বড়দিদি/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

 তখনো সূর্য্যোদয় হয় নাই, পূর্ব্বদিক্‌ রঞ্জিত হইয়াছে মাত্র! প্রমীলা আসিয়া নিদ্রিত সুরেন্দ্রনাথের গলা জড়াইয়া ধরিল,— “মাষ্টার-মশায়।” সুরেন্দ্রনাথের অলস চক্ষু দুটী ঈষৎ উন্মুক্ত হইল,—“কি প্রমীলা?”

 “বড়দিদি এসেছেন।“সুরেন্দ্রনাথ উঠিয়া বসিল। প্রমীলার হাত ধরিয়া বলিল, “চল, দেখে আসি।”

 এই দেখিবার বাসনাটি, তাহার মনে কেমন করিয়া উদয় হইল, বলা যায় না, এবং এতদিন পরে কেন যে সে প্রমীলার হাত ধরিয়া চক্ষু মুছিতে মুছিতে ভিতরে চলিল, তাহাও বুঝিতে পারা গেল না; কিন্তু সে ভিতরে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার পর সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিল। মাধবীর কক্ষের সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রমীলা ডাকিল, “বড়দিদি!”

 বড়দিদি অন্যমনস্ক হইয়া কি একটা কাজ করিতেছিল, কহিল, “কি দিদি?”

 “মাষ্টার-মশাই—”

 দুইজনে ততক্ষণে ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে, মাধবী শশব্যস্তে দাঁড়াইয়া উঠিল। মাথার উপর এক হাত কাপড়্‌ টানিয়া একপাশে সরিয়া দাঁড়াইল। সুরেন্দ্রনাথ কহিতেছিল, “বড়দিদি, তোমার জন্য আমি বড় কষ্টে—” মাধবী অবগুণ্ঠনের অন্তরালে বিষম লজ্জায় জিভ কাটিয়া মনে মনে বলিল, “ছি ছি!”

 “তুমি চলে গেলে—”

 মাধবী মনে মনে বলিল, “কি লজ্জা!”

 মাধবী মৃদু-কণ্ঠে কহিল, “প্রমীলা, মাষ্টারমশায়কে বাহিরে যাইতে বল্‌।”

 প্রমীলা ছোট হইলেও তাহার দিদির আচরণ দেখিয়া বুঝিতেছিল যে, কাজটা ঠিক হয় নাই। বলিল, “চলুন, মাষ্টারমশায়—”

 অপ্রতিভের মত কিছুক্ষণ সে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর বলিল, “চল।” বেশী কথা সে কহিতে জানিত না, বেশী কথা বলিতে সে চায় নাই, তবে সারাদিন মেঘের পর সূর্য্য উঠিলে, হঠাৎ যেমন লোকে সে দিকে চাহিতে চায়, ক্ষণকালের জন্য যেমন মনে থাকে না যে সূর্য্যের পানে চাহিতে নাই, কিংবা চাহিলে চক্ষু পীড়িত হয়, তেমনি একমাস মেঘাচ্ছন্ন আকাশের তলে থাকিয়া প্রথম সূর্য্যোদয়ের সহিত, সুরেন্দ্রনাথ পরম আহ্লাদে চাহিয়া দেখিতে গিয়াছিল, কিন্তু ফল যে এরূপ দাঁড়াইবে, তাহা সে জানিত না।

 সেইদিন হইতে তাহার যত্নটা একটু কমিয়া আসিল। মাধবী যেন একটু লজ্জা করিত। বিন্দু দাসী না কি কথাটা লইয়া একটু হাসিয়াছিল। সুরেন্দ্রনাথও একটু সঙ্কুচিত হইয়া পড়িয়াছিল। আজকাল সে যেন দেখিতে পায়, তাহার বড়দিদির অসীম ভাণ্ডার সসীম হইয়াছে। ভগিনীর যত্ন জননীর স্নেহ-পরশ, যেন তাহার আর গায় লাগে না, একটু দূরে-দূরে থাকিয়া সরিয়া যায়।

 একদিন সে প্রমীলাকে কহিল, “বড়দিদি আমার উপর রাগ করেচেন, না?”

 প্রমীলা বলিল, “হাঁ?”

 “কেন রে?”

 “আপনি অমন ক’রে বাড়ীর ভিতর গিয়েছিলেন কেন?

 “যেতে নেই, না?”

 “তা কি যেতে হয়? দিদি খুব রাগ করেছে।”

 সুরেন্দ্র পুস্তকখানা বন্ধ করিয়া বলিল, “তাই ত–।”

 তার পর একদিন দুপুরবেলা মেঘ করিয়া বড় জল আসিল। ব্রজরাজবাবু আজ দুদিন হইল বাড়ী নাই; জমিদারি দেখিতে গিয়াছিলেন। মাধবীর হাতে কিছু কাজ ছিল না; প্রমীলাও বড় উপদ্রব করিতেছিল, মাধবী তাহাকে ধরিয়া, কহিল, “প্রমীলা, তোর বই নিয়ে আয়, দেখি কত পড়েচিস্‌।”

 প্রমীলা একেবারে কাঠ হইয়া গেল। মাধবী বলিল, “নিয়ে আয়।”

 “বড়দিদি, রাত্তিরে আনব।”

 “না, এক্ষণি আন্‌।” নিতান্ত দুঃখিত-মনে তখন সে বই আনিতে গেল। আনিয়া বলিল, “মাষ্টারমশাই কিছুই পড়ায়নি– খালি আপনি পড়ে।” মাধবী জিজ্ঞাসা করিতে বসিল। আগাগোড়া জিজ্ঞাসা করিয়া বুঝিল যে, সত্যই মাষ্টারমশায় কিছুই পড়ান নাই; অধিকন্তু সে যাহা শিখিয়াছিল, শিক্ষক নিযুক্ত করার পর, এই তিন চারি মাস ধরিয়া বেশ ধীরে ধীরে, সবটুকু ভুলিয়া গিয়াছে। মাধবী বিরক্ত হইয়া বিন্দুকে ডাকিয়া কহিল, “বিন্দু, মাষ্টারকে জিজ্ঞাসা ক’রে আয় ত, কেন প্রমীলাকে এতদিন একটুও পড়ান্‌নি।”

 বিন্দু যখন জিজ্ঞাসা করিতে গেল, মাষ্টার তখন “প্রব্‌লেম্‌” ভাবিতেছিল। বিন্দু কহিল, “মাষ্টারমশায়, বড়দিদি বল্‌চেন যে, আপনি ছোটদিদিকে কিছু পড়ান নি কেন? মাষ্টার-মহাশয় শুনিতে পাইল না। এবার বিন্দু জোরে বলিল, “মাষ্টারমশায়?”

 “কি?”

 “বড়দিদি বল্‌চেন–”

 “কি বলেচেন?”

 “ছোটদিদিকে পড়ান্‌নি কেন?”

 অন্যমনস্ক হইয়া সে জবাব দিল– “ভাল লাগে না।”

বিন্দু ভাবিল, মন্দ নয়। একথা সে মাধবীকে জানাইল। মাধবীর রাগ হইল, সে নীচে আসিয়া দ্বারের অন্তরালে থাকিয়া বিন্দুকে দিয়া বলাইল, “ছোটদিদিকে একেবারে পড়ান্‌নি কেন?” কথাটা বার দুই তিন জিজ্ঞাসা করিবার পরে, সুরেন্দ্রনাথ কহিল, “আমি পারব না।”

 মাধবী ভাবিল, এ কেমন কথা!

 বিন্দু বলিল, “তবে আপনি কি জন্য আছেন?”

 “না থাক্‌লে কোথা যাব?”

 “তবে পড়ান না কেন?”

 সুরেন্দ্রনাথের এবার চৈতন্য হইল! ফিরিয়া বসিয়া কহিল, “কি বলচ?” বিন্দু এতক্ষণ ধরিয়া কি কহিতেছিল, তাহাই আবার আবৃত্তি করিল। সুরেন্দ্রনাথ তখন কহিল, “সে ত রোজ পড়ে!”

 “পড়ে, কিন্তু আপনি দেখেন কি?”

 “না। আমার সময় হয় না।”

 “তবে এ বাড়িতে কেন আছেন?” সুরেন্দ্র চুপ করিয়া তাহা ভাবিতে লাগিল।

 “আপনি আর পড়াতে পার্‌বেন না?”

 “না। আমার পড়াতে ভাল লাগে না।”

 মাধবী ভিতর হইতে কহিল, “জিজ্ঞাসা কর বিন্দু, কেন এতদিন তবে মিছা কথা ব’লে এখানে আছেন?” বিন্দু তাহাই কহিল। শুনিয়া সুরেন্দ্রর “প্রব্‌লেমের” জাল একেবারে ছিন্ন হইয়া গেল; একটু দুঃখিত হইল, একটু ভাবিয়া বলিল, “তাই ত, বড় ভুল হয়েচে।”

 “এই চার মাস ধ'রে ক্রমাগত ভুল?”

 হ্যাঁ, তাই ত হয়েচে দেখ্‌চি– তা’ কথাটা আমার তত মনে ছিল না।”

 পরদিন প্রমীলা পড়িতে আসিল না, সুরেন্দ্রেরও তত মনে হইল না। তার পর-দিনও আসিল না— সেদিনও অমনি গেল!

 তৃতীয় দিবস প্রমীলাকে না দেখিতে পাইয়া, সুরেন্দ্রনাথ একজন ভৃত্যকে কহিল, “প্রমীলাকে ডেকে আন।”

 ভৃত্য ভিতর হইতে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “ছোটদিদি আর আপনার কাছে পড়্‌বেন না।”

 “কার কাছে তবে পড়্‌বে?”

 ভৃত্য বুদ্ধি খরচ করিয়া বলিল, “অন্য মাষ্টার আস্‌বে।”

 বেলা তখন নয়টা বাজিয়াছিল। সুরেন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ ভাবিয়া চিন্তিয়া দুই তিন খানা বই বগলে চাপিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। চশমাটা খাপে পূরিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিল, তারপর ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

 ভৃত্য কহিল, “মাষ্টারবাবু, এ সময়ে কোথায় যাচ্চেন?”

 “বড়দিদিকে ব’লে দিও, আমি যাচ্চি।”

 “আর আস্‌বেন না?”

 সুরেন্দ্রনাথ একথা শুনিতে পাইল না! বিনা উত্তরে ফটকের বাহিরে আসিয়া পড়িল। বেলা দুইটা বাজিয়া গেল, তথাপি সুরেন্দ্রনাথ ফিরিল না। ভৃত্য তখন মাধবীকে সংবাদ দিল, মাষ্টারমহাশয় চলিয়া গিয়াছেন।

 “কোথায় গেছেন?”

 “তা জানি না। বেলা নটার সময় চলে যান; যাবার সময় আমাকে বলে যান যে, বড়দিদিকে বলো আমি চলে যাচ্চি।”

 “সে কিরে? না খেয়ে চলে গেলেন?” মাধবী উদ্বিগ্ন হইল।

 তাহার পর সে নিজ়ে সুরেন্দ্রনাথের কক্ষে আসিয়া দেখিল— সব জিনিষ-পত্রই তেমনি আছে, টেবিলের উপর চশমাটি খাপে মোড়া রাখা আছে, শুধু বই কয়খানি নাই।

 সন্ধ্যা হইল, রাত্রি হইল— সুরেন্দ্র আসিল না। পরদিন মাধবী দুইজন ভৃত্যকে ডাকিয়া কহিয়া দিল, “তোমরা অনুসন্ধান করিয়া ফিরাইয়া আনিলে, দশ টাকা পুরস্কার পাইবে।” পুরস্কারের লোভে তাহারা ছুটিল; কিন্তু সন্ধ্যার পর ফিরিয়া আসিল, কহিল, “কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।”

 প্রমীলা কাঁদিয়া কহিল, “বড়দিদি, তিনি চলে গেলেন কেন?”

 মাধবী তাহাকে সরাইয়া দিয়া কহিল, “বাইরে যা, কাঁদিস্‌নে।”

 দুই দিন, তিন দিন করিয়া দিন যত যাইতে লাগিল, মাধবী তত অধিক উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িল। বিন্দু কহিল, “বড়দিদি, তা এত খোঁজাখুঁজি কেন? কল্‌কাতা সহরে আর কি মাষ্টার পাওয়া যায় না?”

 মাধবী ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “তুই দূর হ— একটা মানুষ একটি পয়সা হাতে না নিয়ে চলে গেল, আর তুই বলিস্‌ খোঁজাখুঁজি কেন?”

 “তার কাছে একটিও পয়সা নেই, তা কি ক’রে জান্‌লে?”

 “তা আমি জানি, কিন্তু তোর অত কথায় কাজ কি?”

 বিন্দু চুপ করিয়া গেল। ক্রমে যখন সাত দিন কাটিয়া গেল, অথচ কেহ ফিরিয়া আসিল না, তখন মাধবী একরূপ অন্ন জল ত্যাগ করিল। তাহার মনে হইত, সুরেন্দ্রনাথ অনাহারে আছে। যে বাড়ির জিনিষ চাহিয়া খাইতে পারে না, পরের কাছে কি সে চাহিতে পারে? তাহার দৃঢ় ধারণা, সুরেন্দ্রনাথের কিনিয়া খাইবার পয়সা নাই, ভিক্ষা করিবার সামর্থ্য নাই, ছোট ছেলের মত অসহায় অবস্থায় হয় ত বা কোন ফুটপাতে বসিয়া কাঁদিতেছে, না হয় কোন গাছের তলায় বই মাথায় দিয়া ঘুমাইয়া আছে।

 ব্রজরাজবাবু ফিরিয়া আসিয়া সব কথা শুনিয়া মাধবীকে কহিলেন, “কাজটা ভাল হয়নি মা।” মাধবী কষ্টে অশ্রু সংবরণ করিল।

 এদিকে সুরেন্দ্রনাথ পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইত। তিনদিন অনাহারে কাটিল; কলের জলে পয়সা লাগে না, তাই ক্ষুধা পাইলে, পেট ভরিয়া জল খাইত।

 একদিন রাত্রে অবসন্ন-শরীরে সে কালীঘাটে যাইতেছিল, কোথায় নাকি শুনিয়াছিল, সেখানে খাইতে পাওয়া যায়। অন্ধকার রাত্রি, তাহাতে আবার মেঘ করিয়াছিল, চৌরঙ্গীর মোড়ে একখানা গাড়ী তাহার উপর আসিয়া পড়িল। গাড়োয়ান কোনরূপে অশ্বের বেগ সংবরণ করিতে পারিয়াছিল। সুরেন্দ্র প্রাণে মরিল না বটে, কিন্তু বক্ষে ও পার্শ্বে প্রচণ্ড আঘাত পাইয়া, অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল; পুলিশ আসিয়া গাড়ী করিয়া হাঁসপাতালে লইয়া গেল। চার পাঁচদিন অজ্ঞান অবস্থায় অতীত হইবার পর, রাত্রে চক্ষু চাহিয়া কহিল, “বড়দিদি!”

 কলেজের একজন ছাত্র, যে সে রাত্রে ‘ডিউটিতে’ ছিল, শুনিতে পাইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সুরেন্দ্র কহিল, “বড়দিদি এসেছেন?”

 “কাল সকালে আস্‌বেন।”

 পরদিন সুরেন্দ্রের বেশ জ্ঞান রহিল, কিন্তু বড়দিদির কথা কহিল না, প্রবল জ্বরে সমস্তদিন ছট্‌ফট্‌ করিয়া সন্ধ্যার সময় একজনকে জিজ্ঞাসা করিল, “আমি হাঁসপাতালে আছি?”

 “হাঁ।”

 “কেন?”

 আপনি গাড়ী–চাপা পড়েছিলেন।”

 “বাঁচবার আশা আছে?”

 “নিশ্চয়।”

 পরদিন সেই ছাত্রটি কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার আত্মীয় কেহ এখানে আছেন?”

 “কেহ না।”

 “তবে সে রাত্রে বড়দিদি বলে ডাক্‌ছিলেন কাকে? তিনি কি এখানে আছেন?”

 “আছেন, কিন্তু তিনি আস্‌তে পারবেন না। আমার পিতাকে সংবাদ দিতে পারেন?”

 “পারি।”

 সুরেন্দ্রনাথ পিতার ঠিকানা বলিয়া দিল। সেই ছাত্রটি সেইদিন পত্র লিখিয়া দিল। তাহার পর বড়দিদির সন্ধান লইবার জন্য জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে স্ত্রীলোক ইচ্ছা কর্‌লে আস্‌তে পারেন, আমরা সে বন্দোবস্ত কর্‌তে পারি। আপনার জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ঠিকানা জান্‌তে পার্‌লে তাঁকেও সংবাদ দিতে পারি।—”

 সুরেন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া, ব্রজরাজবাবুর ঠিকানা কহিয়া দিল।

 “আমার বাসা ব্রজবাবুর বাড়ীর নিকটেই, আজ তাঁকে আপনার অবস্থা জানাব। যদি ইচ্ছা করেন, তিনি দেখ্‌তে আস্‌তে পারেন।”

 সুরেন্দ্র কথা কহিল না। মনে মনে বুঝিয়াছিল— বড়দিদির আসা অসম্ভব। ছাত্রটি কিন্তু দয়াপরবশ হইয়া ব্রজবাবুকে সংবাদ দিল। ব্রজবাবু চমকিত হইলেন, “বাঁচ্‌বে ত?”

 “সম্পূর্ণ আশা আছে।”

 বাড়ীর ভিতর গিয়া কন্যাকে কহিলেন, “মাধবী, যা ভাব্‌ছিলাম তাই হয়েছে! সুরেন গাড়ীচাপা প’ড়ে হাঁসপাতালে আছে।”

 মাধবীর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। “তোমার নাম ক’রে নাকি বড়দিদি বলে ডাক্‌ছিল। তুমি দেখ্‌তে যাবে?” এই সময় পার্শ্বের কক্ষে প্রমীলা, ঝন্‌ ঝন্‌ করিয়া কি সব ফেলিয়া দিল। মাধবী সেই দিকে ছুটিয়া গেল। অনেকক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “তুমি দেখে এসো, আমি যেতে পার্‌ব না।”

 ব্রজবাবু দুঃখিতভাবে, ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “সে বনের পশু— তার উপরে কি রাগ করে?”

 মাধবী কথা কহিল না। তবে ব্রজবাবু একাকী সুরেন্দ্রকে দেখিতে আসিলেন। দেখিয়া বড় দুঃখ হইল, কহিলেন, “সুরেন, তোমার পিতামাতাকে সংবাদ দিলে হয় না?”

 “সংবাদ দিয়েছি।”

 “কোন ভয় নেই, তাঁরা আস্‌লেই একটা বন্দোবস্ত ক’রে দেব।”

 ব্রজবাবু টাকা কড়ির জন্য চিন্তা করিয়া কহিলেন, “বরং আমাকে তাঁদের ঠিকানা বলে দাও, যাতে তাঁদের এখানে আসার পক্ষে কোনরূপ অসুবিধা না হয়, তা করে দেব।”

 সুরেন্দ্র কথাটা তেমন বুঝিল না। বলিল, “বাবা আস্‌বেন, অসুবিধা আর কি আছে?”

 ব্রজবাবু বাটী ফিরিয়া মাধবীকে সমস্ত সংবাদ জ্ঞাত করাইলেন।

 সেই অবধি নিত্য তিনি একবার করিয়া সুরেন্দ্রকে দেখিতে যাইতেন। তাহার উপর একটা স্নেহ জন্মিয়াছিল। একদিন ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মাধবী, তুমি ঠিক বুঝেছিলে, সুরেনের পিতা বেশ অর্থবান্‌ লোক।”

 মাধবী আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন ক’রে জান্‌লে?”

 “তার পিতা একজন বড় উকিল; কাল রাত্রে তিনি এসেছেন।”

 মাধবী মৌন হইয়া রহিল। তাহার পিতা কহিলেন, “সুরেন বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল।”

 “কেন?”

 ব্রজরাজবাবু কহিলেন, “তাহার পিতার সহিত আজ আলাপ হইল। তিনি সে কথা সমস্ত বলিলেন। এই বৎসর পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্ব্বোচ্চ সম্মানের সহিত সুরেন এম্‌, এ পাশ করিলে, বিলাত যাইতে চাহিয়াছিল, কিন্তু নিতান্ত অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক বলিয়া তাঁহার পিতা সাহস করিয়া পাঠাইতে চাহেন নাই; তাই রাগ করিয়া পলাইয়া আসিয়াছিল। সে ভাল হইলে, তিনি বাটী লইয়া যাইবেন।

 নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া, উচ্ছ্বসিত অশ্রু সংবরণ করিয়া লইয়া মাধবী বলিল, “তাই ভাল।”

———