বড়বাড়ী (১৯২৬)/৩
৩
শ্রাবণ মাস। অতি বর্ষায় মিত্রদের পুষ্করিণী জলে পরিপূর্ণ! গ্রামের ভিতরে পর্য্যন্ত জল আসিয়াছে, এমন কি মিত্রদিগের বাটীর নিকট পর্য্যন্ত নৌকা আসে। ইহার উপর কয়েক দিনের অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতে গ্রাম্যপথ জল কাদায় পরিপূর্ণ। দরিদ্র লোকেরা কোনমতে কায়ক্লেশে বাস করিয়া আছে। এমনি দিনে একদিন অপরাহ্নকালে একখানি পাল্কী লইয়া কয়েকজন বেহারা ভিজিতে ভিজিতে মিত্রদের কাছারীঘরের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে সময়ে কাছারীঘরে কয়েকজন চাকর এবং ৫।৭ জন অতিথি বসিয়া ছিল। ঝড়বৃষ্টির জন্য বাবুদের মধ্যে কেহই বাহিরে আসেন নাই। পাল্কী দেখিয়া চাকরদিগের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিল,—“এ পাল্কী কোথা হইতে আসিল?” একজন বাহক বলিল—“রাইগঞ্জ হইতে।” রাইগঞ্জ সুপ্রভার বাপের বাড়ী। চাকর এই কথা শুনিয়া বেহারাদিগের অভ্যর্থনা করিল এবং তাহাদিগের নিকট হইতে রাইগঞ্জ হইতে আগত পত্র লইয়া বাটীর মধ্যে গেল। পত্রের শিরোনামায় কার্ত্তিক বাবুর নাম; কিন্তু চাকরটি কার্ত্তিক বাবুকে না দেখিয়া তারক বাবুর হস্তেই পত্র দিল। তারক রাইগঞ্জের পত্র দেখিয়া সৌৎসুক্যে পড়িতে আরম্ভ করিলেন। কারণ তিনি ইতিপূর্ব্বেই সংবাদ পাইয়াছিলেন যে, তাঁহার শ্বশুর বড় পীড়িত। তিনি পত্র পড়িতে পড়িতে বড় বিমর্ষ হইলেন। খবর ভাল নহে। সুপ্রভা এবং তারককে অবিলম্বে রাইগঞ্জে যাইবার জন্য পত্র আসিয়াছে, তবে একখানি পাল্কী পাঠাইবার কারণ এই—যদি, পাল্কী পাইতে দেরী হয় তবে অন্ততঃ একজন শীঘ্র রওনা হইতে পারিবেন। তারক পত্র পাইয়া মহা বিপদে পড়িলেন। আগামী কল্য জেলা না গেলে কাজের বড় ক্ষতি; এবং যদি রাইগঞ্জ না যান, তাহা হইলে শ্বশুরের সঙ্গে দেখা আর বোধ হয় এ জন্মে হয় না। তারক নানা চিন্তা করিতে করিতে দাদাকে পত্র দিবার জন্য বাহিরে যাইতেছেন, সিঁড়ির মধ্যে সুপ্রভার সহিত দেখা হইল। সুপ্রভা কার্ত্তিকের কন্যা রাধারাণীকে কোলে লইয়া এবং নিজের কন্যা স্বর্ণের হাত ধরিয়া দোতালায় উঠিতেছিলেন। সিঁড়ির মধ্যে তারককে দেখিয়া হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“এতক্ষণে বুঝি ঘুম ভাঙ্গল। আমি মনে করেছিলাম বুঝি আজ আর ওঠা হবে না।” তারক অন্যমনস্ক ভাবে “হুঁ” মাত্র বলিয়া নামিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় সুপ্রভা স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়াই বুঝিতে পারিলেন যে তিনি অন্যমনস্ক। সুপ্রভা ব্যগ্র হইয়া আরও একসিঁড়ি নামিয়া বলিলেন—“দেখ, তোমাকে গোড়ায় দেখে মনে করেছিলাম, বুঝি ঘুম থেকে উঠেছ বলেই মুখ এত ভার হয়েছে; কিন্তু তা ত নয়, তোমার মনে যেন কি ভাবনা হয়েছে। আমায় বলবে না?” তারক দেখিলেন দাদাকে জিজ্ঞাসা না করিয়া যে কথা সুপ্রভাকে বলিবার ইচ্ছা ছিল না, সে কথা তাঁহার মুখের ভাবেই ব্যক্ত হইয়া পড়িয়াছে। তখন তিনি স্থিরস্বরে বলিলেন,—“না, এমন কিছু না; তুমি উপরে যাও, আমি মুখ ধুয়ে এসে সব বলছি।” এই বলিয়া তারক তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেলেন। সুপ্রভা কিছু বুঝিতে পারিলেন না, একটুখানি দাঁড়াইয়া থাকিলেন; কিন্তু পাছে উপর হইতে কার্ত্তিক নামিয়া আসেন, এই ভয়ে আস্তে আস্তে উপরে চলিয়া গেলেন। সুপ্রভা কত কথাই ভাবিতে লাগিলেন। তিনি জানিতেন, তারক সহজে এত গম্ভীর হন নাই, আর সাংসারিক কোন কারণেও তাঁহাকে এত বিচলিত করিতে পারে না। এই জন্যই বাটীর সকলে এবং গ্রামের সকলে তাঁহার স্বামীকে ভালবাসিয়া এবং আদর করিয়া “মহেশ্বর” বলিয়া ডাকে। সুপ্রভা এক মুহূর্ত্তের মধ্যে সব ভাবিয়া ফেলিলেন। যে স্বামীর মুখ এতটুকু মলিন দেখিলে তিনি অস্থির হইয়া পড়েন, আজ সেই স্বামীকে বিমনা এবং প্রগাঢ় চিন্তায় অভিভূত দেখিয়া তাঁহার মাথায় যেন বজ্র ভাঙ্গিয়া পড়িল।
তারক নীচে যাইয়া হাতমুখ ধুইলেন এবং কাছারী বাটীতে যাইবার জন্য বাহিরে যাইতেছেন, এমন সময় কার্ত্তিককে দেখিতে পাইলেন। তিনি অমনি সেই পত্রখানি তাঁহার হস্তে দিলেন।
কার্ত্তিক জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথাকার পত্র?”
“রাইগঞ্জের।”
কার্ত্তিক পত্রখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া বলিলেন, “তাই ত! বিষম সঙ্কট। তোমাকে কাল জেলায় না গেলে ওয়ারেণ্ট বাহির হইতে পারে, একদিকে রাইগঞ্জ না গেলেও নয়। তা’ এক কর্ম্ম কর, ক্ষেপীর মাকে এখনই পাঠাইয়া দিই; তুমি কাল বৈকালে ঐ রাস্তায় রাইগঞ্জ যাইও।” তারক সেই যুক্তি ভাল বিবেচনা করিয়া বাটির মধ্যে ফিরিলেন; কার্ত্তিক বেহারাদিগের নিকট সবিস্তার শুনিবার জন্য বাহিরে গেলেন।
এদিকে তারক তাড়াতাড়ি উপরে গেলেন, দেখেন সুপ্রভা তাঁহার জন্য সিঁড়ির দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া আছেন। তারক তাঁহাকে দেখিয়াই বলিলেন,—“দেখ! বড় বিপদ; তোমার পিতার বড় ব্যামো, তাই তোমাকে এখনই লইয়া যাইবার জন্য বেহারা এসেছে।” সুপ্রভা পিতার ব্যারামের কথা শুনিয়া একান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন এবং যখন শুনিলেন যে ভাসুর তাঁহার বাপের বাড়ী যাওয়ার আদেশ দিয়াছেন, তখনই তিনি নীচে নামিয়া রান্নাঘরে শ্বাশুড়ীর কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; কারণ, শ্বাশুড়ীকে না বলিয়া তিনি কোন কায করিতে আজিও শিখেন নাই। তিনি অতি ধীরস্বরে কহিলেন,—“মা! আমার বাবার বড় ব্যামো, তাই আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেহারা পাঠাইয়াছেন।” শ্বাশুড়ী বধূকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া অনেক ভরসা দিয়া বলিলেন,—“ভয় কি মা, তোমার বাবা ভাল হয়ে যাবেন। তুমি এখনই রওনা হও মা।” এই বলিয়া তিনি তাঁহার যাওয়ার ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। সুপ্রভা সেই মেঘের মধ্যেই শেষবেলায় পিতাকে দেখিবার জন্য যাত্রা করিলেন। প্রতিবেশী দুই একজন এমন দিনে, এই অবেলায় যাইতে নিষেধ করিল, কিন্তু তারকের মা সে কথা শুনিলেন না, বলিলেন,—“না, আর দেরী করা হবে না; কি জানি ঠাকুর না করুন, একটা যদি ভাল-মন্দ হয়, তা হ’লে বৌমার আর আক্ষেপের সীমা থাক্বে না।”
রাইগঞ্জ হইতে যদিও চাকর হরিহর আসিয়াছিল, তবুও কার্ত্তিক, বাড়ীর পুরাতন ভৃত্য—তাঁদের বাপের আমলের চাকর রাধানাথকে সঙ্গে দিবার অভিপ্রায় করিলেন।
রাধানাথ ভৃত্য হইলেও ভৃত্যের মত থাকে না; সে বাড়ীর অভিভাবক। কার্ত্তিক, তারক, সুরেন্দ্র সকলেই তাহাকে “রাধু কাকা” বলিয়া ডাকেন এবং রাধানাথ নিরক্ষর হইলেও তাহার পরামর্শ ব্যতীত তাঁহারা কোন কায করেন না। তাঁহারা জানিতেন যে, তাঁহাদের জমীদারীর সমস্ত সংবাদ রাধানাথ জানে, তাঁহাদের তেজারতির সমস্ত অবস্থা রাধানাথ অবগত। স্বর্গীয় গোরাচাঁদ বাবু রাধানাথকে তাঁহার দক্ষিণ হস্ত মনে করিতেন। ছেলেরাও রাধানাথকে তেমনই সম্মান করিয়া থাকে। বাগ্দীর ছেলে রাধানাথ, বাবুদের কাছে যে সম্মান পাইত, এখনকার দিনে জমীদার বাবুদের নিকট তাঁহাদের ম্যানেজার, দেওয়ানেরাও সে সম্মান পান না।
রাধানাথ যখন শুনিল যে, মেজবধূকে বাপের বাড়ী যাইতে হইবে, তখন সে আপনা হইতেই সাজিয়া আসিল এবং কার্ত্তিককে বলিল—“এমন অবেলায় যখন যেতেই হবে, তখন এ বুড়া সঙ্গে না গেলে চল্বে কেন? মাকে অমনি যেতে দিতে পারি, কেমন ভাই হরিহর?” রাইগঞ্জের চাকর হরিহর বলিল,—“তা, রাদু কাকা, তুমি বুড়া মানুষ, কষ্ট ক’রে না গেলেও পারতে; আমিই সঙ্গে আছি।”