বিষয়বস্তুতে চলুন

পাষাণের কথা/৪

উইকিসংকলন থেকে


[ ৪ ]

 উৎসবের পূর্ব্বদিন হইতে নবনির্ম্মিত স্তূপ পত্রপুষ্পে সজ্জিত হইতে লাগিল। তোরণ, স্তম্ভ, আলম্বন হরিদ্বর্ণ পত্রে ও নানা বর্ণের পুষ্পে মণ্ডিত হইয়া গেল। তৎপূর্ব্বে সে ভাবে আমাদিগকে কেহ সজ্জিত করে নাই। পরে সদ্ধর্ম্মের প্রভাব বৃদ্ধি হইয়া যখন স্তূপের যশঃ বিকীর্ণ হইয়া পড়িয়াছিল তখনও এবম্বিধ উৎসব আমি কখনও দেখি নাই। সদ্ধর্ম্মানুরাগী শকরাজাগণের আগমনে হেমরজতখচিত আবরণে স্তূপের চতুষ্পার্শস্থ বিশাল প্রান্তর পর্য্যন্ত আবৃত হইতে দেখিয়াছি, কিন্তু শ্যাম পল্লব ও শ্বেত পুষ্প মণ্ডিত হইয়া স্তূপের যে শোভা হইয়াছিল, তাহা আর কখনই দেখি নাই। স্তূপের পূর্ব্ব তোরণ নগরাভিমুখে স্থাপিত হইয়াছিল। ইহার আবরণে চারিটি স্তম্ভ ছিল—প্রথম স্তম্ভে তিনটি দেবমূর্ত্তি খোদিত হইয়াছিল। প্রথম স্তম্ভের উত্তর দিকে নাগরাজ চক্রবাকের মূর্ত্তি। নাগরাজ পর্ব্বতশিখরে দণ্ডায়মান, তাঁহার পদতলে কন্দরে কন্দরে সিংহ, বৃক প্রভৃতি শ্বাপদগণ রক্ষিত হইতেছে। নাগরাজের মস্তকে পঞ্চশীর্ষ সর্প তাঁহার নাগত্ব জ্ঞাপন করিতেছে। কেয়ূর, বলয়, হার প্রভৃতি রত্নালঙ্কারে শোভিত হইয়া নাগরাজ পূর্ব্বদ্বার রক্ষা করিতেছেন। নাগরাজের উপরে এরং স্তম্ভের শীর্ষদেশে যে অর্দ্ধবৃত্তের চিহ্ন অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে, তাহা নানাবিধ পত্রের চিত্রে পূর্ণ ছিল। ধর্ম্মরক্ষিত নামক জনৈক প্রকৃত বিশ্বাসী এই স্তম্ভের ব্যয়ভার বহন করিয়াছিলেন। প্রথম স্তম্ভের অপর দুই পার্শ্বে গঙ্গিত ও হয়গ্রীব নামক যক্ষদ্বয়ের মূর্ত্তি অঙ্কিত হইয়াছিল, কেবল চতুর্থ পার্শ্বে সূচিত্রয়ের ভেদের জন্য কোন চিত্র অঙ্কিত হয় নাই। গঙ্গিত করিপৃষ্ঠে ও অজকালক শিলাসঞ্চয়ের উপরে কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান। গঙ্গিতের মস্তকের উপরে অর্দ্ধবৃত্তে পতাকা শোভিত একটি স্তূপ ও অজকালকের মস্তকের উপরে অর্দ্ধবৃত্তে পত্র অঙ্কিত হইয়াছিল। উৎসবের পূর্ব্বে সজ্জার দিন আলম্বন হইতে যক্ষত্রয়ের শীর্ষদেশ পর্য্যন্ত শ্বেত পুষ্পমালায় জড়িত হইয়াছিল, কেবল অর্দ্ধবৃত্তগুলি দৃশ্যমান ছিল। প্রত্যেক যক্ষের মস্তক ও বক্ষ বিবিধ বর্ণের পুষ্পমালায় সজ্জিত হইয়াছিল, নবজাত পল্লবে মূর্ত্তিত্রয়ের বাহুমূল হইতে পাদদেশ পর্য্যন্ত আচ্ছাদিত হইয়াছিল। এইরূপে আবরণ ও বেষ্টনের প্রত্যেক স্তম্ভ-অঙ্কিত স্থান ব্যতীত পত্রপুষ্পে মণ্ডিত হইয়া গিয়াছিল, আলম্বনের শীর্ষদেশ আম্রপল্লবে ও পার্শ্বদেশ রক্তবর্ণ পুষ্পে আচ্ছাদিত হইয়াছিল। আলম্বন হইতে প্রথম সূচি পর্য্যন্ত ফলের স্তবক লম্বিত হইয়াছিল। তোরণ স্তম্ভদ্বয়ের আকার পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছিল। পাদদেশ হইতে প্রথম তোরণ পর্য্যন্ত স্তম্ভদ্বয় শ্বেত, রক্ত, নীল ও হরিদ্রাভ পুষ্পের মালায় জড়িত হইয়া গোলাকার ধারণ করিয়াছিল। স্তম্ভ শীর্ষের শীর্ষচতুষ্টয় নাগকেশর পুষ্পে ও তোরণত্রয় নানাবিধ চম্পকমাল্যে ভূষিত হইয়াছিল। সর্ব্ব নিম্নের তোরণ হইতে বহু আয়াসলব্ধ সহস্রদল শ্বেতপদ্মশ্রেণী লম্বিত হইয়াছিল। সর্ব্বোপরি ছত্রবাহী অশ্বদ্বয় ও ধর্ম্মচক্র ত্রিরত্নের মর্য্যাদা জ্ঞাপনার্থ ত্রিবর্ণের পুষ্প মণ্ডিত হইয়াছিল।

 তোমরা স্তম্ভগাত্রে যেরূপ স্তূপের চিত্র দেখিয়া থাক, নবনির্ম্মিত স্তূপও আকারে তদনুরূপ ছিল। অর্দ্ধগোলাকার স্তূপশীর্ষে একটি চতুষ্কোণ স্তম্ভ স্থাপিত ছিল। স্তম্ভের উপরিভাগে মধ্যদেশে মাল্যশোভিত ছত্র ও চারিকোণে পতাকাবাহী দণ্ডচতুষ্টয় স্থাপিত হইয়াছিল। উৎসব-সজ্জার দিনে পতাকার দণ্ড হইতে তোরণশীর্ষ পর্য্যন্ত ও চতুষ্কোণ স্তম্ভ হইতে বৃত্তাকার আলম্বন শ্রেণী পর্য্যন্ত সুবৃহৎ মাল্য লম্বিত হইয়াছিল। স্তূপের ঊর্দ্ধদেশে মাল্য আবৃত হওয়ায় বোধ হইতেছিল যেন, শ্বেতচন্দ্রাতপের পরিবর্ত্তে শ্বেতবর্ণ পুষ্পের আতপত্র আনিয়া স্তূপশীর্ষে স্থাপন করা হইয়াছে। পত্রপুষ্পমণ্ডলের উপরে উপাসক-উপাসিকা ও দর্শকগণ আসিয়া যাহা দেখিল তাহা বলিতেছি। কোন স্থানে পুষ্পমালার মধ্য হইতে বৃত্তমধ্যে অঙ্কিত চিত্র যেন ফুটিয়া উঠিয়াছে। বৃত্তের মধ্যভাগে উচ্চ আসনের উপরে সপুষ্প পাটলীবৃক্ষ, শাখায় ও কাণ্ডে স্তবকে স্তবকে পাটলী পুষ্প প্রস্ফুটিত হইয়া রহিয়াছে। চারিপার্শ্বে নতজানু হইয়া বা দণ্ডায়মান থাকিয়া উপাসক ও উপসিকাগণ পুষ্প ও মাল্যদ্বারা বৃক্ষের অর্চ্চনা করিতেছে, কারণ ইহা বুদ্ধ ও বিপশ্বীর বোধিদ্রুম। অন্য স্থানে স্রজশোভিত চতুষ্কোণ উচ্চাসনের উপরে দীর্ঘকায় শালবৃক্ষ, পার্শ্বে উপাসক ও উপাসিকগণ অর্চ্চনায় ব্যপৃত, কারণ ইহা বুদ্ধ বিশ্বভূর বেধিক্রম। অপর স্থানে স্তম্ভ চতুষ্টয়ের উপরে স্থাপিত চতুষ্কোণ আসনে সফল উদুম্বর বৃক্ষ, ইহার শাখা সমূহ হইতে মাল্যসমূহ লম্বমান; উভয় পার্শ্বে উপাসক ও উপাসিকগণ, কারণ ইহা বুদ্ধ কনকমুনির বোধিদ্রুম। তোমরা যে স্তম্ভটিকে অসম্পূর্ণ বলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিয়াছ, তাহার মধ্যভাগে বৃত্তের মধ্যে গোলাকার আসনে স্থাপিত শিরীষবৃক্ষ আছে, উৎসবের দিন উহা অপরাজিতার মালায় বেষ্টিত ছিল। ইহার উভয় পার্শ্বে উপাসক ও উপসিকাগণ বিদ্যমান, কারণ ইহা ক্রকুচ্ছন্দের বোধিদ্রুম। অপর স্থানে দ্বাদশ স্তম্ভের উপর স্থাপিত চতুষ্কোণ আসনে অশ্বত্থবৃক্ষ; ইহার চতুষ্পার্শ্বে স্তম্ভশ্রেণী বিন্যস্ত। বৃক্ষকাণ্ডের উভয়পার্শ্বে স্তম্ভশীর্ষে ধর্ম্মচক্র ও তদুপরি ত্রিরত্ন। বৃক্ষের শাখায় শাখায়, অসংখ্য মালা লম্বিত। আকাশে গন্ধর্ব্বগণ বংশী-নিনাদ করিতেছে ও সুপর্ণাগণ ইতস্ততঃ পুষ্পবৃষ্টি করিতেছে। বৃক্ষকাণ্ডের চারি পার্শ্বে উপাসক ও উপাসিকাগণ এবং সঙ্ঘারামের গবাক্ষে অসংখ্য দর্শক চিত্রিত রহিয়াছে। স্তম্ভবেষ্টনের বহির্দ্দেশে একটি বৃহদাকার স্তম্ভ ও তচ্ছীর্ষে শুণ্ডে মাল্য লইয়া দণ্ডায়মান একটী হস্তীর মূর্ত্তি। ইহাই ভগবান শাক্যমুনির বোধিদ্রুম। স্তম্ভবেষ্টনের ও বহির্দ্দেশস্থ স্তম্ভ মহারাজ ধর্ম্মাশোক-বিনির্ম্মিত। অপর স্থানে স্তম্ভশ্রেণীর উপর বিন্যস্ত দ্বিতলগৃহ। স্তম্ভশ্রেণী-বিভাগের মধ্যে বেদি, উহার উপরিভাগে পুষ্পাদি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে ও একপার্শ্বে ষোড়শটি মানবহস্তাঙ্ক। মহাবোধিদ্রুমের পার্শ্বে ভগবান শাক্যমুনি সম্বোধিলাভের পর যে স্থানে সপ্তদিবসকাল মনুষ্যের হিতচিন্তায় মগ্ন হইয়া পরিক্রমণ করিয়াছিলেন, পরে ধর্ম্মাশোক সেই স্থানে এই বিহার নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, ইহাই ভগবানের সংক্রমণের স্থান। একটি সূচিগাত্রে এই চিত্রটি অঙ্কিত আছে। অপরস্থানে চারিটি স্তম্ভশীর্ষে সংন্যস্ত বিহারের মধ্যে, রত্নখচিত আসনে ভগবানের ধর্ম্মচক্র, চক্রের উপরে ছত্র ও মাল্য, পার্শ্বে উপাসক ও উপাসিকাগণ। বিহারের দক্ষিণ পার্শ্বে বিশাল তোরণদ্বার। ইহা এত উচ্চ যে হস্তিপক আরোহী লইয়া ইহার অভ্যন্তরে আরোহীকে প্রবেশ করাইতেছে। তোরণের পশ্চাতে দ্বিতীয় হস্তিপক হস্তীর আহারের জন্য একটি বৃক্ষকে পল্লবশূন্য করিতেছে; বামপার্শ্বে অশ্বচতুষ্টয়-বাহিত রথ দুইটি আরোহী লইয়া দ্রুতবেগে বিহারাভিমুখে আগমন করিতেছে; ইহার পশ্চাতে একটি বৃক্ষে একটি ছত্র রহিয়াছে,—কোন দরিদ্র উপাসক স্থানাভাবে চক্ররাজের উদ্দিষ্টছত্র বৃক্ষে নিবিষ্ট করিয়া গিয়াছে। অপর স্তম্ভে বৃত্তমধ্যে মায়াদেবীর গর্ভধারণের চিত্র। খট্টায় মায়াদেবী সুষুপ্তা, খট্টানিম্নে ভৃঙ্গার ও পাদদেশে প্রদীপ, নিম্নে আসনদ্বয়ে উপবিষ্ট পরিচারিকাদ্বয় ব্যজনে ও সেবায় নিযুক্তা, একজন সখী করযোড়ে মায়াদেবীর মস্তকের নিকট উপবিষ্ট রহিয়াছেন। ঊর্দ্ধে শ্বেতহস্তী। ভগবান শ্বেত হস্তীর আকার ধারণ করিয়া মায়াদেবীর গর্ভে আশ্রয় লইতেছেন। অপর স্তম্ভে বৃত্তমধ্যে পর্ব্বতশ্রেণী অঙ্কিত রহিয়াছে, পর্ব্বতের মধ্যদেশে বিশাল গুহা ও তন্মধ্যে রত্নখচিত আসন। আসনের ঊর্দ্ধে ছত্র। চতুষ্পার্শ্বে উপাসকগণ উপবিষ্ট রহিয়াছেন। গুহার বহির্দ্দেশে সিংহ, শৃগাল, ময়ূর, বানর প্রভৃতি নানা জীব অঙ্কিত রহিয়াছে। গুহা-দ্বারের সান্নিধ্যে সপ্ততন্ত্রী বীণাহস্তে লইয়া গন্ধর্ব্ব পঞ্চশিখ দণ্ডায়মান। ইহা ইন্দ্র-শিলাগুহা। একদা বর্ষাকলে ভগবান শাক্যমুনি যখন রাজগৃহ শৈলমালার সঙ্গিহীন শৈলশিখরে পর্ব্বত-গুহায় বাস করিতেছিলেন, তখন জ্ঞান-লিপ্সাপ্রণোদিত হইয়া বাসব গুহাদ্বারে উপস্থিত হইয়াছিলেন ও বুদ্ধদেবকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। প্রকৃত বিশ্বাসীরা কহিয়া থাকেন যে, অশ্মখণ্ডের উপরে ভগবানের অঙ্গুলি-চালনার চিহ্ণ অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে; বৌদ্ধজগতে ইহার নাম ইন্দ্রশিলাগুহা। যতক্ষণ পর্য্যন্ত ভগবান প্রশ্নের মীমাংসা করিতেছিলেন ততক্ষণ পঞ্চশিখ বীণাসংযোগে সঙ্গীতধ্বনি করিতেছিলেন। অপর স্তম্ভে মৃগজাতকীয় চিত্র। বৃত্তমধ্যে তিনটি বৃক্ষ; দক্ষিণপার্শ্বে পলায়নপর মৃগযূথ, মধ্যদেশে গর্ত্তমধ্যে পতিত একটি বৃহৎ মৃগ ও গর্ত্তের পার্শ্বে স্তুতিশীল মনুষ্যত্রয়, বামপার্শ্বে জনৈক মনুষ্য মৃগযূথের প্রতি শরত্যাগ করিতেছে। কথিত আছে, কোন এক পূর্ব্বজন্মে ভগবান শাক্যমুনি মৃগযূথপতি ছিলেন। একদা জনৈক ব্যাধ মৃগকুল তাড়না করিলে একটি গর্ভবতী মৃগী পলায়নে অক্ষম হইয়া যূথপতিকে সম্বোধন করিয়া কহে, “আমি পলায়নে অক্ষম ও আমি নিহত হইলে আমার গর্ভস্থ ভ্রুণ পর্য্যন্ত নিহত হইবে।” ইতিমধ্যে ধাবমান যূখের সম্মুখে একটি গর্ত্ত দেখিয়া হরিণী পলায়নে বিরত হইল। যূথপতি গর্ত্তের মধ্যে লম্ফপ্রদান করিয়া হরিণীকে কহিলেন “তুমি আমার পৃষ্ঠে পাদনিবেশ করিয়া গর্ত্ত পার হইয়া যাও।” তখন অপর সকলে লম্ফপ্রদানে গর্ত্ত পার হইয়া গিয়াছে। পরক্ষণেই ব্যাধ-নিক্ষিপ্ত শরে আহত হইয়া যূথপতি প্রাণত্যাগ করিলেন।

 অপর স্তম্ভে নাগজাতক। একটি সরোবরতীরে তিনটি হস্তী দণ্ডায়মান। তন্মধ্যে একটি কুলীরক কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছে। কথিত আছে, বনমধ্যে এক বিশাল সরোবরে একটি অতি বৃহৎ কুলীরক বাস করিত। হস্তিগণ জলপানের জন্য সরোবরে অসিলে দশরথরাজ কোন একটির পদ দৃঢ়রূপে আমরণকাল ধারণ করিয়া থাকিতেন। হস্তীর মৃত্যু হইলে কিয়ৎকাল পর্য্যন্ত তিনি আহার পাইতেন। পরে বোধিসত্ত্ব হস্তিনীগর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়া কুলীরকের ব্যবহার শুনিলেন। একদা তিনি পিতার অনুমতি লইয়া সরোবরে গমন করিলেন। কুলীরক তাঁহাকে আক্রমণ করিল ও পরে তাঁহার পত্নীর অনুরোধে দয়ার্দ্র হইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। তাঁহাকে পরিত্যাগ করিবামাত্র তাঁহার পাদপেষণে কুলীরক বিনষ্ট হইল। অপর স্থানে ছদন্তজাতক অঙ্কিত আছে। কথিত আছে, হিমালয়ের নিকটবর্ত্তী ছদন্ত হ্রদের সান্নিধ্যে অষ্টসহস্র ষড়দন্ত হস্তী বাস করিত। বোধিসত্ত্ব এক সময়ে এই হস্তিযূথের অধিপতি ছিলেন ও তাঁহার মহাসুভদ্রা ও বুল্লসুভদ্রা নাম্নী দুইটী পত্নী ছিল। একদা যূথপতি একটি বৃক্ষ উৎপাটন করায় মহাসুভদ্রার নিকটে পত্রপুষ্প ও বুল্লসুভদ্রার নিকটে শুষ্ক পত্র ও শাখা মাত্র পতিত হইল। এই সময় হইতে বুল্লসুভদ্রা যূথপতির প্রতি বিরক্ত হইল ও বিগত পঞ্চশত বুদ্ধদিগের নিকটে প্রার্থনা করিতে লাগিল যে, সে যেন পরজন্মে রাজকন্যা হইয়া জন্মগ্রহণ করে ও ব্যাধ প্রেরণ করিয়া যূথপতিকে বিনষ্ট করিতে পারে। বুদ্ধগণ তাহার আশা সফল করিলেন। বুল্লসুভদ্রা অল্পদিন পরেই মৃত্যুমুখে পতিত হইল ও কোন এক রাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করিয়া কাশীরাজের সহিত বিবাহিতা হইল! সে পূর্ব্বপ্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়া পূর্ব্বস্বামীর নিধনের জন্য কৃতসঙ্কল্প হইল। তৎপ্রেরিত ব্যাধ তাহার নির্দ্দেশানুসারে ছদন্তহ্রদতীরে আসিয়া হস্তিযূথের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিল। ব্যাধ দেখিল, হস্তিযূথপতি হ্রদের একই স্থানে প্রতিদিন স্নান করিয়া থাকেন। সে সেই স্থানে একটি গর্ত্ত খনন করিয়া উপরে শরনিক্ষেপের স্থান মাত্র রাখিয়া কাষ্ঠ ও মৃত্তিকার দ্বারা উপরিভাগ আচ্ছাদিত করিয়া স্বয়ং গর্ত্তমধ্যে লুক্কায়িত রহিল। পরদিবস যূথপতি স্নানার্থ আসিয়া শরাহত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার আর্ত্তনাদে অপর হস্তিগণ আসিয়া ব্যাধের অনুসন্ধান করিতে করিতে ভূগর্ভে কাষায়-পরিহিত ব্যাধকে দেখিতে পাইল। ব্যাধের মুখে সকল কথা অবগত হইয়া যূথপতি তাহাকে হত্যা করিতে সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন “বুল্লসুভদ্রা সামান্য কারণে আমার প্রাণ হরণে কৃতসঙ্কল্প হইয়া আমার দন্তগুলির জন্য তোমাকে প্রেরণ করিয়াছে। কিন্তু আমার দন্ত লইয়া তাহার কোন উপকার হইবে না। তবে তুমি স্বচ্ছন্দে আমার দন্ত কর্ত্তন করিতে পার।” ব্যাধ দন্তগুলি স্পর্শ করিতে অক্ষম হওয়ায় যূথপতি তাহাকে শুণ্ডে উত্তোলন করিয়া ধারণ করিলে সে দন্ত ছেদন করিল; ইহার পর যূথপতির মৃত্যু হইল। চিত্রে বৃত্তমধ্যে বৃক্ষতলে চারিটি হস্তী দণ্ডায়মান। ব্যাধ ধনুর্ব্বাণ ভূমিতে নিক্ষেপ করিয়া দন্ত কর্ত্তন করিতেছে। কোন স্থানে স্তম্ভের মধ্যভাগে চতুষ্কোণ বেষ্টনের মধ্যে স্বর্গের বৈজয়ন্তপ্রাসাদ অঙ্কিত আছে। প্রাসাদ ত্রিতল, দ্বিতলে ও ত্রিতলে বাতায়নপথে অঙ্গনাগণের মুখ লক্ষিত হইতেছে, নিম্নতলে একটি গৃহে কতকগুলি দেবদেবী রহিয়াছেন। পার্শ্বে বিহারমধ্যে ভগবান শাক্যমুনির উষ্ণীষ রক্ষিত। মন্দিরের দক্ষিণ পার্শ্বে একজন পুরুষ চামর ব্যজন করিতেছে ও বাম পার্শ্বে একজন উপাসক করযোড়ে দণ্ডায়মান রহিয়াছে। বিহার ও প্রাসাদের সম্মুখে অপ্সরোগণ নৃত্য করিতেছে ও ভূমিতে উপবিষ্ট পুরুষগণ বীণা প্রভৃতি যন্ত্র বাদন করিতেছে। শাক্যমুনির মহাপরিনির্ব্বাণের পর দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার উষ্ণীষ লইয়া স্বর্গে গমন করেন ও তথায় সদাসর্ব্বদা দেবগণ তাহার উপাসনা করিয়া থাকেন, অপ্সরোগণ নৃত্যগীত করিয়া থাকে। ভিক্ষু ঋষিপালিত এই স্তূপনির্ম্মাণকালে এই স্তম্ভটি দান করিয়াছিলেন। ইহার দুইপার্শ্বে চতুষ্কোণ বেষ্টনীর মধ্যে ছয়টি চিত্র আছে ও ইহাতে বৃত্ত বা অর্দ্ধবৃত্ত নাই। অপর পার্শ্বদ্বয়ে সূচী স্থাপনের জন্য ছয়টি ছিদ্র আছে। ইহার একপার্শ্বে উপরিভাগে বৈজয়ন্ত-প্রাসাদ ও উষ্ণীষ-বিহারের চিত্র অঙ্কিত আছে। এই পার্শ্বে সর্ব্বনিম্নের চিত্রে মগধরাজ অজাতশত্রুর বুদ্ধ-বন্দনার চিত্র অঙ্কিত আছে। চিত্রটি দুইভাগে বিভাগ করা যাইতে পারে। নিম্নে চারিটি হস্তী ও তৎপৃষ্ঠে দুইটি পুরুষ ও তিনটি স্ত্রীলোক। ইহার পরে বৃক্ষদ্বয়ব্যবধানে একটি চতুষ্কোণ বেদী ও তাহার সম্মুখে করযোড়ে নতজানু জনৈক পুরুষ। পশ্চাতে একজন পুরুষ ও চারিজন স্ত্রীলোক। কথিত আছে, রাজা অজাতশত্রু পিতৃহত্যা করিয়া বহুকাল যাবত অনায়াসে নিদ্রালাভ করিতে পারে নাই। শেষে তিনি তাঁহার ভ্রাতা ও চিকিৎসক জীবকের উপদেশানুসারে বুদ্ধ-দর্শনে গমন করিয়াছিলেন। রাজা পঞ্চশত স্ত্রী সমভিব্যাহারে হস্তিপৃষ্ঠে রাজগৃহ নগরদ্বার হইতে নির্গত হইতেছেন। চিত্রের নিম্নদেশে হস্তিপৃষ্ঠে পুরুষদ্বয়ের মধ্যে একজন রাজা অজাতশত্রু ও অপর জন হস্তিপক। চিত্রের ঊর্দ্ধদেশে নতজানু পুরুষ রাজা অজাতশত্রু। অপরস্থানে বৃত্তের মধ্যে অনাথপিণ্ডদের জেতবনদানের চিত্র। বৃত্তের মধ্যে বামপার্শে তিনটি বৃক্ষ। তিনটি মনুষ্য ভূমিতে চতুষ্কোণ সুবর্ণমুদ্রা বিস্তৃত করিতেছে, চতুর্থ ব্যক্তি শকট হইতে সুবর্ণ মুদ্রা বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে। এক ব্যক্তি একটি বৃক্ষের পার্শ্বে শকটের সম্মুখে দণ্ডায়মান। বৃত্তের দক্ষিণপার্শ্বে দুইটি স্বতন্ত্র গৃহ আছে। তাহাদিগের ব্যবধানে পূর্ণভৃঙ্গার হস্তে এক ব্যক্তি দাঁড়াইয়া আছেন, ইনি শ্রাবস্তী নগরের প্রধান শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডদ। অনাথপিণ্ডদের সম্মুখে কতকগুলি পুরুষ দণ্ডায়মান। কথিত আছে, ভগবান শাক্যমুনির জীবনকালে শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডদ বুদ্ধদেবের জন্য একটি বিহার নির্ম্মাণে কৃতসঙ্কল্প হইয়া শ্রাবস্তীনগরোপকণ্ঠে উপযুক্ত স্থানের সন্ধান করিতেছিলেন। নগরোপকণ্ঠে কুমারপাদ জেতের উদ্যানবাটিকা তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তিনি জেতের নিকট উহার মূল্য জিজ্ঞাসা করেন। জেত বলিয়াছিলেন যে সুবর্ণমুদ্রা কর্ত্তৃক ভূখণ্ড আচ্ছাদন করিয়া দিলে তিনি উদ্যান বিক্রয়ে প্রস্তুত আছেন। তদনুসারে অনাগপিণ্ডদ কোটি সুবর্ণমুদ্রা ব্যয় করিয়া অধিকাংশ ভূমি আচ্ছাদন করিলে জেত অবশিষ্ট ভূমি বিনামূল্যে প্রদান করেন। অনাথপিণ্ডদ জলধারা ভূমিতে নিক্ষেপ করিয়া বৌদ্ধসঙ্ঘের নামে উদ্যান উৎসর্গ করিয়াছিলেন। চিত্রে যে দুইটি গৃহ আছে তাহা গন্ধকূটি ও কোশম্বকূটি নামে আখ্যাত। যতদিন সদ্ধর্ম্মের মহিমা অম্লান থাকিবে ততদিন জেতবনের নাম, অনাথপিণ্ডদের নাম ও কূটিদ্বয়ের নাম চিরস্মরণীয় থাকিবে। শুনিয়াছি, কালে শ্রাবস্তীনগরী মৃৎস্তূপে পরিণত হইয়াছে, জেতবনবিহার ও গন্ধকূটি ধূলিরাশিতে পর্য্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু তীর্থযাত্রিগণের পথপ্রদর্শক ভিক্ষু ও শ্রমণগণ অদ্যাপি জেতবন ও কোশম্বকূটির নাম গ্রহণ করিয়া থাকেন। কি দেখিয়া আসিয়াছ? রাপ্তী নদী তীরে কোশলরাজ প্রসেনজিতের উচ্চচূড় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ চূর্ণীকৃত হইয়া রাজপথের ধূলির সহিত মিশ্রিত হইয়াছে। শ্রাবস্তীনগরীর সেই মহাশ্মশান দেখিতে গিয়াছিলে কি? যাহারা পর্ব্বতবাসী পরাক্রান্ত শাক্যজাতির ধ্বংস সাধন করিয়াছিল, তাহাদিগের বংশধরদিগকে দেখিয়াছ কি? শাক্যরাজদিগের গুরু ত্রৈপিটকোপাধ্যায় ভিক্ষুবল ও পুষ্যবুদ্ধি যে মহাবিহার নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, শিলাসঙ্কুল উদ্ভিদ সমাবৃত তাহার ধ্বংসাবশেষও বোধ হয় দেখিয়াছ। গাহড়বালবংশীয় কান্যকুব্জরাজ গোবিন্দচন্দ্র জেতবনে যে সঙ্ঘারাম নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, যে সঙ্ঘারামের ব্যয় নির্ব্বাহার্থ শ্রাবস্তীমণ্ডলে, শ্রাবস্তীবিষয়ে, শ্রাবস্তীভূক্তিতে অষ্টসংখ্যক গ্রাম দান করিয়াছিলেন, শুনিয়াছি তাহার ধ্বংসাবশেষ লইয়া নবরাজ্যের হৈমকান্তি রাজপুরুষগণ রাজবর্ত্ম নির্ম্মাণ করিয়াছেন। মহাচীন হইতে কুরুবর্ষ পর্য্যন্ত সমগ্র মহাদেশের প্রকৃতবিশ্বাসিগণ যে নগরের পথের ধূলিমুষ্টি পবিত্রজ্ঞানে মহাযত্নে সুদূর পিতৃভূমিতে লইয়া যাইতেন, যে বিহার দর্শনে সহস্র সহস্র ক্রোশব্যাপী পথাতিক্রমজনিত শ্রম বিস্মৃত হইতেন, সহস্র সহস্র বর্ষ ধরিয়া প্রকৃত বিশ্বাসিগণ যে স্থানে কোটি কোটি সুবর্ণমুদ্রা মন্দিরবিহারাদির শোভনার্থ ব্যয়িত করিয়াছিলেন, সে স্থানে শ্রাবস্তীনগরের অতীত গৌরবের সাক্ষ্য দিবার কিছুই নাই।

 কোন স্তম্ভে মধ্যদেশে অর্দ্ধবৃত্ত নাই। পূর্ব্ববর্ণিত আবরণে প্রথমস্তম্ভের ন্যায় নাগ বা যক্ষমূর্ত্তি, কোন স্তম্ভে বা অশ্বারুঢ় পতাকাবাহী পুরুষ বা স্ত্রীমূর্ত্তি দেখা যাইত। এইরূপে চুলকোক দেবতা, সুদর্শনা যক্ষিণী, সিরিমা দেবতা, চন্দা যক্ষিণী, সূচীলোম যক্ষ, কুবের যক্ষ প্রভৃতি নানাবিধ মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যাইতেছিল। কোন স্তম্ভে বৃত্ত বা অর্দ্ধবৃত্তের মধ্যে নানাবিধ কৌতুকাবহ চিত্র অঙ্কিত হইয়াছিল। কোন স্থানে চারিটি বানর একটি হস্তীকে বন্ধন করিয়া লইয়া যাইতেছে। হস্তীর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার জন্য শুণ্ডে কাষ্ঠখণ্ড বন্ধন করিয়া দিয়াছে। একটী বানর বন্ধনরজ্জু ধরিয়া অঙ্কুশহস্তে হস্তীকে পথ প্রদর্শন করিয়া চলিয়াছে ও অপর তিনটি নৌকাগুণবাহীদিগের ন্যায় রজ্জুদ্বারা বিশাল জীবটিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। দ্বিতীয় দৃশ্যে বানরগণ হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়াছে, পূর্ব্ববর্ণিত পথপ্রদর্শক হস্তীর স্বন্ধে আরোহণ করিয়াছে, একটি বানর দন্তে দণ্ডায়মান হইয়া চালককে কি বলিতেছে। নিম্নে তিনটি বানর বংশী ঢক্কা ও ডমরু নিনাদিত করিতেছে, দৃশ্যান্তরে একটি রাক্ষস আসনে বসিয়া আছে—একটি বানর তাহার নাসিকারন্ধ্রে বক্র লৌহনিবেশপূর্ব্বক লৌহের শেষভাগ ধরিয়া আছে, নিম্নে একটী ক্ষুদ্র বানর ক্ষুদ্র আসনে উপবিষ্ট হইয়া রাক্ষসের দক্ষিণহস্ত ধারণ করিয়া আছে। নাসারন্ধ্র সংন্যস্ত বক্রলৌহে রজ্জুখণ্ড আবদ্ধ করিয়া একটি হস্তীর গলদেশে বন্ধন করা হইয়াছে। হস্তী প্রাণপণ শক্তিতে টানিতেছে, হস্তিপক অঙ্কুশাঘাত করিতেছে, পশ্চাতে অপর বানর হস্তীর পদে দণ্ডাঘাত করিতেছে, ঊর্দ্ধে ও নিম্নে বানরদ্বয় শঙ্খ ও ঢক্কা নিনাদ করিয়া ভীতিপ্রদর্শন পূর্ব্বক হস্তীকে চালনা করিবার চেষ্টা করিতেছে। চিত্র দেখিয়া স্পষ্ট বোধ হইতেছে এত চেষ্টা সত্ত্বেও রাক্ষসের নাসারন্ধ্রের লোম উৎপাটিত হইতেছে না। কোন স্তম্ভে অশ্বপৃষ্ঠে আরূঢ় স্ত্রী বা পুরুষ, গরুড় বা কিন্নরধ্বজ হস্তে লইয়া ধীর পদক্ষেপে গমন করিতেছে। গরুড় বা কিন্নরধ্বজ বিস্ময়ের বিষয় নহে। এখন যেমন কিরাত দেশের প্রান্তে বৌদ্ধতীর্থে অসংখ্য বংশদণ্ডাগ্রে শ্বেত, কৃষ্ণ, নীল, পীত, রক্ত নানা বর্ণের কেতন দেখিত্তে পাও, তেমনই প্রাচীন যুগে মন্দির বা বিহার হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন নির্ব্বিশেষে নানাবিধ পতাকাশোভিত ধ্বজসমূহ পুণ্যার্থিগণকর্ত্তৃক স্থাপিত হইত। সমগ্র আর্য্যাবর্ত্তে মহারাজ ধর্ম্মাশোক স্থাপিত সিংহ, হস্তী ও বৃষধারী শিলাস্তম্ভ দেখিয়াছ, উহাও ধ্বজমাত্র। সামান্য তীর্থযাত্রীর বংশদণ্ডের পরিবর্তে আসমুদ্রক্ষিতীশ সুচিক্কণ, সমুজ্জ্বল, মসৃণ শিলাস্তম্ভ প্রোথিত করিয়া পুণ্যস্থানে কাষায় কেতন উড্ডীন করিয়াছিলেন। ধর্ম্মলিপি খোদিত হইবার পূর্ব্বে উপগুপ্তের দীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া অশোক আর্য্যাবর্ত্তে যে পুণ্যযাত্রা করিয়াছিলেন সেই সময়ে পুণ্যস্থান মাত্রেই ধর্ম্মাশোকের সিংহ, হস্তী বা বৃষধ্বজ স্থাপিত হইয়ছিল। কবে কোন যবন আসিয়া, ব্রাহ্মণগণের উপাস্য কোন দেবতার পদপ্রান্তে, আর্য্যাবর্ত্তের কোন প্রান্তে, গরুড়ধ্বজ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল; সহস্র সহস্র বর্ষ পরে তাঁহার পুণ্যকর্ম্মের লেখ, সিন্দূর লেপন মুক্ত হইয়া পুনরায় নরলোচনের গোচরীভূত হইয়াছে! তাহা দেখিয়া বা শুনিয়া বিস্মিত হইও না। যদি ব্রাহ্মণের উপাস্য বাসুদেবের উদ্দেশে যবন তীর্থযাত্রী কর্ত্তৃক একটি পাষাণময় গরুড়ধ্বজ নির্ম্মিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে আর্য্যাবর্ত্তে সদ্ধর্ম্মের পঞ্চবিংশ শতাব্দীব্যাপী জীবনে যে লক্ষ লক্ষ কেতনবাহী ধ্বজ স্থাপিত হইয়াছিল, তাহাও দেখিতে পাইবে। পুণ্যস্থানে অনুসন্ধান কর, দেখিতে পাইবে, রাজগৃহে, পাটলীপুত্রে, মহাবোধিতে, বৈশালীতে, বারাণসীতে, শ্রাবস্তীতে, কুশীনগরীতে, কোশাম্বীতে, সঙ্কাশ্যে, উজ্জয়িনীতে, মথুরায়, পৃথুদকে, স্থাণ্বীশ্বরে, জালন্ধরে, তক্ষশিলায়, নগরহারে, পুরুষপুরে, বাহ্লীকে, কপিশায় কত সহস্র ধ্বজ স্থাপিত হইয়াছিল। সদ্ধর্ম্মের গৌরবের তুলনায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের গৌরবও ক্ষীণ। সমস্বরে সদ্ধর্ম্মের সহিত ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের নামোচ্চারণ করা উচিত নহে।

 প্রভাতে উৎসব। নববিবাহিতের আকাঙ্ক্ষার ন্যায় দুর্দ্দমনীয় মনোবেগ লইয়া ঊষাগমের প্রতীক্ষা করিতেছিলাম, যাহা দেখিলাম তাহা আর কখনও দেখি নাই, আর কখনও দেখিব না। তাহার প্রত্যেক ঘটনা আমার মনে কে যেন খোদিত করিয়া রাখিয়াছে। তাহার কিছুই বিস্মৃত হই নাই।