পূরবী/পথিক/সাবিত্রী

উইকিসংকলন থেকে

সাবিত্রী

ঘন অশ্রুবাষ্প ভরা মেঘের দুর্য্যোগে খড়্গ হানি’
ফেলো, ফেলো টুটি’।
হে সূর্য্য, হে মোর বন্ধু, জ্যোতির কনক পদ্মখানি
দেখা দিক ফুটি’।
বহ্নি-বীণা বক্ষে ল’য়ে, দীপ্ত কেশে, উদ্বোধিনী বাণী
সে পদ্মের কেন্দ্রমাঝে নিত্য রাজে, জানি তা’রে জানি
মোর জন্ম-কালে
প্রথম প্রত্যুষে মম তাহারি চুম্বন দিলে আনি’
আমার কপালে।

সে চুম্বনে উচ্ছলিল জ্বালার তরঙ্গ মোর প্রাণে,
অগ্নির প্রবাহ।
উচ্ছসি উঠিল মন্দ্রি’ বারম্বার মোর গানে গানে
শান্তিহীন দাহ।
ছন্দের বন্যায় মোর রক্ত নাচে সে চুম্বন লেগে,
উন্মাদ সঙ্গীত কোথা ভেসে যায় উদ্দাম আবেগে,
আপনা-বিস্মৃত।
সে চুম্বন-মন্ত্রে বক্ষে অজানা ক্রন্দন উঠে জেগে
ব্যথায় বিস্মিত॥

তোমার হোমাগ্নি মাঝে আমার সত্যের আছে ছবি,
তা’রে নমো নমঃ।
তমিস্র সুপ্তির কূলে যে বংশী বাজাও, আদি কবি,
ধ্বংস করি’ তমঃ,
সে বংশী আমারি চিত্ত, রন্ধ্রে তা’রি উঠিছে গুঞ্জরি’
মেঘে মেঘে বর্ণচ্ছটা, কুঞ্জে কুঞ্জে মাধবী মঞ্জরী,
নির্ঝরে কল্লোল।
তাহারি ছন্দের ভঙ্গে সর্ব্ব অঙ্গে উঠিছে সঞ্চরি’
জীবন হিল্লোল॥


এ প্রাণ তোমারি এক ছিন্ন তান, সুরের তরণী;
আয়ুস্রোত-মুখে
হাসিয়া ভাসায়ে দিলে লীলাচ্ছলে—কৌতুকে ধরণী
বেঁধে নিলো বুকে।
আশ্বিনের রৌদ্রে সেই বন্দী প্রাণ হয় বিস্ফুরিত
উৎকণ্ঠার বেগে, যেন শেফালির শিশির-চ্ছুরিত
উৎসুক আলোক।
তরঙ্গ - হিল্লোলে নাচে রশ্মি তব, বিস্ময়ে পূরিত
করে মুগ্ধ চোখ॥

তেজের ভাণ্ডার হ’তে কি আমাতে দিয়েছে যে ভ’রে
কেই-বা সে জানে?
কি জাল হ’তেছে বোনা স্বপ্নে স্বপ্নে নানা বর্ণডোরে
মোর গুপ্ত-প্রাণে?
তোমার দূতীরা আঁকে ভুবন-অঙ্গনে আলিম্পনা;
মুহূর্তে সে ইন্দ্রজাল অপরূপ রূপের কল্পনা
মুছে যায় স’রে।
তেমনি সহজ হোক হাসি কান্না ভাবনা বেদনা,
না বাঁধুক মোরে॥


তারা সবে মিলে থাক অরণ্যের স্পন্দিত পল্লবে,
শ্রাবণ বর্ষণে;
যোগ দিক নির্ঝরের মঞ্জীর - গুঞ্জন - কলরবে
উপল ঘর্ষণে।
ঝঙ্কার মদিরা-মত্ত বৈশাখের তাণ্ডব লীলায়
বৈরাগী বসন্ত যবে আপনার বৈভব বিলায়,
সঙ্গে যেন থাকে।
তার পরে যেন তারা সর্ব্বহারা দিগন্তে মিলায়,
চিহ্ন নাহি রাখে॥

হে রবি, প্রাঙ্গণে তব শরতের সোনার বাঁশিতে
জাগিল মূর্চ্ছনা।
আলোতে শিশিরে বিশ্ব দিকে দিকে অশ্রুতে হাসিতে
চঞ্চল উন্মনা
জানি না কি মত্ততায়, কি আহ্বানে আমার রাগিণী
ধেয়ে যায় অন্যমনে শূন্যপথে হ’য়ে বিবাগিনী,
ল’য়ে তা’র ডালি।
সে কি তব সভাস্থলে স্বপ্নাবেশে চলে একাকিনী
আলোর কাঙালী?

দাও, খুলে দাও দ্বার, ওই তা’র বেলা হ’লো শেষ,
বুকে লও তা’রে।
শান্তি-অভিষেক হোক, ধৌত হোক সকল আবেশ
অগ্নি-উৎস-ধারে।
সীমন্তে, গোধূলি-লগ্নে দিয়ো এঁকে সন্ধ্যার সিন্দুর,
প্রদোষের তারা দিয়ে লিখো রেখা আলোক-বিন্দুর
তা’র স্নিগ্ধ ভালে।
দিনান্ত - সঙ্গীত - ধ্বনি সুগম্ভীর বাজুক সিন্ধুর
তরঙ্গের তালে॥


হারুনা-মারু জাহাজ, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪।