পালামৌ

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন

পালামৌ

পালামৌ

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সম্পাদক

শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রীসজনীকান্ত দাস

ব ঙ্গী য়-সা হি ত্য-প রি ষ ৎ

একমাত্র পরিবেশক

কমলা বুক ডিপো

১৫ বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রীট, কলিকাতা-১২

প্রকাশক
শ্রীসনৎকুমার গুপ্ত
বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ

প্রথম সংস্করণ—বৈশাখ ১৩৫১
দ্বিতীয় মুদ্রণ—বৈশাখ ১৩৫৪
তৃতীয় মুদ্রণ— পৌষ ১৩৫৮

মূল্য দশ আনা

মুদ্রাকর—শ্রীসজনীকান্ত দাস
শনিরঞ্জন প্রেস, ৫৭ ইন্দ্র বিশ্বাস রোড, বেলগাছিয়া, কলিকাতা-৩৭
১১০—২২।১২।১৯৫১

ভূমিকা

 উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে বঙ্গভারতীর একজন কৃতী অথচ অলস ও অসাবধান সাধক বঙ্কিমাগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্রের অন্যতম সার্থক এবং সুসমঞ্জস রচনা “পালামৌ”—বস্তুতঃ আধুনিক কাল পর্য্যন্ত তাঁহার সাহিত্যকীর্ত্তি এই “পালামৌ”কে কেন্দ্র করিয়াই প্রতিষ্ঠিত আছে। এই কারণে সঞ্জীবচন্দ্রের এই রচনাটিই আমরা পুনঃপ্রকাশিত করিলাম।

 “পালামৌ” সঞ্জীবচন্দ্র-সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শনে’ সর্ব্বপ্রথম ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। লেখকের আসল নাম ছিল না; “প্র. না. ব.” এই ছদ্ম নাম ব্যবহৃত হইয়াছিল। ১২৮৭ বঙ্গাব্দের পৌষ-সংখ্যায় আরম্ভ, ১২৮৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে ‘বঙ্গদর্শনে’ ইহা সমাপ্ত হয়। প্রকাশের ক্রম এইরূপঃ ১২৮৭, পৌষ, পৃ. ৪১২-১৯; ফাল্গুন, পৃ. ৫১৩-১৯; ১২৮৮ আষাঢ়, পৃ. ১৩৫-৩৯; শ্রাবণ, পৃ. ১৬৫-৭১; আশ্বিন, পৃ. ২৮১-৮৬; ১২৮৯, ফাল্গুন, পৃ. ৫১৪-১৭। “পালামৌ” সঞ্জীবচন্দ্রের জীবৎ-কালে স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই। তাঁহার মৃত্যুর পর বঙ্কিমচন্দ্র ‘সঞ্জীবনী সুধা’ নাম দিয়ে সঞ্জীবচন্দ্রের রচনার যে সঙ্কলন প্রকাশ করেন, তাহাতেই “পালামৌ” সর্ব্বপ্রথম পুস্তকাকারে মুদ্রণগৌরব লাভ করে। দুঃখের বিষয়, অনবধানবশতঃ ‘সঞ্জীবনী সুধা’তে অনেক মুদ্রাকর-প্রমাদ ঘটিয়া স্থানে স্থানে অর্থ বোইকল্য ঘটিয়াছে এবং যে-কোন কারণেই হোক ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশিত সর্ব্বশেষ অংশ স্থান পায় নাই। বসুমতি-সংস্করণ সঞ্জীব-গ্রন্থাবলিতে ‘সঞ্জীবনী সুধা’র পাঠই অনুসৃত হইয়াছে। সুতরাং আমরাই সর্ব্বপ্রথম সম্পূর্ণ “পালামৌ” পুস্তকাকারে প্রকাশ করিলাম, ইহা বলা চলে। আমরা ‘বঙ্গদর্শনে’র পাঠ গ্রহণ করিয়াছি।

 সঞ্জীবচন্দ্রের জীবনী বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন, বঙ্কিম-রচনাবলীর “বিবিধ” খণ্ডে তাহা প্রকাশিত হইয়াছে। সঞ্জীবচন্দ্রের প্রচলিত গ্রন্থাবলীর সঙ্গেও তাহা সচরাচর যুক্ত দেখা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের পরও আরও উপকরণ সঞ্জীবচন্দ্রের জীবনী সম্পর্কে যাহা পাওয়া গিয়াছে, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত “সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা”র ‘সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ পুস্তকে তাহা সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। সঞ্জীবচন্দ্রের গ্রন্থপঞ্জীও উহাতে দেওয়া হইয়াছে।

 বঙ্কিমচন্দ্রের মত আমরাও মনে করি, “তিনি যে এ পর্য্যন্ত বাঙ্গালা সাহিত্যে আপনার উপযুক্ত আসন প্রাপ্ত হয়েন নাই, তাহা যিনি তাঁহার গ্রন্থগুলি যত্নপূর্ব্বক পাঠ করিবেন, তিনিই স্বীকার করিবেন। কালে সে আসন প্রাপ্ত হইবেন”। এই ভরসা লইয়াই আমরা তাঁহার একটি শ্রেষ্ঠ রচনা পুনঃপ্রকাশ করিলাম। এ যুগের পাঠকেরা এই রচনা হইতেই সঞ্জীবচন্দ্রের সাহিত্যকীর্ত্তি সম্বন্ধে সচেতন হইবেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।

 চন্দ্রনাথ বসু “পালামৌ” সম্বন্ধে লিখিয়াছেন:

 ...উপন্যাস না হইয়াও পালামৌ উৎকৃষ্ট উপন্যাসের ন্যায় মিষ্ট বোধ হয়। পালামৌর ন্যায় ভ্রমণকাহিনী বাঙ্গালা সাহিত্যে আর নাই। আমি জানি উহার সকল কথাই প্রকৃত, কোন কথাই কল্পিত নয়। কিন্তু মিষ্টতা মনোহারিত্বে উহা সুরচিত উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত ও সমতুল্য।

 রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘আধুনিক সাহিত্যে’ সঞ্জীবচন্দ্রের “পালামৌ” সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন। এই আলোচনা সকলের পাঠ্য। আমরা নিম্নে সেই আলোচনা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া এই ভূমিকা সমাপ্ত করিতেছি। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন:

 পালামৌ ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সৌন্দর্য্যের প্রতি সঞ্জীবচন্দ্রের যে একটি অকৃত্রিম সজাগ অনুরাগ প্রকাশ পাইয়াছে এমন সচরাচর বাংলা লেখকদের মধ্যে দেখা যায় না। সাধারণত আমাদের জাতির মধ্যে একটি বিজ্ঞবার্দ্ধক্যের লক্ষণ আছে—আমাদের চক্ষে সমস্ত জগৎ যেন জরাজীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সৌন্দর্য্যের মায়া-আবরণ যেন বিস্রস্ত হইয়াছে—এবং বিশ্বসংসারের অনাদি প্রাচীনতা পৃথিবীর মধ্যে কেবল আমাদের নিকটই ধরা পড়িয়াছে। সেই জন্য অশন বসন ছন্দ ভাষা আচার ব্যবহার বাসস্থান সর্ব্বত্রই সৌন্দর্য্যের প্রতি আমাদের এমন সুগভীর অবহেলা। কিন্তু সঞ্জীবের অন্তরে সেই জরার রাজত্ব ছিল না। তিনি যেন একটি নূতনসৃষ্ট জগতের মধ্যে একজোড়া নূতন চক্ষু লইয়া ভ্রমণ করিতেছেন। “পালামৌ”তে সঞ্জীবচন্দ্র যে, বিশেষ কোনো কৌতূহলজনক নূতন কিছু দেখিয়াছেন, অথবা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু সর্ব্বত্রই ভালবাসিবার ও ভালো লাগিবার একটা ক্ষমতা দেখাইয়াছেন। “পালামৌ” দেশটা সুসংলগ্ন সুস্পষ্ট জাজ্বল্যমান চিত্রের মতো প্রকাশ পায় নাই, কিন্তু যে সহৃদয়তা ও রসবোধ থাকিলে জগতের সর্ব্বত্রই অক্ষয় সৌন্দর্য্যের সুধাভাণ্ডার উদ্ঘাটিত হইয়া যায় সেই দুর্লভ জিনিসটি তিনি রাখিয়া গিয়াছেন, এবং তাঁহার হৃদয়ের সেই অনুরাগপূর্ণ মমত্ববৃত্তির কল্যাণকিরণ যাহাকেই স্পর্শ করিয়াছে—কৃষ্ণবর্ণ কোলরমণীই হৌক্‌, বনসমাকীর্ণ পর্ব্বতভূমিই হৌক্‌, জড় হৌক্‌, চেতন হৌক্‌, ছোট হৌক্‌, বড় হৌক্‌ সকলকেই একটি সুকোমল সৌন্দর্য্য এবং গৌরব অর্পণ করিয়াছে।

 লেখক যখন যাত্রা আরম্ভকালে গাড়ি করিয়া বরাকর নদী পার হইতেছেন এমন সময় কুলীদের বালকবালিকারা তাঁহার গাড়ি ঘিরিয়া “সাহেব একটি পয়সা” “সাহেব একটি পয়সা” করিয়া চীৎকার করিতে লাগিল—লেখক বলিতেছেন “এই সময় একটি দুই বৎসর বয়স্ক শিশু আসিয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল। কেন হাত পাতিল তাহা সে জানে না, —সকলে হাত পাতিয়াছে দেখিয়া সেও হাত পাতিল। আমি তাহার হস্তে একটি পয়সা দিলাম, শিশু তাহা ফেলিয়া দিয়া আবার হাত পাতিল; অন্য বালক সে পয়সা কুড়াইয়া লইলে শিশুর ভগিনীর সহিত তাহার তুমুল কলহ বাধিল।”

 সামান্য শিশুর এই শিশুত্বটুকু, তাহার উদ্দেশ্যবোধহীন অনুকরণবৃত্তির এই ক্ষুদ্র উদাহরণটুকুর উপর সঞ্জীবের যে-একটি সকৌতুক স্নেহহাস্য নিপতিত রহিয়াছে সেইটি পাঠকের নিকট রমণীয়;—সেই একটি উল্টা-হাতপাতা ঊর্দ্ধমুখ অজ্ঞান লোভহীন শিশু ভিক্ষুকের চিত্রটি সমস্ত শিশুজাতির প্রতি আমাদের মনের একটি মধুররস আকর্ষণ করিয়া আনে।

 দৃশ্যটি নূতন এবং অসামান্য বলিয়া নহে পরন্তু পুরাতন এবং সামান্য বলিয়াই আমাদের হৃদয়কে এরূপ বিচলিত করে। শিশুদের মধ্যে আমরা মাঝে মাঝে ইহারই অনুরূপ অনেক ঘটনা দেখিয়া আসিয়াছি, সেইগুলি বিস্মৃতভাবে আমাদের মনের মধ্যে সঞ্চিত ছিল;—সঞ্জীবের রচিত চিত্রটি আমাদের সম্মুখে খাড়া হইবামাত্র সেই সকল অপরিস্ফুট স্মৃতি পরিস্ফুট হইয়া উঠিল এবং তৎসহকারে শিশুদের প্রতি আমাদের স্নেহরাশি ঘনীভূত হইয়া আনন্দরসে পরিণত হইল।...

 সঞ্জীব বালকের ন্যায় সকল জিনিস সজীব কৌতুহলের সহিত দেখিতেন এবং প্রবীণ চিত্রকরের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্ব্বাচন করিয়া লইয়া তাঁহার চিত্রকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেন এবং ভাবুকের ন্যায় সকলের মধ্যেই তাঁহার নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ করিয়া দিতেন।

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।