ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/সপ্তম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম অধ্যায়।

 উক্ত সকল ঘটনা দেখিয়া আমার মন অতিশয় ব্যাকুল হওয়াতে আমি প্যারীর কবরস্থানহইতে ঘরে গিয়া ব্যামোহে পড়িলাম। সেই পীড়াতে আমি প্রায় দেড় মাস পর্য্যন্ত শয্যাগত হইয়া রহিলাম; ইতোমধ্যে খ্রীষ্টিয়ান পাড়াতে আর যাইতে পারিলাম না, কিন্তু আমার আয়ার সহিত ধর্ম্মের বিষয়ে বিস্তর মিষ্ট আলাপ করিতাম। সে ব্যক্তি সর্ব্বদা যত্ন পূর্ব্বক আমার সেবা করিত, কিন্তু এখন পূর্ব্বাপেক্ষা শ্রমী হইয়া যাহাতে আমি সন্তুষ্ট হইব কেবল এমত কর্ম্ম করিতে চেষ্টান্বিতা হইত। আর সে খ্রীষ্টিয়ান হওয়াতে আমারই প্রভুর দাসী এবং আমার সহিত একই স্বর্গের অধিকারিণী হইল, ইহা জানিয়া তাহার প্রতি আমারও পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রেম জন্মিল। অনেক বৎসর পূর্ব্বে আয়া আমার সহিত কান্‌পুরহইতে আসিয়াছিল, এই হেতুক আমরা যে গ্রামে তখন ছিলাম সেই গ্রামে তাহার আত্মীয় লোক কেহই ছিল না; এবং তাহার স্বামী ও সন্তান না থাকাতে সে কান্‌পুরে আর ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছা না করিয়া আমারই সহিত থাকিতে স্থির করিয়াছিল; এই কারণ তাহার থ্রীষ্টিয়ান হওয়া এক প্রকার সহজ কর্ম্ম। তথাপি শিশু কালাবধি সে মুসলমান জাতির নিয়ম সকল পালন করাতে ভিন্ন জাতীয় লোকদের সহিত আহারাদি করিতে তাহাকে অতিশয় কঠিন বোধ হইল; এমত দেখিয়া আমি তাহাকে এই পরামর্শ দিলাম, যে তুমি হঠাৎ জাতি ত্যাগ না করিয়া বরং কিছু দিন এ বিষয়ে বিবেচনা কর, পাছে লোকে বলে সাহেব লোকেরা ফাঁদ পাতিয়া তোমাকে খ্রীষ্টিয়ান করিয়াছেন।

 এক দিবস আয়া আমার খাটের নিকটে বসিয়া বর্ণমালা পড়িতেছিল, কারণ সে যে অবধি খ্রীষ্টিয়ান হইতে মানস করিয়াছিল সেই অবধি পাঠ শিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল; এমত সময়ে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আয়া! প্রথমে খ্রীষ্ট ধর্ম্ম গ্রহণ করিতে তোমার মনে কে প্রবৃত্তি দিল?

 আয়া বলিল, মেম সাহেব, ফুলমণির সন্তানেরা ধর্ম্মকে কিরূপ ভারি বিষয় জ্ঞান করে, আমি ইহা দেখিয়া চেতনা পাইয়াছিলাম; কেননা আমি ভাবিলাম, ইহারা শিশুমাত্র, অতএব এই শিশুগণ কোন ক্ষুদ্র দোষ করিলে যদি এমত উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল হয়, তবে নিত্য ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতেছি যে আমি, আমি কি প্রকারে প্রভুর কোপ এড়াইতে পারিব? ধর্ম্মাত্মা এরূপে আমার মনের মধ্যে পাপের বোধ জন্মাইয়া আমাকে ইহা জ্ঞাত করাইলেন, যে প্রায়শ্চিত্ত বিনা ঐ পাপ কখন ক্ষমা হইতে পারিবে না। সাধু ও সত্যবতী এমত প্রায়শ্চিত্তের বিষয় আমাকে অনেকবার কহিত, তাহাতে আমি আরও শুনিতে ইচ্ছুক হইয়া তাহাদিগকে বিনতি করিলাম, তোমরা যীশু খ্রীষ্টের তাবৎ বৃত্তান্ত আমার সাক্ষাতে পাঠ কর। আমি তাঁহার মহা দয়ার বিষয়ে যত শুনিলাম, ততই আমার মন তাঁহার প্রতি আকর্ষিত হইল; কিন্তু খ্রীষ্টের মৃত্যুদ্বারা পাপি লোকেরা কি প্রকারে নির্দোষী হইতে পারে, ইহা তখন আমি ভাল বুঝিতাম না। পরে প্যারী মরণ কালে খ্রীষ্টের রক্তময় হস্তের দৃষ্টান্ত দিয়া যখন করুণাকে তাহা বুঝাইয়া দিল, তখন আমিও সুন্দররূপে জ্ঞাতা হইলাম যে যীশুর পতিত রক্তদ্বারা পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরা কেবল ক্ষমা পায় তাহা নয়, ঈশ্বর তাহাদিগকে নির্দোষি জ্ঞান করেন; ইহা জানিয়া আমি এমন মহা পরিত্রাণ অবজ্ঞা করিতে আর পারিলাম না।

 আমি কহিলাম, হাঁ আয়া! ঈশ্বরের স্মরণ পুস্তকহইতে যীশুর রক্তময় হস্ত যে আমাদের পাপ মুচাইয়া ফেলে, তাহা অতি সুন্দর দৃষ্টান্ত। আর আমার নিজ পাপ সকল এই রূপে মোচন হইয়াছে, ইহা আমাদের প্রিয়া প্যারী কেমন দৃঢ় বিশ্বাস করিত।

 প্যারীর মৃত্যুর কথা স্মরণ হওয়াতে আয়া কাঁদিতে২ বলিল, আ মেম সাহেব! প্যারীর পীড়া হইলে পর তাহার সহিত আমার যে দুই বার সাক্ষাৎ হইল, তদ্দ্বারা আমার কেমন লাভ জন্মিয়াছে। আহা! সকল খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকেরা যদি প্যারী ও ফুলমণির মত হইত, তবে বোধ করি অল্প দিনের মধ্যে একটিও হিন্দু কিম্বা মুসলমান আর থাকিত না।

 এমত সময়ে এক জন বাহিরে দাঁড়াইয়া আয়াকে ডাকিলে আমাদের কথোপকথন ভঙ্গ হইল; তাহাতে আমি তৎক্ষণাৎ সেই মিষ্ট রব শুনিয়া জানিলাম যে সত্যবর্তী আসিয়াছে, অতএব তাহাকে ঘরের ভিতরে ডাকিলাম। সত্যবতী আসিয়া বলিল, মেম সাহেব, মা আমাদিগকে কহিলেন, যে স্কুলহইতে ফিরিয়া আসিবার সময়ে

আয়ার নিকটে গিয়া মেম সাহেব কেমন আছেন, ইহা জিজ্ঞাসা করিয়া আইস; এই নিমিত্তে আমরা আসিয়াছি।

 আমি বলিলাম, সত্যবতি, অদ্য আমি কিছু ভাল আছি, অতএব তোমার ভাই যদি বাহিরে থাকে, তবে তাহাকে ডাকিয়া আন। তাহাতে সাধু আসিয়া আমাকে আপন রীত্যনুসারে অতি শিষ্টরূপে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। পরে আমার মেজের উপর বড় একখান আর্শি দেখিয়া তাহারা দুইজনে অত্যন্ত আশ্চর্য্য জ্ঞান করিল, কারণ পূর্ব্বে তাহারা এমন বস্তু কখন দেখে নাই। তখন সত্যবতী আনন্দপূর্ব্বক করতালি দিয়া বলিল, ও দাদা! আমি মাকে গিয়া বলিব, যে এখানে আসিয়া আমরা এক আকৃতি দুই জন মেম ও দুই জন আয়াকে দেখিতে পাইলাম; এ কথার ভাব মা কখন বুঝিতে পারিবেন না। পরে মেজের উপর যে গোলাপ জল ও আতরাদির শিশি ছিল, তাহাও দেখিয়া ছেল্যারা বড় প্রশংসা করিল, এবং আমি কিঞ্চিৎ আতর তাহাদের কাপড়ে ঢালিয়া দিলে তাহারা অত্যন্ত আহ্লাদে পুলকিত হইয়া কি করিবে তাহা জানিল না। কিন্তু এমত হইলেও তাহারা বড় শিষ্ট ব্যবহার করিয়া কোন দ্রব্যেতে হাত দিল না, এবং কোন সামগ্রী আমার নিকটে চাহিল না।

 পরে আমি যে পীড়িত ছিলাম, তাহা সাধু স্মরণে রাখিয়া বলিল, মেম সাহেব, বোধ করি আমরা এখন ঘরে গেলে ভাল হয়, এখানে থাকিয়া কেবল আপনাকে ব্যামোহ দিতেছি। কিন্তু তাহা না হইয়া বরং তাহাদের নিষ্কপট কথা শুনিয়া আমার মনে আমোদ জন্মিতেছিল, এই হেতু আমি কহিলাম, না না, এখন তোমরা ঘরে যাইও না। আজি স্কুলে কি শিখিয়াছ, তাহা বসিয়া২ আমাকে বল।

 এই কথা শুনিয়া সত্যবতী কহিল, ও মেম সাহেব, আপনি অনেক দিন হইল এক বার বলিয়াছিলেন, কোন রবিবার দিনে আমি গিয়া ধর্ম্মপুস্তকের পদ তোমাদের মুখস্থ শুনিব; কিন্তু এক বারও যান নাই, অতএব যদি আজ্ঞা করেন, তবে স্কুলের পাঠ না দিয়া গত রবিবারের শিক্ষিত পদ গুলিন আপনার সাক্ষাতে বলি; তাহার মধ্যে অনেক উত্তম২ কথা আছে। আমি কহিলাম, ভাল তাহাই বল; পরে তোমার পিতা কি প্রকারে সে সকল পদ তোমাদিগকে বুঝাইয়া দিয়াছেন, তাহাও বলিতে হইবে। সত্যবতী প্রথমে আরম্ভ করিতে চাহিল, তাহাতে তাহার ভাই হাসিয়া বলিল, সত্যবতি, আমি প্রথমে মুখস্থ বলিলে বলিতে পারিতাম; কিন্তু ক্ষতি নাই, তুমি বলিতে চাহিতেছ, অতএব তুমিই বল।

 তখন সত্যবতী শুদ্ধরূপে এই২ পদ সকল মুখস্থ বলিতে লাগিল, যথা; “বালকের গন্তব্য পথে তাহাকে শিক্ষা দেও, তাহাতে সে প্রাচীন হইলে তাহাহইতে বিমুখ হইবে না।” হিতোপদেশ ২২।৬।

“বালকের মনে অজ্ঞানতা বদ্ধ থাকে, কিন্তু শাসনদণ্ড দ্বারা তাহা তাহাহইতে দূরে যায়।” হিতোপদেশ ২২।১৫।

 “হে বালকগণ, পরমেশ্বরের বাক্যানুসারে তোমরা পিতা মাতার আজ্ঞাবহ হও, কেননা ইহা উপযুক্ত।” ইফিষীয় মণ্ডলীর প্রতি পত্র ৬।১।

 “যীশু শিশুগণকে দেখিয়া কহিলেন, শিশুদিগকে আমার নিকটে আসিতে দেও, তাহাদিগকে বারণ করিও না, কেননা এমত ব্যক্তিরা ঈশ্বরের রাজ্যের অধিকারী।” মার্ক ১০।১৪।

 সত্যবতী আপন পাঠ সাঙ্গ করিলে পর আমার মুখ পানে দৃষ্টি করিয়া বলিল, ঐ শেষ পদটি সকলহইতে ভাল। যীশু খ্রীষ্ট বলেন, শিশুদিগকে আমার নিকটে আসিতে দেও, ইহাতে তাঁহার কত বড় দয়া প্রকাশ পায়! '

আহা! আমি যীশুর প্রতি অতিশয় প্রেম করি। এই প্রিয়া বালিকার বাক্য শুনিয়া আমার চক্ষুঃ জলেতে ছল্২ করিল, তাহাতে সে তাহা টের পাইয়া আপন ছোট শাড়ির অঞ্চল দিয়া শীঘ্র মুচাইয়া ফেলিল।

 পরে সাধু বলিল, সত্যবতি, যে বালকেরা আপন পিতা মাতার আজ্ঞাবহ হইয়া ইহকালে পুরস্কার পাইয়াছিল, তাহাদের কথা ধর্ম্মপুস্তকের মধ্যে আমরা কি প্রকারে খুজিয়া বাহির করিলাম, সে বিষয়ও মেমকে জানাও।

 সত্যবতী কহিল, সকল কথা এখন আমার মনে নাই, কিন্তু যে দুই জন বালকের বৃত্তান্ত আমি ধর্ম্ম পুস্তকের মধ্যে আপনি খুজিয়া বাহির করিলাম, তাহা মেম সাহেবকে বলিতে পারি। যূষফ ও শৌল আপন২ পিতার আজ্ঞা পালন করাতে শেষে রাজা হইয়াছিল। যূষফ আপন পিতার কথা শুনিয়া ভ্রাতাদের তত্ত্ব করিতে গিয়াছিল, তাহাতে সে মিসর দেশে নীত হইয়া শেষে দেশাধ্যক্ষ হুইল। তদ্রূপ শৌল আপন পিতার গর্দভ অন্বেষণ করিতে গেলে, শিমূয়েল ভবিষ্যদ্বক্তা তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহাকে ইস্রায়েল দেশের রাজপদে অভিষিক্ত করিলেন।

 আমি এই কথাতে ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, ভাল সত্যবতি, তুমি ভারি দৃষ্টান্ত বাহির করিয়াছ বটে! এখন বল দেখি, যদি তুমি আপনার পিতা মাতার কথা শুন, তবে কি একটি ছোট রাণী হইবার অপেক্ষা কর?

 সত্যবতী অতিশয় গম্ভীর হইয়া কহিল, না মেম, এমত নয়; কিন্তু মা বাপের কথা শুনিলে ঈশ্বর আমার প্রতি প্রেম করিবেন, তাহা হইলে আমি আর কোন পুরস্কার চাহি না। এখন দাদার পাঠ লউন, ইনি আমা অপেক্ষা অনেক পদ জানেন।

 তখন সাধু স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া স্পষ্টরূপে বলিতে লাগিল, যথা;

 “পরমেশ্বর বিষয়ক যে ভয়, সেই জ্ঞানের আরম্ভক; কিন্তু অজ্ঞানেরা বিদ্যা ও উপদেশ তুচ্ছ বোধ করে।” হিতোপদেশ ১।৭।

 “হে আমার পুত্ত্র, পাপিগণ তোমাকে কুপথে লওয়াইলে তুমি সম্মত হইও না। তাহাদের সহিত সে পথে যাইও না, তাহাদের পথহইতে তোমার চরণ ফিরাও।” হিতোপদেশ ১।১০,১৫।

 “মূর্খ পুত্ত্র আপন পিতার মনস্তাপ ও মাতার দুঃখজনক হয়।” হিতোপদেশ ১৭।২৫।

 “আমিই প্রকৃত মেষপালক; যে জন প্রকৃত মেষপালক, সে মেষের নিমিত্তে আপন প্রাণ সমর্পণ করে। আমার মেষগণ আমার রব শুনে; আমি তাহাদিগকে জানি, এবং তাহারা আমার পশ্চাৎ গমন করে। আমি তাহাদিগকে অনন্ত পরমায়ু দি; তাহারা কখনো বিনষ্ট হইবে না, এবং কেহ আমার হস্তহইতে তাহাদিগকে হরণ করিতে পারিবে না।” যোহন ১০।১১,২৭,২৮।

 “আমি দ্রাক্ষালতাস্বরূপ, তোমরা শাখাস্বরূপ; যে জন আমাতে থাকে, এবং যাহাতে আমি থাকি, সে প্রচুর ফলেতে ফলবান্ হয়; কিন্তু আমা ভিন্ন তোমরা কিছুই করিতে পার না।” যোহন ১৫।৫।

 সাধুর পাঠ সাঙ্গ হইলে পর আমি জিজ্ঞাসিলাম, ভাল সাধু, প্রভু যীশু খ্রীষ্ট কি ভাবে আপনাকে মেষপালক বলিলেন, তাহা কি তুমি জান?

 সাধু উত্তর করিল, হাঁ মেম সাহেব, জানি। যেমন মেষপালক আপন মেষগণকে রক্ষা করে, তদ্রূপ যীশু আপন বিশ্বস্ত লোকদিগকে সকল আপদহইতে ত্রাণ করেন। ধর্ম্মপুস্তকের এক স্থানে লেখা আছে, শয়তান গর্জনকারি সিংহ; যীশু সেই গর্জনকারি সিংহহইতে আপন শিষ্যদিগকে রক্ষা করেন, অর্থাৎ তাহাদিগকে এমত

শক্তি দেন যে তাহারা শয়তানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারে।

 তখন সত্যবতী বলিল, ও দাদা! তুমি মেষশাবকের বিষয়ে মেম সাহেবকে বলিতে

ভুলিয়াছ। দেখ, ছোট বাচ্চা গুলিন ক্লান্ত হইলে মেষপালক যেমন তাহাদিগকে ক্রোড়ে করিয়া লইয়া যায়, তদ্রূপ যীশু আপন লোকদের ছোট ছেল্যাদিগকে প্রেম করিয়া বলেন, শিশুদিগকে আমার নিকটে আসিতে দেও!

 তাহাতে আমি কহিলাম, সত্যবতি, একথা যথার্থ বটে; এবং যীশু খ্রীষ্ট এক বার আপনি বালক ছিলেন, অতএব তিনি ছেল্যাদের সুখ ও দুঃখ সকল ভালরূপে জ্ঞাত আছেন।

 ইহা শুনিয়া সত্যবতী প্রফুল্ল বদনে বলিল, ও মেম সাহেব, আমি যখন যীশুর নিকটে প্রার্থনা করি, তখন ঐ কথা আমার মনে উঠে। একবার পাদরি সাহেবের মেম প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, যদি বৃষ্টি না হয়, তবে সন্ধ্যাকালে আমি তাবৎ স্কুলের বালক বালিকাকে ওপারে লইয়া যাইয়া

এক সাহেবের পোষা চিত্র বাঘ দেখাইব; তাহাতে আমি প্রার্থনা করিলাম যেন সে দিন বৃষ্টি না হয়। প্রার্থনা করিয়া আমি ভাবিতে লাগিলাম, কি জানি এমত ক্ষুদ্র বিষয়ে প্রার্থনা করিলে ঈশ্বর আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হইবেন; কিন্তু পরে মনে করিলাম, যীশু যখন বালক ছিলেন, তখন বোধ হয় তিনিও পোষা বাঘ দেখিয়া সন্তুষ্ট হইতেন, অতএব আমি ঐরূপ প্রার্থনা করিতে আর ভয় করিলাম না। আমার প্রার্থনাও সফল হইল, কারণ সে দিবসে বৃষ্টি হইল না, তাহাতে আমরা বাঘকে স্বচ্ছন্দে দেখিলাম।

 তখন সাধু বলিল, মেম সাহেব, পিতা সেই কথা শুনিয়া কহিলেন, সত্যবতী ভাল করিয়াছে। পৌল প্রেরিত লিখিয়াছেন; যথা, “দৌর্ব্বল্যেতে আমাদের সহিত দুঃখ ভোগ করিতে অক্ষম, এমন মহাযাজক আমাদের নহেন।” ইব্রী ৪।১৫। অতএব বয়ঃপ্রাপ্ত লোকেরা যাহা চাহে তাহার নিমিত্তে যদি প্রার্থনা করিতে আজ্ঞা পাইয়াছে, তবে অবশ্য শিশুরাও যাহা২ ইচ্ছা করে তাহার জন্যে প্রার্থনা করিতে পারে।

 আমি কহিলাম, তোমার পিতা যথার্থ বুঝিয়াছে। এখন বল দেখি, “তোমরা আমাতে থাক,” এই যে আজ্ঞা খ্রীষ্ট আপনার শিষ্যগণকে দিয়াছেন ইহার অভিপ্রায় কি?

 সাধু বলিল, ইহার অর্থ এই, আমাদিগকে খ্রীষ্টের পশ্চাৎ২ গমন করিতে হইবে, ও তাঁহার নিকটে থাকিতে হইবে। আমি জিজ্ঞাসিলাম, তিনি এমত আজ্ঞা কেন দিলেন? সাধু কহিল, যেমন ভাল গাছের মূলহইতে রস না পাইলে শুষ্ক হইয়া যায়, সেইরূপ খ্রীষ্টের লোকেরা যদি তাঁহার সঙ্গ ছাড়ে, তবে তাহাদের ধর্ম্ম নষ্ট হয়; কারণ শয়তান আসিয়া সতত মনুষ্যদের মনকে পরীক্ষা করে, তাহাতে তাহারা যদি খ্রীষ্টের অনুগ্রহ ও শক্তি না পায়, তবে শয়তানকে জয় করিতে না পারিয়া পাপে পতিত হইবে।

 এমত কথোপকথন হইতে২ অনেক সময় বহিয়া গেল; ইতোমধ্যে আমি ও ছেল্যারা সকলই ভুলিয়া গিয়াছিলাম, যে তাহাদের মাতা তাহাদের অপেক্ষাতে ভাবিতা হইয়া থাকিবে। কিঞ্চিৎকাল পরে ফুলমণি আপন হারাণ ধনকে আপনি খুজিতে আইল। সে ছেল্যাদিগকে আমার সহিত দেখিয়া কিছু মাত্র অসন্তুষ্টা না হইয়া বলিল, মেম সাহেব, আপনি পীড়িতা আছেন, অতএব ভয় হয় ছেল্যারা আপনাকে বিস্তর ব্যামোহ দিয়া থাকিবে; আমি এখন উহাদিগকে একেবারে ঘরে লইয়া যাই।

 ফুলমণির এইরূপ ব্যবহারদ্বারা বাঙ্গালাদেশস্থ স্ত্রীলোকেরা শিক্ষা পাইতে পারে, বিশেষতঃ অনেকেই সাহেব লোকদের কিম্বা আপন২ প্রতিবাসিদের ঘরে অসময়ে উপস্থিতা হইয়া তাহাদিগকে নিরর্থক ব্যস্ত করে।

 আমি ফুলমণিকে বলিলাম, না ফুলমণি, তোমার ছেল্যারা আমাকে কিছু মাত্র ব্যামোহ দেয় নাই; আমি ইহাদিগকে ধর্ম্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, কেননা আমার বোধে খ্রীষ্টের খোঁয়াড়ের মেষশাবকগণকে শিক্ষা দেওয়া অপেক্ষা পৃথিবীর মধ্যে আর উত্তম কর্ম্ম নাই।

 এমত সময়ে সাধু ও সত্যবতী আমার হিরামন তোতাকে দেখিবার জন্যে বারাণ্ডায় দৌড়িয়া গেল। তাহাতে আমি তাহাদের প্রশংসা করিতে ভয় না করিয়া বলিলাম, ফুলমণি, আমি দেখিতেছি যে তোমার সন্তানেরা ধর্ম্মকে ভাল বাসে, এবং তাহাদের স্বর্গস্থ পিতা যাহাতে সন্তুষ্ট হইবেন কেবল এমত কর্ম্ম করিতে চেষ্টা করে; অতএব স্পষ্ট বোধ হয়, যে ঈশ্বর তোমার সকল সুশিক্ষাতে আশীর্ব্বাদ করিতেছেন।

 ফুলমণি কহিল, আঃ মেম সাহেব! আমি এই প্রার্থনা করি, যেন আমি শিমূয়েল ও তীমথির মায়ের ন্যায় ছেল্যাদিগকে শিশুকাল অবধি ধর্ম্ম পথে লওয়াইতে পারি, এবং শিমূয়েল ও তীমথি যেরূপ ঈশ্বরপরায়ণ হইয়া উঠিল, সেইরূপ আমার সন্তানেরাও যদি ধার্ম্মিক হইয়া উঠে, তবে আমার মনোবাঞ্ছা সিদ্ধ হইবে।

 আমি উত্তর করিলাম, ভয় নাই ফুলমণি, তুমি অবশ্য সেই বর পাইবা; কারণ ঈশ্বর বলিয়াছেন, “যাহারা আমার প্রতি প্রেম করে তাহাদিগের প্রতি আমিও প্রেম করি,” এবং তিনি তাহাদিগকে কখন রিক্ত হস্তে বিদায় করেন না। করুণা যদি আপন সন্তানদিগকে শিক্ষা দিয়া তাহাদের নিমিত্তে প্রার্থনা করিত, তবে এখন তাহার পুত্ত্রের বিনাশের বিষয়ে সে আপনাকে নির্দোষি জানিয়া কিছু শান্তা হইত।

 এই কথা সাঙ্গ হইলে পর সাধু ও সত্যবতী ভিতরে আইলে ফুলমণি তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া বিদায় লইয়া ঘরে গেল।

 আহা! এই দরিদ্র খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোক ও তাহার প্রিয় সন্তানদের সহিত সাক্ষাৎ করণদ্বারা আমার মন কেমন উল্লাসিত হইল। ভারতবর্ষের তাবৎ লোক এক দিবস প্রভুর সেবা করিবে, ফুলমণির পরিবার এমত সুদিবসের বায়না স্বরূপ হইয়াছে, আমি ইহা ভাবিয়া মনে২ এই প্রার্থনা করিলাম, হে প্রভো, এমত কাল শীঘ্র উপস্থিত কর; এবং সুস্থকারি কিরণবিশিষ্ট ধর্ম্মরপ সূর্য্য উদয় করাইয়া এই দেশের ভ্রমান্ধকার নষ্ট কর। হে প্রভো, যদ্যপি আমি কেবল কাষ্ঠছেদক ও জলবাহক স্বরূপ হই, তথাপি আমাদ্বারা যেন এই মহৎ কর্ম্মের কিছু২ বৃদ্ধি হয়!

 প্রায় দেড় মাস গত হইলে পর আমি স্বাস্থ্য পাইয়া পুনর্ব্বার বাহিরে যাইতে পারিলাম; তাহাতে প্রথমে দুঃখিনী করুণার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাঞ্ছা করিয়া তাহার বাটীতে উপস্থিতা হইয়া দেখিলাম, তাহার মুখ অতিশয় ম্লান এবং মনের দুঃখ প্রযুক্ত বড় কৃশ হইয়াছে।

 করুণা আমাকে দেখিবামাত্র আপন পুত্ত্রের মৃত্যুর দিবস মনে করিয়া তৎক্ষণাৎ ক্রন্দন করিতে২ বলিল, আ মেম সাহেব! আমার কেমন মন্দ কপাল, দুঃখেতেই আমার কাল বহিয়া যাইতেছে। তাহাতে আমি বংশির বিষয়ে আর কিছু বলিতে ভাল না বুঝিয়া কহিলাম, করুণা, তোমার মন যাহাতে শোকহইতে বিশ্রাম পায় এমত চেষ্টা কর। আপন কপালকে দোষ দেওয়াতে কোন ফল নাই; বরং তদ্দ্বারা অন্তঃকরণ কঠিন হয়, এবং তাহাতে তোমার প্রতি ঈশ্বরের ক্রোধ জন্মে। বল দেখি করুণা, পৃথিবীর মধ্যে দুঃখ কি প্রকারে প্রবেশ করিল?

 করুণা উত্তর করিল, পাপদ্বারা দুঃখ হইল।

 আমি কহিলাম, একথা সত্য; তবে দুঃখ ঘুচাইবার জন্যে দুঃখের কারণকে দূর করিতে হয়, অর্থাৎ কপালকে দোষ না দিয়া আপন পাপের বিষয়ে ক্রন্দন ও বিলাপ করত তাহা ত্যাগ করিতে হয়। যীশু বলিয়াছেন, খিদ্যমান লোকেরা ধন্য, কারণ তাহারা সান্ত্বনা পাইবে; অর্থাৎ যাহারা পাপের বিষয়ে খেদ করে তাহারাই ধন্য; যেমন আমি পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম, যে জন আপন পীড়ার নিমিত্তে খেদ করিয়া ঔষধাদি খায় সে ব্যক্তি অবশ্য সুস্থ হইতে পারে। পাপ মনের রোগ, খ্রীষ্ট তাহার চিকিৎসক হইয়াছেন, তুমি তাঁহার প্রতি বিশ্বাস রাখিলে পাপহইতে মুক্ত হইবা।

 করুণা কহিল, হাঁ মেম সাহেব, সে সত্য বটে; কিন্তু আমার তাবৎ দুঃখ আপনাহইতে জন্মে না, ইহাতে আমার স্বামির অধিক দোষ আছে। দেখুন, আজি আমি সুঁড়ির দোকান পর্য্যন্ত পয়সা চাহিবার জন্যে তাহার পিছে২ গিয়াছিলাম, তথাচ একটি কড়াও পাইলাম না; বরং সে আমাকে গালি দিয়া তাড়াইয়া দিল।

 আমি কহিলাম, করুণা, তুমি যদি পারিপাট্য ও মিষ্ট কথাদ্বারা আপনার বাটীকে রম্যস্থান করিতা, তবে সে অন্য স্থানে কেন চঞ্চল হইয়া বেড়াইবে? কিন্তু তুমি তাহাই করিলে সেও তোমাকে ভাল রূপে প্রতিপালন করিবে।

 করুণা বলিল, বোধ হয় তাহা কেবল আমাহইতে হইবে না। কেহ যদি আমাকে শিক্ষা দেয়, তবে কি জানি হইলেও হইতে পারে।

 পরে আমি কহিলাম, করুণা, আমার পরামর্শে যদি চলিতে পার, তবে আমি তোমাকে শিক্ষা দিই। তুমি প্রথমে ঈশ্বরের দশ আজ্ঞা মুখস্থ কর, পরে সে সকল আজ্ঞা পালন করিতে যত্নবতী হও, বিশেষতঃ বিশ্রামবারকে পবিত্র রূপে মানিয়া প্রভুর গীর্জা ঘরে যাও। আহা করুণা! তুমি যদি এত দিন গীর্জায় যাইতা, তবে এখন ধর্ম্মের বিষয়ে এমত অজ্ঞান হইয়া থাকিতা না।

 করুণা বলিল, মেম সাহেব, আমার একখানিও ভাল কাপড় নাই, এই জন্যে গীর্জায় যাইতে লজ্জা করি। সকলে রবিবার দিনে ভাল কাপড় পরিয়া আইসে, কেবল আমি কি মলিন বস্ত্র পরিয়া যাইব?

 আমি উত্তর করিলাম, করুণা, প্রভুর গৃহে পরিষ্কার বস্ত্র পরিয়া যাওয়া উচিত বটে, তথাচ যদি কোন প্রকারে এমত বস্ত্র যোগাইতে না পার, তবে গীর্জা ত্যাগ করা অপেক্ষা সামান্য বস্ত্র পরিয়া যাওয়া ভাল; কেননা শরীর এক প্রকার তুচ্ছনীয় বস্তু, আত্মা অতিশয় দুর্লভ, অতএব তোমার আত্মা যেন খ্রীষ্টের পবিত্রতাতে ভূষিত হয়, এমত চেষ্টা কর। দায়ূদ রাজা যখন জিজ্ঞাসিলেন, “পরমেশ্বরের পর্ব্বতে কে আরোহণ করিবে? ও তাঁহার ধর্ম্মধামে কে অধিষ্ঠান করিবে?” তখন ধর্ম্মাত্মা উত্তর করিলেন, “যাহার পরিষ্কৃত করতল ও পবিত্র অন্তঃকরণ আছে; যে জন মিথ্যা কথাতে মনোনিবেশ ও মিথ্যা শপথ না করে; এমত ব্যক্তি পরমেশ্বরহইতে আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হইবে।” গীত ২৪।৩,৪,৫। আর করুণা, বিবেচনা কর, তুমি যদি এখন মনুষ্যদের সমাজে মলিন বস্ত্র পরিয়া যাইতে লজ্জা কর, তবে শেষ বিচারে তাবৎ পৃথিবীস্থ লোকদের ও দিব্য দূতগণের সাক্ষাতে পাপরূপ মলিন নেকড়া পরিয়া কি প্রকারে দাঁড়াইবা? সে যাহা হউক, তুমি কি গীর্জায় যাইবার জন্যে কোন প্রকারে একখান উপযুক্ত কাপড় কিনিয়া রাখিতে পার না?

 করুণা কহিল, মেম সাহেব, চারিটি ভাত খাইয়া যে তৃপ্তা হই, এমত কড়ি স্বামী আমাকে আনিয়া দেয় না, তবে কোথাহ্ইতে ভাল শাড়ি কিনিব? এবং এখন গীর্জায় গেলে আমার কি ফল হইবে? আমি আপন দুর্ভাগ্য ছেল্যার আত্মা নষ্ট করিয়াছি, অতএব ঈশ্বর আমার প্রার্থনা কখন শুনিবেন না। ঐ ছেল্যার সহিত আমাকে অনন্তকাল নরকাগ্নিতে পুড়িতে হইবে।

 ইহা শুনিয়া আমি কহিলাম, হায়২ করুণা! তুমি কি এত শীঘ্র প্যারীর শেষ বাক্য ভুলিয়া গেলা?

 করুণা বলিল, না না মেম, তাহা ভুলি নাই, বরং আমি অনেকবার আপন অন্তঃকরণের মধ্যে সেই মিষ্ট কথা গুলিন আন্দোলন করিয়া থাকি; তথাচ খ্রীষ্ট যে আমাকে ত্রাণ করিবেন আমার এমত ভরসা হয় না।

 আমি কহিলাম, করুণা, তুমি ভয় করিও না; তিনি অবশ্য তোমাকে ত্রাণ করিবেন। তুমি প্রতিদিন এইরূপ প্রার্থনা করিও, হে পরমেশ্বর! তোমার পুত্ত্র যীশু খ্রীষ্টের রক্ত যে তাবৎ পাপহইতে আমাদিগকে পরিষ্কৃত করে, আমার মনে এমত দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাইয়া দেও।

 করুণা স্বীকার করিয়া কহিল, ভাল মেম সাহেব, তাহাই করিব।

 পরে আমি বলিতে লাগিলাম, তোমার গৃহ যেন সুখের স্থান হয়, এই জন্যে আমি তোমাকে আর দুই একটি উপদেশ দিই। তোমার নিজ ব্যবহার পূর্ব্বাপেক্ষা উত্তম হউক, তাহা হইলে যদ্যপিও তোমার স্বামী তাহাতে হঠাৎ মনোযোগ না করে, তথাপি শেষে তাহা দেখিয়া তোমার প্রশংসা অবশ্য করিবে। তুমি সকল প্রকার রাগ ত্যাগ করিয়া ঘরের উচিত কর্ম্ম সকল নির্ব্বাহ কর; এবং প্রেমচাঁদ কর্ম্মহইতে ফিরিয়া আইলে ফুলমণি যেমন তাহার ঘরে পরিবার কাপড় ও হুকা ইত্যাদি প্রস্তুত করিয়া রাখে, তেমনি তুমিও সর্ব্ব প্রকারে আপনার স্বামির সন্তোষ জন্মাইতে চেষ্টা কর। বিশেষতঃ প্রতিদিন পরমেশ্বরের নিকটে প্রার্থনা কর, তিনি যেন তোমাকে এই সকল করিতে সুমতি ও শক্তি দিয়া তোমাদের দুই জনের মন ফিরাইয়া দেন। আহা! ঈশ্বর এই প্রার্থনা শুনিলে তোমরা কেমন সুখে বাস করিবা। নবীন এখন আমার নিকটে প্রায় থাকে, তথাপি সে তোমারি সন্তান, এবং তাহার শিক্ষার বিষয়ে ঈশ্বর তোমার নিকটে হিসাব লইবেন, এই জন্যে তুমি তাহাকে এমত কথা বল; আমি এত দিন পর্য্যন্ত ঈশ্বরকে না জানিয়া তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়াছি, কিন্তু এখন ধর্ম্ম পথে চলিতে ইচ্ছা করি, ও তোমাকেও সেই পথে আনিতে চাহি। নবীন এমত কথা শুনিয়া তোমাকে তুচ্ছ না করিয়া আরও সম্মান করিবে; কেননা খ্রীষ্টিয়ানদের কিরূপ ব্যবহার করা উচিত তাহা সে সুন্দররূপে জ্ঞাত আছে। এই নূতন পথ তোমার পক্ষে প্রথমে কঠিন বোধ হইবে তাহা আমি জানি, তথাপি তাহা ত্যাগ করিও না, বরণ অদ্যাবধি আপন ব্যবহার সুধরাইতে আরম্ভ কর। কি জানি তোমার স্বামী এই সময়ে সুঁড়ির দোকানে মাতাল হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে; কিন্তু তদ্দ্বারা নিরাশ না হইয়া তাহার প্রত্যাগমনের নিমিত্তে সকল দ্রব্য সুন্দর রূপে আয়োজন করিয়া রাখ। তোমার নিকটে খরচের জন্যে টাকা পয়সা কিছু নাই, তাহা আমি জানি, অতএব এই দুইটি টাকা লও; এবং যাবৎ তোমরা দুই জনে সুখে বাস না কর, ও এক সঙ্গে প্রভুর ভজনালয়ে না যাও, তাবৎ আমি তোমাদের জন্যে ঈশ্বরের নিকটে প্রার্থনা করিতে ক্ষান্তা হইব না।

 এই কথা শুনিয়া করুণার মুখ কিছু প্রফুল্ল হইল, কিন্তু পরে সে নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, আহা! এমন সুগতি কি আমার হইবে? আমার গৃহ কি কখন ফুলমণির গৃহের মত হইবে?

 আমি কহিলাম, করুণা, অবশ্য হইতে পারে, কিন্তু এই নিমিত্তে তোমাকে চৌকি দিয়া প্রার্থনা করিতে হইবে। তুমি আপনার মনকে নিত্য২ চৌকি দেও, যেন কোন প্রকারে পাপ তাহাতে প্রবেশ করিতে না পারে; এবং কোন বিপদে পড়িলে ফুলমণির নিকটে গিয়া তাহার পরামর্শ লও, সে তোমাকে অবশ্য সদুপদেশ দিবে।

 এই সকল কথা সাঙ্গ হইবা মাত্র এক জন চৌকিদার নবীনের বাপকে ধরিয়া ঘরে লইয়া আইল। তখন সে অতিশয় মাতাল হইয়া প্রায় অচৈতন্য হইয়াছিল। চৌকিদার করুণাকে বলিল, তোর ভাতারকে লও, গো। আমি না থাকিলে সে এখনি গাড়ীতে চাপা পড়িয়া মরিত। স্বামির অবস্থা দেখিয়া করুণার মুখ রাগেতে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; তাহাতে আমি বলিলাম, সাবধান! করুণা সাবধান, অচৈতন্য মানুষকে অনুযোগ করাতে কোন ফল দর্শিবে না। উহাকে ধীরে২ বিছানাতে শয়ন করাইয়া দেও, এবং প্রাতঃকালেও উহাকে ভর্ৎসনা করিও না।

 আমি সেখানে দাঁড়াইয়া করুণা কি করে তাহা দেখিতে লাগিলাম; তাহাতে সে একখান মাদুর ও কাঁথা ঘরের মধ্যে বিছাইয়া মিষ্ট রবে বলিল, ও গো, এখানে শুইয়া ঘুমাও। করুণার এমত নূতন ব্যবহার দেখিয়া তাহার মাতাল স্বামী তাহাকে কিছু মাত্র চিনিতে না পারিয়া বিছানাতে শুইয়া আপনা আপনি বলিতে লাগিল, এ বেটী বড় ভাল মানুষ, ইহার ঘরে বরাবর আসিব। পরে সে শীঘ্র ঘুমাইয়া পড়িল, তাহাতে করুণা পুনর্ব্বার বাহিরে আসিয়া দাবাতে আমার সহিত কথা কহিতে লাগিল।

 আমি কহিলাম, দেখ, এখন বেলা গেল বটে, তথাপি বোধ করি শীঘ্র বাজারে গেলে কিছু মাছ পাইতে পারিবা, তাহা আনিয়া কল্য তোমার স্বামিকে ভালরূপে খাওয়াও। এবং করুণা, এ সকল কর্ম্মেতে তোমাকে অতি চেষ্টান্বিতা ও অনবরত যত্নবতী হইতে হইবে; তাহা না হইলে একেবারে তুমি উত্তম কর্ম্ম কি প্রকারে করিতে পারিবা? যেমন পূর্ব্বে বলিলাম, উত্তম ব্যবহার করা প্রথমে তোমার অতিশয় কঠিন বোধ হইবে; কিন্তু ভয় নাই, কেবল আপনার দুর্বলতা ও পাপিষ্ঠ স্বভাব মনে রাখিয়া নিত্য২ ঈশ্বরের নিকটে শক্তি ও অনুগ্রহ যাচ্ঞা কর, তাহাতে তিনি অবশ্য তাহা প্রদান করিবেন।

 করুণা কিঞ্চিৎ কাল চিন্তিতা হইয়া রহিল, শেষে সে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আ মেম সাহেব! যদ্যপিও আমি পূর্ব্বাপেক্ষা সদ্ব্যবহারিণী হই, তথাপি নবীনের বাপ ভাল না হইলে আমার ইহকালে কোন প্রকারে সুখ হইবে না।

 আমি উত্তর করিলাম, করুণা, তোমার সদ্ব্যবহার ও মৃদু স্বভাব দেখিয়া বোধ হয় সেও ক্রমে২ ভাল হইতে পারিবে। কিন্তু যদ্যপি এমত সুঘটনা না হয়, তবে কি তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিবা? তুমি ঈশ্বরের সৃষ্ট বস্তু, ইহা মনে রাখিও। অতএব যাহা ঘটে, ঘটুক; ঈশ্বরকে প্রেম ও সেবা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য, ইহা যদি মনে না রাখ, তবে তুমি ধর্মের পথে কিঞ্চিৎ ক্লেশ পাইলে বিরক্তা হইয়া তাহা ত্যাগ করিবা। যাহারা সুখ কি মান কিম্বা আর কোন সাংসারিক বস্তু পাইবার জন্যে সাধুদের পথে চলে, তাহারা যদি সে বস্তু না পায়, তবে নিরাশ হইয়া পূর্ব্বকালীন যিহূদীয়দের ন্যায় বলে, ঈশ্বরের সেবা করা বৃথা, এবং সৈন্যাধ্যক্ষ পরমেশ্বরের আজ্ঞা পালন করাতে ও তাঁহার সম্মুখে শোকাচার করাতে আমাদের লাভ কি? কিন্তু যাহারা ঈশ্বরের বিশেষতঃ তাঁহার পুত্ত্রের প্রতি প্রেম করিয়া সদাচারী হয়, তাহারা কোন আপদ প্রযুক্ত পিছে হাঁটিয়া যায় না; কারণ তাহারা জ্ঞাত আছে, যে ইহকালে যদ্যপি আমরা প্রকাশরূপে লাভ না পাই, তথাপি স্বর্গেতে প্রচুর ধন অবশ্য পাইব।

 করুণা কাঁদিতে২ কহিল, হাঁ মেম সাহেব! এই কথা সত্য বটে। আহা! ঈশ্বর যদি আমার পাপ ক্ষমা করিয়া শেষে আমাকে স্বর্গে লন, তবে এই জগতে দুঃখ পাইলেও কিছু ক্ষতি নাই। আমি অনেক দোষ করিয়াছি তাহা জানি, তথাপি এখন আমার মনে এক প্রকার ভরসা উঠিতেছে, যে ঈশ্বর আমার প্রতি দয়া করিলেও করিতে পারেন। আজি অবধি আমি প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যাকালে তাঁহার নিকটে প্রার্থনা করিব। ও মেম সাহেব, দীনহীন পাপিষ্ঠা যে আমি, আমাকেও যে আপনি শিক্ষা দিয়াছেন, এই কারণ পরমেশ্বর আপনাকে আশীর্ব্বাদ করুন!

 অনন্তর আমি কহিলাম, আইস করুণা, আমরা এখনি হাঁটু পাতিয়া প্রার্থনা করি, যেন প্রভু তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া তোমার চেষ্টা সকল গ্রাহ্য করেন, ও তোমার স্বামির এবং তোমার সন্তানের মনকে পরিবর্ত্ত করান। করুণা কহিল, হাঁ মেম সাহেব, তাহাই করুন; কেননা আমি আপনা আপনি ভাল কর্ম্ম করিতে পারিব না। তখন আমরা উভয়ই হাঁটু গাড়িয়া করুণার যে২ পারমার্থিক দ্রব্যের প্রয়োজন ছিল, তাহা আমি এক২ করিয়া পরমেশ্বরকে জানাইলাম, এবং সেই প্রার্থনা সমাপ্ত হইলে পর করুণা ক্রন্দন করত আর কথা কহিতে পরিল না।

 সে সময়ে প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছিল, অতএব আমি করুণার নিকটে বিদায় হইয়া ঘরে গেলাম। তাহার সহিত সাক্ষাৎ করাতে আমার অন্তঃকরণ উল্লাসিত হইল, কারণ তখন বোধ করিলাম, যে ঈশ্বর ভারি যন্ত্রণাদ্বারা তাহার মনকে আপনার প্রতি আকর্ষণ করাইতে মনস্থ করিয়াছেন, এবং সান্ত্বনা বাক্য কহিবার জন্যে তাহাকে দুঃখরূপ অরণ্যেতে আনিয়াছেন; যেমন এই দেশস্থ এক জন কবি কহিয়াছেন, যথা,

ধার্ম্মিক লোকের এই নিশ্চয়, দুঃখ পাইলে সুখ হয়,
 তাহার সাক্ষী দেখ না, আকাশে।
আগে রাত্রি পিছে দিন, জান সবে তাহার চিন,
 সোণা রূপা অনলে পরশে॥