বড়বাড়ী (১৯২৬)/৪
৪
সেই দিন সন্ধ্যার সময়ে একখানি পাল্কী রাইগঞ্জের রাস্তার উপর দিয়া যাইতেছিল; একে শ্রাবণ মাস, চারিদিক জলে পরিপূর্ণ, তাহাতে আবার আকাশে মেঘ, অল্প অল্প বৃষ্টি হইতেছিল। মনোহরপুর হইতে রাইগঞ্জ যাইবার একটাই রাস্তা এবং রাস্তাটী বরাবর রাইগঞ্জ পার হইয়া উত্তর দিকে গিয়াছে। বেহারারা বড় সাবধানে যাইতেছিল; মেটে রাস্তা অত্যন্ত পিচ্ছিল হইয়াছিল, তাই তাহারা মধ্যে মধ্যে অস্পষ্ট স্বরে পরস্পরকে হুঁসিয়ার করিতেছিল। রাধানাথ পাল্কীর পশ্চাতে ছিল, সে গান না গাহিয়া থাকিতে পারিত না। আজ যে এমন দুর্গম পথে যাইতেছে, তবুও সে গান করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। বুড়া হইলে কি হয়, এখনও তাহার শরীরে বল আছে, গলায় জোর আছে, আওয়াজ নরম হয় নাই। সে গাইতেছে—
“রবে না দিন চিরদিন, সুদিন কুদিন
একদিন দিনের সন্ধ্যা হবে।”
এতক্ষণ পর্য্যন্ত বৃষ্টি কিছু আস্তে আস্তে হইতেছিল, কিন্তু ক্রমে যতই অন্ধকার বাড়িতে লাগিল, ততই বৃষ্টিও বৃদ্ধি হইতে লাগিল। পাল্কীতে আটজন বেহারা এবং রাধানাথ ও রাইগঞ্জের চাকর হরিহর। কিছুদূর কষ্টে সৃষ্টে যাইয়াই রাধানাথ হাঁকিয়া বলিল, “ওরে সুবল, রাস্তা ছেড়ে এই মাঠ আড়াআড়ি ধর না, বড় যে ঝড় উঠে এল!” একজন বেহারা বলিল, “মাঠে যে জল দাঁড়িয়াছে।” রাধানাথ বলিল, “তোদের ভয় নাই, জল খুব কম, হাঁটুও ডুবে না, আমি এগুতে যাচ্ছি।” পাল্কীর মধ্যে সুপ্রভা তাহা বোধ হয় পাঠক-পাঠিকা বুঝিতে পারিয়াছেন। সন্ধ্যার পূর্ব্বক্ষণ পর্য্যন্তও সুপ্রভা এক একবার পাল্কীর দ্বার খুলিয়া রাইগঞ্জ কতদূর দেখিতেছিলেন; কিন্তু এখন অন্ধকার হওয়ায় আর দেখিতে পাইতেছিলেন না। তিনি বেহারাদের সঙ্গে রাধানাথের কথোপকথন শুনিতে পাইয়া ভিতর হইতে মাঠের রাস্তা ধরিতে আদেশ করিলেন। বেহারাগণ অগত্যা বাঁধা রাস্তা ছাড়িয়া মাঠের রাস্তায় নামিল।
রাধানাথ যাহা বলিয়াছিল তাহাই ঠিক, জল অর্দ্ধ হস্তের বেশী নহে। কিন্তু তাহারা যাইতে পারিতেছিল না; একে অন্ধকার, তাতে মাঠের রাস্তা। দুই একজনের দুই একবার পা পিছ্লাইয়াও গেল। আর আগাইতে পারা যায় না দেখিয়া শেষে সকলে পাল্কী লইয়া দাঁড়াইল। রাধানাথ বেগতিক দেখিয়া পাল্কীর দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, ‘মা! এখন কি উপায়, মাঠের মধ্যে বেহারারা চলিতে পারে না।’ রাধানাথের ইচ্ছা যে, সে সুপ্রভাকে পাল্কী হইতে নামাইয়া পদব্রজে যাইতে বলে, কিন্তু তাহা সে পারিল না। সুপ্রভা পিতাকে দেখিবার জন্য নিতান্ত উৎকণ্ঠিতা হইয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “রাধু কাকা! তুমি আগে আগে চল, আমি পাল্কী থেকে নেমে হাঁটিয়াই যাইব।” এই বলিয়া তিনি পাল্কী হইতে নামিলেন। রাধানাথ আগে আগে যাইতে লাগিলেন, স্বর্ণকে কোলে লইয়া সুপ্রভা মধ্যে, তাঁহার পশ্চাতেই হরিহর এবং সর্ব্বশেষে পাল্কী লইয়া বেহারাগণ। কিন্তু একে একে বেহারারা সকলেই পিছাইয়া পড়িল। রাধানাথ খুব জোরে জোরে আগে যাইতেছে এবং সুপ্রভাও প্রাণপণে যাইতেছেন। পথের মধ্যে সুপ্রভার কতবার পা পিছ্লাইয়া গেল; কিন্তু পিতৃবৎসলা তবুও অবিরাম গতিতে যাইতে লাগিলেন। মনোহরপুর হইতে অনেক দূর আসিয়াছেন, আর একক্রোশ গেলেই রাইগঞ্জ পৌঁছান যায়। রাস্তার মধ্যে হাঁটিতে হাঁটিতে কতবার সুপ্রভা রাইগঞ্জের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, প্রতিবারেই হরিহর ‘ঐ সুমুখের গ্রাম’ বলিয়া ভরসা দিয়াছে।
কিছুদূর যাইয়া সুপ্রভা আর চলিতে পারিলেন না, এদিকে স্বর্ণ কোলের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। এতক্ষণ পর্য্যন্ত সে ঘুমাইয়া ছিল। রাধানাথ নিজের গায়ের মোটা চাদর পুরু করিয়া স্বর্ণের গায়ের উপর দিয়াছিল, এই জন্য এতক্ষণ তাহার ঘুম ভাঙ্গে নাই। এখন সে কাঁদিতে লাগিল। সুপ্রভা তাহার মুখে স্তন দিলেন, কিন্তু সে শীতে কাঁদিতে লাগিল। তখন সুপ্রভা বলিলেন “আর যে চলিতে পারি না। খুকির হাত পা অবশ হইয়া আসিতেছে।” রাধানাথ তখন অন্য উপায় না দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে, বেহারাদিগকে ডাকিলেন; কিন্তু কোন উত্তর পাইলেন না, তাহারা কিছুদূর পাছে পাছে আসিয়া দক্ষিণদিক দিয়া গ্রামের দিকে গিয়াছে। একজন বেহারা সঙ্গেই ছিল সে একটু দূর হইতে উত্তর দিল এবং তাড়াতাড়ি নিকটে আসিল। সুপ্রভা বলিলেন, “হরি! আমার আর চলিবার শক্তি নাই; আমি এখানে জলের মধ্যেই বসি, রাধু কাকা আমার সঙ্গে থাকুক। তুমি স্বর্ণকে কোলে করিয়া দৌড়ে গ্রামে যাও স্বর্ণ আর একটু এ জলের মধ্যে থাকিলে মরিয়া যাইবে।” হরিহর কি করে উভয় সঙ্কট; সে যাইতেও পারে না, থাকিতেও পারে না। তখন সে বেহারদিগকে গালাগালি দিতে আরম্ভ করিল। সে সময়ে অন্ততঃ যদি পাল্কীথানা নিকটে থাকিত তাহা হইলে তাহার মধ্যে সুপ্রভাকে বসাইতে পারিলেও প্রাণ রক্ষা হয়। বেহারা তাহার সঙ্গীদিগকে অনেক ডাকাডাকি করিল, কিন্তু কোন উত্তর পাইল না, তাহারা ততক্ষণ নিজ নিজ বাটীতে পৌছিয়াছে।
রাধানাথ তখন বলিল, “দেখ হরিহর, আর কোন উপায় ত দেখি না।” হরিহর কোন কথা না বলিয়া মেয়েটিকে কাপড় ঢাকা দিয়া কাঁধে করিয়া গ্রামের দিকে ছুটিল। রাধানাথ বলিল, “মা, তুমি আমার হাত ধরিয়া চলিতে পারিবে কি?” সুপ্রভা নিরুপায় হইয়া তাহাতে সম্মত হইলেন, এবং রাধানাথের কাঁধের উপর ভর দিয়া চলিতে লাগিলেন। তাঁহারা কিছু দূর অগ্রসর হইয়াছেন, এমন সময়ে মেয়েটিকে বাড়ীতে রাখিয়া হরিহর কাঁদিতে কাঁদিতে সেই স্থানে ফিরিয়া আসিল, এবং কহিল, “দিদিঠাকুরুণ, কর্ত্তা নেই।” সুপ্রভা সেইখানেই মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়িলেন। হরি এবং রাধানাথ ধরাধরি করিয়া তাঁহাকে বাটীতে লইয়া গেল।