বিষয়বস্তুতে চলুন

বড়দিদি/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

বড়দিদি

প্রথম পরিচ্ছেদ

 এ পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের লোক আছে, তাহারা যেন খড়ের আগুন। দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেও পারে, আবার খপ্ করিয়া নিবিয়া যাইতেও পারে। তাহাদিগের পিছনে সদা-সর্ব্বদা একজন লোক থাকা প্রয়োজন,– সে যেন আবশ্যক অনুসারে, খড় যোগাইয়া দেয়।

 গৃহস্থ-কন্যারা মাটির দীপ সাজাইবার সময় যেমন তৈল এবং শলিতা দেয়, তেমনি তাহার গায়ে একটি কাটি দিয়া দেয়। প্রদীপের শিখা যখন কমিয়া আসিতে থাকে,– এই ক্ষুদ্র কাটিটির তখন বড় প্রয়োজন,– উস্কাইয়া দিতে হয়; এটি না হইলে তৈল এবং শলিতাসত্ত্বেও প্রদীপের জ্বলা চলে না।

 সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃতিও কতকটা এইরূপ। বল, বুদ্ধি, ভরসা তাহার সব আছে, তবু সে একা কোন কাজ সম্পূর্ণ করিতে পারে না। খানিকটা কাজ সে যেমন উৎসাহের সহিত করিতে পারে, বাকিটুকু সে তেমনি নীরব আলস্যভরে ছাড়িয়া দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে। তখনই একজন লোকের প্রয়োজন– সে উস্কাইয়া দিবে।

 সুরেন্দ্রের পিতা সুদূর পশ্চিমাঞ্চলে ওকালতি করিতেন। বাঙলা দেশের সহিত তাঁহার বেশী কিছু সম্বন্ধ ছিল না। এইখানেই সুরেন্দ্র তাহার কুড়ি বৎসর বয়সে এম্‌,এ পাশ করে। কতকটা তাহার নিজের গুণে, কতকটা বিমাতার গুণে। এই বিমাতাটি এমন অধ্যবসায়ের সহিত তাহার পিছনে লাগিয়া থাকিতেন যে, সে অনেক সময় বুঝিতে পারিত না যে, তাহার নিজের স্বাধীন সত্তা কিছু আছে কি না! সুরেন্দ্র বলিয়া কোনো স্বতন্ত্র জীব এ জগতে বাস করে, না, এই বিমাতার ইচ্ছাই একটি মানুষের আকার ধরিয়া কাজকর্ম্ম, শোয়া-বসা, পড়াশুনা, পাশ প্রভৃতি সারিয়া লয়! এই বিমাতাটি, নিজের সন্তানের প্রতি কতকটা উদাসীন হইলেও, সুরেন্দ্রর হেফাজতের সীমা ছিল না। থুথুফেলাটি পর্য্যন্ত তাঁহার দৃষ্টি অতিক্রম করিত না! এই কর্ত্তব্য-পরায়ণা স্ত্রীলোকটির শাসনে থাকিয়া, সুরেন্দ্র নামে লেখাপড়া শিখিল, কিন্তু আত্মনির্ভরতা শিখিল না। নিজের উপর তাহার বিশ্বাস ছিল না। কোনো কর্ম্মই যে তাহার দ্বারা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর এবং সম্পূর্ণ হইতে পারে, ইহা সে বুঝিত না। কখন্‌ যে তাহার কি প্রয়োজন হইবে, এবং কখন্‌ তাহাকে কি করিতে হইবে, সেজন্য সে সম্পূর্ণরূপে আর একজনের উপর নির্ভর করিত। ঘুম পাইতেছে, কি ক্ষুধা বোধ হইতেছে, অনেক সময়, এটাও সে নিশ্চিত ঠাহর করিতে পারিত না। জ্ঞান হওয়া অবধি, তাহাকে বিমাতার উপর ভর করিয়া, এই পঞ্চদশ বর্ষ কাটাইতে হইয়াছে। সুতরাং বিমাতাকে তাহার জন্য অনেক কাজ করিতে হয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাইশ ঘণ্টা তিরস্কার, অনুযোগ, লাঞ্ছনা, তাড়না, মুখবিকৃতি, এতদ্ভিন্ন পরীক্ষার বৎসর, পূর্ব্ব হইতেই, তাহাকে সমস্ত রাত্রি সজাগ রাখিবার জন্য নিজের নিদ্রাসুখ-বিসর্জ্জন দিতে হইত! আহা, সপত্নীপুত্রের জন্য কে কবে এত করিয়া থাকে! পাড়া-প্রতিবাসীরা এক মুখে রায়-গৃহিণীর সুখ্যাতি করিয়া উঠিতে পারে না।

 সুরেন্দ্রের উপর তাঁহার আন্তরিক যত্নের এতটুকু ত্রুটি ছিল না— তিরস্কার-লাঞ্ছনার পর-মুহূর্ত্তে যদি তাহার চোখ-মুখ ছল-ছল করিত, রায়-গৃহিণী সেটি জ্বরের পূর্ব্বলক্ষণ নিশ্চিত বুঝিয়া, তিন দিনের জন্য তাহার সাগু ব্যবস্থা করিয়া দিতেন। মানসিক উন্নতি এবং শিক্ষাকল্পে, তাঁহার আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। সুরেন্দ্রের অঙ্গ পরিষ্কার কিংবা আধুনিক রুচি-অনুমোদিত বস্ত্রাদি দেখিলেই তাহার সখ এবং বাবুয়ানা করিবার ইচ্ছা তাঁহার চক্ষে স্পষ্ট ধরা পড়িয়া যাইত, এবং সেই মুহূর্ত্তেই দুই-তিন সপ্তাহের জন্য, সুরেন্দ্রর বস্ত্রাদি রজক-ভবনে যাওয়া নিষিদ্ধ হইত।

 এমনি ভাবে সুরেন্দ্রর দিন কাটিতেছিল। এমনি সস্নেহ সতর্কতার মাঝে কখন কখন তাহার মনে হইত, এ জীবনটা বাঁচিবার মত নহে,— কখন বা সে মনে ভাবিত, বু্ঝি এমনি করিয়াই সকলের জীবনের প্রভাতটা অতিবাহিত হয়। কিন্তু এক এক দিন আশপাশের লোকগুলা গায়ে পড়িয়া তাহার মাথায় বিভিন্ন ধারণা গুঁজিয়া দিয়া যাইত।

 একদিন তাহাই হইল। একজন বন্ধু তাহাকে পরামর্শ দিল যে, তাহার মত বুদ্ধিমান্‌ ছেলে বিলাত যাইতে পারিলে, ভবিষ্যতে অনেক উন্নতির আশা আছে। স্বদেশে ফিরিয়া আসিয়া সে অনেকের অনেক উপকার করিতে পারে। কথাটা সুরেনের মন্দ লাগিল না। বনের পাখীর চেয়ে পিঞ্জরের পাখীটাই বেশী ছট্‌ফট্‌ করে! সুরেন্দ্র কল্পনার চক্ষে যেন একটু মুক্ত বায়ু, একটু স্বাধীনতার আলোক, দেখিতে পাইতেছিল, তাই তাহার পরাধীন প্রাণটা, উন্মত্তের মত, পিঞ্জরের চতুর্দ্দিকে ঝট্‌পট্‌ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

 সে পিতাকে আসিয়া নিবেদন করিল যে, তাহার বিলাত যাইবার উপায় করিয়া দিতে হইবে। তাহাতে যে সকল উন্নতির আশা ছিল– তাহাও সে কহিল। পিতা কহিলেন, ‘ভাবিয়া দেখিব।’ কিন্তু গৃহিণীর ইচ্ছা একেবারে প্রতিকূল। তিনি পিতা-পুত্রের মাঝখানে ঝড়ের মত আসিয়া পড়িয়া এমনি অট্টহাসি হাসিলেন যে, দুইজনেই স্তম্ভিত হইয়া গেল!

 গৃহিণী কহিলেন, “তবে আমাকেও বিলাত পাঠাইয়া দাও–না হইলে সুরোকে সাম্‌লাইবে কে? যে জানে না, কখন্‌ কি খাইতে হয়, কখন্‌ কি পরিতে হয়, তাকে একলা বিলাত পাঠাইতেছ? বাড়ীর ঘোড়াটাকে সেখানে পাঠান যা, ওকে পাঠানও তাই। ঘোড়া-গরুতে বুঝিতে পারে যে, তার খিদে পেয়েছে, কি ঘুম পেয়েছে— তোমার সুরো তাও পারে না—” তার পর আবার হাসি!

 হাস্যের আধিক্য দর্শনে রায় মহাশয় বিষম লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। সুরেন্দ্রনাথও মনে করিল যে, এরূপ অকাট্য যুক্তির বিপক্ষে কোনরূপ প্রতিবাদ করা যায় না। বিলাত যাইবার আশা সে ত্যাগ করিল। তাহার বন্ধু এ কথা শুনিয়া বিশেষ দুঃখিত হইল। কিন্তু বিলাত যাইবার আর কোন উপায় আছে কি না, তাহাও সে বলিয়া দিতে পারিল না। কিন্তু অবশেষে কহিল যে, এরূপ পরাধীনভাবে থাকার চেয়ে ভিক্ষা করিয়া খাওয়া শ্রেয়ঃ; এবং ইহাও নিশ্চয় যে, এরূপ সম্মানের সহিত যে এম্, এ. পাশ করিতে পারে— উদরান্নের জন্য তাহাকে লালায়িত হইতে হয় না।

 সুরেন্দ্র বাটী আসিয়া এ কথা ভাবিতে বসিল। যত ভাবিল, তত সে দেখিতে পাইল যে, বন্ধু ঠিক বলিয়াছে— ভিক্ষা করিয়া খাওয়া ভাল। সবাই কিছু বিলাত যাইতে পারে না, কিন্তু এমন জীবিত ও মৃতের মাঝামাঝি হইয়াও সকলকে দিন কাটাইতে হয় না।

 একদিন গভীর রাত্রে সে ষ্টেশনে আসিয়া কলিকাতার টিকিট্‌ কিনিয়া গাড়ীতে বসিল, এবং ডাকযোগে পিতাকে পত্র লিখিয়া দিল যে, কিছুদিনের জন্য সে বাড়ী পরিত্যাগ করিতেছে; অনর্থক অনুসন্ধান করিয়া বিশেষ লাভ হইবে না, এবং সন্ধান পাইলেও যে, সে বাটীতে ফিরিয়া আসিবে, এরূপ সম্ভাবনাও নাই।

 রায়-মহাশয় গৃহিণীকে এ পত্র দেখাইলেন। তিনি বলিলেন, “সুরো এখন মানুষ হইয়াছে, বিদ্যা শিখিয়াছে— পাখা বাহির হইয়াছে— এখন উড়িয়া পলাইবে না ত কখন্‌ পলাইবে!”

 তথাপি তিনি অনুসন্ধান করিলেন— কলিকাতায় যাহারা পরিচিত ছিল, তাহাদিগকে পত্র দিলেন; কিন্তু কোন উপায় হইল না। সুরেন্দ্রর কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।

———