পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ

উইকিসংকলন থেকে
পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ
পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ
রা ম কৃ ষ্ণ মি শ ন
বেলুড় মঠ, হাওড়া

পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ
রা ম কৃ ষ্ণ মি শ ন
বেলুড় মঠ, হাওড়া

স্বামী পবিত্রানন্দ
অধ্যক্ষ, অদ্বৈত আশ্রম কর্তৃক
৪, ওয়েলিংটন লেন, কলিকাতা
হইতে প্রকাশিত।

অগ্রহায়ণ―১৩৫৩

মুদ্রাকর—শ্রীনগেন্দ্রনাথ হাজরা
বােস প্রেস।
৩০, ব্রজনাথ মিত্র লেন,
কলিকাতা।

পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ

 “হে ভারত, ভুলিও না—তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না—তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের —নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে; ভুলিও না— তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত; ভুলিও না—তোমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়া মাত্র; ভুলিও না-নীচ জাতি, মূর্থ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার ভাই। হে বীর, সাহস অবলম্বন কর। সদর্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই; বল—মূর্থ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া সদর্পে ডাকিয়া বল— ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই—ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ; আর বল দিন রাত—হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা, কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।”  “পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ “তিনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) যে দিন থেকে জন্মেছেন, সে দিন থেকে সত্যযুগ এসেছে। এখন সব ভেদাভেদ উঠে গেল, আচণ্ডাল প্রেম পাবে। মেয়ে-পুরুষ ভেদ, ধনী-নিধনের ভেদ, পণ্ডিত-মূর্খ ভেদ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন। আর তিনি বিপদভঞ্জন—হিন্দু-মুসলমান ভেদ, ক্রিশ্চান-হিন্দু ইত্যাদি সব চলে গেল।”

 “প্রেমে বাঙ্গাল বাঙ্গালী, আর্ষ ম্লেচ্ছ, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল, এমন কি নর নারী পর্যন্ত ভেদ নাই।”

 “যে ধর্ম গরীবের দুঃখ দূর করে না, মানুষকে দেবতা করে না, তা কি আবার ধর্ম? আমাদের কি আর ধর্ম? আমাদের ‘ছুৎমার্গ’, খালি ‘আমায় ছুয়াে না’, ‘আমায় ছুয়ে না’।... আমাদের জাতটা নিজেদের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে, সেইজন্য ভারতের এত দুঃখ কষ্ট। সেই জাতীয় বিশেষত্বের বিকাশ যাতে হয়, তাই করতে হবে—নীচ জাতকে তুলতে হবে...খাটি হিন্দুদেরই এ কাজ করতে হবে।”

 “ধর্ম কি আর ভারতে আছে দাদা! জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ, যােগমার্গ সব পলায়ন! এখন আছেন কেবল ছুৎমার্গ, ‘আমায় চুয়াে না’, ‘আমায় চুয়াে না। দুনিয়া অপবিত্র আমি পবিত্র! সহজ ব্রহ্মজ্ঞান! ভালা মাের বাপ!! হে ভগবান!! এখন ব্রহ্ম হৃদয়করেও নাই, গােলকেও নাই, সর্বভূতেও নাই, এখন ভাতের হাঁড়িতে!”

 “যারা অপরের নিঃশ্বাসে অপবিত্র হয়ে যায়, তারা আবার অপরকে কি পবিত্র করবে? ছুৎমার্গ এক প্রকার মানসিক ব্যাধি, সাবধান! সব প্রকার বিস্তারই জীবন, সব প্রকার সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু।”

 “জাতির আদিম অর্থ ছিল—এবং সহস্র বর্ষ ধরিয়া এই অর্থ প্রচলিত ছিল—প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ প্রকৃতি, নিজ বিশেষত্ব প্রকাশ করিবার স্বাধীনতা। এমন কি, খুব আধুনিক শাস্ত্র গ্রন্থসমূহেও বিভিন্ন জাতির একত্র ভােজন নিষিদ্ধ হয় নাই; আর প্রাচীনতর গ্রন্থসমূহের কোথাও বিভিন্ন জাতিতে বিবাহ নিষিদ্ধ হয় নাই। ভারতের পতন হইল কখন? যখন এই জাতি বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল।•••আধুনিক জাতিভেদ প্রকৃত জাতিভেদ নহে, উহা প্রকৃত জাতির উন্নতির প্রতিবন্ধক স্বরূপ।”

 “আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরূপ এই দুই মহান, মতের সমন্বয়ই–বৈদান্তিক মস্তিষ্ক এবং ইসলামীয় দেহ—একমাত্র আশা।••••••আমার মাতৃভূমি যেন ইসলামীয় দেহ এবং বৈদান্তিক হৃদয়রূপ এই দ্বিবিধ আদর্শের বিকাশ করিয়া কল্যাণের পথে অগ্রসর হয়েন।”  “রামানুজ যেমন সকলের প্রতি সমভাব দেখাইয়া ও মুক্তিতে সকলেরই অধিকার আছে বলিয়া সর্বসাধারণে ধর্মপ্রচার করিয়া ছিলেন, সেইরূপ••••••প্রচার করিতে হইবে।”

 “ভূত ভারতশরীরের রক্তমাংসহীন কঙ্কালকুল, তােমরা কেন শীঘ্র শীঘ্র ধূলিতে পরিণত হয়ে বায়ুতে মিশে যাচ্ছ না?... এখন অবাধ বিদ্যাচর্চার দিনে উত্তরাধিকারীদের দাও, যত শীঘ্র পার দাও। তােমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নৃতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটীর ভেদ করে, জেলে, মালা, মুচি, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝােড়, জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত থেকে। এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে, নীরবে সয়েছে—তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভােগ করেছে—তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুটো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারবে; আধ খান। রুটী পেলে ত্রৈলােক্যে এদের তেজ ধরবে না; এর রক্তবীজের প্রাণসম্পন্ন। আর পেয়েছে অদ্ভুত সদাচারবল, যা ত্রৈলােক্যে নাই। এত শান্তি, এত প্রীতি, এত ভালবাসা এত মুখটি চুপ করে দিন রাত খাটা এবং কার্যকালে সিংহবিক্রম।•••এই সামনে তােমার উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ ভারত। •••তােমার যাই বিলীন হওয়া অমনি শুবে কোটিজীমূতস্যন্দী ত্রৈলােক্যকম্পনকারী ভবিষ্যৎ ভারতের উদ্বোধন' ধ্বনি, ‘ওয়াহ গুরু কি ফতে।”

রামকৃষ্ণ মিশনের নিবেদন

 নােয়াখালী জেলায় ও ত্রিপুরা জেলার কতকাংশে ব্যাপকভাবে স্পষ্টতঃ সম্প্রদায়-বিশেষভুক্ত দলবদ্ধ সশস্ত্র গুণ্ডাগণ কর্তৃক অনুষ্ঠিত নানাবিধ দানবীয় অত্যাচারের হৃদয়বিদারক দুঃখকাহিনী সংবাদপত্রে পাঠ করিয়া আমরা অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি। বিংশ শতাব্দীতে কোন সুপ্রতিষ্ঠিত সভ্য শাসনতন্ত্রের আমলে দীর্ঘদিন ধরিয়া এরূপ ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ, নারীহরণ এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ ও বিবাহ অবাধে চলিতে পারে, ইহা একেবারে কল্পনাতীত।

 নির্যাতিতগণকে আমরা বর্তমান অবস্থায় যতটা সম্ভব সাহায্য প্রেরণ করিতেছি। আমরা আশা করি যে তাহার যথাশক্তি নিজেদের ঘর-বাড়ী, বিশেষতঃ কুলনারীগণের মর্যাদা রক্ষা করিতে চেষ্টা করিবেন। ইহাই তাঁহাদের শাস্ত্রের আদেশ। সাধারণ লােকের কর্তব্য মহাপুরুষের কর্তব্য হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। নিশ্চেষ্টতাকে যেন সমদর্শিতা বলিয়া ভুল বুঝা না হয়। প্রাচীন ভারতের মহামহিম স্মৃতিকার মনু আত্মরক্ষার জন্য আততায়ীকে বধ পর্যন্ত করিবার বিধান দিয়াছেন। আর শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ মহানির্বাণতন্ত্রের “গৃহী ব্যক্তি শত্রুর সম্মুখে শূরভাব অবলম্বন করিবেন”—এই উক্তিটি উদ্ধত করিয়া উহার ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে বলিয়াছেন, “শত্রুগণকে বীর্য প্রকাশ করিয়া শাসন করিতে হইবে। ইহা গৃহস্থের কর্তব্য। গৃহস্থের পক্ষে ঘরের এক কোণে বসিয়া কাঁদিলে আর ‘অহিংসা পরমাে ধর্মঃ বলিয়া বাজে বকিলে চলিবে না। যদি তিনি শত্রুগণের নিকট শৌর্য প্রদর্শন না করেন, তাহা হইলে তাহার কর্তব্যের অবহেলা করা হয়।” (‘কর্মযােগ’, ২য় অধ্যায়)

 তাঁহাদের ইহাও জানা উচিত যে কেহ নিপীড়িত হইয়া ধর্মান্তর। গ্রহণ করিতে বাধ্য হইলে তাহার স্বধমে ফিরিয়া আসার পক্ষে কোন বাধা থাকিতে পারে না। ধর্ম মানুষের আন্তরিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। উহা বাহিরের জবরদস্তি দ্বারা কেহ নাশ করিতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দের নগণ্য অনুগামী হিসাবে আমাদের দৃঢ় ধারণা যে হিন্দুসমাজ ধর্মের নামে ছুৎমার্গ, স্বধর্মে। প্রত্যাবর্তন নিরােধ ও আরও নানাবিধ বাধারূপ কূপমণ্ডুকত্বের। শেষ চিহ্নগুলি মুছিয়া ফেলিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। ঐগুলি এখন শুধু নিরর্থক নহে, বরং যে সমাজ একদিন এত বলশালী ছিল যে গ্রীক, শক, হূণ প্রভৃতি বিজাতীয়গণকে নিজ অঙ্গে মিলাইয়া লইতে পারিয়াছিল, তাহার জীবনীশক্তি ক্ষয় করিতেছে। বলা বাহুল্য, বলপূর্বক অপহৃতা নারীগণকে সসম্মানে সমাজে ফিরাইয়া আনিতে হইবে। তাহা না হইলে যে উৎপীড়িত তাহাকেই শাস্তি দেওয়া হইবে। ইহা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সমাজ যেন নিজ অক্ষমতার দোষ নিরীহ উৎপীড়িতগণের স্কন্ধে না চাপান।

 আমরা নিপীড়িতগণকে জোরের সহিত বলিতেছি, স্বার্থান্ধ বাক্তিগণ আপাততঃ যতই শক্তিশালী বলিয়া প্রতীয়মান হউক না কেন, বিগত মহাযুদ্ধে ইহাই প্রতিপন্ন হইয়াছে যে মানবজাতির কল্যাণ ভগবানেরই হস্তে, স্বার্থান্ধ ব্যক্তিগণের হস্তে নহে। জীবনের ইহা এক অমােঘ আধ্যাত্মিক নিয়ম যে পাপ প্রথমাবস্থায় যতই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, পরিণামে তাহাকে নির্মূল হইতেই হইবে। শ্রীভগবান নিপীড়িতগণকে সাহস ও বল এবং অত্যাচারিগণকে বিচারবুদ্ধি ও মৈত্রীভাব প্রদান করুন।

স্বামী মাধবানন্দ

সাধারণ সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন।

সমাজব্যবস্থাপক পণ্ডিতসমাজের নির্দেশ (১)

 হিন্দুসমাজে চতুর্বর্ণ ও তদন্তৰ্গত শ্রেণীর অস্তিত্ব সত্ত্বেও হিন্দুসমাজ এক ও অবিভাজ্য। কিন্তু বিভিন্ন বর্ণের সামাজিক অধিকারের প্রশ্ন তুলিয়া বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি দ্বারা হিন্দুসমাজের সঘশক্তিকে দুর্বল করিবার উদ্দেশ্যে নানাদিক হইতে নানাবিধ প্রচেষ্টা চলিতেছে। এই পরিস্থিতিতে হিন্দুসাধারণের সামাজিক অধিকার সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ঘােষণার আবশ্যকতা উপলব্ধি করিয়া নিম্নলিখিত সমাজব্যবস্থাপক পণ্ডিত মহােদয়গণ নিম্নলিখিত মর্মে নির্দেশ দিতেছেন –

 ১। হিন্দু জাতির বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীসমূহের মধ্যে সামাজিক অধিকার-বৈষম্য থাকিবে না।

 ২। হিন্দুর মন্দিরে ও দেবদেবীর পূজামণ্ডপে হিন্দুমাত্রেরই প্রবেশাধিকার থাকিবে। কাহারও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক মন্দিরে বা মণ্ডপে অপরের প্রবেশ মালিকের অনুমতি-সাপেক্ষ হইবে।

 ৩। হিন্দুসমাজের ক্ষৌরকার, রজক প্রভৃতি হিন্দুমাত্রেরই কার্য করিবে, এ বিষয়ে কোন প্রতিবন্ধক থাকিবে না।

 ৪। ব্রাহ্মণ হিন্দুমাত্রেরই পূজাচনাদি ধর্মকার্যে পৌরােহিত্য করিতে পারিবেন। তজ্জন্য সামাজিক অবনতি ঘটিবে না। এতদ্বারা কেহ যেন অপরের বৃত্তিচ্ছেদ করিতে উৎসাহিত না হন।

ভট্টপল্লী সমাজ— শ্রীনারায়ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ, শ্রীশ্রীজীব ন্যায়তীর্থ,শ্রীমন্মথনাথ তর্কতীর্থ।

বাকুলা সমাজ—শ্রীসূর্যকান্ত স্মৃতিব্যাকরণতীর্থ, শ্রীরামপ্রসাদ কাব্যতীর্থ।

নবদ্বীপ সমাজ—মহামহােপাধ্যায় শ্রীচণ্ডীদাস ন্যায়তর্কতীর্থ, সভাপতি, ব্রাহ্মণ মহাসভা; শ্রত্রিপথনাথ স্মৃতিতীর্থ, শ্রীরামকণ্ঠ তর্কতীর্থ, শ্রীপূর্ণচন্দ্র কাব্যতীর্থ, শ্রীরামপ্রসাদ কাব্য-ব্যাকরণতীর্থ, গােবিন্দচন্দ্র স্মৃতিরত্ন কাব্যতীর্থ।

কোটালিপাড়া সমাজ—মহামহােপাধ্যায় মহাকবি ভারতচার্য শ্রীহরিদাস সিন্ধান্তবাগীশ, মহামহােপাধ্যায় শ্রীকালীপদ তর্কাচার্য, শ্রীসুরেন্দ্রমােহন বেদান্ত তীর্থ, অমরেন্দ্রমােহন কাব্য-ব্যাকরণতীর্থ।

বিক্রমপুর সমাজ—শ্রীমনােমােহন স্মৃতিরত্ন, শীতারাপদ তর্কতীর্থ।

কলিকাতা—মহামহােপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী, বিজনকুমার মুখােপাধ্যায়, বিচারপতি, কলিকাতা হাইকোর্ট ও সভাপতি সংস্কৃত এসােসিয়েশন; শ্রীঅনন্তপ্রসাদ শাস্ত্রী, অধ্যক্ষ, রাজকীয় সংস্কৃত কলেজ;শ্রীবনমালী চক্রবর্তী, বেদান্ততীর্থ।
সমাজব্যবস্থাপক পণ্ডিতগণের নির্দেশ (২)

 বলপূর্বক ধর্মান্তরিত হিন্দুর হিন্দুত্ব যে অক্ষুন্ন থাকিবে তাহা নির্দেশ করিয়া শাস্ত্র-ব্যবস্থাপক ও সমাজ-ব্যবস্থাপক পণ্ডিতগণ নিম্নলিখিত ব্যবস্থা দিয়াছেন –

 “সম্প্রত্যত্যাচারেণ নিপীড়িতানাং বলাদ্ধমান্তরং গ্রাহিতানাং জনানাং ধর্ষিতানাং চ নারীণাং হিন্দুত্ব অক্ষুন্নমেব। বলা বিবাহােহপি অবিবাহ এব শাস্ত্রদৃষ্টা। তেষাং সর্ব্বেষাং স্বসমাজে যথাপূর্ব্বং সাদর অবস্থানং নিৰ্বিবাদম ইতি সর্ব্বে ধর্মাচার্যা বিদ্বাংসে ব্রাহ্মাণাশ্চ ঐকমত্যেন ঘােষিতবন্ত ইতি।”

 বর্তমান অত্যাচার-নিপীড়িত ও বলপূর্বক ধর্মান্তরিত জনসমূহের ও ধর্ষিতা নারীগণের হিন্দুত্ব অক্ষুন্ন আছে। বলপূর্বক বিবাহ হইয়া থাকিলেও তাহা শাস্ত্রদৃষ্টিতে বিবাহই নহে। তাহাদের সকলেই স্বসমাজে পূর্ববৎ স্বচ্ছন্দে অবস্থান করিতে পারিবেন, এ বিষয়ে কাহারও কোনও মতভেদ নাই—ইছ সকল ধর্মাচার্য, বিদ্বদ্বর্গ ও ব্রাহ্মণমণ্ডলী একবাক্যে উদেঘাষিত করিয়াছেন। ইতি

 মহামহােপাধ্যায় শ্রীদুর্গাচরণ সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, যােগেন্দ্রনাথ তর্ক-বেদান্ততীর্থ, বিধুশেখর শাস্ত্রী, শ্রীহরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, শ্রীকালীপদ তর্কাচার্য, পণ্ডিত শ্রচণ্ডীচরণ তর্কতীর্থ, শ্রীশরচ্চন্দ্র সাংখ্যবেদান্ততীর্থ, উপেন্দ্রচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ, ডক্টর শ্রীশ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়।

স্বামী যােগেশ্বর আনন্দ তীর্থের ঘােষণা

পুরীর গােবর্ধন মঠের জগৎগুরু স্বামী যােগেশ্বর আনন্দ তীর্থ। বলেন আমরা দৃঢ়তার সহিত ঘােষণা করিতেছি যে, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণকে স্মৃতির বিধান অনুসারে কোন অবস্থাতেই ধর্মান্তর গ্রহণ বলা চলে না এবং জোরপূর্বক বিবাহ স্থায়ী বিবাহ বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কোন আইন নাই যারা বলপূর্বক বিবাহকে সিদ্ধ বলিয়া গণ্য করা চলিতে পারে। একজন হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করিলেও তিনি হিন্দুই থাকিবেন—বলপূর্বক কেহ তাহাকে ধর্মান্তরিত করিতে পারে না।

শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের বিধান

দাক্ষিণাত্যের কুম্ভকোণমস্থ সুপ্রসিন্ধ কামকাটি পীঠের জগদগুরু শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বিধান দিয়াছেন—

বলপূর্বক যে সকল হিন্দু ধর্মান্তরিত হইয়াছেন, তাহারা স্বধর্মচ্যুত হইয়াছেন বলিয়া বিবেচিত হইবেন না; অথবা যে সকল হিন্দুনারী অপহৃতা বা অপমানিত হইয়াছেন, হিন্দুসমাজ তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারিবেন না। এই সমস্ত ব্যক্তিকে সমাজে ফিরাইয়া আনিয়া আবার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।
মহাত্মা গান্ধীর বাণী

 ইহা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি যে, বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করাকে মােটেই স্বধর্মচ্যুতি বলা যাইতে পারে না; অথবা অপহৃতা নারীদিগকে সমাজে প্রতি গ্রহণ করিতে কোন বাধা থাকিতে পারে না। এইরূপ ক্ষেত্রে কোন শুদ্ধি বা প্রায়শ্চিত্তের প্রয়ােজন নাই।

মালব্যজীর শেষ বাণী

 মালব্যজী দেশবাসীর নিকট তাহার শেষ বাণীতে বলেন—

 আজ মানবতার সর্বনাশ সমুপস্থিত বলিয়া আমার মনে হইতেছে। হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্ম’ আজ বিপদাপন্ন। এখন এমন এক সময় আসিয়াছে, যখন হিন্দুদিগকে আত্মরক্ষার জন্য, নিজেদের দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সাহায্য লইয়া আগাইয়া আসিবার জন্য একতাবদ্ধ হইতে হইবে।...

 হিন্দু নেতৃবৃন্দের যেমন তাহাদের মাতৃভূমির প্রতি কর্তব্য আছে, তেমনি নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমধর্মাবলম্বীদের প্রতিও কর্তব্য আছে। হিন্দুদের এখন সঘবদ্ধ হওয়া, এক মন-প্রাণ হইয়া কাজ করা, একমাত্র সেবার লক্ষ্য লইয়া একদল নিঃস্বার্থ ও দেশপ্রাণ কর্মী গঠন করা, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বর্ণের মধ্যে ভেদাভেদ বিস্তৃত হওয়া, হিন্দুদিগকে এবং তাহাদের আদর্শ ও সংস্কৃতিকে বাঁচাইয়া রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা আবশ্যক।

কাশী পণ্ডিতসভার বিধান।

 বারাণসীর পণ্ডিতদের প্রতিনিধিমণ্ডলী কাশী পণ্ডিতসভা বলিয়াছেন যে, বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করণ ও নারীদের সতীত্বহরণে হিন্দুদের জাতিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা নাই। এইরূপ বিপদের সময় ভগবানের নাম জপ করিলেই শুদ্ধ হইয়া যাইবে। সমগ্র ভারতে কাশীর পণ্ডিতদের বিধানকে শ্রদ্ধা করা হয়। নােয়াখালী ও অন্যত্র যে বর্বরতা ও অমানুষিক অত্যাচার চলিতেছে পণ্ডিত সভা তাহার তীব্র নিন্দা ও দুর্গতদের প্রতি গভীর সহানুভূতি জানাইয়া বলিয়াছেন যে ঐ দুবৃত্তদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা এবং প্ররােচনাকারীদের কঠোর দণ্ড দেওয়া উচিত।

স্মৃতির প্রমাণ

পণ্ডিত কৃষ্ণগােপাল গােম্বামী শাস্ত্রী, স্মৃতিমীমাংসাতীর্থ, এম এ, পি আর এস, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক বলেন যে, বলপূর্বক কাহাকেও ধর্মান্তরিত করিলে সে তজ্জন্য স্বধর্মচ্যুত হয় না; কারণ মনুস্মৃতিতে আছে, “বলপূর্বক দান, বলপূর্বক উপভােগ, বলপূর্বক লিখন এবং অপর যাহা কিছু বলপূর্বক করা হয় তৎসমস্তই মনুর মতে অসিদ্ধ” (৮।১৬৮)। এতদ্ব্যতীত বলপূর্বক ধর্ষিতা নারীগণকে পরিবারে ফিরাইয়া লইবার বিধান অত্রিস্মৃতিতে আছে, “সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি কোন নারী ছলে, বলে বা কৌশলে ধর্ষিতা হয়, তবে ঐ নারীর পাপস্পর্শ হয় না এবং সে পরিত্যক্তাও হইতে পারে না; কারণ ঐ কার্যে তাহার অনুমোদন ছিল না” (১৯৩-৯৪ শ্লোক)।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মত

 শ্রীধাম নবদ্বীপে শ্রীশ্রীধামেশ্বর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর শ্রীমন্দিরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এক সভা বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি বর্বরোচিত কার্যের নিন্দা করিয়া ও উক্ত কার্যের পরিসমাপ্তি কামনা করিয়া নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেন―

 জীবমাত্রেই হরি ভজনে অধিকারী। ধর্ম চিত্তের অভিরুচির উপর নির্ভর করে। বলপূর্বক কেহ কাহাকেও ধর্মান্তরিত করিতে পারে না। নোয়াখালি, ত্রিপুরা প্রভৃতি স্থানে অনেকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত হওয়ায় বিমর্ষ হইয়াছেন। তাহাদের দুঃখে দুঃখী হইয়া ও তাহাদিগকে সান্ত্বনা দিবার নিমিত্ত শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া সমিতি জানাইতেছেন যে, কোনরূপ শুদ্ধি ব্যতীতই ধর্মান্তরিত সকলকে তাহারা সাদরে ও সাগ্রহে ক্রোড় দিতে প্রস্তুত আছেন। ইতি—শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির পক্ষে অন্যতম সভ্য শ্রীহংসগোপাল গোস্বামী।

একমাত্র ভক্তির দ্বারা জাতিভেদ উঠে যেতে পারে। ভক্তের জাতি নেই। ভক্তের থাক আলাদা। তাদের মধ্যে জাতি-বিচারের কোন দরকার নাই। ভক্তি হলেই দেহ, মন, আত্মা, সব শুদ্ধ হয়। গৌর নিতাই হরিনাম। দিতে লাগলেন, আর আচণ্ডালে কোল দিলেন। ঈশ্বরের নামে মানুষ পবিত্র হয়। অস্পৃশ্য জাতি ভক্তি থাকলে শুদ্ধ, পবিত্র হয়। ভক্তি না থাকলে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ নয়। ভক্তি থাকলে চণ্ডাল, চণ্ডাল নয়। ভক্ত হলে চণ্ডালেরও অন্ন খাওয়া যায়। যে চামড়া ছুঁতে নাই, সেই চামড়া। পাট করার পর ঠাকুর ঘরে লয়ে যাওয়া যায়।

—শ্রীরামকৃষ্ণ

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।