকণ্ঠে আত্মগত কহিয়া উঠিল, “আবার সেই ছায়া! সে নয়—তবু যেন সেই! নাঃ, মানুষ আমায় আর থাক্‌তে দিলে না। আবার দেখছি পাগল করে আমায় পথে বার করে দেবে।”