পূরবী/পূরবী/মাটির ডাক

উইকিসংকলন থেকে

মাটির ডাক

শালবনের ঐ আঁচল ব্যেপে
যেদিন হাওয়া উঠতো ক্ষেপে
ফাগুন-বেলার বিপুল ব্যাকুলতায়,
যেদিন দিকে দিগন্তরে
লাগতো পুলক কি মন্তরে
কচি পাতার প্রথম কল-কথায়,
সেদিন মনে হ’তো কেন
ঐ ভাষারি বাণী যেন
লুকিয়ে আছে হৃদয়-কুঞ্জ-ছায়ে;
তাই অমনি নবীন রাগে
কিশলয়ের সাড়া লাগে
শিউরে-ওঠা আমার সারা গায়ে।

আবার যেদিন আশ্বিনেতে
নদীর ধারে ফসল-ক্ষেতে
সূর্য্য-ওঠার রাঙা-রঙীন বেলায়
নীল আকাশের কূলে কূলে
সবুজ সাগর উঠতো দুলে
কচি ধানের খামখেয়ালি খেলায়
সেদিন আমার হ’তো মনে
ঐ সবুজের নিমন্ত্রণে
যেন আমার প্রাণের আছে দাবী;
তাই তো হিয়া ছুটে পালায়
যেতে তা’রি যজ্ঞশালায়,
কোন্ ভুলে হায় হারিয়েছিল চাবি!


কার কথা এই আকাশ বেয়ে
ফেলে আমার হৃদয় ছেয়ে,
বলে দিনে, বলে গভীর রাতে,
“যে জননীর কোলের পরে
জন্মেছিলি মর্ত্তঘরে,
প্রাণ ভরা তোর যাহার বেদনাতে,

তাহার বক্ষ হ’তে তোরে
কে এনেছে হরণ ক’রে,
ঘিরে তোরে রাখে নানান পাকে।
বাঁধন-ছেঁড়া তোর সে নাড়ী
সইবে না এই ছাড়াছাড়ি,
ফিরে ফিরে চাইবে আপন মাকে।”
শুনে আমি ভাবি মনে,
তাই ব্যথা এই অকারণে,
প্রাণের মাঝে তাই তো ঠেকে ফাঁকা,
তাই বাজে কার করুণ সুরে—
“গেছিস দূরে, অনেক দূরে,”
কি যেন তাই চোখের পরে ঢাকা।
তাই এতদিন সকল খানে
কিসের অভাব জাগে প্রাণে
ভালো ক’রে পাইনি তাহা বুঝে;
ফিরেছি তাই নানামতে
নানান হাটে, নানান পথে
হারানো কোল কেবল খুঁজে খুঁজে।

আজকে খবর পেলেম খাঁটি—
মা আমার এই শ্যামল মাটি,
অম্নে ভরা শোভার নিকেতন;
অভ্রভেদী মন্দিরে তা’র
বেদী আছে প্রাণ-দেবতার,
ফুল দিয়ে তা’র নিত্য আরাধন।
এইখানে তা’র অঙ্ক-মাঝে
প্রভাত-রবির শঙ্খ বাজে,
আলোর ধারায় গানের ধারা মেশে,
এইখানে সে পূজার কালে
সন্ধ্যারতির প্রদীপ জ্বালে
শান্ত মনে ক্লান্ত দিনের শেষে।
হেথা হ’তে গেলেম দূরে
কোথা যে ইঁট-কাঠের পুরে
বেড়া-ঘেরা বিষম নির্ব্বাসনে,
তৃপ্তি যে নাই কেবল নেশা,
ঠেলাঠেলি, নাই তো মেশা,
আবর্জ্জনা জমে উপার্জ্জনে।

যন্ত্র-জাঁতায় পরাণ কাঁদায়,
ফিরি ধনের গোলক-ধাঁধায়,
শূন্যতারে সাজাই নানা সাজে;
পথ বেড়ে যায় ঘুরে ঘুরে,
লক্ষ্য কোথায় পালায় দূরে,
কাজ ফলে না অবকাশের মাঝে।


যাই ফিরে যাই মাটির বুকে,
যাই চ’লে যাই মুক্তি-সুখে,
ইঁটের শিকল দিই ফেলে দিই টুটে,
আজ ধরণী আপন হাতে
অন্ন দিলেন আমার পাতে,
ফল দিয়েছেন সাজিয়ে পত্রপুটে।
আজকে মাঠের ঘাসে ঘাসে
নিঃশ্বাসে মোর খবর আসে
কোথায় আছে বিশ্বজনের প্রাণ,
ছয় ঋতু ধায় আকাশতলায়,
তা’র সাথে আর আমার চলায়
আজ হ’তে না রইলো ব্যবধান।

যে দূতগুলি গগন-পারের,
আমার ঘরের রুদ্ধ দ্বারের
বাইরে দিয়েই ফিরে ফিরে যায়,
আজ হয়েছে খোলাখুলি
তাদের সাথে কোলাকুলি,
মাঠের ধারে পথতরুর ছায়।
কি ভুল ভুলেছিলেম, আহা,
সব চেয়ে যা নিকট, তাহা
সুদূর হ’য়ে ছিল এতদিন,
কাছেকে আজ পেলেম কাছে—
চারদিকে এই যে-ঘর আছে
তা’র দিকে আজ ফির্‌লো উদাসীন॥


(২৩ ফাল্গুন, ১৩২৮)