পূরবী/পথিক/আহ্বান

উইকিসংকলন থেকে

আহ্বান

আমারে যে ডাক দেবে, এ জীবনে তা’রে বারম্বার
ফিরেছি ডাকিয়া।
সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার
থাকিয়া থাকিয়া।
দীপখানি তুলে ধ’রে, মুখে চেয়ে, ক্ষণকাল থামি’
চিনেছে আমারে।
তা’রি সেই চাওয়া, সেই চেনার আলোক দিয়ে আমি
চিনি আপনারে॥

সহস্রের বন্যাস্রোতে জন্ম হ’তে মৃত্যুর আঁধারে
চ’লে যাই ভেসে।
নিজেরে হারায়ে ফেলি অস্পষ্টর প্রচ্ছন্ন পাথারে
কোন নিরুদ্দেশে।

নামহীন দীপ্তিহীন তৃপ্তিহীন আত্ম-বিস্মৃতির
তমসার মাঝে
কোথা হ’তে অকস্মাৎ করো মোরে খুঁজিয়া বাহির
তাহা বুঝি না যে।
তব কণ্ঠে মোর নাম যেই শুনি, গান গেয়ে উঠি—
“আছি, আমি আছি।”
সেই আপনার গানে লুপ্তির কুয়াশা ফেলে টুটি’,
বাঁচি, আমি বাঁচি।
তুমি মোরে চাও যবে, অব্যক্তের অখ্যাত আবাসে
আলো উঠে জ্ব’লে,
অসাড়ের সাড়া জাগে, নিশ্চল তুষার গ’লে আসে
নৃত্য-কলরোলে॥

নিঃশব্দ চরণে ঊষা নিখিলের সুপ্তির দুয়ারে
দাঁড়ায় একাকী,
রক্ত-অবগুণ্ঠনের অন্তরালে নাম ধরি’ কারে
চ’লে যায় ডাকি’।
অমনি প্রভাত তা’র বীণা হাতে বাহিরিয়া আসে,
শূন্য ভরে গানে,
ঐশ্বর্য্য ছড়ায়ে দেয় মুক্ত হস্তে আকাশে আকাশে,
ক্লান্তি নাহি জানে॥

কোন্ জ্যোতির্ম্ময়ী হোথা অমরাবতীর বাতায়নে
রচিতেছে গান
আলোকের বর্ণে বর্ণে; নির্ণিমেষ উদ্দীপ্ত নয়নে
করিছে আহ্বান।
তাই তো চাঞ্চল্য জাগে মাটির গভীর অন্ধকারে;
রোমাঞ্চিত তৃণে
ধরণী ক্রন্দিয়া উঠে, প্রাণস্পন্দ ছুটে চারিধারে
বিপিনে বিপিনে॥

তাই তো গোপন ধন খুঁজে পায় অকিঞ্চন ধূলি
নিরুদ্ধ ভাণ্ডারে।
বর্ণে গন্ধে রূপে রসে আপনার দৈন্য যায় ভুলি’
পত্রপুষ্প-ভারে।
দেবতার প্রার্থনায় কার্পণ্যের বন্ধ মুষ্টি খুলে,
রিক্ততারে টুটি’
রহস্য-সমুদ্র-তল উন্মথিয়া উঠে উপকূলে
রত্ন মুঠি মুঠি॥

তুমি সে আকাশ-ভ্রষ্ট প্রবাসী আলোক, হে কল্যাণী,
দেবতার দূতী।
মর্ত্ত্যের গৃহের প্রান্তে বহিয়া এনেছে তব বাণী
স্বর্গের আকূতি।

ভঙ্গুর মাটির ভাণ্ডে গুপ্ত আছে যে অমৃত-বারি
মৃত্যুর আড়ালে
দেবতার হ’য়ে হেথা তাহারি সন্ধানে তুমি, নারী,
দু’বাহু বাড়ালে॥

তাই তো কবির চিত্তে কল্পলোকে টুটিল’ অর্গল
বেদনার বেগে;
মানস-তরঙ্গ-তলে বাণীর সঙ্গীত-শতদল
নেচে ওঠে জেগে।
সুপ্তির তিমির বক্ষ দীর্ণ করে তেজস্বী তাপস
দীপ্তির কৃপাণে;
বীরের দক্ষিণ হস্ত মুক্তিমন্ত্রে বজ্র করে বশ,
অসত্যেরে হানে॥

হে অভিসারিকা, তব বহুদূর পদধ্বনি লাগি’,
আপনার মনে,
বাণীহীন প্রতীক্ষায় আমি আজ একা ব’সে জাগি,
নির্জ্জন প্রাঙ্গণে।
দীপ চাহে তব শিখা, মৌনী বীণা ধেয়ায় তোমার
অঙ্গুলি-পরশ।
তারায় তারায় খোঁজে তৃষ্ণায় আতুর অন্ধকার
সঙ্গ-সুধারস॥

নিদ্রাহীন বেদনায় ভাবি, কবে আসিবে পরাণে
চরম আহ্বান?
মনে জানি, এ জীবনে সাঙ্গ হয় নাই পূর্ণ তানে
মোর শেষ গান।
কোথা তুমি, শেষবার যে ছোঁয়াবে তব স্পর্শমণি
আমার সঙ্গীতে?
মহা-নিস্তব্ধের প্রান্তে কোথা ব’সে রয়েছে, রমণী,
নীরব নিশীথে?

মহেন্দ্রের বজ্র হ’তে কালো চক্ষে বিদ্যুতের আলো
আনো, আনো ডাকি’,
বর্ষণ-কাঙাল মোর মেঘের অন্তরে বহ্নি জ্বালো,
হে কাল-বৈশাখী।
অভারে ক্লান্ত তা’র স্তব্ধ মূক অবরুদ্ধ দান
কালো হ’য়ে উঠে।
বন্যাবেগে মুক্ত করো, রিক্ত করি’ করো পরিত্রাণ,
সব লও লুটে॥

তা’র পরে যাও যদি যেয়ো চলি’; দিগন্ত-অঙ্গন
হ’য়ে যাবে স্থির।
বিরহের শুভ্রতায় শূন্যে দেখা দিবে চিরন্তন
শান্তি সুগম্ভীর।

স্বচ্ছ আনন্দের মাঝে মিলে যাবে সর্ব্বশেষ লাভ,
সর্ব্বশেষ ক্ষতি;
দুঃখে সুখে পূর্ণ হবে অরূপ-সুন্দর আবির্ভাব,
অশ্রুধৌত জ্যোতি॥

ওরে পান্থ, কোথা তোর দিনান্তের যাত্রা-সহচরী?
দক্ষিণ পবন
বহুক্ষণ চ’লে গেছে অরণ্যের পল্লব মর্ম্মরি;
নিকুঞ্জ-ভবন
গন্ধের ইঙ্গিত দিয়ে বসন্তের উৎসবের পথ
করে না প্রচার।
কাহারে ডাকিস তুই, গেছে চ’লে তা’র স্বর্ণরথ
কোন সিন্ধুপার॥

জানি জানি আপনার অন্তরের গহন-বাসীরে
আজিও না চিনি।
সন্ধ্যারতি লগ্নে কেন আসিলে না নিভৃত মন্দিরে
শেষ পূজারিণী?
কেন সাজালে না দীপ, তোমার পূজার মন্ত্র গানে
জাগায়ে দিলে না
তিমির রাত্রির বাণী, গোপনে যা লীন আছে প্রাণে
দিনের অচেনা॥

অসমাপ্ত পরিচয়, অসম্পূর্ণ নৈবেদ্যের থালি
নিতে হ’লো তুলে।
রচিয়া রাখেনি মোর প্রেয়সী কি বরণের ডালি
মরণের কূলে?
সেখানে কি পুষ্পবনে গীতহীনা রজনীর তারা
নব জন্ম লভি’
এই নীরবের বক্ষে নব ছন্দে ছুটাবে ফোয়ারা
প্রভাতী ভৈরবী॥


হারুনা-মারু জাহাজ, ১ অক্টোবর, ১৯৪২