পাতা:হারানো খাতা - অনুরূপা দেবী.pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
হারানাে খাতা।
৮১

মেয়েটিকে যেন বেশী করিয়াই সুন্দরী মনে হইতেছিল। বাজনা বাজান সখ মিটিয়া গেলে সে কোলের উপর হইতে যন্ত্রটাকে নিজের পাশে নামাইয়া রাখিয়া একটা পায়ের উপর আর একটা পা তুলিয়া দিয়া বেঞ্চির পিঠের উপর নিজের পিঠ চাপিয়া একটু আয়েস করিয়া বসিল এবং তারপর গুণ গুণ করিয়া একটা গান আপনার মনেই গাহিতে লাগিল। বাজনা সুর যখন চড়িয়া উঠিয়াছিল, পাশের বাড়ীর ছাদে যে যুবকটি প্রায় প্রত্যহই তাহার উচু পাঁচিলের ছােট ছােট ফুকর দিয়া তাহার অদৃশ্যপ্রায় মুর্ত্তিটাকে একবার চোখ বুলাইয়া লইয়া কৃতার্থ হইবার লােভে উঁকিঝুঁকি মারিয়া শেষে বিরক্তমনে আর এক দিকে চলিয়া যায়, আজও তাহার সেতারের সুর নিজের সেই নিত্যকর্ম্ম পদ্ধতিতে ত্রুটি রাখে নাই; কিন্তু গানের এ গুঞ্জন সেই উৎসুক পিয়াসীর কর্ণগােচর পর্য্যন্ত হইল না, এ শুধু এই পুষ্পবাসিত, নিরালা ছাদটির বুকেই একা একা নিজের সকরুণ মূর্চ্ছনায় মূর্চ্ছিত হইয়া রহিল। সে একেবারেই যেন আপনাকে ভুলিয়া গিয়া অমনস্কভাবে গাহিতেছিল—

“এসো এসো ফিরে এসো, বঁধুহে, ফিরে এসাে।
আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত্ত—নাথহে, ফিরে এসো।
ওহে নিষ্ঠুর ফিরে এসাে, ওগাে করুণ কোমল এসো,
আমার সজল জলদ স্নিগ্ধকান্ত, সুন্দর ফিরে এসো।”

 গানের সঙ্গে যখন প্রাণের ঘনিষ্টতর সংযােগ ঘটিয়া উঠে, তখন গানের বাণী আর বাহিরের শব্দ মাত্র থাকে না, তাহা প্রাণের কথায় পরিণত হইয়া যায়, গান তখন ধ্যানের আসন গ্রহণ করে। গায়িকাও তেমনিতর তন্মনস্ক হইয়া গিয়া বেঞ্চির পিঠে মাথা রাখিয়া এলায়িতদেহে অর্দ্ধমুদ্রিতনেত্রে পায়ের তালে তাল দিয়া যেন গানের বাণী ভুলিয়া গিয়া প্রাণের ভাষাতেই ভাসিয়া চলিতেছিল,—