পাষাণের কথা/৫

উইকিসংকলন থেকে

[ ৫ ]

 প্রভাতে সূর্য্যোদয়ের বহুপূর্ব্বে নগরের দিক হইতে কোলাহল শ্রুত হইতে লাগিল। তখন শিশির কাল। হিমকণসিক্ত প্রান্তরে শুভ্রতুষারের ক্ষীণাবরণ শুক্ল উত্তরচ্ছদের ন্যায় দেখাইতেছিল। হিমকণসিক্ত পল্লবে তুষারখণ্ড আবদ্ধ থাকায় মনে হইতেছিল যেন বনস্পতিগণ পুণ্যাহে লাজ নিক্ষেপ করিতেছেন। নৈশ তমোভেদ করিয়া যখন পূর্ব্বপ্রান্তে বাহ্লীকাঙ্গনার সীমন্তে সিন্দূর ছটার ন্যায় অরুণরাগ লক্ষিত হইল, তখন জনসঙ্ঘের পাদপেষণে প্রান্তরের তুষারাবরণ কর্দ্দমে পরিণত হইয়াছে, অসাধারণ কোলাহলে বিহগকুল কুলায় পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছে, নানা রাগরঞ্জিত উষ্ণীষে ও শিরস্ত্রাণে সমগ্র প্রান্তর পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। জনতার মধ্যদেশে রজ্জুরক্ষিত কোষ্ঠপালগুপ্ত পথ, স্তূপবেষ্টনী হইতে নগরদ্বার পর্য্যন্ত বিস্তৃত। যেন একটি বিশাল কালব্যাল মৃত্যু যন্ত্রণায় লম্বমান হইয়াছে। সূর্য্যোদয়ের ঈষৎ পূর্ব্বে পুরাঙ্গনাগণ এই পথ পরিষ্কৃত করিয়া গেল, তাহাদিগের পর কুমারীগণ দলে দলে অঞ্চল ভরিয়া নানাবিধ পুষ্প লইয়া আসিয়া সুগন্ধি কুসুমে পথ আচ্ছন্ন করিয়া গেল। সুগন্ধ জলপূর্ণ ভৃঙ্গার হস্তে বালকগণ আসিয়া পুষ্পরাশি সিঞ্চন করিয়া গেল, ইতিমধ্যে স্তূপের চারি তোরণের আবরণপার্শ্বে উপবিষ্ট বাদকগণ যন্ত্র সংযোগে স্তুতিগান আরম্ভ করিল। আমরা যে পুষ্পসজ্জায় সজ্জিত হইয়াছিলাম তাহা প্রফুল্ল রাখিবার জন্য পরিচারকগণ সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে উপর্যুপরি গন্ধবারি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। এমন সময়ে নগরবারে তুর্য্যনিনাদ শ্রুত হইল, সঙ্গে সঙ্গে নগরতোরণ হইতে দেবযাত্রা নির্গত হইল। দেবযাত্রার পুরোভাগে, পংক্তির পর পংক্তি চীবরধারী ভিক্ষু ও শ্রমণ। প্রতি পংক্তিতে পাঁচজন, এইরূপ শতাধিক পংক্তি নির্গত হইল। পরে বাদিকা ও নর্ত্তকীদল পুণ্যসঙ্গীত ও যন্ত্রবাদন করিতে করিতে ভিক্ষুগণের পদানুসরণ করিল। তাহাদিগের পরে বহুমূল্য বেশভূষায় ভূষিত হইয়া নগরের দেবদাসী, গণিকা, লেনাশোভিকাগণ আসিল। ইহার নগরদ্বার হইতে নির্গত হইলে অত্যুচ্চ শ্বেতবর্ণ সপ্তচ্ছত্র পরিলক্ষিত হইল। শ্বেতচ্ছত্র দর্শনে জনতা হইতে বিশাল কলরব উত্থিত হইল, কোষ্ঠপালগণের রজ্জুবন্ধন উল্লঙ্ঘন করিয়া জনসঙ্ঘ নগরাভিমুখে প্রতিগমনের চেষ্টা করিতে লাগিল। বহু চেষ্টায় যাত্রার পথ অবাধ রহিল, কিন্তু সে কলরব আর মধ্যাহ্নের আগে প্রশমিত হইল না। শ্বেতচ্ছত্র ক্রমে নিকটে আসিলে দৃষ্ট হইল যে, উহার নিম্নে সুবর্ণদণ্ডযুক্ত মুক্তা ও হীরকখচিত চন্দ্রাতপ। রাজা ধনভূতি ও তাঁহার মহিষীগণ নিজহস্তে চন্দ্রাতপের স্বর্ণদণ্ড ধারণ করিয়া আসিতেছেন। চন্দ্রাতপের নিম্নে স্বর্ণ নির্ম্মিত ছত্রদণ্ডধারী পাটলীপুত্রের সেই লোলচর্ম্ম মহাস্থবির। তাঁহার পার্শ্বে শ্বেতাঙ্গ দীর্ঘকায় শ্বেতবস্ত্র-পরিহিত জনৈক প্রৌঢ় ব্যক্তি দক্ষিণহস্তে একটি স্ফটিকাধার লইয়া আসিতেছেন। মহাস্থবির সেই স্ফটিকাধারের উপর স্বর্ণছত্র ধারণ করিয়া আছেন। হিমক্লিষ্ট প্রভাতে নগ্নপদ ও স্বল্পাচ্ছাদন সত্ত্বেও বোধ হইতেছিল যেন, তাঁহার বয়সের অর্দ্ধ শতাব্দী কালের হ্রাস হইয়া গিয়াছে, লোলচর্ম্ম পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, কালভারাবনত দেহযষ্টি দণ্ডের ন্যায় তুঙ্গ হইয়াছে, বোধ হয় নির্ব্বাণ লাভ হইলেও তাঁহার আকারের এইরূপ পরিবর্ত্তন হইত না। তাঁহার পার্শ্বচর প্রৌঢ়কে দেখিয়া জনসঙ্ঘের মধ্যস্থিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিমাত্রই তাঁহাকে সসম্মানে অভিবাদন করিলেন, অন্যান্য সকলে বিস্ময়স্তিমিত নয়নে চাহিয়া রহিল। অদ্য দেবযাত্রায় তথাগতের শরীর-ভার বহনের সৌভাগ্য কাহার হইল তাহা বুঝিতে পারা গেল না। চন্দ্রাতপের পশ্চাতে রাজকর্ম্মচারিগণ ও তাঁহাদিগের পশ্চাতে নগরের যে কেহ অবশিষ্ট ছিল সকলে বাহির হইয়া আসিল। দেবযাত্রা সম্পূর্ণরূপে তোরণদ্বার অতিক্রম করিল। আজিকার দিনে হস্তী, অশ্ব, উষ্ট্র, রথ ব্যবহৃত হইল না—রাজা হইতে সামান্য নাগরিক পর্য্যন্ত সকলেই নগ্নপদে দেবযাত্রায় যোগদান করিলেন। ক্রমে যাত্রার পুরোভাগ স্তূপের তোরণের সম্মুখীন হইল। সদ্যঃস্নাত কৌষেয় বস্ত্র পরিহিত যবনশিল্পিচতুষ্টয় জলধারা, অর্ঘ্য ও পুষ্পপ্রদানে দেবযাত্রার পূজা করিলেন; পরে যথাক্রমে সমগ্র দেবযাত্রা তিনবার স্তূপবেষ্টনী পরিক্রমণ করিল, পরে পূর্ব্ব তোরণ দিয়া বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া পরিক্রমণের পথে সপ্তবার প্রদক্ষিণ করিল। দেবযাত্রার পুরোভাগ দক্ষিণ তোরণের সম্মুখীন হইলে আর্ত্তিমিদোর পরিক্রমণের পথে আসিয়া বর্ত্তুলাকার স্তূপগাত্র স্পর্শ করিবামাত্র দুই খণ্ড বিশাল প্রস্তর অন্তর্হিত হইল; দৃষ্ট হইল, মানব দেহ পরিমিত স্থান মুক্ত হইয়াছে। যবনশিল্পীর আহ্বানে রক্তবর্ণ পরিচ্ছদ পরিহিত দশজন উল্কাধারী উন্মুক্ত পথে অগ্রসর হইল। ধনভূতি, পাটলীপুত্রবাসী মহাস্থবির ও তথাগতের শরীরভারবাহী শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ব্যতীত অপর সকলেই বহির্দ্দেশে দণ্ডায়মান রহিলেন। চামর হস্তে ধনভূতি, স্বর্ণছত্র হস্তে মহাস্থবির ও শরীরভারহস্তে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ উল্কাধারিগণের পশ্চাতে গহ্বর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। পরে শুনিয়াছি গৃহমধ্যে বিস্তৃত চতুষ্কোণ গর্ভগৃহ নির্ম্মিত হইয়াছিল। এই কক্ষের মধ্যভাগে বিশাল পাষাণনির্ম্মিত আধারে, সুবর্ণপাত্রে তথাগতের শরীরসহ স্ফটিকনিধান নিহিত হইয়াছিল। ক্রমে রাজা,—মহিষীগণ যথাযোগ্য অনুক্রমানুসারে রাজপুরুষ ও নগরবাসিগণ গহ্বরমধ্যে প্রবেশ করিয়া তথাগতের শরীর দর্শন, স্পর্শন ও অর্চ্চনক্রিয়া সমাধা করিলেন। শেষ নাগরিক যখন গর্ভগৃহ হইতে নির্গত হইল, তখন সূর্য্যোদয়ের পর দ্বিপ্রহর কাল অতীত হইয়াছে। ক্রমে প্রান্তর ও নগরোপকণ্ঠ, পটমণ্ডপে ও হরিদ্বর্ণ পল্পবাচ্ছাদিত কুটীরে আচ্ছাদিত হইয়া গেল। নাগরিকগণের কথোপকথনে জানিতে পারিলাম যে, দ্বিপ্রহর রাত্রির পূর্ব্বে জনসঙ্ঘের এক প্রাণীও নগরে প্রত্যাবর্ত্তন করিবে না। দেখিলার প্রান্তরে নূতন নগর বসিয়াছে, রাজপুরুষগণ রাজপথ নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন পথিপার্শ্বে—পটমণ্ডপে বা সামান্য বস্ত্রাচ্ছাদনে অসংখ্য বিপণি বসিয়াছে, ক্রেতারও অভাব নাই। নানাস্থান হইতে রন্ধনের ধূম উত্থিত হইতে লাগিল। জনসঙ্ঘ দেব-দর্শনে পূর্ণমনোরথ হইয়া উৎসবানন্দে উন্মত্ত হইল। বেষ্টনের বহির্দ্দেশে পুষ্পবিক্রেতৃগণের বিপণি। দিবা দ্বিপ্রহরের মধ্যে তাহদিগের সঞ্চিত পুষ্পরাশি বিক্রীত হইয়া গেল, দিবাবসানের পূর্ব্বে আর তাহাদিগের পণ্যসংগ্রহ হইল না। স্তূপের পূর্ব্ব তোরণ হইত্তে নগরদ্বার পর্য্যন্ত প্রধান রাজপথ। এই পথে পুষ্পবিক্রেতাদিগের, পরে সুরা ও তাম্বুল বিক্রেতাদিগের বিপণি। দেবার্চ্চন সমাপ্ত হইলে নগরবাসিগণ যেন মরুভূমির ন্যায় শুষ্ক হইয়া উঠিল; স্তূপবেষ্টনী হইতে বহির্গত হইয়াই দলে দলে আসব পানে ধাবমান হইল। পণ্যশালায় প্রবেশ করিয়া পূর্ণ পাত্র পান, বাহিরে আসিয়া তাম্বুল ক্রয় ও তাম্বুলবিক্রেত্রীর সহিত হাস্য পরিহাস, কণ্ঠ শুষ্ক হইলে পুনরায় আসবের বিপণিতে প্রবেশ, এই কর্ম্মেই বোধ হয় অধিকাংশ নাগরিক দিনযাপন করিয়াছিল। নাগরিকগণ উৎসবের দিন যে পরিমাণে সুরা গলাধঃকরণ করিয়াছিল, তাহাতে সপ্তশতবর্ষ পরে হইলে তাহাদিগকে হূণজাতির সহিত তুলনা করিতাম। বৃক্ষতলে কোন স্থানে বারনারীগণ যন্ত্রসংযোগে নৃত্যগীত আরম্ভ করিয়াছে; তাহাদিগের কম্পিত কলেবর ও রক্তনেত্র কাদম্বের মহিমা ঘোষণা করিতেছে। উৎসবের জন্য শৌণ্ডিকগণ বোধ হয় কদম্ববৃক্ষের কাণ্ড পর্য্যন্ত বকযন্ত্রে নিক্ষিপ্ত করিয়াছিল। কোন স্থানে কোন বিলাসী নাগরিকের বিশাল পটমণ্ডপ স্থাপিত হইয়াছে। উৎসবের দিবসে নৃত্যগীত ও হাস্য কোলাহলে বস্ত্রাবাস পরিপূরিত হইয়া উঠিয়াছে, সুরার স্রোত প্রবাহিত হইয়াছে। পথে দলে দলে নাগরিক ও নাগরিকগণ অর্চ্চনান্তে স্নানার্থ নদীতীরে চলিয়াছে। নদীবক্ষে ক্ষুদ্র বৃহৎ নানাবিধ জলযান নানাভরণভূষিত হইয়া মহোৎসবের পরিচয় প্রদান করিতেছে। নদীবক্ষে উৎসবের স্রোত সমভাবে প্রবাহিত, নদীতীর্থের পথ নাগরিকগণের পাদপেষণে কর্দ্দমাক্ত হইয়া উঠিয়াছে, ক্ষুদ্র নদীর জল বহু লোকের সমাগমে মলিন হইয়া উঠিয়াছে। নদীবক্ষেও ক্ষেপনী হস্তে উৎসববিহ্বল তরুণ ও তরুণী, বৃদ্ধ ও বালক। নদীর সান্নিধ্যে বৃক্ষতলে কোন স্থানে চীবরধারী ভিক্ষুগণ প্রব্রজ্যা প্রদান করিতেছেন, মুণ্ডিতশীর্ষ উপাসক ও উপাসিকগণ “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি, ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি” ইত্যদি মন্ত্র পাঠ করিয়া আজীবন সঞ্চিত কলুষরাশি ক্ষয়ের চেষ্টা করিতেছেন। কোন স্থানে স্থবির ও ত্রৈপিটকোপাধ্যায়গণ অভিধর্ম্মকোষব্যাখ্যা ও অভিধর্ম্মবিভাষাশাস্ত্রের কূটতর্ক লইয়া ব্যস্ত হইয়াছেন। এইরূপে দিবসের তৃতীয় প্রহর অতীত হইল। তৃতীয় ও চতুর্থ প্রহরের মধ্যে উৎসব ক্ষণেকের জন্য স্থগিত হইল, সকলেই আহারের চেষ্টায় ব্যস্ত হইল। বৃহৎ পটমগুপে রাজা ও রাজ্ঞীগণ সমবেত ভিক্ষুসঙ্ঘের আহারের আয়োজন করিয়াছেন। মর্য্যাদা নির্ব্বিশেষে ভিক্ষু ও স্থবিরগণ ভোজনে উপবিষ্ট হইয়াছেন, রাজা, বৃদ্ধ মহাস্থবির ও নবাগত শ্বেতাঙ্গপুরুষ তখনও অভুক্ত অবস্থায় আছেন, তাঁহারা ভোজনব্যাপার পর্য্যবেক্ষণ করিতেছেন। ভিক্ষুগণের আহার শেষ হইলে সকলে পুনরায় স্তূপবেষ্টনীর মধ্যে ফিরিয়া আসিলেন। তখন দিবাকর অস্তমিত প্রায়। ইতিমধ্যে পরিচারিকাগণ আমাদিগের পুষ্পসজ্জা দূরে নিক্ষেপ করিয়াছে, নানাবিধ কাচ ও স্ফটিক নির্ম্মিত দীপ ও পাত্র আনীত হইয়াছে, কারণ সন্ধ্যা সমাগমে স্তূপে দীপোৎসব হইবে। ক্রমে সমগ্র স্তূপবেষ্টনী ক্ষুদ্র প্রদীপমালায় সজ্জিত হইল, স্থানে স্থানে উল্কাশ্রেণী সন্নিবিষ্ট হইল; বেষ্টনীর চতুষ্পার্শ্বে অগ্নি প্রজ্জ্বালিত করিবার জন্য স্তূপীকৃত ইন্ধন সংগৃহীত হইল। একে একে সপরিবারে সম্ভ্রান্ত নাগরিকগণ সুসজ্জিত হইয়া বেষ্টনীর মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; নানা রত্নখচিতা সর্ব্বাভরণভূষিতা, বিচিত্র বেশধারিনী পুরাঙ্গণাগণের একত্র সমাবেশে ভীষণাকার পাষাণবেষ্টনী পুনরায় যেন কুসুম সজ্জায় সজ্জিত হইল।

 সন্ধ্যাসমাগমে সমগ্র প্রান্তর আলোকমালায় ভূষিত হইল, প্রতি পটমণ্ডপে, বস্ত্রাবাসে, প্রতি পর্ণকুটীরে প্রদীপশ্রেণী প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। প্রান্তরের স্থানে স্থানে বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বালিত হইল। রাজপুরুষগণের আদেশে প্রান্তরের বৃক্ষগুলি পর্য্যন্ত আলোকমালায় সজ্জিত করা হইয়াছিল। স্তূপের ও বেষ্টনীর আলোকগুলি প্রজ্জ্বালিত হইলে মনে হইল, যেন চক্রাকারে ঘূর্ণ্যমান জ্যোতিষ্কমণ্ডল ইতস্ততঃ উল্কানিক্ষেপ করিতে করিতে নগরপ্রান্তে প্রান্তর মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। দীপোৎসবের সহিত উৎসবের স্রোত প্রবল হইয়া উঠিল, সুরা ও তাম্বুলের বিপণিতে প্রবেশলাভ দুঃসাধ্য হইয়া পড়িল। রজনীকালে আলোকমালা ও জনসঙ্ঘের কোলাহলের ভয়ে নিশাচরগণ বহুদূরে পলায়ন করিল। সন্ধ্যা অতীত হইলে রাজা ধনভূতি মহিষীসমভিব্যাহারে স্তূপের গর্ভগৃহে প্রবেশ করিলেন। গর্ভমধ্যে মহাস্থবির ও নবাগত শ্বেতাঙ্গপুরুষ পূর্ব্ব হইতে আসীন ছিলেন। রাজা ও রাজ্ঞীগণ আসন গ্রহণ করিলে নবাগত শ্বেতাঙ্গ পুরুষ সকলকে সম্বোধন করিয়া যাহা কহিলেন তাহা হইতে তাঁহার পরিচয় পাওয়া গেল।

 তিনি বলিলেন, মহারাজ প্রিয়দর্শী ত্রিংশদ্বর্ষকাল চেষ্টা করিয়া আর্য্যাবর্ত্তে যত স্থানে ভগবান শাক্যের শরীর ছিল, তাহা সংগ্রহ করিয়া পাটলীপুত্রে লইয়া গিয়াছিলেন। প্রিয়দর্শীর দেহাবসানের পর তথাগতের শরীর দর্শন মগধবাসী ব্যতীত অন্য কাহারও পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। আমরা বহু চেষ্টায় উদ্যান প্রদেশে একটা শরীরনিধান হইতে কিয়দংশমাত্র সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি। মৌর্য্যরাজবংশের অধঃপতনের পর যখন বন্যার স্রোতের ন্যায় শকতাড়িত যবনজাতি বাহ্লীক হইতে আসিয়া কপিশা ও উদ্যান অধিকার করিয়াছিল, তখনও শরীরগর্ভে অনেক চৈত্যস্তূপাদি বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে, কারণ যবনগণ তখনও সদ্ধের্ম্মের প্রতি অনুরাগী হয় নাই বা এতদ্দেশবাসিগণের সহিত সহানুভূতি করিতে শিক্ষা করে নাই। অধুনা যবনগণ এতদেশীয় ধর্ম্ম বিশ্বাসে আস্থা স্থাপন করিতে শিখিয়াছে, সুতরাং বিদেশীয়গণের অধিকারে সদ্ধর্ম্মের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে। সদ্ধর্ম্মের উন্নতি অতি অল্প কালমাত্র আরব্ধ হওয়ায় তাহার বাহ্যলক্ষণ এখনও পরিস্ফুট হয় নাই। সদ্ধর্ম্মের অবস্থা পরিবর্ত্তিত না হইলে যাহা সংগ্রহ করিয়াছি, হয় ত তাহাও সংগ্রহ করিতে পারিতাম না। তক্ষশিলা মহাবিহারের অধিকারে ত্রিংশদ্বর্ষ যাপন করিয়া প্রকৃত বিশ্বাসীদিগের যৎকিঞ্চিৎ অনুগ্রহলাভে সমর্থ হইয়াছি, তক্ষদত্তের পুত্র সিংহদত্তকে শতদ্রু নদীতীর হইতে সুবস্তুনদীর উপত্যকা পর্য্যন্ত সকলেই কৃপাদৃষ্টিতে দেখিয়া থাকেন, বিশ্বাস করিয়া থাকেন। মৈত্রেয়নাথের অনুকম্পাবলে আমি গৌতমের শরীরাংশ লাভে সমর্থ হইয়াছি। মহারাজ! যিনি আপনার নগরে আশ্রয় লইয়াছেন, তিনি আর্য্যাবর্ত্তে মহাস্থবিরগণের স্থবির, অর্হৎপাদ ও বোধিসত্বপাদ।

 অর্দ্ধশতাব্দী অবনতির পরে সদ্ধর্ম্ম পুনরুজ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছে। যাঁহার অঙ্গুলি হেলনে আর্য্যাবর্ত্তের প্রান্ত হইতে প্রান্ত পর্য্যন্ত ধর্ম্মের প্রতি, বুদ্ধের প্রতি, সঙ্ঘের প্রতি বিশ্বাসিগণের সুষুপ্ত মমতা জাগ্রৎ হইয়া উঠিয়াছে, যিনি মৌর্য্যাধিকার কালে মহাসঙ্ঘের প্রকৃত গৌরব দর্শন করিয়াছেন, তাঁহারই চেষ্টায় এই মহানুষ্ঠান সফল হইয়াছে। তিনি সমগ্র বৌদ্ধজগতের প্রণম্য, তাঁহারই আদেশে আমি তক্ষশিলা হইতে তথাগতের শরীরাংশ লইয়া, শত শত ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া আর্য্যাবর্ত্তের প্রান্তে, ধনভূতির রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, তাঁহারই আদেশে যবন রাজ্য হইতে ববন শিল্পী প্রেরিত হইয়াছে এবং তাঁহারই আদেশে সত্যধর্ম্মের বিশ্বাসিগণ প্রাণপণ শক্তিতে স্তূপ নির্ম্মাণকার্য্যে সহায়তা করিয়াছেন। মহাস্থবির নবাগত শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বাক্যে লজ্জিত হইলেন ও কিয়ৎক্ষণ পরে রাজা ধনভূতিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন আপনি তক্ষদত্তপুত্র সঙ্ঘস্থবির সিংহদত্তের প্রকৃত পরিচয় অবগত নহেন। অদ্য যিনি তথাগতের শরীরভার বহন করিয়া তক্ষশিলা হইতে আটবিক মহাকোশলে আসিয়াছেন। তিনি এককালে শতদ্রু ও বিপাশা নদীর মধ্যভাগের অধিকারী ছিলেন। বিতস্তা নদীতটে ইঁহারই পূর্ব্বপুরুষ নবাগত যবন রাজের অব্যাহত গতি প্রতিরোধের চেষ্টা করিয়াছিলেন। বিজিত হইয়াও যিনি পৌরববংশের গৌরব রক্ষায় সমর্থ হইয়াছিলেন, তিনি সিংহদত্তের পূর্ব্বপুরুষ। শকতাড়িত যবন প্লাবনে যখন সমগ্র পঞ্চনদে আর্য্যাধিকার বিলুপ্ত হইয়াছিল, তখন স্বাধিকারচ্যুত হইয়া সিংহদত্ত প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাহার পর ত্রিংশদ্বর্ষকাল অতীত হইয়াছে এখন সিংহদত্ত তক্ষশিলা সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষপদ প্রাপ্ত হইয়াছেন। কিন্তু আমি যখন তীর্থপর্য্যটনে টক্কদেশে গিয়াছিলাম, তখন সিংহদত্ত শিশু; তিনি পৌরবজাতির অগ্রণী তক্ষদত্তের একমাত্র পুত্ত্র। কুমারপাদ সিংহদত্তের বয়ঃক্রম এখন ষষ্টি বর্ষের অধিক হইবে। সঙ্ঘে আশ্রয় লাভ করিয়া তাঁহার গৌরব বৃদ্ধি হইয়াছে, তিনি যবন রক্তে শতদ্রুতীর হইতে সিন্ধুনদ পর্য্যন্ত প্লাবিত করেন নাই বটে, তিনি পৌরবজাতির সহস্র সহস্র বর্ষব্যাপী অধিকারচ্যুত হইয়াছেন বটে; কিন্তু সমগ্র পঞ্চনদ আজ তাহার যশঃসৌরভে পরিপূর্ণ। সৃষ্টিকর্ত্তা তাহাকে অন্যবিধ বিজয়গৌরবের জন্য সৃষ্টি করিয়াছিলেন, আসুরিক বলে যবনের নিকট পরাজিত হইয়া তিনি মানসিক বলে সমগ্র যবনজাতিকে পদানত রাখিয়াছেন। যাহারা সাকেত ও মাধ্যমিক পর্য্যন্ত লুণ্ঠন করিয়া গিয়াছে, তাহারা অবশেষে তক্ষশিলার সিংহদত্তের পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত হইয়াছে। কপিশা হইতে গান্ধার পর্য্যন্ত, গান্ধার হইতে শতদ্রুতীর পর্য্যন্ত এই তরুণ মহাস্থবিরের মানসিক বলে বিজিত হইয়াছে। আজ সদ্ধর্ম্মের উন্নতির অঙ্কুর মাত্র দেখা দিয়াছে, আমি শতাধিক বর্ষকালব্যাপী ঘটনাসমূহ লক্ষ্য করিতেছি। অধিকতর উন্নতির সময় অদূরবর্ত্তী। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সূচনায় আর্য্যাবর্ত্তের পশ্চিমপ্রান্তে যে মেঘ দৃষ্ট হইয়াছিল, মৌর্য্যরাজ্যের অবসানে, সেই মেঘোৎসৃষ্ট প্লাবনে মুমূর্ষু সঙ্ঘে পুনরায় বলসঞ্চার হইয়াছে, পুনরায় পশ্চিম প্রান্তে মেঘ দেখা দিয়াছে, কুরুবর্ষে আর্য্যজাতির ও বাহ্লীকে যবনজাতির অধিকার লুপ্ত হইয়াছে, উত্তরমরু হইতে সমুদ্র তরঙ্গের ন্যায় শকজাতি আর্য্যাবর্ত্তের উত্তরখণ্ড আচ্ছন্ন করিয়াছে। ক্ষণেকের জন্য মহানদী শকপ্লাবন রুদ্ধ করিয়াছে। বাধা প্রাপ্ত হইয়া স্রোতের শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে, যেদিন এ স্রোতোবেগ বন্ধনমুক্ত হইবে, সেই দিন ইহা অবাধ গতিতে আর্য্যাবর্ত্তের অধিকাংশ স্থান প্লাবিত করিয়া ফেলিবে। বন্যার গতি যবনপ্লাবনের ন্যায় শতদ্রুতীরে রুদ্ধ থাকিবে না, ইহার বেগ প্রবলতর; প্রাচীন আর্য্য সভ্যতা প্লাবনে ভাসিয়া যাইলেও যাইতে পারে; যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তাহা হইলে মহদুপকার সাধিত হইতে হইবে। কারণ, মরুবাসী জাতিসকল যখন প্রাচীন আবাসভূমি পরিত্যাগ করিয়া নূতন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন তদ্দেশের আদিম অধিবাসিগণ যদি একেবারে অভিভূত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহারা শীঘ্রই পুনরায় আধিপত্যের কিয়দংশ লাভ করিতে সমর্থ হয়। মরুবাসী বর্ব্বরগণ সত্বরই নূতন দেশের প্রাচীন সভ্যতার নিকট নতশীর্ষ হইয়া থাকে। যদি সদ্ধর্ম্মের অঙ্কুরমাত্রও পঞ্চ নদে বিদ্যমান থাকে, তাহা হইলে কালে সমগ্র শকজাতি ত্রিরত্নের আশ্রয় গ্রহণ করিবে। আমি অতি বৃদ্ধ হইয়াছি, মানব জীবনের পরিমাণ অতিক্রম করিয়াছি, আমার দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ; কিন্তু আমি অনুভব করিতে পারিতেছি, যে সদ্ধর্ম্মে উন্নতির দিন আসিতেছে। সে দিন সুদূর নহে, সদ্ধর্ম্মের নবীনগৌরব মৌর্য্যাধিকারকালে লুপ্তপ্রায় গৌরবাপেক্ষা উজ্জ্বলতর হইবে। আমার জীবনের কার্য্য সমাপ্ত হইয়াছে, আমার জন্ম অদ্যাপি শেষ হয় নাই, সুতরাং আমাকে জন্মান্তর গ্রহণ করিতে হইবে, আমার দেহ পরিবর্ত্তনের সময় আসন্নপ্রায়। কিন্তু যাহারা থাকিবে তাহার দেখিবে,—সদ্ধর্ম্মের পুনরুত্থান কাল সমাগত প্রায়। ব্রহ্মন্য ধর্ম্ম ও সদ্ধর্ম্মের ঘাত প্রতিঘাতে আর্য্যাবর্ত্তবাসিগণ হীনবল হইয়া পড়িয়াছে, আর্য্যাবর্ত্তে এমন বল নাই যে, তৎকর্ত্তৃক শকজাতির আক্রমনের দুর্দ্দমনীয় বেগ প্রতিরুদ্ধ হয়। শিক্ষার ও দূরদর্শিতার অভাবে আর্য্যাবর্ত্তের রাজাগণ আসন্ন বিপৎপাত সম্বন্ধে চিন্তাশূন্য। যখন শকজাতি আক্রমণ করিবে, তখন রাজন্যবর্গ একে একে সকলেই বিনষ্ট হইবে। ইহার পর মহাস্থবির তুষ্ণীম্ভাব ধারণ করিলেন। অনেকক্ষণ পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া সিংহদত্ত কহিলেন, মহারাজ! সযত্নরক্ষিত তথাগতের শরীরাংশ আপনার হস্তে সমর্পণ করিলাম। যদি কোন দিন রাজ্যের দুর্দ্দিন উপস্থিত হয়, যদি আপনার রাজ্যে আপনার রাজ্যবাসিগণ তথাগতের ধর্ম্মে বীতরাগ হয়, তাহা হইলে আমার সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ এই যে, আপনি বা আপনার উত্তরাধিকারিগণ আমাদিগের শরীরাংশ আমাদিগকে প্রত্যপর্ণ করিবেন। তক্ষশীলা মহনগরীর মহাবিহারের অধ্যক্ষ যিনি থাকিবেন তিনি সাদরে ইহা গ্রহণ করিবেন। সিংহদত্ত কল্পনাও করিতে পারেন নাই যে, যেদিন নগরবাসিগণ তথাগতের ধর্ম্ম বিস্মৃত হইবে, তাহার বহুপূর্ব্বে হূণগণের পরশুর আঘাতে তক্ষশিলার ভিক্ষুগণের মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে; বিশাল মহাবিহারের অগ্নিদগ্ধ ভস্মাবশেষ বায়ুভরে সিন্ধু তীরে উপনীত হইবে। যেদিন শরীরনিধানের উপরে মহাভার স্তূপ ভাঙ্গিয়া পড়িবে, সেদিন তক্ষশিলা নগরীর অস্তিত্ব পর্য্যন্ত থাকিবে না; খস্, হূণ, দরদবংশজাত মেষপাল মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের উপরে সানন্দে মেষচারণ করিবে; তক্ষশিলা নগরীর নাম পর্য্যন্ত আর্য্যাবর্ত্তে শ্রুত হইবে না।

 রাজা, সিংহদত্ত, মহাস্থবির ও রাজ্ঞীগণ গর্ভগৃহের বাহিরে আসিলে সশব্দে শিলাখণ্ড দ্বয় স্বস্থানে আসিল। তখন উৎসব আমোদ থামিয়া আসিয়াছে, দীপমালা নির্ব্বানোন্মুখ, হিমকণস্পৃষ্ট শীতলবায়ু নিদ্রালস নাগরিকগণকে স্পর্শ করিতেছে, অধিকাংশ ব্যক্তি নগরাভিমুখে ফিরিয়া চলিয়াছে; বিপণিশ্রেণী যেন ইন্দ্রজালবলে অন্তর্হিত হইয়াছে। কেবল সুরাপানোন্মত্ত নাগরিক ও বারাঙ্গণাগণের দেহ মৃতদেহের ন্যায় পথে পথে লুণ্ঠিত হইতেছে। চিন্তাভারাবনতদেহে নিঃশব্দে সকলে রথারোহণে নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। অবশিষ্ট প্রদীপগুলি পরিচারকগণ নির্ব্বাপিত করিল। যে সকল অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বালিত হইয়াছিল, তৎসমুদয় হইতে ধূমরাশি উত্থিত হইতে লাগিল। রক্ষিগণ ব্যতীত বিশাল প্রান্তর জনশূন্য হইয়া গেল। ক্রমশঃ বায়ু বহিতে লাগিল। অল্পক্ষণ পরে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। পথে শয়ন করিয়া যাহারা তখনও উৎসবের আমোদ ভোগ করিতেছিল, তাহারা আশ্রয়ানুসন্ধান করিতে বাধ্য হইল। ঝটিকা ও বৃষ্টির মধ্যে আর্ত্তিমিদোর অনাবৃত দেহে স্তূপবেষ্টনীর দক্ষিণ তোরণে অপেক্ষা করিতেছিলেন। ক্রমে অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিল, মুসলধারে বৃষ্টি পতিত হইতে লাগিল। কাহার প্রতীক্ষায় যবনশিল্পী নিদ্রা ও আশ্রয় ত্যাগ করিয়া তোরণদ্বারে দণ্ডায়মান ছিলেন, তাহা আর বুঝা গেল না।