প্রেম-পাগলিনী/প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রেম-পাগলিনী।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
পশ্চিম গগনে সাঁঝের তারা দেখা দিয়াছে। সেই উজ্জ্বল প্রদীপ্ত আভা দেখিয়াই যেন অপরাপর ক্ষুদ্র তারকানিচয় ক্রমশই ক্ষীণপ্রভ হইয়াছে। সান্ধ্য-সমীরণ গাছের পাতা কাঁপাইয়া, গৃহস্থের গবাক্ষ-পথ দিয়া প্রকোষ্ঠ মধ্যে প্রবেশ করতঃ সদ্য প্রদীপ্ত প্রদীপ নির্ব্বাণ করিতেছে। কখনও বা প্রসুপ্ত শিশুর কুন্তলকলাপ দোলাইয়া তাহার অনিন্দ্যসুন্দর ফুল্ল নলিনী সম মুখখানি চুম্বন করিয়া অপরের অগোচরে পলায়ন করিতেছে। আমি থানার প্রশস্ত প্রাঙ্গণ মধ্যে পায়চারি করিতেছি, এমন সময়ে সাহেবের আরদালি আসিয়া আমার হাতে একখানি পত্র দিল।
পত্রখানি পাঠ করিয়া জানিতে পারিলাম, মলঙ্গার কোন মুসলমানের বাড়ীতে খুন হইয়াছে; আমাকে তখনই তাহার অনুসন্ধানে যাইতে হইবে।
পত্র পাঠ করিয়া আমি একজন কনষ্টেবলকে একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম। শকট আনীত হইলে আমি সত্বর তাহাতে আরোহণ করিলাম এবং কোচমানকে মলঙ্গায় যাইতে আদেশ করিলাম।
অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি মলঙ্গায় উপস্থিত হইলাম। বাড়ীখানি খুঁজিয়া লইতে আমায় বিশেষ কষ্টও পাইতে হইল না।
কার্য্যস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, মুসলমানের বাড়ীখানি কাঁচা-খোলার চাল। বাড়ীর সদর দরজায় দুইজন কনষ্টেবল দণ্ডায়মান ছিল, আমাকে দেখিয়া উভয়েই সেলাম করিয়া পথ ছাড়িয়া দিল। আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। ভিতরে তিনখানি ঘর। একজন কনষ্টেবলও সেখানে মোতায়েন আছে।
তিনখানি ঘরের মধ্যে একখানি শয়ন-ঘর, একখানা রান্না ঘর এবং অপরখানিতে সংসারের যাবতীয় দ্রব্য সঞ্চিত থাকে। আমি প্রথমেই শয়ন-গৃহে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় আট হাতের কম নহে। ঘরের একটী দরজা এবং তিনটী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জানালা ছিল। ঘরের মেঝেয় বিলাতী মাটী (সিমেণ্ট) দেওয়া। ভিতরে একখানি কাঁঠাল কাঠের তক্তাপোষ, তাহার উপর একটা ছিন্ন মাদুর, তদুপরি দুইখানি ময়লা কাঁথা, সর্ব্বোপরি একখানা চাদর। বিছানার চারিদিকে চারিটী বালিস ছিল বটে, কিন্তু তাহার মধ্যে তিনটী ক্ষুদ্র। শয্যার দক্ষিণ দিকে মেঝের উপর কাঁঠাল কাঠের একটা সিন্দুক—উপরে আলকাতরা মাখান। সিন্দুকের উপর একখানি ময়লা আসন, তাহার উপর একটা বৈঠকে দস্ত বাঁধান হুকা। সিন্দুকের পার্শ্বে একখানি জলচৌকির উপর কতকগুলি বাসন সজ্জিত। ঘরের অপর দিকে একটা সেগুন কাষ্ঠের বস্ত্রাধার, তাহাতে তিন চারিখানি ময়লা কাপড়, একটা জামা ও একখানা বৃন্দাবনের চাদর। অপর পার্শ্বে কতকগুলি কড়ির সিকা। এক একটী সিকায় এক একটী রঙ্গিল হাঁড়ী।
শয্যার উপর এক বৃদ্ধের মৃতদেহ। সর্ব্বাঙ্গে একখানি মোটা চাদর দিয়া আবৃত। বৃদ্ধের মুখে তখনও ফেণা; চক্ষু রক্তবর্ণ এবং উন্মীলিত মুখভঙ্গী অতি বিকট। তাহাকে দেখিয়া বোধ হয়, তাহার বয়স প্রায় ষাইট বৎসর। দেখিতে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণ কিন্তু জরাগ্রস্ত বলিয়া বোধ হইল না।
গৃহ মধ্যে আরও দুইজন লোক ছিল, উভয়েই রমণী। একজনকে যুবতী বলিয়া বোধ হইল, তাহার সর্ব্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত, মুখে ঘোম্টা। অপরা প্রৌঢ়া, বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর।
যে পুলিস-কর্ম্মচারী বাড়ীর ভিতরে ছিল, তাহার মুখে শুনিলাম, যে বৃদ্ধের মৃত্যু হইয়াছে, তাহার নাম মহম্মদ,—সেই বাড়ীর মালিক। সে আতসবাজী বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। মেছুয়াবাজারে তাহার একখানি বাজীর দোকান আছে এবং কাঁকুড়গাছিতে একখানি বাগানও জমা আছে। সরকার বাহাদুরের আদেশ মত সেই বাগানেই মহম্মদ আতসবাজী প্রস্তুত করিত। সে নিতান্ত দরিদ্র নহে, আপনার ও পরিবারের ভরণ-পোষণ সংগ্রহ করিতে তাহাকে পরের দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে হইত না। . বরং সে অপরকে মধ্যে মধ্যে দুই চারি টাকা কর্জ্জ দিয়া উপস্কার করিত। সেইদিন বেলা দশটার সময় মহম্মদ ভগ্নীর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিল। যখন বাড়ী ফিরিয়া আসিল, তখন বেলা প্রায় চারিটা। বাড়ীতে আসিয়াই স্ত্রীর সহিত দুই একটা কথাবার্ত্তার পর সে শয়ন করিয়াছিল। প্রায় এক ঘণ্টার পর হঠাৎ সে গোঁ গোঁ শব্দ করিতে আরম্ভ করে। তাহার স্ত্রী সেই শব্দ শুনিয়া দৌড়িয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার বড়ই ভয় হইল। সে দেখিল, তাহার স্বামী গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছে, তাহার মুখ দিয়া ফেণা নির্গত হইতেছে, তাঁহার চক্ষু ঘোর রক্তবর্ণ হইয়াছে, তাহার দৃষ্টি উপরে উঠিয়াছে, চক্ষুর তারা যেন সদাই ঘুরিতেছে। ভয় পাইলেও সে দুই একবার ডাকিয়াছিল, কিন্তু কোন সাড়া পায় নাই। তাহার ভয় আরও বাড়িয়া উঠিল, সে এক প্রতিবেশিনী——সেই প্রৌঢ়ারমণীকে ডাকিয়া আনিল। উভয়ে মিলিয়া মহম্মদের জ্ঞান উৎপাদনের জন্য বিধিমতে চেষ্টা করিল কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। তখন প্রৌঢ়ার পরামর্শে পুলিসে সংবাদ দেওয়া হইল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মহম্মদ অধিকক্ষণ জীবিত ছিল না। পুলিসের লোক আসিবার পূর্ব্বেই সে ইহধাম ত্যাগ করিয়াছিল।
পুলিস-কর্ম্মচারীর নিকট হইতে এই সকল কথা শুনিবার পর,—স্বয়ং লাস পরীক্ষা করিবার জন্য অগ্রসর হইলাম এবং সেই প্রৌঢ়াকে মহম্মদের গাত্রবস্ত্রখানি ধীরে ধীরে তুলিয়া লইতে বলিলাম।