পাহাড়ে মেয়ে/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


ষোলকলা পূর্ণ।

 “দ্বিতীয় দিবসে কিন্তু আর তত চিন্তা রহিল না, তৃতীয় দিবসে আরও কমিয়া গেল। এইরূপে দশপনের দিবসের মধ্যে সমস্ত চিন্তাই আমার মন হইতে দূরে পলায়ন করিল; তবে হঠাৎ কখন কখন পিতামাতার চিন্তা আমার মনে উদিত হইত বটে; কিন্তু তাহাও জলবিম্বের মত তখনই আবার অগাধ আমোদ-সাগরে মিশিয়া যাইত।

 “এইরূপে দেখিতে দেখিতে ক্রমে তিনমাস অতীত হইয়া গেল। বাটীর সমস্ত লোকের সহিত আমার ভালবাসা জন্মিল, তাহাদের মত আদব-কায়দা, ভাবভঙ্গি, চালচলন প্রভৃতি সমস্তই শিক্ষা করিলাম। ধূমপান করিতে শিখিলাম, ক্রমে সুরাদেবীর আরাধনা করিতেও পরাঙ্মুখ হইলাম না। তখন ক্রমে দেবী আমার মস্তকে পদার্পণ করিয়া আমাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন, ও আমার উপর তাহার সম্পূর্ণ অধিকার বিস্তার করিয়া চিরদিনই আমার পূজা গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 ‘‘—‘তাহার’ সহিত তাঁহার অন্যান্য দুই একটী বন্ধুও ক্রমে আমার ঘরে আসিয়া বসিতে আরম্ভ করিলেন। আমি ভদ্রলোকদিগকে আমার সাধ্যমত যত্ন করিতে কোনক্রমেই ক্রটি করিতাম না। সুতরাং আমার ঘরে যিনি একবার আসিতেন, তিনি আমার উপর কখন অসন্তুষ্ট হইতেন না। প্রথম প্রথম কিছুদিবস তাঁহার কোন বন্ধুই তাঁহার অবর্ত্তমানে আমার ঘরে আসিতেন না; কিন্তু যখন তাঁহারা আসিতেন, আমাদিগের দুই চারি টাকা মদ্যপানাদিতে খরচ না করাইয়া তাঁহারা প্রতিগমন করিতেন না। বলা বাহুল্য, সেই সমস্ত খরচই আমার ‘তিনি’ প্রদান করিতেন। এ নিয়ম কিন্তু বহুদিবস থাকিল না। ক্রমে সময়ে, অসময়ে, রাত্রিকালে ও দিবাভাগে তাঁহার সহিত একত্র, কখন বা পৃথক, অর্থাৎ যখন ইচ্ছা তখনই তাঁহারা আমার ঘরে আসিতে আরম্ভ করিলেন। ইহাতে আমারও কোন প্রতিবন্ধক রহিল না; অধিকন্তু, একাকী কেহ কোন সময়ে আমার ঘরে আগমন করিলে, তাহা আমি কোনরূপেই অপরের কর্ণগোচর হইতে দিতাম না। এই সময় তাঁহারা ‘তাহাকে’ লুকাইয়া আমাকে কিছু কিছু প্রদান করিতেও পরাঙ্মুখ হইতেন না; আমিও তাহা গ্রহণ করিতে কোন প্রকার আপত্তি করিতাম না।

 “এইরূপে এক বৎসরকাল অতীত হইতে না হইতেই আমি যাহা কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই, তাহাই হইল। যদিও এখন অনেকেই আমার সহায় হইয়াছিলেন, তথাপি আমার প্রধান এবং যাঁহাকে আমি আন্তরিক একটুও ভালও বাসিতাম, ‘তিনি’ আমাকে পরিত্যাগ করিলেন;—বিসূচিকা রোগে হঠাৎ ‘তাঁহার’ মৃত্যু হইল। ইহাতে আমার মনে অতিশয় কষ্ট হইল বটে, কিন্তু সে কষ্ট অধিকক্ষণ স্থায়ী হইতে পাইল না, অবিরত সুরাপান ও অপরের সহিত আমোদ-প্রমোদ করিয়া সেই কষ্টকে আমার মন হইতে সহজেই দূরীভূত করিতে সমর্থ হইলাম।

 “হায়! তখন আমি ঘূণাক্ষরেও বুঝিতে পারিয়াছিলাম না যে, আমি দিন দিন কেবল পাপকেই প্রশ্রয় দিতেছি। পাপের কুহকিনী মায়ায় ভুলিয়া তাহাকেই সুখ-জনক জ্ঞান করেতেছি, এবং নিত্য নিত্য সেই পাপের অতলস্পর্শ সমুদ্রের ভিতর অরক্ষিত ভাবে ক্রমে ক্রমে প্রবিষ্ট হইতেছি।

 “আমি যদিও বিধবা; কিন্তু পূর্ব্বে স্বামীসহবাস আমার অদৃষ্টে ঘটে নাই। যদিও আমি ধর্ম্মের মস্তকে পদাঘাত করিয়াছিলাম, কিন্তু এ পর্য্যন্ত আমাকে কেহ দ্বিচারিণী বলিতে পারিত না। যদিও আমি অন্য পুরুষের সহিত আমোদ আহ্লাদ করতাম, যদিও তাহাদিগের সহিত কখন সর্ব্বসমক্ষে,কখন বা নির্জ্জনে বসিয়া একত্র সুরাপান ও আমোদ-আহ্লাদ করিতে কোনরূপে কুণ্ঠিত হইতাম না, তথাপি সেই একজন ভিন্ন অন্য কাহাকেও এ পর্য্যন্ত কোন ভাবে আমার হৃদয়ে স্থান প্রদান করি নাই; কিন্তু এখন আমার মহাপাপের পরিণাম স্মরণ করিয়া হৃদয়ে ভয়ানক আতঙ্ক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে! আর পাপমুখে এখন আমার বলিতেও লজ্জা হইতেছে যে, ‘তাঁহার’ মৃত্যুর পর, আর আমার কিছুই বাকী রহিল ন! ক্রমে ক্রমে আমি ‘দ্বিচারিণী, ত্রিচারিণী ও বহুচারিণী হইয়া পড়িলাম।

 “উঃ! প্রথম অবস্থায় বুঝতে না পারিয়া, আমি কি ভয়ানক কার্য্যই করিয়াছিলাম! হে জগদীশ্বর! এই বিধবা হিন্দু-রমণীর সেই মহাপাপের ভয়ানক যন্ত্রণা হইতে কি কখনও পরিত্রাণ নাই? হে জগৎপিতা! অমি শুনিয়াছি যে, অপনার নিকট সকলেরই ক্ষমা আছে, সকল পাপীকেই আপনি পাপানুযায়ী ক্ষমাও করিয়া থাকেন; কিন্তু জগদীশ! আমি নিজেই বুঝিতে পারিতেছি, আমার দ্বারা যে সকল মহাপাপের অবতারণা হইয়াছে, সেই সকল পাপের কোন প্রকার ক্ষমা নাই; আমার ন্যায় মহাপাপিনী যদি ক্ষমাযোগ্য হইবে, তাহা হইলে এই জগতে প্রকৃত মহাপাপীর দণ্ড আর কে সহ্য করিবে? সর্ব্বনিয়ন্তা! আপনি যদি আমাকে উপযুক্ত দণ্ড প্রদান না করিবেন, ভয়ানক নরক যন্ত্রণায় যদি আমাকে দগ্ধীভূত না করিবেন, তবে আর কাহার নিমিত্ত সেই সকল দণ্ডের সৃষ্টি? আমা অপেক্ষা অধিকতর পাপী এ জগতে আর কে হইতে পারে?”