পুনশ্চ/খোয়াই

উইকিসংকলন থেকে

খোয়াই

পশ্চিমে বাগান বন চষা ক্ষেত
মিলে গেছে দুর বনান্তে বেগুনি বাষ্পরেখায়;
মাঝে আম জাম তাল তেঁতুলে ঢাকা
সাঁওতাল পাড়া;
পাশ দিয়ে ছায়াহীন দীর্ঘপথ গেছে বেঁকে
রাঙা পাড় যেন সবুজ শাড়ির প্রান্তে কুটিল রেখায়।
হঠাৎ উঠেচে এক একটা যুথভ্রষ্ট তাল গাছ,
দিশাহারা অনির্দ্দিষ্টকে যেন দিক-দেখাবার ব্যাকুলতা।
পৃথিবীর একটানা সবুজ উত্তরীয়,
তারি একধারে ছেদ পড়েচে উত্তরদিকে,
মাটি গেছে ক্ষয়ে,
দেখা দিয়েচে
উর্ম্মিল লাল কাঁকরের নিস্তব্ধ তোলপাড়;

মাঝে মাঝে মরূচে-ধরা কালো মাটি
মহিষাসুরের মুণ্ডের মতো।
পৃথিবী আপনার একটি কোণের প্রাঙ্গণে
বর্ষাধারার আঘাতে রচনা করেচে
ছোট ছোট অখ্যাত খেলার পাহাড়,
বয়ে চলেচে তার তলায় তলায় নামহীন খেলার নদী।
শরৎকালে পশ্চিম আকাশে
সূর্যাস্তের ক্ষণিক সমারোহে
রঙের সঙ্গে রঙের ঠেলাঠেলি,—
তখন পৃথিবীর এই ধূসর ছেলেমানুষীর উপরে
দেখেচি সেই মহিমা
যা একদিন পড়েচে আমার চোখে
দুর্লভ দিনাবসানে
রোহিত সমুদ্রের তীরে তীরে
জনশূন্য তরুহীন পর্ব্বতের রক্তবর্ণ শিখর শ্রেণীতে,
রুণ্ঠরুদ্রের প্রলয় ভ্রূকুঞ্চনের মতো।
এই পথে ধেয়ে এসেচে কালবৈশাখীর ঝড়,
গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে,
ঘোড়সওয়ার বর্গি সৈন্যের মতো,
কাঁপিয়ে দিয়েচে শাল সেগুনকে,
নুইয়ে দিয়েচে ঝাউয়ের মাথা,
হায় হায় রব তুলেচে বাঁশের বনে,
কলাবাগানে করেচে দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য,
ক্রন্দিত আকাশের নীচে ঐ ধূসর বন্ধুর
কাঁকরের স্তূপগুলো দেখে মনে হয়েচে
লাল সমুদ্রে তুফান উঠল,
ছিটকে পড়চে তার শীকরবিন্দু।

এসেছিনু বালককালে।
ওখানে গুহাগহ্বরে,
ঝির ঝির ঝরুনার ধারায়,
রচনা করেচি মন-গড়া রহস্য কথা,
খেলেচি মুড়ি সাজিয়ে
নির্জ্জন দুপুরবেলায় আপনমনে একলা।


তারপরে অনেক দিন হোলো,
পাথরের উপর নির্ঝরের মতো
আমার উপর দিয়ে
বয়ে গেল অনেক বৎসর।
রচনা করতে বসেচি একটা কাজের রূপ
ঐ আকাশের তলায় ভাঙামাটির ধারে,
ছেলেবেলায় যেমন রচনা করেচি
নুড়ির দুর্গ।
এই শালবন, এই একলা-স্বভাবের তালগাছ,
ঐ সবুজ মাঠের সঙ্গে রাঙামাটির মিতালি,
এর পানে অনেকদিন যাদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়েচি,
যারা মন মিলিয়েছিল
এখানকার বাদলদিনে আর আমার বাদলগানে,
তারা কেউ আছে কেউ গেল চলে।
আমারও যখন শেষ হবে দিনের কাজ,
নিশীথ রাত্রের তারা ডাক দেবে
আকাশের ওপার থেকে—

তার পরে?
তারপরে রইবে উত্তরদিকে
ঐ বুক-ফাটা ধরণীর রক্তিমা,
দক্ষিণ দিকে চাষের ক্ষেত,
পূবদিকের মাঠে চরবে গোরু।
রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে
গ্রামের লোক যাবে হাট করতে।
পশ্চিমের আকাশপ্রান্তে
আঁকা থাকবে একটি নীলাঞ্জন রেখা॥

৩০ শ্রাবণ, ১৩৩৯