বিষয়বস্তুতে চলুন

পাষাণের কথা/১১

উইকিসংকলন থেকে

[ ১১ ]

 বৃদ্ধের শুশ্রূষায় সৈনিক ক্রমশঃ সুস্থ হইয়া উঠিলেন। উভয়ে ক্ষুদ্র পর্ণকুটীরমধ্যে বাস করিতেন ও পরস্পরের সাহায্যে দিনপাত করিতেন। বৃদ্ধের শুশ্রূষায় জীবন লাভ করিয়া যুবা তাঁহার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন ও নির্জ্জন, শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যমধ্যে বৃদ্ধকে ত্যাগ করিয়া যাইতে পারিতেছিলেন না। তিনি যথাসাধ্য বৃদ্ধের সেবা করিতেন কুটীর মার্জ্জন, পুষ্প ও ফল আহরণ, ভগ্নস্তূপের চতুঃপার্শ্ব মার্জ্জন ইত্যদি সমুদায় কার্য্যভার তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছিলেন। অবসরমত বৃদ্ধ আগন্তুককে প্রাচীন কাহিনী শ্রবণ করাইতেন, তথাগতের কথা, সদ্ধর্ম্মের কথা, প্রাচীন রাজগণের কথা প্রতিদিনই আবৃত্তি করিতেন। বুদ্ধ-কথা শুনিয়া যুবকের চক্ষুদ্বয় অশ্রুভারাক্রান্ত হইত। তরুণ শাক্যরাজকুমার কিরূপে নাগরিকের দুঃখদর্শনে ব্যাথিত হইয়া সংসারত্যাগ করিয়াছিলেন, কত ক্লেশ সহ্য করিয়া সম্বোধি লাভ করিয়াছিলেন, কিরূপে তাঁহার জীবন ধর্ম্ম প্রচারে ব্যয়িত হইয়াছিল এই সকল কথা শুনিতে শুনিতে হেমন্তের দীর্ঘ রাত্রি অতিবাহিত হইত। বৃদ্ধ স্তূপগাত্রের ও বেষ্টনীর স্তম্ভসমূহের লেখমালা পাঠ করিয়া স্তূপনির্ম্মাণের কথার কিয়দংশ অবগত হইয়াছিলেন। সময় সময় দুইজনে ধনভূতি ও তাঁহার নাগরিকগণের কথাও হইত। বৃদ্ধ প্রিয়দর্শী ও দেবপুত্র কণিষ্ক প্রভৃতি সদ্ধর্ম্মের পৃষ্ঠপোষক রাজগণের সম্বন্ধে যাহা জানিতেন আগন্তুককে তাহা শ্রবণ করাইতেন। অভিধর্ম্মের ব্যাখ্যা অপেক্ষা প্রাচীন ইতিহাসের কথা যুবক অধিক মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতেন। গুপ্তরাজবংশের আধিপত্যকালে আত্মবিচ্ছেদে ও সাহায্যাভাবে সদ্ধর্ম্মের কিরূপে অবনতি হইয়াছিল তাহা বলিতে বলিতে বৃদ্ধ আত্মহারা হইয়া যাইতেন; যুবকও অতিশয় মনোযোগের সহিত সে কথা শ্রবণ করিতেন। শকসাম্রাজ্যের অধঃপতনের পর কিরূপে ধীরে ধীরে সদ্ধর্ম্মের অবনতি হইয়াছিল, তাহার বর্ণনা করিতে তৎকালে বৃদ্ধের সমকক্ষ আর কেহ ছিল বলিয়া বোধ হয় না। বৃদ্ধ, বোধ হয়, আর্য্যাবর্ত্তের নগরে নগরে ভ্রমণ করিয়া সদ্ধর্ম্মের অবনতির কাহিনী সংগ্রহ করিয়াছিলেন। সদ্ধর্ম্মের শাখাভেদ ও শাখাসমূহের মধ্যে কলহ, হীনযান মহাযানের দ্বন্দ্ব কোন্ বিষয়ে, কোন্ ভূক্তিতে, কোন্ নগরে, কোন্ সময়ে, কি ভাবে হইয়াছিল, তাহা বৃদ্ধের জিহ্বাগ্রে অধিষ্ঠান করিতেছিল। সময় বুঝিয়া কূটবুদ্ধি, ভীরু, কাপুরুষ ব্রাহ্মণগণ কিরূপে ধীরে ধীরে উত্তরাপথের নানাদেশে শীর্ষ উত্তোলন করিতেছিল বৃদ্ধ তাহা অবগত ছিলেন। লিচ্ছবীবংশের দৌহিত্র সন্তান হইয়াও সমুদ্র গুপ্ত গোপনে সদ্ধর্ম্মের কতদূর অনিষ্টসাধন করিয়াছিলেন বৃদ্ধ তাহার বিশেষ বিবরণ জানিতেন। কিরূপে গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণের সহায়তায় ব্রাহ্মণগণ উত্তরাপথে পুনরায় মুখ প্রদর্শন করিতে সক্ষম হইয়াছিল, কিরূপে ব্রাহ্মণগণের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা সত্ত্বেও উত্তরাপথবাসিগণ রাজভয়ে পুনরায় ব্রাহ্মণদিগের পদানত হইয়াছিল, আত্মবিচ্ছেদে দুর্ব্বল বৌদ্ধসঙ্ঘ কিরূপে ব্রাহ্মণদিগের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতায় পতিত হইয়াছিল তাহা বর্ণনা করিতে করিতে বৃদ্ধ আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিতেন। অবশেষে কুমার গুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে কিরূপে ব্রাহ্মণগণ রাজবলে বলীয়ান হইয়া আপনাদিগকে ভিক্ষু ও শ্রমণগণের সমকক্ষ বলিয়া পরিচয় দিতেন সে কথা বলিতে বলিতে বৃদ্ধের নয়নদ্বয় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিত।

 দীর্ঘকাল ব্রাহ্মণদ্বেষী বৌদ্ধের সহবাসে অবস্থান করিয়া ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম্মাবলম্বী যুবকও ব্রাহ্মণদ্বেষী হইয়া উঠিলেন। উভয়ে এইরূপে আমাদিগের নিকট দীর্ঘকাল অতিবাহিত করিয়ছিলেন। এক দিন প্রভাতে যুবক বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহাদিগের বিচ্ছেদের সময় সন্নিকট হইয়াছে; স্থবির শীঘ্রই জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করিয়া নূতনের অন্বেষণে মহাযাত্রা করিবেন। যুবকের হৃদয় চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে দিন আসিল; বৃদ্ধের দুর্ব্বল হৃৎপিণ্ড বহু চেষ্টা করিয়াও পর্য্যাপ্ত পরিমাণ শ্বাস আহরণে অসমর্থ হইল, জীর্ণ পঞ্জর যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও হৃৎপিণ্ডের সহায়তা করিতে সমর্থ হইল না; ধীরে ধীরে বৃদ্ধের ক্লান্ত দেহ সুষুপ্তির আশ্রয় গ্রহণ করিল। যুবক শূন্য হৃদয়ে শূন্য দেহের পার্শ্বে বসিয়া মহাশূন্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে করিতে দিনপাত করিলেন। শূন্য ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বৃদ্ধের লঘুভার দেহ মৃত্তিকায় প্রোথিত করিয়া ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে জীর্ণ পর্ণকুটীরের জীর্ণ দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া যুবক স্তূপসন্নিধান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 তাহার পর বহুদিন মনুষ্য দেখি নাই। স্তূপের ধ্বংসাবশেষ লতাগুল্মে আচ্ছন্ন হইয়া গেল, গ্রীষ্মের পর গ্রীষ্মে প্রবল বায়ু জীর্ণ কুটীরের আচ্ছাদনতৃণ হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, বর্ষার পর বর্ষা আসিয়া কুটীরের প্রাচীন কাষ্ঠদণ্ডগুলিকে প্রাচীনতর করিয়াছে, বসন্তে কুটীরের জীর্ণপঞ্জর শ্যামল তৃণে ও নবীন লতিকায় আচ্ছন্ন হইয়াছে, পুনরায় গ্রীষ্মে তৃণ, পত্র, পুষ্প শুষ্ক হইয়া ধূলিতে পরিণত হইয়াছে। স্তূপের যে স্তম্ভগুলি তখনও পর্য্যন্ত দণ্ডায়মান ছিল মনুষ্যহস্তে মার্জ্জনার অভাবে সেগুলি পিচ্ছিল শৈবালময় হইয়া উঠিয়াছে। সেই সময়ে বৃদ্ধের সমাধির উপরে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষ জন্মগ্রহণ করিয়ছিল। কালক্রমে বয়োবৃদ্ধির সহিত বৃক্ষটি দীর্ঘাকার প্রাপ্ত হইলে তাহার চতুঃপার্শ্বস্থ ভূখণ্ড অপেক্ষাকৃত পরিষ্কৃত হইয়া উঠিয়াছিল। নিদাঘে দ্বিপ্রহরে নানাবিধ মৃগ আসিয়া বৃক্ষতলে আশ্রয় গ্রহণ করিত, ও সন্ধ্যাগমে পুনরায় নিবিড় বনমধ্যে প্রস্থান করিত। তবে বৃক্ষের আকারবৃদ্ধির সহিত আর একটি ঘটনা ঘটিতেছিল, তাহাতে আমাদিগের বিশেষ উপকার হয় নাই। বৃক্ষের শাখাপ্রশাখাসমূহের ভারে নানাস্থানে দণ্ডায়মান প্রাচীন স্তূপবেষ্টনীর স্তম্ভগুলি ক্রমশঃ পতিত হইতেছিল, বৃক্ষকাণ্ডের স্থূলতাবৃদ্ধির সহিত মূলগুলির সংখ্যা ও অবয়ববৃদ্ধি হইতেছিল এবং তাহার ফলে বহুপ্রাচীন পরিক্রমণের পথের পাষাণখণ্ডগুলি স্থানচ্যুত ও উৎপাটিত হইতেছিল। কতকাল ধরিয়া অশ্বত্থবৃক্ষ ধ্বংসাবশিষ্ট স্তূপের বিনাশসাধনে প্রবৃত্ত ছিল তাহা বলিতে আমি অক্ষম। কিন্তু সে বহুকাল হইবে। এই দীর্ঘকালের মধ্যে মানবের আকার আমাদিগের নয়নগোচর হয় নাই। সময়ের প্রারম্ভ হইতে সেই সময় পর্য্যন্ত যাহা কিছু দেখিয়াছিলাম সর্ব্বদা সেই কথাই চিন্তা করিতাম। হরিদ্বর্ণ, শৈবালসমাচ্ছাদিত রক্ত প্রস্তরকণমণ্ডলীর মধ্যে সর্ব্বদাই প্রাচীন কাহিনীর আলোচনা হইত। সকলেই পুনরায় মানবদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হইয়া থাকিত। গ্রীষ্মের পর বর্ষা, বর্ষার পর শীত, এইরূপ ভাবে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হইল। মানবের চিরপরিচিত পদশব্দ আমাদিগের আর কর্ণগোচর হইল না।

 কোন কোনও দিন দ্বিপ্রহরে পিপাসিত মৃগসমূহ জলাম্বেষণে আসিয়া অশ্বত্থ বৃক্ষতলে বিশ্রাম করিত, ইহাদিগের পদচিহ্ন বর্ষা ব্যতীত অপর সময়ে সপ্তাহকাল পর্য্যন্ত বৃক্ষতলে দৃষ্ট হইত। একদিন প্রভাতে দীর্ঘাকার, ক্ষীণদেহ একটি ব্যাঘ্র বৃক্ষতলে ক্লান্তি দূর করিতেছিল এবং সময়ে সময়ে উৎকর্ণ হইয়া বনমধ্য হইতে আগত পদশব্দ লক্ষ করিতেছিল। অল্পক্ষণ পরে বহু দূরে হস্তিপদশব্দ শ্রুত হইল। সেই পদশব্দ বনবাসী স্বাধীন করিযূথের আহারান্বেষণে যথেচ্ছ পাদচারণের শব্দ নহে, মনুষ্যকর্ত্তৃক চালিত হস্তীর ধীর—সমভাবে পাদক্ষেপণের শব্দ। শব্দ শ্রুতিগোচর হইলে শার্দ্দূল অস্থির হইয়া উঠিল। তখন তাহার দ্রুতবেগে পলায়নের ক্ষমতা নাই; অনুমান হইল, বহুক্ষণ হইতে এবং বহুদূর হইতে কেহ যেন তাহাকে তাড়না করিয়া আনিয়াছে। বহু কষ্টে ব্যাস্ত্রটি নিকটবর্ত্তী বেতসকুঞ্জে আশ্রয় গ্রহণ করিল এবং তাহার পরক্ষণেই বনমধ্য হইতে লৌহবর্ম্মাবৃত একটি বৃহৎ হস্তী নির্গত হইল। তাহার স্বন্ধে হস্তিপক ও পৃষ্ঠে যোদ্ধৃবেশে জনৈক বৃদ্ধ ও একটি বালক। আঘ্রাণে ব্যাঘ্রের অবস্থান অবগত হইয়া লৌহমণ্ডিত হস্তী ধীরে ধীরে বেতসবনের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। বেতস লতার একটি অঙ্গুলি ঈষৎ কম্পিত হইল। অমনই বালকের হস্তনিক্ষিপ্ত শর ব্যাঘ্রের কণ্ঠে আমূল বিদ্ধ হইল। আর্ত্তনাদে বনভূমি বিকম্পিত করিয়া, এক লম্ফে ব্যাঘ্র বেতসকুঞ্জ উত্তীর্ণ হইয়া অশ্বত্থবৃক্ষতলে পতিত হইল, ও মুহূর্ত্ত মধ্যে প্রাণত্যাগ করিল। হস্তিপক হস্তিকে উপবেশন করিতে আদেশ করিল; কিন্তু বেত্রলতায় আচ্ছাদিত স্তূপবেষ্টনীর ভগ্ন স্তম্ভে আঘাত প্রাপ্ত হইয়া হস্তী উপবেশন করিতে পারিল না—কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া উপবেশন করিল। বৃদ্ধ ও বালক হস্তিপৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিয়া মৃত ব্যাঘ্রের নিকঠ গমন করিলেন। উল্লাসে বালক শার্দ্দূলের দীর্ঘদেহ হস্তীর নিকট আনয়ন করিবার উপক্রম করিল; কিন্তু বৃদ্ধ তাহাকে নিষেধ করিলেন। বালকের উল্লাস প্রশমিত হইল না; ব্যাঘ্রের দেহ লইয়া বালক ক্রীড়া করিতে আরম্ভ করিল। তাহার জীবনে এই প্রথম শার্দ্দূল হনন। সে দেখিতেছিল, তাহার পর ব্যাঘ্রের কণ্ঠে আমূল বিদ্ধ হইয়া হৃৎপিণ্ড ভেদ করিয়াছে। বৃদ্ধ তখন পশ্চাৎপদ হইয়া বেতসকুঞ্জে বারণের পদস্খলনের কারণ অনুসন্ধান করিতেছিলেন। বেতসলতায় আচ্ছাদিত হইয়া প্রাচীন স্তূপবেষ্টনীর স্তম্ভ লুক্কায়িত ছিল। সূচীবৎ তীক্ষ্ণ ভগ্ন পাষাণের অগ্রভাগ, উপবেশনকালে, হস্তীর পশ্চাৎদেশে বিদ্ধ হওয়ায় যাতনায় হস্তী উপবেশন করিতে পারে নাই। তিনি শূলের দণ্ডে বেতসলতা অপসৃত করিয়া পাষাণখণ্ড দর্শন করিলেন। বৃদ্ধের মুখমণ্ডল গম্ভীর ভাব ধারণ করিল; তিনি চিত্রাঙ্কিতের স্থায় শূলহস্তে বেতসকুঞ্জমধ্যে দণ্ডায়মান রহিলেন। হর্ষোৎফুল্ল বালক পিতাকে উচ্চৈঃস্বরে আহ্বান করিতেছিল; সে আহ্বান তাঁহার কর্ণগোচর হইল না। বালক বিরক্ত হইয়া বৃক্ষতল হইতে বেতসকুঞ্জে দৌড়াইয়া আসিল, পিতার হস্ত ধরিয়া আকর্ষণ করিল, কিন্তু পরক্ষণেই তাঁহার মুখের ভাব দর্শন করিয়া পশ্চাৎপদ হইয়া ধীরে ধীরে বৃক্ষতলে প্রত্যাবর্ত্তন করিল। এই ভাবে দিন অতীত হইল। বালক ব্যাঘ্র লইয়া গৃহে ফিরিবার জন্য ব্যস্ত হইল, গুরুভার বর্ম্মে পীড়িত হইয়া হস্তীও অসুস্থতার চিহ্ন প্রকাশ করিতে লাগিল। ক্রমে আলোকের অভাব অনুভব হইলে বৃদ্ধের চিন্তার অবসান হইল। বেতসকুঞ্জ হইতে অশ্বত্থবৃক্ষতলে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া বৃদ্ধ হস্তিপককে হস্তীর বর্ম্ম মোচন করিতে আদেশ করিলেন ও তাহার পৃষ্ঠের আস্তরণ বৃক্ষতলে বিস্তৃত করিতে কহিলেন। ইহাতে হস্তিপক বিস্মিত হইল, কিন্তু নীরবে আজ্ঞা পালন করিল। বৃক্ষতলে কঠিন আস্তরণে পিতা ও পুত্র উপবেশন করিলেন। হস্তিপক হস্তী লইয়া জলাম্বেষণে গেল। হস্তিপক প্রত্যাবর্ত্তন করিলে সন্ধ্যাকালে সকলে বনমধ্য হইতে শুষ্ক কাষ্ঠ আহরণ করিয়া অশ্বত্থবৃক্ষের চতুষ্পার্শ্বে চারিটি স্তূপ নির্ম্মাণ করিলেন ও কাষ্ঠস্তূপে অগ্নি সংযোগ করিয়া বৃক্ষতলে বিশ্রামের আয়োজন করিতে লাগিলেন। সম্মুখে হস্তী ও চতুষ্পার্শ্বে অগ্নিকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া মনুষ্যত্রয় রজনী অতিবাহিত করিলেন। নিশাচর মৃগসমূহ রজনীতে জলান্বেষণে আসিয়া অগ্নির ভয়ে বৃক্ষতলে আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারিল না। প্রভাতে হস্তী সজ্জিত করিয়া পিতাপুত্র বৃক্ষতল পরিত্যাগ করিলেন। তৎপূর্ব্বে দিবালোকে হস্তীকর্ত্তৃক সংগৃহীত ইন্ধন অগ্নিকুণ্ডসমূহের চতুষ্পার্শ্বে স্তূপীকৃত হইয়াছিল, কুণ্ডচতুষ্টয় সমভাবে প্রজ্জ্বলিত ছিল ও তাহার ধূম বহুদূর পর্য্যন্ত দৃষ্ট হইতেছিল। অশ্বত্থবৃক্ষের সান্নিধ্য পরিত্যাগকালে পিতাপুত্ত্রে কথোপকথন হইতেছিল যে, অগ্নি সন্ধ্যাকাল অবধি প্রজ্জ্বলিত থাকিবে, অশুষ্ক কাষ্ঠ প্রজ্জ্বলনহেতু ধূমের স্তম্ভ বহুদূর হইতে দৃষ্ট হইবে, দূরে নগরে ও শিবিরে বনমধ্যস্থ ধূম দৃষ্ট হইলে লোক আসিবে।

 অগ্নিকুণ্ডসমূহ দ্বিপ্রহর রাত্রি পর্য্যন্ত প্রজ্বলিত ছিল, প্রভাতেও অঙ্গাররাশি হইতে প্রভূত ধূম নির্গত হইয়া আকাশে পূঞ্জীকৃত হইতেছিল। প্রথম প্রহর অতীত হইলে ধূম লক্ষ্য করিয়া হস্তীর পর হস্তী বহুসংখ্যক মনুষ্য বহন করিয়া অশ্বত্থবৃক্ষতলে আসিতে আরম্ভ করিল। কয়েকজন মনুষ্য ব্যাঘ্রের ত্বক্‌ছেদন করিয়া তৎক্ষণাৎ হস্তিপৃষ্ঠে প্রস্থান করিল; কিন্তু অপর সকলে বৃক্ষশাখা ও পত্রের সাহায্যে অশ্বত্থবৃক্ষতলে অগ্নিকর্ত্তৃক পরিষ্কৃত ভূখণ্ডে পর্ণকুটীর নির্ম্মাণে প্রবৃত্ত হইল। কেহ কেহ চতুষ্পার্শ্বস্থ বেতসকুঞ্জসমূহ ছেদনে সচেষ্ট হইল। সুবর্ণবর্ণ উষ্ণীষ পরিহিত জনৈক যুবক, সম্ভবতঃ কোন উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী, অন্যান্য সকলের কার্য্য নির্দ্দেশ করিতেছিলেন। ক্রমে অশ্বত্থ বৃক্ষতলে শত হস্ত পরিমিতি ভূমি সন্ধ্যার পূর্ব্বে পরিষ্কৃত হইল। প্রতিদিন দিবসের আরম্ভ হইতে শেষ পর্য্যন্ত শ্রমজীবিগণ পরিশ্রম করিয়া ধীরে ধীরে স্তূপবেষ্টনীর চতুঃপার্শ্বস্থিত ভূখণ্ড পরিষ্কৃত করিল, তোরণ ও বেষ্টনীর যে কয়েকটি স্তম্ভ তখনও পর্য্যন্ত দণ্ডায়মান ছিল সেগুলি ক্রমশঃ পরিষ্কৃত হইল। অবশেষে শ্রমজীবিগণ কণিষ্ককর্ত্তৃক নির্ম্মিত পাষাণাবৃত পথ পরিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হইল। পাষাণাচ্ছাদিত থাকায় পথে দীর্ঘাকার বৃক্ষাদি জন্মে নাই, তবে স্থানে স্থানে পাষাণ উন্মূলিত করিয়া বৃহৎ অশ্বত্থ ও বটবৃক্ষসমূহ দণ্ডায়মান ছিল। কিন্তু তথাপি বনমধ্যে আসিলে বোধ হইত যে, এই ভীষণ গহনে অতীতে কোন কালে একটি প্রশস্ত বর্ত্ম ছিল। সুতরাং অতি অল্প আয়াসেই কণিষ্ক নির্ম্মিত রাজপথ পরিষ্কৃত হইতে লাগিল। প্রাচীন নগরোপকণ্ঠে প্রবাহিত ক্ষুদ্র নদীর স্রোতের গতিপরিবর্ত্তনহেতু রাজপথ স্থানে স্থানে বিলুপ্ত হইয়াছিল। কণিষ্কের সময়ে নদীর উপরিভাগে যে স্থানে রক্তপ্রস্তরনির্ম্মিত সেতু নির্ম্মিত হইয়াছিল সে স্থান হইতে নদী বহু দূরে অপসৃত হইয়াছিল; অন্যান্য পার্ব্বত্য নদীর সহিত যুক্ত হইয়া ক্ষুদ্র নদী বৃহদাকার ধারণ করিয়াছিল; রাজপথের আচ্ছাদনের পাষাণ স্রোতোবেগে উভয় পার্শ্বে বিক্ষিপ্ত হইয়াছিল; কণিষ্কের নামযুক্ত পাষাণখণ্ডসমূহ নূতন নদীর উভয় তীরে বহুদূর পর্য্যন্ত বালুকাস্তরে প্রোথিত হইয়া শকরাজের অক্ষয় কীর্ত্তি ঘোষণা করিতেছিল। নূতন নদীর উপরিভাগে পাষাণনির্ম্মিত নূতন দীর্ঘ সেতু নির্ম্মিত হইল; কণিষ্কের ক্ষুদ্র সেতু সংস্কৃত হইয়া নূতন আকার ধারণ করিল; নূতন নদীপারে নূতন রাজপথ পুরাতন রাজপথে আসিয়া মিলিত হইল ও পুরাতন রাজপথ উত্তরে প্রতিষ্ঠান ও পশ্চিমে বিদিশা পর্য্যন্ত সংস্কৃত হইল।

 ইহার পর একদিন বৃদ্ধ আসিলেন। শুনিলাম, বৃদ্ধকে সকলে রাজসম্বোধন করিল। শুনিলাম, বৃদ্ধের নাম যশোধর্ম্মদেব; তিনি গান্ধার ও কীর হইতে সমতট ও প্রাগ্‌জ্যোতিযের অধীশ্বর। আরও শুনিলাম সামান্য সৈনিকপদ হইতে সৌভাগ্যবলে বৃদ্ধ রাজপদবী লাভ করিয়াছেন; প্রাচীন রাজবংশ লুপ্ত হইয়াছে; কান্যকুব্জে গুপ্তবংশের কেহ নাই; অনুগাঙ্গপ্রদেশে ও মগধে গুপ্তরাজগণ যশোধর্ম্মদেবের অনুগ্রহপ্রার্থী। বৃদ্ধ আসিয়া একে একে তোরণের সমস্ত স্তম্ভগুলি পরীক্ষা করিয়া শ্রমজীরিগণকে মৃত্তিকা খননে নিযুক্ত করিলেন। বহু শতাব্দী পরে প্রাচীন পরিক্রমণের পথ সূর্য্যালোক দর্শন করিল; ক্রমে স্তূপের অর্দ্ধবৃত্তাকৃতি নয়নগোচর হইল। ধীরে ধীরে বহুযত্নে শ্রমজীবিগণ পাষাণের উপর পাষাণ রক্ষা করিয়া মণ্ডলাকারে পাষাণসজ্জা করিল। আমি উৎসুকনেত্রে দেখিতেছিলাম; ভরসা করিয়াছিলাম যে, ইহারা গর্ভগৃহের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবে ও তথাগতের শরীর-নিধান উদ্ধার করিতে সমর্থ হইবে। কিন্তু বোধ হয় মনুষ্যলোকে সেকথা বহুদিনলুপ্ত হইয়াছিল। বহুকাল পরে বিদেশীয় যাত্রিদলকে ভণ্ড শ্রমণগণ স্বরচিত উপাখ্যান শ্রবণ করাইত ও বলিত, “কণিষ্ক রাজার তনুত্যাগের দিন ইন্দ্রদেবতা আসিয়া মস্তকে শরীর-নিধান বহন করিয়া তুষিতস্বর্গে লইয়া গিয়াছেন ও ব্রহ্মা তাহার উপর ছত্র ধারণ করিয়া গিয়াছেন।” নিরীহ, ধর্ম্মপ্রাণ, সরলস্বভাব বিদেশীয়গণ শ্রমণগণের মিথ্যাবাক্যে আস্থা স্থাপন করিয়া সেই কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। শুনিয়াছি, তোমরাও সেই বৃত্তান্তে আস্থা স্থাপন করিয়া গ্রন্থরচনা করিয়া থাক। আমি যাহা ভরসা করিয়াছিলাম, তাহা হইল না; ক্ষুদ্র বৃহৎ পাষাণখণ্ডসমূহ লইয়া স্তূপ নির্ম্মিত হইল। নির্ম্মাণকালে সর্ব্ববিধ পাবাণ এমন কি ভগ্ন মূর্ত্তিসমূহও স্তূপের উপরিভাগে সজ্জিত হইয়াছিল। কণিষ্কনির্ম্মিত রাজপথ আচ্ছাদনের দুই একখণ্ড প্রস্তরও তাহার মধ্যে ছিল। এই নিমিত্তই তোমরা কণিষ্কের নামাঙ্কিত পাষাণ স্তূপের অর্দ্ধবর্ত্তুলাকার পিণ্ডমধ্যে প্রাপ্ত হইয়াছিলে। স্তূপ সংস্কৃত হইল বাট, কিন্তু বেষ্টনী বা তোরণ সমূহের সংস্কার হইল না। স্তূপের চারিটি তোরণের সম্মুখে হরিদ্রা বর্ণ প্রস্তরনির্ম্মিত পিষ্টকাকৃতি চারিটি মন্দির নির্ম্মিত হইল। ক্রমে নানাবিধ মূর্ত্তি নগর হইতে আসিতে লাগিল এবং স্তূপের পার্শ্বে নানা স্থানে ক্ষুদ্র মন্দিরসমূহে স্থাপিত হইতে লাগিল।

 শ্রমজীবিগণ বহুদিন সংস্কার ও নির্ম্মাণ কার্য্যে ব্যাপৃত ছিল। তাহাদিগের নিকট হইতে অনেক কথা শুনিয়াছিলাম। যশোধর্ম্ম একজন সামান্য পদাতিক সৈন্য ছিলেন; স্কন্দগুপ্তের অধীনে তরুণ বয়সে যুদ্ধব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তরুণসৈনিক বৃদ্ধ সম্রাটের পার্শ্বে থাকিয়া দীর্ঘকালব্যাপী হূণযুদ্ধে বহু স্থানে অসমসাহস প্রদর্শন করিয়াছিলেন। শত শত যুদ্ধে বৃদ্ধ সম্রাটের প্রাণরক্ষা করিয়া অবশেষে প্রতিষ্ঠানের মহাযুদ্ধে সম্রাট নিহত হইলে তিনি বনরাসে গমন করিয়াছিলেন। তখন বুঝিলাম বৃদ্ধ কে; বেতসকুঞ্জে ভগ্ন পাষাণস্তম্ভ কেন তাঁহার চিত্তাকর্ষণ করিয়াছিল; মৃগয়া পরিত্যাগ করিয়া—একমাত্র পুত্ত্রের আহ্বানে বধির হইয়া বৃদ্ধ সম্রাট কণ্টকাঘাতে ক্ষত বিক্ষত হইয়া কি নিমিত্ত বেতসবনে চিত্রার্পিতের ন্যায় দণ্ডায়মান ছিলেন? সেই স্তম্ভপার্শ্বে বৃদ্ধ স্থবির সমাহিত। পর্ণকুটীরের পল্লবিত দণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া বেতস লতা কুঞ্জে পরিণত হইয়াছিল তাহা বৃদ্ধ দর্শনমাত্রেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, জীবনদাতা বৃদ্ধ স্থবিরের কথা সহসা মনে উদিত হইয়া বৃদ্ধকে পাষাণবৎ নিশ্চল করিয়াছিল। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর লোকালয়ে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া যুবক তাহার জীবনদাতার কথা বিস্মৃত হইয়াছিলেন। বহুকালপরে—জীবনের শেষ সীমায় দণ্ডায়মান হইয়া রক্তবর্ণ পাষাণের স্তম্ভদর্শনে সম্রাটের মনে পরমোপকারী বৌদ্ধ স্থবিরের কথা পুনরায় উদিত হইয়াছিল। বুঝিলাম, বৃদ্ধ সম্রাট গুরুর আদেশে স্তূপ সংস্কার করিতেছেন, সদ্ধর্ম্মের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হইয়া সম্রাট এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন নাই, কৃতজ্ঞতায় অনুপ্রাণিত হইয়া সসাগরাধরণীর সম্রাট অজস্র অর্থব্যয়ে ধনভূতির স্তূপ পুনর্নির্ম্মাণ করিতেছেন। শুনিলাম, সমুদ্রগুপ্তের বিশাল সাম্রাজ্যের বহির্দ্দেশস্থ দেশসমূহ যশোধর্ম্মের বাহুবলে জিত হইয়াছিল, হিমমণ্ডিত উত্তর দেশীয় পর্ব্বতে, বালুকাতপ্ত উত্তরমরুদেশে, খস ও হূণগণ যশোধর্ম্মের ভয়ে কম্পিত হইয়া থাকে। শুনিলাম, আর্য্যাবর্ত্তের হূণাধিকার লুপ্ত হইয়াছে; বহু রক্তপাতে অর্জ্জিত তোরমাণের সাম্রাজ্য তোরমাণের সহিত অন্তর্হিত হইয়াছে; লৌহিত্যতীরে প্রাগ্‌জ্যোতিষের রক্তপিপাসু ব্রাহ্মণগণ যশোধর্ম্মের নামে কম্পিত হইয়া থাকে ও গোপনে অন্ধকার রজনীতে পশুহত্যা করিয়া রক্তপিপাসা শান্ত করিয়া থাকে। শুনিলাম, পূর্ব্বসমুদ্রতীরে হরিদ্বর্ণ তালীবনবেষ্টিত মহেন্দ্রগিরিশীর্ষে যশোধর্ম্মের জয়স্তম্ভ প্রোথিত হইয়াছে; তুষারমণ্ডিত হিমগিরি হইতে পশ্চিম সমুদ্রের উপকূল পর্য্যন্ত সমগ্র ভূমি যশোধর্ম্মের অধীনতা স্বীকার করিয়া থাকে; আর্য্যাবর্ত্তে সমুদ্র গুপ্তের পরবর্ত্তীকালে কেহ আর এতাদৃশ বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয় নাই।