বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (প্রথম খণ্ড)/ভাগবত/রাধাকৃষ্ণ দাসের ভাগবত

উইকিসংকলন থেকে

রাধাকৃষ্ণ দাসের ভাগবত।

(রচনাকাল ১৯শ শতাব্দী।)

দ্বারকা-বিলাস।

 যে পুথি হইতে এই অংশ উদ্ধৃত হইল তাহা ১০০ বৎসরের ঊর্দ্ধ কালের। এই কবিতার উপরে যে সকল গদ্য হেডিং দেওয়া আছে, তাহাও গ্রন্থকারের রচিত।

নারদগোস্বামী শ্রীকৃষ্ণের নিকটে লক্ষীরূপা রুক্মিণীর প্রসঙ্গ কহেন৷

নারদের স্তবে তুষ্ট হয়ে নারায়ণ।
মুনি প্রতি সাধুবাদ দিলেন তখন॥
ঊভয়ে উভয়ে পেয়ে মনে তুষ্ট অতি।
কহেন শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র নারদের প্রতি॥
কহ কহ গুণাকর দেব-ঋষিবর।
গমনাগমন তব আছে চরাচর॥
দেখিয়াছ মুনিরাজ ইন্দ্র-চন্দ্রলোক।
শিবলোক ব্রহ্মলোক বৈকুণ্ঠ গোলোক॥

স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে গমন তোমার।
হেরিয়াছ রম্য স্থান বিবিধ প্রকার॥
আমিই করেছি পুরী দ্বারকা নামেতে।
কিরূপ হয়েছে শুনি তোমার মুখেতে॥

শ্রীপতির শ্রীমুখেতে শুনে এই বাণী।
উত্তর করেন দেব-ঋষি মহামুনি॥
মুনি বলে শুন হরি সংসারের সার।
তুলনার স্থান-দান নাহি দ্বারকার॥
অতুল্য দ্বারক-পুরী এ তিন ভুবনে।
জনমিয়া হেন স্থান না দেখি নয়নে॥
যথা তুমি আবির্ভাব ত্রিজগৎ-পতি।
সেই সে পরম স্থান প্রশংসিত অতি॥
উত্তম হয়েছে পুরী শুন হে মাধব।
কিন্তু এক বিহীনেতে শ্রীহীন এ সব॥
শুনিয়া বিস্ময় হয়ে কহে বিশ্বম্ভর।
শ্রীহীন কহিলে কেন কহ যোগি-বর॥
এত মণি মুক্তা দিয়ে সাজাএছি পুর।
তথাচ শ্রীহীন কেন কহিলে ঠাকুর॥

মুনি বলে শুন ওহে কমলার পতি।
সামান্য মণিতে কিহে শোভে দ্বারাবতী॥
কত শত মণি মুক্তা প্রবাল কাঞ্চন।
যার কটাক্ষেতে লোক পায় নানা ধন॥
এ হেন কমলা লক্ষ্মী নাহি যার ঘরে।
লক্ষ্মীহীনা দেখি পুরী দুঃখিত অন্তরে॥
সেই দুঃখে দুঃখ বড় হতেছে হে মনে।
লক্ষ্মীহারা হয়ে হরি আছহ কেমনে॥
বিদর্ভ-নগরে ভূপ ভীষ্মক-দুহিতে।
জন্ম লরেছেন লক্ষ্মী রুক্মিণী-রূপেতে॥
বিবাহ করিয়া লক্ষ্মী আন নারায়ণ।
তবে হবে দ্বারকার পরম শোভন॥
কমলাঙ্গী কমলা নাহিক গৃহে যার।
শ্রীবিনে শ্রীহীন তেঁই বলি দ্বারকার॥

কমলার কথা কৃষ্ণ করিয়া শ্রবণ।
সজল হইল দুটি কমল-লোচন॥
কমলা-কারণে নীল-কমল অস্থির।
সুস্থির না মানে মন হইল অস্থির॥
রুক্মিণীর নাম আসি অন্তরে পশিল।
নির্ব্বাণ বিচ্ছেদ-অগ্নি জ্বলন্ত হইল॥
হাসিয়া নারদ প্রতি কহেন গোবিন্দ।
ঘটক হইয়া মুনি করহ সম্বন্ধ॥
আটক কি আছে বলে দেব-ঋষি কয়।
কল্য বিদর্ভেতে গিয়া করএ বিষয়॥
এত বলে দেব-ঋষি হইল বিদায়।
পয়ার প্রবন্ধে রাধাকৃষ্ণ দাস গায়॥

নারদগোস্বামী ভীষ্মক-রাজার নিকট উপস্থিত হইয়া শ্রীকৃষ্ণের সহিত রুক্মিণীর বিবাহের কথা কহেন।

আনন্দে গোবিন্দ-গুণ করিয়া কীর্ত্তন।
বিদর্ভে নারদ মুনি করিলা গমন॥
সভামাঝে ভূপতি বসেছে বার দিয়া।
তথায় নারদ-মুনি উতরিলা গিয়া॥
নিরখিয়া নারদেরে নরেন্দ্র সত্বরে।
সভাসুদ্ধা উঠে রাজা অভ্যর্থনা করে॥
বন্দনা করিয়া রাজা যোগীর চরণ।
পাদ্য অর্ঘ্য পদে শীঘ্র করিলা অর্পণ॥
যোগাইয়া কুশাসন যোগীরে বসায়।
স্বাগত কুশল কথা জিজ্ঞাসেন রায়॥

রাজা বলে মুনি অদ্য মম শুভক্ষণ।
ভাগ্যগুণে দেখিলাম তোমার চরণ॥
ধন জন রাজ্য মোর সফল হইল।
তব দরশনে মনে সন্তোষ বাড়িল॥
মুনি বলে তুমি রাজা ধর্ম্মশীল অতি।
পরম বৈষ্ণব তুমি বিষ্ণুপদে মতি॥
শান্ত দান্ত সুশীল সুধীর গুণধাম।
প্রজার পালনে তুমি অযোধ্যার রাম॥

দেব-দ্বিজ-অনুরক্ত তুমি হে ভূস্বামী।
দেখিলে তোমায় বড় তুষ্ট হই আমি॥
অপরে কহেন মুনি শুন দণ্ডধারী।
শুনেছি তোমার আছে অদত্তা কুমারী॥
পরম-লক্ষণ কন্যা রূপে ধন্যা অতি।
বর পাত্র স্থির কোথা করেছ নৃপতি॥

ভূপ বলে ভাল কথা কহিলে গোসাই।
দুহিতার তুল্যপাত্র দেখিতে না পাই॥
ভুবন-মোহিনী কন্যা কারে করি দান।
কহ কহ যোগি-রাজ ইহার বিধান॥
মুনি বলে শুন হে বিদর্ভ-অধিপতি।
পাইয়াছ যে কন্যা সে অতি ভাগ্যবতী॥
সকল কারণ আমি জেনেছি যোগেতে।
স্বয়ং লক্ষ্মী অবতীর্ণ তোমার গৃহেতে॥
সে কন্যা সামান্য কন্যা নহে নরেশ্বর।
তার তুল্য একমাত্র আছে পাত্রবর॥
যদু-বংশে জন্ম বসুদেবের কুমার।
দ্বারকা-নগরে বাস কৃষ্ণ নাম তার॥
ধনে মানে কুলে শীলে শ্রেষ্ঠ সকলেতে।
শ্রীকৃষ্ণে প্রদান কর আপন দুহিতে॥

শ্রীকৃষ্ণের নাম শুনে নারদের মুখে।
ডুবিল ভীষ্মক ভূপ পরম পুলকে॥
রাজা বলে হেন দিন হবে কি গোসাই।
জগৎ-পতি কৃষ্ণ হবে আমার জামাই॥
যার নাম করে জীব ভব পার হয়।
সে কৃষ্ণ জামাতা হলে যমের কি ভয়॥
মূঢ়মতি আমি অতি কুমতি কুজ্ঞান।
হবে কি আমায় হরি করিবেন ত্রাণ॥
মুনি বলে যবে তব হয়েছে কুমারী।
তখনি জামাতা কৃষ্ণ হয়েছে তোমারি॥
শুন শুন মহীপতি বলিহে তোমারে।
নারায়ণ বিনা লক্ষ্মী কে লইতে পারে॥



জন্ম জন্ম কত পুণ্য করেছ রাজন।
সেই ফলে লাভ হল লক্ষ্মী-নারায়ণ॥
অতঃপর বিলম্বেতে নাহি কিছু কায।
লগ্ন পত্র দিন স্থির কর মহারাজ॥
এত বলি মুনিরাজ হইল বিদায়।
দ্বারকা-বিলাস রাধাকৃষ্ণ দাসে গায়॥

রুক্মিণীর জনৈক সখী শ্রীকৃষ্ণের কথা শ্রবণ করিয়া রুক্মিণীর নিকটে কহেন॥

রাজার সভায় শুনে কৃষ্ণের প্রসঙ্গ।
কোন সখী রুক্মিণীরে কহে করি রঙ্গ॥
শুন ওগো রাজসুতা ঠাকুর কুমারী।
অতঃপর বিধি বিভা ঘটালে তোমারি॥
এতদিনে ভগবতী হৈল অনুকূল।
ফুটাইল প্রজাপতি বিবাহের ফুল॥
আসিয়া নারদমুনি রাজার সভায়।
সম্বন্ধ নির্ব্বন্ধ কথা কহিল রাজায়॥
রূপবতী ওগো সতি আপনি যেমন।
কৃষ্ণ নামে শ্রেষ্ঠ রূপে কে আছে একজন॥
তার সঙ্গে হল তব সম্বন্ধ নির্ব্বাহ।
সেই বরে নৃপবর দিবেন বিবাহ॥
যেরূপ কহিল কথা নারদ গোসাই।
তার তুল্য পুরুষেতে সুপুরুষ নাই॥
প্রসন্ন হএছে বিধি তোমার উপর।
ভাল হল ঘটে গেল মনোমত বর॥
কৃষ্ণ নাম শুনে দেবী সখীর মুখেতে।
ডুবিল ভীষ্মক-সুতা পুলক রসেতে॥
মনে মনে ভাবে দেবী হেন ভাগ্য হবে।
পূরাইব মন-সাধ পাইব মাধবে॥

দাসী বলে শ্রীকৃষ্ণ কি রাখিবে চরণে।
সাজাইব সেই পদ তুলসী-চন্দনে॥
এত ভাবি আখি-পদ্মে প্রেম-অশ্রু বয়।
কৃষ্ণ নাম শুনে হৃদ্‌পদ্ম প্রকাশয়॥

মানসে সঁপিল দেবী কৃষ্ণ-পদে মন।
মনে মনে মাধবেরে করিলা বরণ॥
উদ্দেশে কৃষ্ণের প্রতি কহেন রুক্মিণী।
দেখ কৃষ্ণ দয়া কর দেখিয়া দুঃখিনী॥
নাম শুনে শ্রীচরণে সপিলাম প্রাণ।
ভেবে দাসী কাল শশী কর কৃপা দান॥
এত ভাবি অশ্রুজলে নয়ন পূরিল।
কৃষ্ণনাম-রূপ অশ্রু অন্তরে পশিল॥
রুক্মিণীর ভাব দেখে কোন সখী কয়।
শুভকর্ম্ম শুনে মাগো কান্না ভাল নয়॥
বিবাহ শ্রবণে নারী হয় হৃষ্ট মন।
তোমার বিরস ভাব এ আর কেমন॥
আর সখী বলে সখী তা নয় তা নয়।
হয়েছে বয়স্থাকাল বিবাহ না হয়॥
সেই জন্য রাজ-কন্যা দুঃখিতা অন্তরে।
গলে সুধা দিলে ক্ষুধা তৃপ্ত নাহি করে॥
হেন রূপে সখী সবে রঙ্গ আরম্ভিল।
রাধাকৃষ্ণ দাস দ্বিজ ভাষায় রচিল॥

রুক্মিণীর বিবাহ-কারণ ভীষ্মক-রাজার স্বীয় পুত্ত্রের সহিত পরামর্শ।

কহেন বিদর্ভপতি আপন অপত্য প্রতি
শুন বাছা রুক্মী গুণাকর।
তব ভগ্নী মম কন্যা রুক্মিণী রূপেতে ধন্যা
তার জন্যে চিন্তিত অন্তর॥
কন্যাকাল হল তার তুল্যপাত্র পাওয়া ভার
রুক্মিণীরে কারে করি দান।
রূপে গুণে কুলে শীলে হেন পাত্র নাহি মিলে
কি করিব ইহার বিধান॥
শুন শুন বাছা ধন অদ্যকার বিবরণ
হয়েছিল নারদ-আগমন।
বিবাহের কথা যত করিলাম অবগত
শুনিয়া কহিল তপোধন॥



রুক্মিণী লক্ষ্মী-রূপিণী নহে সামান্য কামিনী
এ কন্যার পতি-যোগ্য বর।
ভূমণ্ডলে পাওয়া ভার কৃষ্ণচন্দ্র বিনা আর
বসুদেব-পুত্ত্র গুণাকর॥

নিরমল যদু-কুল তাহে শ্রীকৃষ্ণ অতুল
অনুকূল হলে ভগবান।
কৃষ্ণে করি কন্যা দান বাড়াব কুলের মান
চরণে চরমে পাব স্থান॥
সামান্য পুরুষ নয় সেই কৃষ্ণ বিশ্বময়
বেদে বলে সংসারের সার।
জামাতা করিয়া তারে কাঁটা দিব যম-দ্বারে
ভবে ফিরে আসিব না আর॥
সেই কন্যা-তুল্য বর বুঝ রাজা তবান্তর
তবে লগ্ন পত্র করি স্থির।
যেমন মম নন্দিনী জামাতা হইলে তিনি
তবে ঘুচে মনের তিমির॥

কৃষ্ণের পরম শত্রু দুষ্ট রুক্মী রাজ-পুত্ত্র
হরি নাম করিয়া শ্রবণ।
শ্রবণেতে দিয়া কর কহে একি নরেশ্বর
কটূত্তর কহিলে বচন॥
নারদের মন্ত্রণায় একি তব ভ্রান্তি রায়
কৃষ্ণে কন্যা দিতে চাহ দান।
করিলে এমত কায লজ্জা পাবে মহারাজ
হইবে কুলের অপমান॥
তব সুতা সে রুক্মিণী আমার কনিষ্ঠ ভগ্নী
-গোপ-সুতে করিলে অর্পণ।
কুল-ধর্ম্ম দূর হবে রাজাগণে কুচ্ছা[১] কবে
চল্‌তে হবে নোয়াএ বদন॥
কি কহিব নারদায় এ কথা কৈলে আমায়
সমুচিত করিতাম তার।

ক্ষান্ত হও মহারাজ কর না কুৎসিত কায
রুক্মিণীর পাত্র আছে আর॥
রাধাকৃষ্ণ রাঙ্গা পায় বিক্রীত করিয়া কায়
মনে ভেবে যুগল-চরণ।
সেই রাধাকৃষ্ণ দাস এই দ্বারকা-বিলাস
সুভাষায় করিল রচন॥

যুবরাজ রুক্মীর শ্রীকৃষ্ণ-নিন্দা।

রুক্মী কহে ওগো তাত করহ শ্রবণ।
কৃষ্ণের কুলজী কই গুন দিয়া মন॥
শুনেছ গোকুল-গ্রামে আহীর[২] একজন।
নন্দঘোষ নাম ধরে করে গোচারণ॥
যেই কৃষ্ণে শ্রেষ্ঠ বলে নষ্ট লোকে গণে।
স্পষ্ট সেত নন্দ-সুত রাষ্ট[৩] জগজনে॥
নীচ মধ্যে গণি তারে গোপ-কুলে জন্ম।
রাখালি ঘেটালি করে বেড়ায় আজন্ম॥
কৃষ্ণের বিনষ্ট কর্ম্ম কৈতে অঙ্গ জ্বলে।
গোকুলে গোয়ালা-বধূ হরে ছলে বলে॥
চৌর্য্যকার্য্যে সেই কৃষ্ণ অতি চমৎকার।
চুরি করে ননী খেত গোপ-গোপিকার॥
গোপ-কুলে জাতি-কুল করিল নির্ম্মল।
কৃষ্ণ সম কষ্টদাতা দিতে নাহি তুল॥
রাখালের অগ্রগণ্য মান্য গোয়ালার।
ক্ষিতিতলে ক্ষেত্রি-দলে গণ্য নহে তার॥
বীরত্ব মহত্ব তার পেয়েছে প্রকাশ।
জরাসন্ধ-শঙ্কাতে করিল সিন্ধু-বাস॥
বিন্দুবৎ বলবুদ্ধি নাহি তার ঘটে।
কপট লম্পটতায় পটু ভাল বটে॥

ধর্ম্ম কর্ম্ম নাহি মানে পর-হিংসা করে।
বিনি অপরাধে বধে কংস নৃপবরে॥
দেখ দেখ মহারাজ কৃষ্ণের কুকর্ম্ম।
গোকুলে স্ত্রীহত্যা আদি করেছে আজন্ম॥

লোকে বলে কৃষ্ণ বসুদেবের কুমার।
সে সম্পর্কে কংসরাজা মাতুল তাহার॥
মাতৃ-ভ্রাতা মাতুল পরম গুরুজন।
ধন জন্য গুরু-বধ করিল দুর্জ্জন॥
এমন পাপিষ্ঠ কৃষ্ণ দুষ্ট কদাচারী।
কতগুলা মূর্খলোক ব্যাখ্যা করে তারি॥
বলিতে বলিতে রুক্মী ক্রোধে হুতাশন।
দুই চক্ষু হৈল যেন মধ্যাহ্ন-তপন॥
তর্জ্জন-গর্জ্জনে রুক্মী পিতা প্রতি কয়।
রুক্মিণীর তুল্য পাত্র আছে মহাশয়॥
আপনি দেখিয়া আমি সম্বন্ধ করিব।
ধনী মানী বীর দেখে রুক্মিণীরে দিব॥
চিন্তা ত্যজ মহীপতি ভেব না অন্তরে।
সম্বন্ধ করিতে আমি চলিগো সত্বরে॥
এত বলি যুবরাজ করিল গমন।
দেশ দেশান্তরে বর করে অন্বেষণ॥
রাধাকৃষ্ণ দাস বলে দোষ নাই আমার।
স্তুতি নিন্দা নারায়ণ সমান তোমার॥

যুবরাজ শিশুপালের সহিত রুক্মিণীর সম্বন্ধ করেন।

হেন মতে রাজপুত্ত্র ভীষ্মক-নন্দন।
দমঘোষ-গৃহে রুক্মী করিলা গমন॥
রুক্মীরে দেখিয়া দমঘোষ রাজ্য-পতি।
আইস আইস বলে করে অভ্যর্থনা অতি॥
তবে বাপু আছ সুখে রাজ্যের কুশল।
রুক্মী কহে আশীর্ব্বাদে কুশল মঙ্গল॥
দমঘোষ বলে বাছা কহ বিবরণ।
কি লাগিয়া এ পর্য্যন্ত হল আগমন॥
রাজপুত্ত্র বলে কিছু প্রয়োজন আছে।
সেই জন্য আগমন আপনার কাছে॥
অদত্তা কনিষ্ঠা এক আছএ আমারি।
উপযুক্ত বর পাত্র না পাই তাহারি॥
অতএব অন্তরে করেছি অনুমান।
তব সুত শিশুপালে ভগ্নী দিব দান॥

সর্ব্বাংশে সুন্দর তব পুত্ত্র শিশুপাল।
ধনে মানে কুলে শীলে বিক্রমে বিশাল॥
অনুমতি ইথে যদি করহ আপনি।
লগ্ন পত্র লেখাপড়া করিগো এখনি॥

এত শুনি দমঘোষ সন্তোষ অন্তর।
হেসেও সে বলে এত করণীয় ঘর॥
অকর্ত্তব্য নহে ইহা কর্ত্তব্য নিশ্চয়।
বিদর্ভেতে কুটুম্বিতে সুখের বিষয়॥
এত শুনি রুক্মী অতি প্রফুল্লিত মন।
লগ্নপত্র নিধার্য্য করিল ততক্ষণ॥
পণ গণ দান আদি নিল্লয়[৪] হইল।
মিষ্টান্ন সন্দেশ রুক্মী বহু বিলাইল॥
সুখ-যুত রাজ-সুত আসিয়া স্বস্থানে।
সমুদয় কহে নিজ পিতা-বিদ্যমানে॥

শ্রবণে বিদর্ভপতি অতি দুঃখ-মন।
কুরব[৫] শ্রবণে রায় নীরব বদন॥
মনে মনে বলে কৃষ্ণ তুমি ইচ্ছাময়।
মম ইচ্ছা পূর্ণ কর হইয়া সদয়॥
বাসনা তোমায় আমি করি কন্যাদান।
সে সুখেতে দুঃখ দেয় মূর্খ কুসন্তান॥
নিজে বৃদ্ধ অশক্ত অপত্য ভাল নয়।
মম সত্য পূর্ণ কর হইয়া সদয়॥
এত ভাবি মহীপতি মৌনেতে থাকিল।
রুক্মী গিয়া অন্তঃপুরে রাণীরে কহিল॥
কল্য মাতা ছয় দণ্ড পরে শুভক্ষণ।
রুক্মিণীর গাত্রে কর হরিদ্রা-লেপন॥
শিশুপাল-সঙ্গে হল সম্বন্ধ নির্ব্বাহ।
পরদিনে গোধূলিতে হইবে বিবাহ॥
এত শুনি রাজরাণী তুষ্ট অতিশয়।
পয়ার প্রবন্ধে রাধাকৃষ্ণ দাস কয়॥

রুক্মিণীর জনৈক দাসী শিশুপাল-সহিত সম্বন্ধ শুনিয়া রুক্মিণীর নিকট কহেন।

রাণীর মহলে এত করিয়া শ্রবণ।
কোন সখী রুক্মিণীরে কহিছে তখন॥
শুভ সমাচার শুন ঠাকুর কুমারী।
আজি কালি মধ্যে বিভা ঘটাবে তোমারি॥
মিলেছে কুলীন বর অতি চমৎকার।
ঠাকুর জামাই পাল ঘোষের কুমার॥
বড়ই সুন্দর বর শিশুপাল নাম।
সুখেতে পূরাও দেবি নিজ মনস্কাম॥
শিশুপালের কথা শুনে সখীর বদনে।
করে আচ্ছাদিল দেবী যুগল-নয়নে॥
চিন্তিতা হইলা মনে অচিন্ত্যরূপিণী।
মনে মনে বলে রক্ষা কর চিন্তামণি॥
দাসী বলে পীতাম্বর দেহ পদাশ্রয়।
দূর কর শিশুপালে হও হে সদয়॥
তোমা ভিন্ন অন্য মতি নাহিক আমার।
দুঃখিনীরে দুঃখ-নীরে কর কৃষ্ণ পার॥
বাঞ্ছা-কল্পতরু তুমি বেদাগমে বলে।
মম বাঞ্ছা পূর্ণ কর রাখ পদতলে॥

এত বলি মৌনে রহে ভীষ্মক-নন্দিনী।
কাণাকাণি করে দেখে যতেক সঙ্গিনী॥
কেহ কহে ওমা ওমা এ আর কেমন।
বিবাহের নামে কেন বিরস বদন॥
বিবাহ শ্রবণে নারী হয় আনন্দিতা।
হর্ষযুতা ঠাকুরাণী হলে যে দুঃখিতা॥
কোন সখী বলে সখী তা নয় তা নয়।
বিবাহের নামেতে অমন লজ্জা হয়॥
নির্লজ্জ কহিবে লোকে সলজ্জ না হলে।
সেই হেতু মুখে লাজ মন রসে টলে॥
কোন সখী বলে ভাব বুঝেছি অন্তরে।
শিশুপালে ঠাকুরঝীর মনে নাহি ধরে॥

মনে মনে কারে বুঝি সঁপেছেন মন।
সেই ভাবে রাজবালা সচঞ্চল মন॥
হেন রূপে রঙ্গ করে যত সখীগণে।
দ্বারকা-বিলাস রাধাকৃষ্ণ দাসে ভণে॥

রুক্মিণীর গাত্রহরিদ্রা।

হয়ে আনন্দিতা ভীষ্মক-বনিতা
স্থির করি শুভক্ষণ।
মহা আনন্দেতে কন্যার অঙ্গেতে
করে হরিদ্রা লেপন॥
প্রতিবাসিগণ পায়্যা নিমন্ত্রণ
হয়ে সভে আনন্দিতা।
ভূপতি-ভবনে চলে রামাগণে
ভূষণে হয়ে ভূষিতা॥
যত নারীগণে গজেন্দ্র-গমনে
নিমন্ত্রণে সুখে যায়।
মধুর বচনে যত রামাগণে
রাণী বিনয় জানায়॥

গিন্নীবান্নী যারা সভে মেলে তারা
করে মঙ্গল আচরণ।
সুখে কোন ধনী করে শঙ্খ-ধ্বনি
উল্লসিত নারীগণ॥
যত কুল-বালা আনন্দে বিভোলা
কমলা লইঞা রঙ্গে।
হুলু হুলু দিয়া হরিদ্রা লইয়া
পরশে রুক্মিণীর অঙ্গে॥
পুলকিতা হয়ে গন্ধ-তৈল লয়ে
মাখাইল অঙ্গময়।
তাহাতে রুক্মিণী বিশেষ দুঃখিনী
বিষ-প্রায় জ্ঞান হয়॥
পরে যত মেয়ে দেবীরে লইয়ে
বসায়ে কদলীতলে।

পরম যতনে জাহ্নবী-জীবনে
নাওয়াইল কুতূহলে॥
বিচিত্র বসন পরায় তখন
কাঁচলি বিজলী-প্রায়।
বিনাইয়া কেশ করিল বিন্যাস
কুসুম শোভিত তায়॥
কনকে বেষ্টিত রতনে জড়িত
মণিময় আভরণ।
রুক্মিণীর অঙ্গে পরাইল রঙ্গে
যেথা সাজে যেমন॥
আখি নীলোৎপল তাহাতে কজ্জল
উজ্জ্বল করিয়া দিল।
কোন স্ত্রী রসিকা চন্দন-কলিকা
নাসিকায় প্রকাশিল॥
অতি চমৎকার মালতীর হার
পরায়ে দিল গলেতে।
এস মা রুক্সিণি বলে নাপিতিনী
অলক্ত দিল পদেতে॥
একে দুটি পদ জিনি কোকনদ
অলক্ত পরিল তায়।
শোভিল এমন প্রভাত-তপন
উদিত যেন দু পায়॥
একান্ত মনেতে গুর-চরণেতে
সমর্পণ করি মন।
রাধাকৃষ্ণ দাস দ্বারকা-বিলাস
ভাষাতে করে রচন॥

কৃষ্ণের উদ্দেশে রুক্মিণী স্তব করেন।

দেবী রুক্মিণী দুঃখিনী হয়ে মনে।
বলে হে হরি হে মরি হে জীবনে॥
আমি কৃষ্ণ-প্রাণী সদা কৃষ্ণে মতি।
করুণা কর কিঞ্চিৎ দীন-পতি॥

তার বিপদে শ্রীপদে ভিক্ষা করি।
রাখ দাসীজনে দীন-বন্ধু হরি॥
জেনে অসীম মহিমা ও নামেতে।
প্রাণ সঁপেছি হে তোমার প্রেমেতে॥
নাহি অন্য গতি তোমা ভিন্ন হরি।
যদি না তার হে তবে প্রাণে মরি॥
হে শ্রীকান্ত নিতান্ত অধিনী বলে।
দেহ কৃপাবারি মনোদুঃখানলে॥
তোমা বিহনে স্বপনে নাহি জানি।
দুঃখে ত্রাহি মে ত্রাহি মে চক্রপাণি॥
শুনি ভক্তজনে তুমি হিতকারী।
ভাবি ভক্তিভাবে তার হে মুরারি॥
আমি নিশ্চিত বিক্রীত শ্রীপদেতে।
কর পূর্ণ আশা মরি দুর্গমেতে॥
কৃপা-সিন্ধু তুমি পুরাণে শুনেছি।
যতনে চরণে শরণ লয়েছি॥
কর হিত উচিত হে বংশীধারী।
শরণাগত হে আমি যে তোমারি॥
রাধাকৃষ্ণ দাসে বিনয়েতে ভাষে।
হরি তার হে তার হে দীন দাসে॥

রুক্মিণী পত্র লিখিয়া দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের নিকটে প্রেরণ করেন।

হেনরূপে ভাবান্তর ভীষ্মক-দুহিতা।
লক্ষ্মীকান্ত বিনে লক্ষ্মী অন্তরে দুঃখিতা॥
কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান কৃষ্ণ নাম সার।
কৃষ্ণ ভিন্ন অন্য মনে ধরে না যে আর॥
চিন্তামণি বিনা দেবী চিন্তাযুক্ত মনে।
কিরূপে পাইব কৃষ্ণ আখির অঞ্জনে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া যুক্তি করিলা নিশ্চিত।
আত্মপত্র দ্বারকায় পাঠান উচিত॥
কারে পাঠাইব তথা কে আছে এমন।
গোপনে লইয়া লিপি যাবে কোন্‌ জন॥



এরূপে অচিন্তাময়ী অন্তরে চিন্তিয়া।
প্রতিবাসী এক দ্বিজে আনে ডাকাইয়া॥
সমুদায় বিবরণ কয়্যে দ্বিজবরে।
কান্দে দেবী ব্রাহ্মণের দুটি পদে ধরে॥
গদগদ ভাষে দেবী প্রীতি করে কয়।
এক উপকার কর দ্বিজ মহাশয়॥
একবার দ্বারকায় যাইতে হইবে।
আমার এই পত্রখানি কৃষ্ণেরে সঁপিবে॥
বহু পুরস্কার কৃষ্ণ করিবে তোমায়।
জন্মের মত আমি তব বিকাইব পায়॥
ধনের প্রসঙ্গ শুনে নির্দ্ধন ব্রাহ্মণ।
বলে মা অবশ্য তথা করিব গমন॥
রাখিব তোমার বাক্য দ্বারকায় যাব।
তব হিত করে ধন সমুচিত পাব॥
এত শুনি রুক্মিণী হইয়া তুষ্ট-মন।
পত্রমধ্যে লিখিলেন আত্ম-বিবরণ॥
সংগোপনে সেই পত্র ব্রাহ্মণে সঁপিল।
পত্র লয়ে দ্বিজবর দ্বারকা চলিল॥
দিবা রাত্রি যায় দ্বিজ বিশ্রাম না করে।
অপরেতে উত্তরিল দ্বারকা-নগরে॥

দেখি দ্বারকার শোভা চমকে ব্রাহ্মণ।
কোন স্থানে আইলাম ভাবয়ে তখন॥
শুনেছি অমরাবতী ইন্দ্রের আলয়।
সেই বুঝি এই স্থান হইবে নিশ্চয়॥
কিম্বা ব্রহ্মলোক হবে ব্রহ্মার আবাস।
অথবা বৈকুণ্ঠ কিম্বা শিবের কৈলাস॥
পৃথিবীতে নানা রাজ্য করেছি ভ্রমণ।
কুত্রাপি এমন স্থান করিনে দর্শন॥
ধন্য ধন্য কৃষ্ণচন্দ্র বড় ধনী বটে।
বহু অর্থ পাব আমি কৃষ্ণের নিকটে॥

এত বলি পুব-মধ্যে করিল গমন।
দ্বিজ দেখি প্রণতি করেন নারায়ণ॥

মিষ্ট বাক্য কৃষ্ণচন্দ্র দ্বিজ প্রতি কয়।
কোথা হৈতে আইলেন দ্বিজ মহাশয়॥
বিপ্র বলে বাস করি বিদর্ভ-নগরে।
পত্র লয়ে আসিয়াছি কৃষ্ণের গোচরে॥
অনুভাবে বুঝি কৃষ্ণ হইবে আপনি।
আসিয়াছি দিতে তোমায় এই পত্রখানি॥
কৃষ্ণ বলে আমি কৃষ্ণ শুনহে ব্রাহ্মণ।
প্রদান করহ পত্র পড়ি বিবরণ॥
শুনিয়া ব্রাহ্মণ কৃষ্ণ-হস্তে পত্র দিল।
রুক্মিণীর পত্র হরি পড়িয়া বুঝিল॥
পাইয়া পবিত্র পত্র কৃষ্ণ পুলকিত।
পয়ার প্রবন্ধে দ্বিজ করিল রচিত॥

কৃষ্ণের বিদর্ভে যাত্রা।

যাইতে বিদর্ভ-রাজ্যে কৃষ্ণ কৃপাবান্‌।
আজ্ঞা দিলা সারথিরে সাজাতে বিমান॥
শ্রীমুখের আজ্ঞা শুনে দ্বারুক সত্বরে।
যতনে গরুড়-ধ্বজ রথ সজ্জা করে॥
পবন-গমন অশ্ব রথেতে যুড়িল।
গদা খড়্গ ধনু অস্ত্র রথেতে তুলিল।
অপরেতে সুসজ্জিত হয়্যে নারায়ণ।
চক্রোপরি চক্রধারী উঠিলা তখন॥
ব্রাহ্মণে সঙ্গেতে করি যতনে লইল।
রঙ্গেতে ত্রিভঙ্গ শ্যাম বিদর্ভে চলিল॥
দারুক চালায় অশ্ব পবন-সমান।
চকিতে আকাশ-পথে উঠে রথখান॥
দেখিয়া দ্বিজের মনে ত্রাস উপজিল।
হাতে হৈতে জল-পাত্র অমনি পড়িল॥
কান্দিয়া ব্রাহ্মণ বলে হল সর্ব্বনাশ।
লভ্য যাকু পূর্ব্ব ধন হইল বিনাশ॥
কৃষ্ণের নিকটে না মিলিল কড়া কড়ি।
পৈত্রিক বিষয় গেল আসি রড়ারড়ি[৬]
এত ভাবি কহে দ্বিজ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি।



এত ভাবি কহে দ্বিজ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি।
ওহে কৃষ্ণ রাখ রথ করিহে মিনতি[৭]
উঠিয়া তোমার রথে প্রমাদ ঘটিল।
পূর্ব্ব ধন জল-পাত্র মাটীতে পড়িল॥
তুমিত আমার হস্তে বহু ধন দিলে।
সঞ্চিত ধনেতে শেষ বঞ্চিত করিলে॥
কি আশ্চর্য্য এ ঐশ্বর্য্য বহুমূল্য ধন।
কিছু ব্যয় নাই মাত্র মধুর বচন॥
ভাগ্যবন্ত দয়াবন্ত জান্তে বাকি নাই।
জলপাত্র তুলি দেও ফিরে ঘরে যাই॥
ব্রাহ্মণের বাক্যে কৃষ্ণ লজ্জিত হইল।
রাথ রথ সারথিরে কহিতে লাগিল॥
শুনে সুত বলে যথা পাত্রটি পড়িল।
তথা হৈতে রথ এক যোজন আইল॥
ছাড়াইয়া চারি কোশ আগে এল রথ।
ফিরে যাওয়া এখন আর ভার এত পথ॥
সে উত্তর দ্বিজবর শ্রবণ করিয়া।
বলে আমি রথ হইতে পড়ি ঝাপ দিয়া॥
অতি ভ্রান্ত ব্রাহ্মণের অতি ভ্রান্ত মন।
তুচ্ছ ধনে বাসনা ত্যজিয়া কৃষ্ণধন॥
ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ দিতে সাধ্য যার।
সামান্য লাগিয়া তারে করে তিরস্কার॥

হাসিয়া কহেন কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের প্রতি।
স্থিরচিত্ত হও মনে বিপ্র মহামতি॥
ধনের জন্যেতে তুমি হওনা দুঃখিত।
তুষিব তোমার চিত্ত্য দিয়া সমুচিত॥
চল আগে বিদর্ভেতে করিহে গমন।
কষ্ট যাবে তুষ্ট হবে পাবে বহু ধন॥
এত বলি প্রবোধিয়া দরিদ্র ব্রাহ্মণে।
বিদর্ভে চলিলা হরি রুক্মিণী-হরণে॥
রাধাকৃষ্ণ-পাদপদ্ম হৃদে করি আশ।
দ্বিজবর বিরচিল দ্বারকা-বিলাস॥

শ্রীকৃষ্ণের বিদর্ভে গমন।

হেনরূপে হৃষীকেশ বেড়াইয়া নানা দেশ
উত্তরিয়া বিদর্ভ-নগরে।
থাকি অতি সংগোপনে বার্ত্তা দিতে প্রিয়াজনে
পাঠাইলা উক্ত দ্বিজবরে॥
হরিষে বিষাদ মন হয়্যে চলিল ব্রাহ্মণ
যেখানেতে ভীষ্মক-নন্দিনী।
নিরক্ষিয়া সে ব্রাহ্মণে কমলা প্রফুল্ল মনে
প্রণমিয়া কহেন রুক্মিণী॥
কহ দ্বিজ মহাশয় গিএছিলে যে আশয়
সে বিষয় হল কি সুসার।
কি হইল মম পক্ষে কি উত্তর কৃষ্ণ-পক্ষে
প্রাণ-রক্ষে হবে কি আমার॥

দ্বিজ বলে রাজকন্যা আমারে হৈয় না দৈন্যা
কালী তব কুশল করেছে।
পাঠাইয়েছিলে যত্র যারে লিখিছিলে পত্র
সেই কৃষ্ণ বিদর্ভে এসেছে॥
এত শুনি দ্বিজমুখে শ্রবণ জুড়ায় সুখে
সুসংবাদ করিয়া শ্রবণ।
আনন্দে অঙ্গ অবশ উপজিল প্রেমরস
নিভিল বিচ্ছেদ-হুতাশন॥

দেবী অতি তুষ্ট মনে বিনয়ে কহে ব্রাহ্মণে
ওহে দ্বিজ যে কর্ম্ম করিলে।
কি দিব সামান্য ধন জন্মের মত হে ব্রাহ্মণ
বিনি মূলে আমারে কিনিলে॥
দ্বিজ বলে একি দায় তুল্য দেখি দুজনায়
তিনিও বলেন ঐ কথা।
একি জ্বালা ভাবি তাই দেওয়া থোয়া কারু নাই
মধুর বচন মাত্র বৃথা॥
এত ভাবি দুঃখ-মনে ব্রাহ্মণ চলে ভবনে
ওখানেতে শুন চমৎকার।

লক্ষ্মী দিয়াছেন বর ঘুচেছে পত্রিকা-ঘর
মনোহর হয়েছে আগার॥
দ্বিজের বনিতা যিনি ভূষণে ভূষিতা তিনি
দাস দাসী হয়েছে বিস্তর।
না দেখিয়া নিজ-ভর্ত্তা দুঃখে ব্রাহ্মণী উন্মত্তা
কোথা কর্ত্তা বলে নিরন্তর॥
হেন কালে দ্বিজবর না দেখিয়া নিজ-ঘর
প্রতিবাসিগণে জিজ্ঞাসয়।
মম গৃহ কি হইল ব্রাহ্মণী কোথায় গেল
কে লইল আমার বিষয়॥
রাধাকৃষ্ণ-রাঙ্গা-পায় বিক্রীত করিয়া কায়
মনে ভেবে যুগল-চরণ।
সেই রাধাকৃষ্ণ দাস এই দ্বারকা বিলাস
পদ্যমতে করিল রচন॥

ব্রাহ্মণীর সহিত ব্রাহ্মণের পরিচয়।

 ব্রাহ্মণ আপন ভবন অন্বেষণ না পাইয়া অত্যন্ত অশান্ত-ভ্রান্তযুক্ত হইয়া নগর-পথে ভ্রমণ করিবাতে ভগবদিচ্ছায় ঐ ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণী বসন ভূষণ পরিধান পূর্ব্বক দাসীগণ সমভিব্যাহারে অট্টালিকার উপরিভাগে আরোহণ পূর্ব্বক স্বপতি অভাবে ঐ সতী অতি সকাতরা হইয়া পতির জন্যে দুঃখান্তঃকরণে রাজপথ বিলক্ষণরূপে নিরীক্ষণ করিতেছেন। এমত কালে আপন ভর্ত্তা ব্রাহ্মণকে সন্দর্শন করিয়া অত্যন্ত হর্ষ পূর্ব্বক জনৈক দাসীকে কহিলেন—হে দাসী ঐ ব্রাহ্মণকে আমার নিকটে ডাকিয়া আন। যে আজ্ঞা বলিয়া দাসী ত্বরিত গমনে দ্বিজ-সন্নিধানে আগমন পূর্ব্বক বিনয় বাক্যের দ্বারায় ব্রাহ্মণের প্রতি কহিতেছেন—হে ঠাকুর মহাশয় আমাদিগের কর্ত্রী ঠাকুরাণী আপনাকে স্মরণ করিয়াছেন। ব্রাহ্মণ কহিল হে দাসী আমি ভিক্ষুক দরিদ্র নির্ধন ব্রাহ্মণ আমাকে তোমার ঠাকুরাণীর কি প্রয়োজন। দেখিতে পাই তুমি ভাগ্যবন্ত ব্যক্তির বাটীতে থাক এবং ভাগ্যবতী নারীর প্রেরিতা আমি কি ভরসায় নারীর কথায় যাই, তথাপি দাসী সে সমস্ত কথা অন্যথা করিয়া ব্রাহ্মণের করগ্রহণ পূর্ব্বক বাটীর মধ্যে লইয়া গেল। ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণকে অবলোকন করিয়া হাস্য বদনে পতির চরণে শিরঃ সংস্থাপন করিবাতে ব্রাহ্মণের আশীর্ব্বাদ—এস বাছা পুত্ত্রবতী ভব। ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণের কুরব শ্রবণে লজ্জিতা হইয়া বলে সে আবার কি কথা, চিনিতে বুঝি পার না, আমি যে তোমার ব্রাহ্মণী। ব্রাহ্মণ বলিল যদ্যপি তুই আমার ব্রাহ্মণী তবে কিরূপে এরূপ বিভব প্রাপ্ত হইয়াছিস এবং নানারূপ মণি মাণিক্য রজত কাঞ্চন বসন ভূষণ অপূর্ব্ব ভবন কার দ্বারায় সঞ্চয় করিয়াছিস, অনুমান করি কএক দিবস বাটীতে না থাকাতে আমাকে তুচ্ছ বোধ করিয়া  * * * * * । ব্রাহ্মণী কহিল হে স্বামিন্‌ আপনি শিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তি হইআ নষ্ট লোকের ন্যায় দুষ্ট কথা কহিবেন না, আমি পতিব্রতা পতিভক্তা পতি-প্রেমাসক্তা। নিজ ভর্ত্তা ভিন্ন অন্য পুরুষ পরেশ হইলেও দর্শন বা স্পর্শন করি না। তবে যেরূপে এরূপ বিষয় প্রাপ্ত হইয়াছি তাহা কহি শ্রবণ কর—গত রাত্রে পূর্ব্ব পত্র-কুটীর-মধ্যে শয়নে থাকিয়া সুস্বপ্ন সন্দর্শন করিয়াছি—যেন জনৈক ভুবনমোহিনী গৌরাঙ্গী কমলাসনা কমল-বদনা কমল-নয়না আমার শিয়রে বসিয়া বলিতে লাগিলেন—ওগো ব্রাহ্মণী তোমার ব্রাহ্মণের গুণে আমি কমলা বাধিত হওত অচলা হইয়া তোমার গৃহে চিরবাস করিলাম, এই স্বপ্নভঙ্গে আশ্চর্য্য ঐশ্বর্য্য দেখিয়া চমৎকার জ্ঞান করিয়াছি। ব্রাহ্মণী এই কথা কহিবাতে ব্রাহ্মণের কোন মতে বিশ্বাস হইল না। পরে দৈববাণী শ্রবণে বিপ্র বিশ্বাস মানিয়া স্বনারীর কর গ্রহণান্তর স্বর্ণময় পুরীতে প্রবেশ করত পরম সুখে কাল যাপন করিতে লাগিলেন॥

রুক্মিণী আদ্য শক্তি দেবীকে পূজা করিয়া চৌত্রিশ অক্ষরে স্তব করেন।

এখানেতে রুক্মিণীর শুন বিবরণ।
কৃষ্ণ-আগমন শুনে প্রফুল্লিত মন॥
বসন ভূষণ পরে হয়ে আনন্দিতা।
সুস্থির হইলা মনে ভীষ্মক-দুহিতা॥
অপরেতে রাজরাণী কহে নারীগণে।
রুক্মিণীরে লয়ে যাও দেবী-দরশনে॥
কুলের দেবতা কালী আইস পূজা কোরে।
এত শুনি নারীগণ চলিল সত্বরে॥
দেবীর আলয়ে গিয়া রুক্মিণী তখন।
পূজিয়া পার্ব্বতী-পদ করয়ে স্তবন॥

জয় জয় জয়কালী কালান্ত-রূপিণী।
কালাচাঁদে পতি দে মা কাল-সীমন্তিনী॥

খড়্গিনী খর্পর-ধরা খলহাস্য-মুখী।
খেদে মরি কৃষ্ণধনে দিয়া কর সুখী॥
গিরিজা গণেশ-মাতা গতি-প্রদায়িনী।
গোলোক-নাথেরে মোরে দেহগো জননী॥
ঘোরবনে দৈত্যগণে করিলে নির্ম্মূল।
ঘনশ্যামে পতি দে মা হয়ে অনুকূল॥
উকার-রূপিণী কালী উকার-রূপিণী।
উৎকণ্ঠা ঘুচায়ে দেও কৃষ্ণ গুণমণি॥
চণ্ডে বধে চামুণ্ডা হয়েছে তব নাম।
চিন্তামণি দিয়া মোর পুরাও মনস্কাম॥
সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের তুমি সে কারণ।
ছলনা ছাড়িয়া মোরে দেহ কৃষ্ণধন॥
জগদম্বে জগন্মাতা জগতের গতি।
জগৎপতি কৃষ্ণ যেন হয় মম পতি॥
ঝরঝর রসনা হইতে সুধা ঝরে।
ঝটিতে শ্রীকৃষ্ণে দেখা জুড়াই অন্তরে।
একার-রূপিণী মাগো একার-রূপিণী।
ইঙ্গিতে কৃষ্ণেরে দে মা ঈশান-মোহিনী॥
টলটল করে ধরা পরশে চরণ।
টেনে ফেলে শিশুপালে দে মা কৃষ্ণধন॥
ঠাকুরাণী কর পার ঠকঠকি-হাতে।
ঠাকুর ত্রিভঙ্গে দে মা ধরি চরণেতে॥
ভুম্বুরেতে সদাশিব তব গুণ গান।
ডরে মরি কৃষ্ণে দিয়া কর পরিত্রাণ॥
ঢলঢল সুধাপানে নয়নের তারা।
ঢেকে মেরে শিশুপালে কৃষ্ণে দে মা তারা॥
ণকার-রূপিণী দুর্গে ণকার-রূপিণী।
নন্দ-সুতে পতি দে মা নন্দের নন্দিনী॥
ত্রৈলোক্য-তারিণী তুমি তুল্য দিতে নাই।
তব পদে ধরি তারা কৃষ্ণে যেন পাই॥
থাকিতে জননী তুমি দুঃখ পাই মনে।
স্থির হই স্থান পেলে কৃষ্ণের চরণে॥
দুর্গা নামে দুর্গতি ঘুচাও তিন পুরে।
দীনবন্ধু কৃষ্ণে দে মা দুঃখ যাকু দূরে॥

ধনেশে করেছ ধনী ধন বিতরিয়া।
ধন্য কর এ দাসীরে কৃষ্ণধন দিয়া॥
নিত্যময়ী নিরঞ্জনী নির্ব্বাণদায়িকা।
নারায়ণে পতি দে মা নগেন্দ্র-বালিকা॥
পশুপতি পবিত্র পাইয়া তব পদ।
পীতাম্বরে পতি দিয়া ঘুচাও বিপদ॥
ফুৎকারে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ফুৎকারেতে লয়।
ফাঁপরে পড়েছি দে মা কৃষ্ণ-পদাশ্রয়॥
বিশ্ব-আদ্যা কালী তুমি বেদে শুন্তে পাই।
বংশীধর হয় বর এই বর চাই॥
ভবদারা ভয়হরা ভূধর-অঙ্গনা।
ভগবানে পতি দিয়া ঘুচাও ভাবনা॥
মহামায়া মহেশ্বরী মহিষ-মর্দ্দিনী।
মাধবে মিলায়ে দে মা মহেশ-মোহিনী॥
যশোদা-কুমারী যোগমায়া যোগেশ্বরী।
যদুনাথে পতি দে মা মনোদুঃখে তরি॥
রুদ্রাণী রূধির-ধারা বহে কলেবরে।
রমানাথে পতি দিয়া রক্ষা কর মোরে॥
লোলোলোলো করে জিহ্বা লম্বিত চিকুর।
লক্ষ্মীকান্তে পতি দে মা দুঃখ যাকু দূর॥
বগলা বরদা বামা বিভু-বিশ্বেশ্বরী।
বৈকুণ্ঠনাথেরে মোরে দে মা কৃপা করি॥
শক্তিরূপা শ্যামা তুমি এ তিন সংসারে।
সুস্থ কর শ্যামচাঁদে সঁপিয়া আমারে॥
হংসরূপা হংসেশ্বরী হেমন্ত-নন্দিনী।
হরি দিয়া হর দুঃখ হরবিলাসিনী॥
ক্ষেমঙ্করী তব পদে এই অভিলাষ।
ক্ষীরোদশায়ী কৃষ্ণে পাই পূর্ণ কর আশ॥

রুক্মিণী-হরণ।

হর-সীমন্তিনী পূজিয়া রুক্মিণী
স্তব করি ভক্তিরূপে।
সহচরী সঙ্গে চলিলেন রঙ্গে
মজিতে ত্রিভঙ্গরূপে॥

পথে যেতে যেতে বলে অন্তরেতে
কোথা হে দয়াল হরি।
প্রাণে মরে দাসী দেখা দেও আসি
কোথা আছ পরিহরি॥
না হেরে তোমায় ধৈর্য্য ধরা দায়
সহ্য নাহি হয় ক্লেশ।
কর পরিত্রাণ তবে থাকে মান
নহে প্রাণ অবশেষ॥
এসেছ আপনি শুনি গুণমণি
অধিনী জীবনে আছে।
কর হিতাহিত কর না বঞ্চিত
তবে যাব কার কাছে॥

এত ভাবি মনে সখীগণ সনে
দেবী করেন গমন।
বলে কোন মেয়ে হের দেখ চেয়ে
মেঘে আচ্ছন্ন গগন॥
ত্বরিত গমনে চলগো ভবনে
বিলম্বেতে নাহি ফল।
আচম্বিতে একি ঘোর মেঘ দেখি
চল চল এল জল॥
সে কথা শুনিয়া বিস্ময় হইয়া
দেখেন দেবী রুক্মিণী।
নহে জলধর রথের উপর
কৃষ্ণরূপে কাদম্বিনী॥
দেবীমনে তুষ্ট বলে এল কৃষ্ণ
কষ্ট ঘুচাতে আমারি।
এতেক ভাবিয়া চলিল চলিয়া
রুক্মিণী রাজ-কুমারী॥
অপরে শ্রীহরি আসি ত্বরা করি
রথ লয়্যে নিকটেতে।
রুক্মিণীর কর ধরি পীতাম্বর
তুলিল আপন রথে॥

রুক্মিণীরে হরি যদি লন হরি
প্রহরী যতেক ছিল।
হয়ে ক্রোধান্তর করে উচ্চৈঃস্বর
ধর ধর আরন্তিল॥
হয়্যে কোপবন্ত যতেক সামন্ত
শ্যামাঙ্গে বরিষে বাণ।
বলে ওরে চোর আয়ুঃ শেষ তোর
আজি হারাইলি প্রাণ॥
পাছু না বুঝিয়া মুষিক হইয়া
সিংহ-গৃহে কর জোর।
নাহি ত্রাণ পাবে আজি শাস্তি হবে
ঘোর ভেঙ্গে যাবে চোর॥
এতেক বলিয়া সকলে রুষিয়া
যুড়িয়া ধনুকে শর।
কৃষ্ণের উপরে অস্ত্র বৃষ্টি করে
যেন বর্ষে জলধর॥

হাসি নারায়ণ ধরি সুদর্শন
রিপু-অস্ত্র নিবারিল।
স্ব-অস্ত্রে কেশব নাশে সৈন্য সব
ত্রাসে কত পলাইল॥
হয়্যে দুঃখ-যুত গিয়ে ভগ্নদূত
ধায়ে রুক্মীর গোচরে।
বহে ঘনশ্বাস বলে সর্ব্বনাশ
রুক্মিণী হরিল চোরে॥
দূতের বচন করিয়া শ্রবণ
রুক্মী ক্রোধানলে জ্বলে।
যত রাজা ছিল গর্জিয়া উঠিল
রাগে মার মার বলে॥
হয়ে সুখ-যুত হাতে বান্ধি সূত
শিশুপাল এসেছিল।
রুক্মিণীহরণ শুনিয়া তখন
শিরে হস্ত দে বসিল॥

শ্রীগুরু-চরণ করিয়া স্মরণ
বিকাইয়া সে চরণে।
রাধাকৃষ্ণ দাস দ্বারকা-বিলাস
পয়ার প্রবন্ধে ভণে॥

রুক্মী রাগান্বিত হইয়া শ্রীকৃষ্ণের সহিত যুদ্ধ করিতে যায়।

রুক্মী বলে কে করিল সাহস দুস্কর।
কে হরিল রুক্মিণীরে কেবা সে তস্কর॥
যাইতে যমের ঘরে কে আসি ইচ্ছিল।
জ্বলন্ত অনলে আসি কেবা ঝাঁপ দিল॥
দূত বলে যুবরাজ নিবেদন করি।
জন্ম যার চৌর্য্যবৃত্তি নাম চোরা হরি॥
সেই কৃষ্ণ লম্পট কপট আগমনে।
রুক্মিণী হরিল পথে বধে সৈন্যগণে॥
কৃষ্ণনাম শ্রবণেতে করিয়া শ্রবণ।
অধিক জ্বলিল কোপে কৃষ্ণ-দ্বেষিগণ॥
ভীষ্মক ভূপতি শুনে এ সব সংবাদ।
বলে কৃষ্ণ পূরালে কি মোর মনসাধ॥
বাঞ্ছা-কল্পতরু তুমি বাঞ্ছা-সিদ্ধিকারী।
অতএব বাঞ্ছা পূর্ণ করিলে আমারি॥

ডুবিল ভীষ্মক-ভূপ আনন্দ-সাগরে।
অপরে সমরে রুক্মী চলে ক্রোধভরে॥
জরাসন্ধ শিশুপাল আদি ক্ষেত্রিগণে।
কোপ করি ধনু ধরি চলে সভে রণে॥
সসৈন্যে ভূপতিগণে কৃষ্ণেরে ঘেরিল।
মাতঙ্গ ধরিতে যেন পতঙ্গ ধাইল॥
আতঙ্ক ত্যজিয়া বলে জরাসন্ধ রায়।
এখানে মরিতে কেন আইলি দুরাশয়॥
লোভে ক্ষোভ পাপে মৃত্যু ঘটিল তোমার।
জান না যে জরাসন্ধ সাপক্ষ ইহার॥
পালাইয়া বেঁচে আছ লুকায়ে সাগরে।
অদ্য সদ্য পাঠাইব যমালয় তোরে॥

শিশুপাল বলে একি সহ্য হয় আমার।
করিল আমার হস্তে সূতা-বান্ধা সার॥
মম সঙ্গে সম্বন্ধ হইল পাকাপাকি।
স্বচ্ছন্দে করিল চুরি মোরে দিয়া ফাঁকি॥
কি কব দুঃখের কথা খেদে ফাটে বুক।
কোন লাজে দেশে গিয়া দেখাইব মুখ॥
এত বলি শিশুপাল অতি রাগান্তরে।
বাণ বরিষণ করে কৃষ্ণ-কলেবরে॥
অন্য অন্য যত রাজা যুদ্ধে প্রবেশিল।
কৃষ্ণের উপরে অস্ত্রবৃষ্টি আরম্ভিল॥
সমূহ বিপক্ষে যদি আরম্ভিল রণ।
ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে প্রবর্ত্তিল নারায়ণ॥
শারঙ্গ ধনুকে কৃষ্ণ গুণ চড়াইয়া।
খরসান নানা বাণ এড়েন রুষিয়া॥
কৃষ্ণ-অস্ত্রে অম্বরে হইল অন্ধকার।
বিপক্ষের বাণ বাণে করিল সংহার॥
শ্রীকৃষ্ণের বাণ খেয়ে শক্রর সামন্ত।
পড়িল অনেক জন হইল প্রাণান্ত॥
যত রথী সৈন্যপতি হইল মূর্চ্ছিত।
বিষ্ণু-বাণে বীরগণে ব্যথায় ব্যথিত॥
রাধাকৃষ্ণ-পাদপদ্ম হৃদে করি আশ।
রাধাকৃষ্ণ দাসে ভাষে দ্বারকা-বিলাস॥

শ্রীকৃষ্ণের স্মরণে বলরাম আসিয়া যুদ্ধ করেন।

হেন রূপে রাজাগণে করে বিসম্বাদ।
মনে মনে মন্ত্রণা করেন কালাচাঁদ॥
শক্রগণ সঙ্গে মোর সমর বাজিল।
দাদা বলরাম বার্ত্তা কিছু না জানিল॥
এত বলি বলরামে করিল স্মরণ।
শ্যামের স্মরণে রামের চিত্ত উচাটন॥
যোগ-পথে অবগত হইয়া সকল।
বিদর্ভে চলিল রাম সমরে অটল॥

রুক্মীর সহিত কৃষ্ণ যুদ্ধ করে যথা।
করিয়া মৃগেন্দ্র-ধ্বনি উত্তরিল তথা॥

বলভদ্রে দেখি কৃষ্ণ তুষ্ট অতি মনে।
মধুপানে মত্ত রাম প্রবর্ত্তিল রণে॥
লাঙ্গল মুষল লয়্যে রাম করে রণ।
সৈন্য নাশে অগ্নি যেন দহে উলুবন॥
এক মুষলের ঘাতে শত শত মরে।
রিপুচয় পায় ভয় হাহাকার করে॥
দেখে রণ রাজাগণ শিরে হস্ত দিল।
বলে আর বাঁচা ভার লাঙ্গলা আইল॥
ত্রাস ভেবে শত্রু সবে করে হায় হায়।
কেহ কহে রক্ষা ভার অদ্যকণর দায়॥
কার্য্য নাই চল ভাই কেহ কহে কারে।
যুদ্ধ করে লাঙ্গলারে কে জিনিতে পারে॥

কেহ বলে যা বলিলে পালান মঙ্গল।
নহে প্রাণ অবসান হইতে মুষল॥
হেন মতে সকলেতে করএ বিচার।
সমরে সংহারে রাম সামন্ত অপার॥
ক্রোধ-যুত রাজ-সুত রুক্মী হয়ে মনে।
দর্প করে যুদ্ধ করে শ্রীকৃষ্ণের সনে॥
করে বাণ সুসন্ধান যত জানা ছিল।
সে সমস্ত হল ব্যর্থ কৃষ্ণ নিবারিল॥
হয়ে ত্রস্ত নিজ অস্ত্র এড়ি ভগবান।
খানখান করিলা রিপুর রথখান॥
কৃষ্ণচন্দ্র অর্দ্ধচন্দ্র-অস্ত্র প্রহারিয়া।
বিরথী করিলা তার সারথি কাটিয়া॥

সমর ছাড়িয়া রুক্মী পলাইতে চায়।
ধরে কেশ হৃষীকেশ রথে বান্ধে তায়॥
রুক্মীরে বন্ধন যদি করিলেন হরি।
পায়ে ভয় ভঙ্গ দেয় রণে যত অরি॥
হেন রূপে কৃষ্ণপক্ষে হয় জয় জয়।
বিপক্ষে বিমুখ হয় হয়ে পরাজয়॥

রুক্মীর বন্ধন দেখে বলেন বলাই।
বলি তাই একি ভাই করেছ কানাই॥
সম্বন্ধে গৌরব রুক্মী শ্যালক তোমার।
বন্ধন-মোচন শীঘ্র করহ উহার॥
এত বলি বলদেব বন্ধন এলায়।
মৃত্যুকল্প হয়ে দুঃখে রুক্মী গৃহে যায়॥
রাধাকৃষ্ণ-পাদপদ্ম হৃদে করি আশ।
রাধাকৃষ্ণ দাসে ভাষে দ্বারক-বিলাস॥

দ্বারিকাবাসিনী নারীগণ রুক্মিণীরে নিরীক্ষণপূর্ব্বক রূপবর্ণন করেন।

কমলারে সঙ্গে লয়ে কমললোচন।
উদয় হইল আসি দ্বারকা-ভূবন॥
রুক্মিণীরে হেরে যত পুরবাসি-নারী।
বলে দিদি এ রূপের তুল্য দিতে নারি॥
বর্ণিতে ইহার বর্ণ হারি মানে বর্ণ।
এ বর্ণ নিকটে মরি কি ছার সুবর্ণ॥
স্বর্ণ বুঝি কেমনে এ বর্ণ দেখেছিল।
তেঁই সে বিরাগে দীপ্ত অনলে দহিল॥
মুখচন্দ্র যেন পূর্ণচন্দ্র-বিনিন্দিত।
তাহে আখিপদ্ম নীলপদ্ম প্রকাশিত॥
কুসুম-কোদণ্ড যেন দ্বিখণ্ড করিয়া।
তুরু-মাঝে মদন রেখেছ প্রকাশিয়া॥
গৃধিনীর গর্ব্ব খর্ব্ব দেখে শ্রুতি-মূল।
নাসায় মিশায় খগ আর তিল-ফুল॥
সীঁথিতে সিন্দুর-বিন্দু কি শোভা করেছে।
প্রভাতের ভানু যেন উদয় হয়েছে॥
এ নারীর ওষ্ঠাধর না হেরেছে যেই।
তুচ্ছ পক্ক বিম্বকে প্রশংসা করে সেই॥
সাগরে মুক্তার স্থিতি শুনিগো শ্রবণে।
এবে কি করেছে বাস ইহার দশনে॥
হেরে বুঝি কুচপদ্ম পদ্ম লাজভরে।
মনদুঃখে সদা থাকে সলিল-ভিতরে॥

চাঁচর চিকুর কিবা দেখি চমৎকার।
হেন জ্ঞান যেন নব মেঘের সঞ্চার॥
কি কব কটির কথা আহা মরে যাই।
হেরে বুঝি লাজে সিংহ বনবাসী তাই॥
ইহার নিতম্ব বুঝি করিয়া দর্শন।
খেদে ক্ষিতি মাটি হল হেন লয় মন॥
জিনি রামরম্ভা-তরু ঊরু মনোলোভা।
পাদ-পদ্ম হতে স্থলপদ্ম নহে শোভা॥
এইরূপে রামাগণে রূপ প্রশংসয়।
পয়ার প্রবন্ধে রাধাকৃষ্ণ দাসে কয়॥

রুক্মিণীর সহিত শ্রীকৃষ্ণের মিলন।

হেন রূপে নারীগণ প্রশংসিল সর্ব্বজন
অপরেতে করহ শ্রবণ।
বেদ-বিধি-অনুসারে কমলাঙ্গী কমলারে
বিবাহ করিল নারায়ণ॥
রতনে রতন পায় মনের বেদনা যায়
কৃষ্ণ-বামে বসিল রুক্মিণী।
তমাল-বৃক্ষেতে যেন স্বর্ণলতা শোভেছেন
মেঘ-আড়ে যেন সৌদামিনী॥
যতনে রতনাসনে বসিলেন দুই জনে
দাসীগণে করএ ব্যজন।
লক্ষ্মী পেয়ে নারায়ণ পরম সন্তুষ্ট মন
কমলার প্রফুল্ল বদন॥
মিলনে যুগল রূপ সুশোভিত অপরূপ
সেরূপ বর্ণন নাহি হয়।
হেরে করি অনুমান মনে হেন হয় জ্ঞান
রবি শশী একত্রে উদয়॥
নিত্য রূপ-নিরীক্ষণে বসন্ত সামন্ত সনে
সুপ্রকাশ হইলা তথায়।
দেখিবারে নিত্য লীলা প্রকাশিত ষোল কলা
কোকিল পঞ্চম স্বরে গায়॥
মিলিয়া ভ্রমর সবে গুন গুন গুন ররে
ঝঙ্কার করয়ে নিরন্তর।

উভয়ের পাদ-পদ্ম জ্ঞান করি স্থলপদ্ম
মধু-লোভে ধায় মধুকর॥
রাধাকৃষ্ণ-রাঙ্গা-পায় বিক্রীত করিয়া কায়
মনে ভাবি যুগল-চরণ।
সেই রাধাকৃষ্ণ দাস এই দ্বারিকা-বিলাস
পদ্য-ছন্দে করিল রচন॥

বৈশম্পায়ন জন্মেজয়ের প্রতি কহিতেছেন—শুন মহারাজ শ্রীহরি অষ্টাদশ সহস্র একশত অষ্ট মহিষী লইয়া সুখান্তরে দ্বারকা নগরে সকৌতুকে পরম সুখে স্বচ্ছন্দ পূর্ব্বক বিহার করেন। প্রত্যেক মহিষীর গর্ভে শ্রীহরির দশ পুত্ত্র দশ কন্যা হয়। প্রধান মহিষী রুক্মিণীর সন্তান প্রদ্যুম্ন প্রভৃতি এবং জাম্বুবতীর সন্তান জাম্বু প্রভৃতি সত্যভামার সন্তান সারণ প্রভৃতি ইত্যাদি শ্রীহরির সন্তানদিগের নাম এবং শ্রীহরির কুমারদিগের এক এক ব্যক্তির ঐরূপ দশ দশ পুত্ত্র ও দশ দশ কন্যা হয়। এমত প্রকারে শ্রীহরির ছাপ্পান্ন কোটি পুত্ত্র পৌত্ত্রে পৃথিবী পরিপূর্ণ হইল, তাহারা মহাবল পরাক্রান্ত দোর্দ্দণ্ড প্রতাপাম্বিত হইয়া দ্বারকায় কালযাপন করেন। শ্রীহরির বংশবৃদ্ধি প্রসঙ্গ যে ব্যক্তি একান্ত চিত্তে শ্রবণ করে সে ব্যক্তি নিঃসন্তান থাকিলে সন্তান প্রাপ্ত হয়েন॥


  1. কুৎসা=দুর্ণাম।
  2. গোপ।
  3. রাষ্ট্র=প্রকাশ।
  4. নির্ণয়।
  5. কুকথা।
  6. দ্রুতগতি।
  7. বিনয়।