বত্রিশ সিংহাসন/১

উইকিসংকলন থেকে

রত্নমঞ্জরী প্রথম পুত্তলিকা

কহিল, মহারাজ, আমি এক উপাখ্যান বলি শ্রবণ কর। আপনার গুণ আপনি প্রকাশ করিলে গুণবান, পুরুষকেও নিগুণ বলিয়া ব্যাখ্যা যায়, ইন্দ্রও আপন গুণ আপনি কহিলে লঘু হয়েন, অন্য লোকে যে প্রশংসা করে সেই প্রশংসাই যথার্থ। তুমি বাস্তবিক গুণবান, ও মর্যাদাবান, বট এবং যাহা কহিলে তাহাও যথার্থ বটে, কিন্তু এতাদৃশ অহঙ্কার করা উচিত নহে। এই পৃথিবী অতি বিস্তৃত, পরমেশ্বর এই পৃথিবীকে রত্নগত্তা করিয়াছেন, এই পৃথিবীতে নানা গুণের মনুষ্য আছে, তুমি যে মহামোহান্ধকারে রহিয়াছ, তাহা কিছুই জানিতেছ না। হে অজ্ঞান তোমার ন্যায় কোটি কোটি মনুষ্য এই পৃথিবীতে জন্মিয়াছে। যে রাজা এই সিংহাসনের স্বামী ছিলেন তোমার ন্যায় তাহার যে কত শত ক্ষুদ্র ভূত ছিল তাহার সঙ্খা নাই, অতএব তুমি কিসের অহঙ্কার করিতেছ।

 এই কথায় রাজা জ্বলদগ্নিপ্রায় ক্রুদ্ধ হইয়া পুত্তলিকাকে কহিলেন তোমার বড় আস্পর্ধা দেখিতেছি, থাক, আমি এই সিংহাসন এখনি ভগ্ন করিয়া ফেলিতেছি। বররুচি পুরোহিত কহিলেন মহারাজ ইহা সদ্বিবেচনার কর্ম্ম নহে। প্রথমতঃ পুত্তলীর বাক্য শ্রবণ করুন, তাহার পর যাহা কত্তব্য করিবেন। এই বাক্যে রাজা ক্রোধ সম্বরণ পূর্ব্বক অন্তঃক্রদ্ধ হইয়া পুত্তলীকে বলিলেন কি বৃত্তান্ত বলিতে চাহ বল। পুত্তলিকা কহিল মহারাজ তুমি তাহা না শুনিয়াই ক্রোধে অন্ধপ্রায় হইয়াছ, শুনিলে না জানি কি করিবে, ফলতঃ তাহা শুনিলে তুমি আরো লজ্জিত এবং লোকসমাজে উপহাস্য হইবে, অতএব বলা অপেক্ষা না বলাই ভাল, রাজা বিক্রমদিত্যের সহিত আমাদের যে দিবসাবধি বিচ্ছেদ হইয়াছে সেই অবধি আমাদের কপাল ভাঙ্গিয়াছে, এবং উপযুক্ত ব্যক্তির অভাবে সিংহাসনও ভাঙ্গিয়া ফেলিবার যোগ্য হইয়াছে, অতএব এখন সিংহাসন ভাঙ্গিবার আর কি ভয়।

 পুত্তলীর এই বাক্য শুনিয়া রাজমন্ত্রী তাহাকে বলিলেন তুমি কি জন্য আক্ষেপ করিতেছ, তোমার রাজার বৃত্তান্ত বল। পুত্তলিকা বলিল শকাদিত্য রাজা অম্বাবতী নগরে রাজ্য করিতেন। ঐ রাজা অত্যন্ত প্রতাপ যুক্ত, দেবভক্ত এবং দাতা ছিলেন, অতএব প্রথমতঃ তাহার বৃত্তান্ত কহি শ্রবণ কর।

 অম্বাবতী নগরে শ্যামস্বয়ম্বর নামে এক ব্রাহ্মণ রাজা ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ সামান্য ভাবে রাজ্য করিতেন, পরে তাহার রাজ্যের সমৃদ্ধি ও যশোবৃদ্ধি হইলে তিনি গন্ধর্ব্বসেন নামে বিখ্যাত হইলেন। এই রাজার চারি বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণী ক্ষত্রিয়া বৈশ্য ও শূদ্রা চারি ধর্ম্মপত্নী ছিল। ব্রাহ্মণী অতি সুন্দরী ও সুশীল ছিলেন, তাহার এক পুত্র হইয়া ছিল, তাহার নাম ব্রহ্মনীত। ব্রহ্মনীত সকল শাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন,বিশেষতঃ জ্যোতিষ বিদ্যাতে তাহার এমত অসাধারণ ব্যুৎপত্তি জন্মিয়াছিল যে কোন দিনে কোন, ক্ষণে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হইবে তিনি তাহা গণনা করিয়া বলিতে পারিতেন। ক্ষত্রিয়ার গর্ভে তিন পুত্র হইয়াছিল, প্রথম শঙ্কু, দ্বিতীয় বিক্রম, তৃতীয় ভর্তৃহরি। ইহারা ক্ষত্রিয় ধর্মাবলম্বী ও অতি বলবান, এবং বীর পুরুষ ছিলেন, এই জন্য তাহাদের নাম সর্বত্র সুপ্রকাশিত হইয়াছিল। তাহাদিগের বদান্যতাগুণে পৃথিবীস্থ তাবৎ লোকে তাহাদিগকে কল্পবৃক্ষ কহিতেন। বৈশ্যা রাণীর গর্ভে যে পুত্র হইয়াছিল তাহার নাম চন্দ্ররক্ষা, তিনি অতিসুখী ও দয়ালু ছিলেন। শূদ্রা রাণীর গভর্জাত পুত্রের নাম ধন্বন্তরি, তিনি বৈদ্য-শাস্ত্রে অতি পণ্ডিত ছিলেন। এই প্রকার গন্ধর্ব্বসেন রাজার ছয় পুত্র ছিল। তাহারা প্রত্যেকেই এক এক গুণে বিখ্যাত ছিলেন।

 ব্রাহ্মণীর গভজাত পুত্র রাজমন্ত্রী হইয়াছিলেন, কিন্তু কোন অপরাধ জন্য রাজা তাহাকে কর্ম্মচ্যুত করেন, তাহাতে তিনি তথা হইতে ধারা নগরে প্রস্থান করিলেন। ঐ নগরে তোমার পূর্ব পুরুষেরা বাস করিতেন, এবং তৎকালে তোমার পিতা ঐ স্থানের রাজা ছিলেন, তিনি ব্রহ্মনীতকে অতিশয় সম্মান করিলেন। কিন্তু কিছু কাল পরে ব্রহ্মনীত তাহাকে সংহার করিয়া তাহার রাজ্যপহরণ করিলেন। তদনন্তর উজ্জয়িনী নগরে আসিয়া লোকান্তরগত হইলেন। তাহার পর ক্ষত্রিয়া-গভজাত পুত্র শঙ্কু তৎপদে অভিষিক্ত হইয়। অম্বাবতী নগরে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।

 শঙ্কু রাজা হইলে পর এক দিবস সভাপণ্ডিতগণ তাহাকে কহিলেন মহারাজ পৃথিবীতে আপনার এক শত্রু জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। রাজা শঙ্কু এই কথায় সন্ধুচিত হইলেন। পরে পণ্ডিতেরা কহিলেন আমরা গণনা দ্বারা যাহা দেখিলাম তাহাই নিবেদন করিলাম, কিন্তু আর এক কথা আছে তাহা সহসা বলিতে সাহস হয় না। রাজা কহিলেন যখন তোমরা এ কথা বলিলে তখন তাহাও বলিবার বাধা কি। পণ্ডিতেরা কহিলেন আমাদিগের গণনায় এই স্থির হইতেছে রাজা বিক্রমাদিত্য আপনাকে নষ্ট করিয়া রাজ্য লইবেন। শঙ্কু হাস্য করিয়া আর আর সভাসদগণকে বলিলেন এই সকল পণ্ডিতেরা উন্মত্ত, ইহাদের কোন জ্ঞান নাই, এজন্য এমত কথা কহিলেন। ইহা কহিয়া রাজা তাহাদিগের কথায় মনোযোগ করিলেন না। পণ্ডিতেরা বুঝিলেন রাজা শাস্ত্রকে মিথ্যা জানিয়াছেন এবং আমাদিগকে ক্ষিপ্ত জ্ঞান করিয়াছেন। সুতরাং লজ্জিত হইয়া প্রস্থান করিলেন।

 কিয়দিদবস পরে পণ্ডিতেরা পুনৰ্বার জ্যোতি গণনা করিলেন এবং গণনান্তে এক জন কহিলেন আমার বোধ হইতেছে রাজা বিক্রমাদিত্য অতি নিকটে আসিয়াছেন। দ্বিতীয় জন বলিলেন আমার বোধ হয় তিনি নিকটস্থ কোন বনে আছেন। তৃতীয় জন কহিলেন তিনি অমুক বনে সরোবর তটে কুটীর নির্মাণ করিয়া আছেন। তদনন্তর তাহাদিগের এক জন অরণ্যে গমন পূর্ব্বক দেখিলেন যথার্থই রাজা বিক্রমাদিত্য বনমধ্যে সরসী-তীরে বসিয়া পার্থিব শিবলিঙ্গ নির্মাণ করিয়া দেবাধিদেব মহাদেবের আরাধনা করিতেছেন। এতদবলোকনে তিনি আর আর পণ্ডিত গণের নিকট আসিয়া তাহা বিজ্ঞাপন করিলেন এবং সকলে রাজসদনে উপস্থিত হইয়া রাজাকে বলিলেন মহারাজ আপনি আমাদিগের শাস্ত্র মিথ্যা জ্ঞান করিয়াছিলেন,কিন্তু এইক্ষণে আমরা প্রত্যক্ষ দেখিয়া আসিলাম রাজ। বিক্রমাদিত্য অমুক বনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

 রাজা শঙ্কু এই কথা শুনিয়া তখন কোন উত্তর করিলেন না, পরদিবস প্রত্যুষে স্বয়ং সভাপণ্ডিত গণ সমভি ব্যাহারে বিপিন প্রবেশ করিয়া দূরবর্তী থাকিয়া দেখিলেন যথার্থই বিক্রমাদিত্য যোগাসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া সরোবরে অবগাহন করিলেন, তাহার পর পুনব্বার যোগাসনে উপবেশন করিয়া মহাদেবের উপাসনা করিতে লাগিলেন। এতদবলোকনে শঙ্কু বিক্রমাদিত্যের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। বিক্রমাদিত্য একমনে মহাদেবের অর্চনা করিতে লাগিলেন। অর্চনা সমাপন হইলে শঙ্কু মহাদেবের মস্তকে মূত্র ত্যাগ করিয়া দিলেন। ইহা দেখিয়া তাহার সমভিব্যাহারী পণ্ডিতগণ বিস্মিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, কি, পূজিত শিবলিঙ্গের মস্তকে মূত্র ত্যাগ করিল, অতএব এ ব্যক্তির বুদ্ধি লোপ হইয়াছে। পরে তাহাদিগের এক জন রাজাকে কহিলেন মহারাজ এ কি করিলেন। দেবতা ব্রাহ্মণের দর্শন মাত্রে পূজা প্রণামাদি করিতে হয়, তাহা না করিয়া এ কি বিপরীত কর্ম্ম করিলেন। রাজা উত্তর করিলেন আমি দেবতা ব্রাহ্মণের পূজা করিব, মৃত্তিকার পূজা কি জন্য করিব। ব্রাহ্মণ কহিলেন মহারাজ তোমার আসন্নকাল উপস্থিত দেখিতেছি, কেননা আসমুকালে বুদ্ধির বৈলক্ষণ্য জন্মিয়া থাকে। রাজা কহিলেন ভগবান অদৃষ্টে যাহা লিখিয়াছেন তাহা কেহই খণ্ডন করিতে পারে না। পণ্ডিতগণ বলিতে লাগিলেন। বাজা যেরূপ কদর্য্য কার্য করিলেন ইহার আর ভদ্রস্থত নাই।

 অনন্তর শঙ্কু, বিক্রমাদিত্যের বিনাশ বাসনায়, একখান অঙ্গার লইয়া ভূমিতে সাতটা রেখা অঙ্কিত করিলেন, তাহার অভিপ্রায় এই যে, বিক্রমাদিত্য তাহাতে পাদ বিক্ষেপ করিলে তৎক্ষণাৎ জ্ঞানশূন্য ও মরণাপন্ন হইবেন, কিন্তু পাছে রেখা দেখিয়া পাদ বিক্ষেপ না করেন এজন্য তাহা মৃত্তিকা দ্বারা আচ্ছাদিত করিয়া রাখিলেন। তৎপরে একটা সশা ও এক খান ছুরিকা আনাইয়া তাহা এরূপ মন্ত্রপূত করিলেন যে, যে ব্যক্তিঐ ছুরিকা দ্বারা সশ কাটিবে তৎক্ষণাৎ তাহার নিজ মুণ্ড দেন হইবে। সভাসদ গণ বিক্রমাদিত্যের বিনাশের এই সকল কুচক্র দেখিয়া মনে মনে অনেক বিলাপ করিতে লাগিলেন। ক্ষত্রিয়গণ কহিলেন এই প্রকার কুচক্র দ্বারা মহাপ্রাণী বধ করা ক্ষত্রিয়-ধর্ম্ম-বিরুদ্ধ। অনন্তর শঙ্কু বিক্রমাদিত্যকে আহ্বান করিয়া বলিলেন আইস আমরা একত্রে বসিয়া সশা ভক্ষণ করি। বিক্রমাদিত্য সর্ব্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, যোগ দ্বারা শঙ্কুর চক্রান্ত বুঝিয়া রেখাতে পাদক্ষেপ না করিয়া সাবধানে তাহার নিকটে আসিলেন এবং দক্ষিণ হস্তে ছুরিকা ও বাম হস্তে সশা গ্রহণ করিলেন। পরে শঙ্কু যেমন অন্যমনস্ক হইয়াছেন সেই সময় ঐ ছুরিকা দ্বারা তাহাকে এমত আঘাত করিলেন যে তাহাতে একবারে তাহার প্রাণান্ত হইল এবং চক্রান্ত ও বিপরীত-ফল-জনক হইল।

 এতাৰদৰ্শন করিয়া রত্নমঞ্জরী পুত্তলী ভোজরাজকে কহিল মহারাজ পরমেশ্বর ইচ্ছা করিলে তৃণকে পর্ব্বত ও পর্ব্বতকে তৃণ করিতে পারেন। আর শাস্ত্রের লিখন কখন অলীক হয় না। মাতৃগর্ভে মনুষ্যের জন্ম গ্রহণ কালে তাহার ভবিষ্যৎ সুখ দুঃখ ও শুভাশুভ নির্দিষ্ট হয়, তদনুসারে তাহার সুখ দুঃখ ও শুভাশুভ প্রাপ্তি হইয়া থাকে। অতএব রাজা বিক্রমাদিত্যের অদৃষ্টে যাহা ছিল তাহাই ঘটিল। তিনি তাকে সংহার করিয়া তাহার শোণিতে তিলক করিয়া অস্বাবতী নগরের ভূপতি হইলেন। শঙ্কু রাজার পত্নী পতি-বিয়োগে পতির সহিত সহমৃত হইলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য রাজ্য বত্রিশ সিংহাসন। প্রাপ্ত হইয়া রাজ-নিয়মানুসারে রাজত্ব করিতে লাগি- লেন। এবং করস্থ নৃপতিগণ তাহার রাজ্য লাভে সুখী হইয়া সকল সময়ে সভায় উপস্থিত থাকিয়া সভার শােভা বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য মহা সমারােহ পূর্ব্বক মৃগয়ায় গমন করিলেন। এবং অরণ্য মধ্যে এক সনােহর মৃগ দেখিয়া তাহার পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন, কোন সঙ্গী তাঁহার সঙ্গে যাইতে পারিল না। রাজা একাকী এক নিবিড় কাননে প্রবেশ করিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন হায় আমি কোথায় আসিলাম, সঙ্গী গণ কোথায় রহিল, এবং এই ক্ষণে কোথায় যাই। এই চিন্তা করিতে করিতে এক বৃহৎ মহীরুহে আরােহণ করিয়া দেখিলেন সকল দিক অরণ্যময়, কেবল এক দিকে এক নগর মাত্র আছে। তাহা দেখিয়া মনে মনে সাহস হইল। পরে নগরের শােভা ও তন্নিকটে কপােত ও চিল উড়ডীয়মান ও অট্টালিকার উপরিস্থিত কলসের চাকচক্য অবলােকন করিয়া কহিলেন এ এক নূতন নগর দেখিলাম, ইহা গ্রহণ করিতে হইবে।

 রাজা যখন এই সকল কথা বলিতেছেন তখন লুতবরণ নামক ঐ দেশের রাজমন্ত্রী কাকবেশে ঐ অরণ্যাভিমুখে আসিতেছিলেন। তিনি রাজার পূৰ্বোক্ত বাক্যে কুপিত হইয়া তাহার মুখে মল ত্যাগ করিয়া দিলেন। রাজা তাহাতে অত্যন্ত ক্রোধযুক্ত হইলেন। ইত্যবসরে তাহার সঙ্গী লােক তথায় আসিল। তখন রাজা মন্ত্রীকে আজ্ঞা করিলেন যেখানে যত কাক আছে সকলকে আমার নিকটে ধরিয়া আন। এই আজ্ঞাক্রমে মন্ত্রী ব্যাধ গণকে ডাকাইয়া কাক ধারণাথ চতুদ্দিকে প্রেরণ করিলেন। তাহারা যাবতীয় কাক পিঞ্জরে বদ্ধ করিয়া রাজার নিকটে আনিল। রাজা ঐ কাক গণকে কহিলেন অরে চণ্ডালেরা তােমাদের মধ্যে কোন কাক এই কর্ম্ম করিয়াছে তাহা যদি সত্য করিয়া বল তবে আমি সকলকে মুক্তি দি, নতুবা সকলের প্রাণদণ্ড করি। বায়স গণ কহিল আমরা পৃথিবীস্থ তাবৎ কাক এই স্থানে ধৃত আছি, কিন্তু ইহার মধ্যে কোন কাক ঐ কর্ম্ম করে নাই। রাজা এই কথায় অবাে কুপিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তােমাদিগের মধ্যে কে প্রধান, সে অবশ্যই এই কর্ম্ম করিয়াছে। কাকেরা কহিল মহারাজ যদি সত্য বৃত্তান্ত জানিতে ইচ্ছা করেন তবে শুনুন। বাহুবল গ্রামে অতি-পরাক্রমশালী এক রাজা আছেন। লুতরণ নামা উহার এক অতি বিচক্ষণ ও বিদ্বান, মন্ত্রী আছেন, তিনি প্রায়ই সর্ব্বদা বায়স-বেশে থাকেন, এই কর্ম্ম তাহার হইলে হইতে পারে, কেননা কাকের মধ্যে কেবল তিনি ধূত হয়েন নাই। রাজা কহিলেন তাহাকে কি প্রকারে আনয়ন করা যায় তাহা বিবেচনা করিয়া আমাকে বল, এবং তােমাদের মধ্যে দুই কাককে দূত স্বরূপে প্রেরণ কর, তাহারা মন্ত্রিকে লইয়া আইসে।

 ইহা শুনিয়া দুইটা কাক তখনি, কাকবেশী মন্ত্রির নিকটে গমন করিল। মন্ত্রী তাহাদিগকে অতিশয় সমাদর করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তােমরা এখানে কি জন্য আসিয়াছ। তাহারা কহিল মহাশয় তােমার জন্য আমরা তাবৎ কাক মারা যাইতেছি, যদি তুমি রাজা বিক্রমাদিত্যের নিকট গমন কর তবে আমাদের প্রাণ রক্ষা হয়। লুতবরণ বলিলেন ধন্য, তােমরা আপন অর্থ-সিদ্ধির জন্য আমার নিকটে আসিয়াছ, অতএব আমার দ্বারা যাহা হইবেক আমি তাহা অবশ্য করিব। ইহা বলিয়া, মন্ত্রী আপন রাজার অনুমতি লইয়া কাক দ্বয় সমভিব্যাহারে রাজা বিক্রমাদিত্যের সভায় যাত্রা করিলেন। পরে যখন তথায় উপনীত হইলেন তখন আর আর কাক গণ তাহাকে দেখিয়া রাজাকে বলিল মহারাজ যাহার নাম করিতে ছিলাম তিনি এই আসিতেছেন।

 রাজা কাকবেশী মন্ত্রিকে সমাদর পূর্বক আপন সিংহাসনে বসাইয়া কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। মন্ত্রী রাজাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন, এবং জিজ্ঞাসা করিলেন মহারাজ আমাকে কি জন্য স্মরণ করিয়াছেন, আর কিজন্যই বা এই সকল কাককে বন্দীবেশে রাখিয়াছেন। রাজা উত্তর করিলেন আমি এক দিবস, মৃগয়াতে গিয়াছিলাম, অকস্মাৎ নিবিড় বন মধ্যে প্রবেশ করিয়া পথভ্রান্তি প্রযুক্ত এক বৃক্ষারােহণ করিয়া চতুদিকে দৃষ্টি করিতে ছিলাম, এমত সময়ে একটা কাক আমার গাত্রে মল ত্যাগ করিয়া দিল, এই জন্য আমি সকল কাককে ধরিয়া রাখিয়াছি। যে পর্যন্ত ইহারা প্রথম পুত্তলিকা। সত্য না কহিবে সে পর্যন্ত আমি কাহাকে ছাড়িব না, বরঞ্চ প্রাণ দণ্ড করিব। লুতবরণ কহিলেন এ কর্ম্ম আমার দ্বারা হইয়াছে, আমি তােমার অহঙ্কার দেখিয়া ক্রোধ সম্বরণ করিতে না পারিয়া জ্ঞানশূন্যতা প্রযুক্ত এই কর্ম্ম করিয়াছিলাম। রাজা এই বাক্যে হাস্য করিয়া বলিলেন আমি ভূস্বামী, এবং যােদ্ধা, আমি কোন বিষয়ে অক্ষম নহি, অতএব আমার অহঙ্কার কেন না, হইবে।

 লুতবরণ কহিলেন তুমি যে নগর দর্শন করিয়াছ তাহার বিবরণ শ্রবণ কর। রাজা বাহুবল ঐ রাজ্যের পুরাতন নৃপতি, তােমার পিতা গন্ধর্ব্বসেন তাহার মন্ত্রী ছিলেন, পরে মন্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস হওয়াতে রাজা তাহাকে কর্ম্মচ্যুত করেন, তাহাতে তিনি অম্বাবতী নগরে আসিয়া রাজা হইয়া ছিলেন। তুমি বিক্রমাদিত্য, ঐ গন্ধর্ব্বসেনের পুত্র। তুমি এক্ষণে জগদ্বিখ্যাত হইয়াছ, কিন্তু বাহুবল রাজা যে পর্যন্ত তােমাকে রাজ-তিলক না দিবেন সে পর্যন্ত তােমার অচলা লক্ষ্মী হইবেক না। পরন্তু ঐ রাজা তােমার এরূপ অবস্থার সংবাদ পাইলে তােমাকে ভস্মসাৎ করিবেন। অতএব, তোমাকে এক সৎপরামর্শ কহি, তুমি ঐ রাজার। নিকটে গিয়া তাহাকে প্রণয় দ্বারা প্রীত করিয়া, তাহার নিকটে রাজ-তিলক গ্রহণ কর, তাহা হইলে তােমার অচলা, রাজলক্ষ্মী হইবেক।

 রাজা বিক্রমাদিত্য অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন, অতএব এই বাক্যে রুষ্ট না হইয়া প্রত্যুত সহাস্যবদনে তৎসমুদায় অবধান করিয়া শুনিলেন। পরে লুতবরণ তাঁহাকে কহিলেন যদি তােমার বাহুবল রাজার নিকটে যাওয়া পরামর্শ সিদ্ধ হয় তবে শুভক্ষণ দেখিয়া আমার সমভিব্যাহারে আইস।

 রাজা বিক্রমাদিত্য লুতবরণ মন্ত্রীর পরামর্শানুসারে পরদিবস তাহার সমভিব্যাহারে বাহুবল রাজার নগরে যাত্রা করিলেন। তথায় উপনীত হইলে লুতবরণ বিক্রমাদিত্যকে বলিলেন তুমি এইখানে অবস্থিতি কর, আমি অগ্রে রাজার নিকট তােমার আগমন সংবাদ বিজ্ঞাপন করি, তাহার পর সাক্ষাৎ হইবে। ইহা বলিয়া লুতবরণ স্বীয় নৃপতি সমীপে উপস্থিত হইয়া তাহাকে তাবৎ বৃত্তান্ত বিজ্ঞাপন পূর্ব্বক কহিলেন মহারাজ গন্ধর্ব্বসেনের পুত্র রাজা বিক্রমাদিত্য আপনকার দর্শনার্থ আগমন করিয়াছেন। ইহা শুনিয়া বাহুবল রাজা তাহাকে তৎক্ষণাৎ আনয়ন করিতে আজ্ঞা দিলেন। মন্ত্রী তাহাকে আনয়ন করিলে রাজা গাত্রোখান পূর্ব্বক আলিঙ্গন করিয়া আপন সিংহাসনের এক পাশে উপবেশন করাইয়া কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। তদনন্তর রাজা তাঁহার বাসার জন্য স্থান নিরূপণ করিয়া দিলেন।

 রাজা বিক্রমাদিত্য কিয়দিবস তথায় অবস্থিতি করিয়া মন্ত্রীকে কহিলেন আমি স্বদেশে গমন করিব, অতএব রাজার নিকট হইতে আমাকে বিদায় করাইয়া দাও। মন্ত্রী কহিলেন আমাদিগের রাজার এমত রীতি নাই, যে কোন ব্যক্তি সাক্ষাৎ করিবার অভিলাষে আসিলে তাহাকে আপনি যাইতে বলেন। অতএব তুমি স্বয়ং বিদায় প্রার্থনা কর, আর যে মনােবাঞ্ছা থাকে তাহাও প্রকাশ করিয়া বল, তাহাতে কোন শঙ্কা করিও। বিক্রমাদিত্য বলিলেন আমার কোন অভিলাষ নাই, বরঞ্চ অন্য কোন ব্যক্তির যদি কোন প্রার্থনা থাকে তাহা আমাকে বলুক। মন্ত্রী বলিলেন মহারাজ আমার কথা শ্রবণ কর, এই রাজার গৃহে এক অপূর্ব্ব সিংহাসন আছে, পূর্ব্বকালে ঐ সিংহাসন দেবদিদেব মহাদেব দেবরাজ ইন্দ্রকে দিয়াছিলেন, পরে ইন্দ্র তাহা বাহুবল রাজাকে দিয়াছেন। ঐ সিংহাসনের অতি চমৎকার গুণ, যে ব্যক্তি তাহাতে উপবেশন করেন তিনি সপ্তদ্বীপ পৃথিবীর অজেয় রাজা হয়েন। ঐ সিংহাসন নানাবিধ রত্নে খচিত এবং অমর্ত্য নির্মিতা অতি অপূৰ্বরূপ বত্রিশ পুত্তলিকা তাহা ধারণ করিয়া আছে। তুমি বিদায় কালে রাজার স্থানে ঐ সিংহাসন প্রার্থনা করিও, তাহা হইলে চিরকাল অখণ্ড সাম্রাজ্য ভােগ করিতে পারিবে।

 এই পরামর্শ প্রদানের পর মন্ত্রী পরদিবস ত্যুষে রাজ-সভায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন মহারাজ রাজা বিক্রমাদিত্য বিদায়নিমিত্ত আপনকার দ্বারে দণ্ডায়মান আছেন। এই সংবাদে বাহুবল রাজা তখনি দ্বারের নিকটে আসিলে, বিক্রমাদিত্য নতশিরা হইয়া তাহাকে প্রণাম করিলেন। বাহুবল রাজা বলিলেন তােমার যাহা অভিলাষ থাকে কহ, আমি তাহা পূর্ণ করিব। বিক্রমাদিত্য কহিলেন মহারাজ যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন তবে আমি এই প্রার্থনা করি দেবরাজ আপনাকে যে সিংহাসন দিয়াছিলেন আপনি সানুগ্রহ হইয়া আমাকে তাহা দান করুন। রাজা বাহুবল বলিলেন এই সিংহাসনের কথা তুমি কি প্রকারে জানিতে পারিলে, বােধ করি, মন্ত্রির স্থানে শুনিয়া থাকিবে। যাহা হউক আমি তােমাকে সেই সিংহাসন দিলাম। ইহা বলিয়া সেই সিংহাসন আনয়ন করাইয়া বিক্রমাদিত্যকে রাজ-তিলক প্রদান পূর্ব্বক তদুপরি উপবেশন করাইলেন, এবং বলিলেন তুমি অদ্বিতীয় ও অজেয় রাজা হইলে, কোন বিষয়ে অন্তঃ করণে ক্ষোভ করিও না, গন্ধর্ব্বসেন আমার পরম বন্ধ, ছিলেন, তুমি তাহার বংশের তিলক হইবে। এই প্রকার আশীৰ্বাদ পূর্ব্বক রাজা বিক্রমাদিত্যকে বিদায় করিলেন।

 রাজা বিক্রমাদিত্য অত্যন্ত আহলাদিত হইয়া তথা হইতে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। রাজ্যস্থ তাবৎ প্রজা তাহার সৌভাগ্য শুনিয়া আনন্দ সাগরে মগ্ন হইল। শত্রুগণ ভয়ে কম্পানৃিতকলেবর হইল। এবং নানা দ্বীপ দ্বীপান্তর হইতে সুহৃৎ রাজা সকল তাঁহার সহিত শুভ সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তদবধি সকল রাজা তাহাকে আরাে মান্য করিতে লাগিলেন। যাহারা তাহা না করিলেন, বা, কোন প্রকার অহঙ্কার প্রকাশ করিয়া তাহার প্রতি বিদ্বেষাচরণ করিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য তাহাদিগকে রাজ্যচ্যুত করিয়া ঐ সকল রাজ্য স্বয়ং শাসন করিতে লাগিলেন। এই প্রকারে পৃথিবীর পূৰ্বাবধি পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত তাহার রাজ্য বিস্তৃত হইল, এবং তাবৎ প্রজা সুখে কাল যাপন করিতে লাগিল। দুৰ্বত্ত দস্যগণ তাহার প্রতাপের বশীভূত হইয়া দস্যুবৃত্তি হইতে একবারে নিবৃত্ত হইল। ভ্রমণ কারীগণ অকুতােভয়ে দেশ ভ্রমণ করিতে লাগিলেন, যিনি যেখানে যাইতেন সেই খানেই রাজা বিক্রমাদিত্যের যশােবাদ ও গুণানুবাদ শ্রবণ করিতেন। এবং প্রজাদিগের গৃহ ধন ধান্যে ও আনন্দ রসে পরিপূর্ণ দেখিতেন। কেহ কাহার প্রতি অন্যায় অত্যাচার করিআছে বিক্রমাদিত্যের রাজ্যে এমত কথা কে কখন শ্রবণ করেন নাই।

 এই রূপ রাজ্য বিস্তার করিয়া এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য সভায় বসিয়া পণ্ডিত গণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার ইচ্ছা, আমার নামে অব্দ প্রচলিত হয়, অতএব তােমরা বিবেচনা করিয়া বল, আমি ইহার যােগ্য কি না। পণ্ডিত গণ বলিলেন মহারাজ আপনার প্রতাপে ত্রিভুবন সশঙ্কিত এবং আপনার শত্রু অথবা তুল্য রাজা কুত্রাপি নাই, অতএব আপনি সর্ব্ব মতে তাহার যােগ্য। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন অব্দ প্রচলিত করুণার্থ কি কর্ত্তব্য। পণ্ডিতেরা বলিলেন প্রথমতঃ দেশ বিদেশীয় ভূম্যধিকারী ও রাজা ও তাবৎ জাতীয় লােককে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিতে হইবে, তৎপরে এক লক্ষ পঞ্চবিংশতি সহস্র কন্যা ও এক লক্ষ পঞ্চবিংশতি সহস্র গাভী ব্রাহ্মণকে দান করিবেন। এবং রাজ্যস্থ তাবৎ ব্রাহ্মণদিগের জীবিকা নির্বাহার্থে এক এক নিস্কর ভূম্যধিকার নির্দিষ্ট করিয়া দিবেন। ইহা ভিন্ন এক বৎসর কোন ভূম্যধিকারীর স্থানে কর গ্রহণ করিবেন না, এবং এক বৎসরের মধ্যে যত ক্ষুধাতুর আতুর দীন দরিদ্র নিকটে আসিবে তাহাদিগের চিরকালের নিমিত্ত জীবনােপয় করিয়া দিবেন। এই সকল কর্ম্ম করিলে পর আপনার নামে চিরকাল। সংবৎ চলিবে।

 রাজা পণ্ডিতের বিধানানুসারে এক বৎসর পর্যন্ত কন্যা দান ও গাে দান এবং আর আর ধর্ম্ম কর্ম্মাদি করিলেন। তাহার পর সংবৎ সৃষ্টি হইল। সেই সংবৎ অদ্যাপি তাহার নামে চলিয়া আসিতেছে।

 বসুমঞ্জরী রাজা বিক্রমাদিত্যের এই সকল গুণানুবাদ করিয়া কহিল হে ভােজরাজ, রাজা বিক্রমাদিত্য এই প্রকার মনুষ্য ছিলেন। তুমি যদি তাহার ভুল হইতে পার তবে সিংহাসনারােহণ কর। ভােজরাজ বলিলেন তুমি যে সকল কথা কহিলে তাহা প্রকৃত ও আমার মনােনীত বটে। তদনন্তর সভাসদ গণকে বলিলেন আমিও সংবৎ সৃষ্টি করিব, তােমরা সকলে তাহার উদ্যোগ কর। এই মন্ত্রণায় সেই দিবস গত হইল।  পর দিবস রাজা প্রাতঃকালে গাত্রোখান করিয়া পুনর্ব্বার সিংহাসনােপবেশনে ব্যগ্রচিত্ত হইয়া মন্ত্রীকে অবিলম্বে সভা করিতে আজ্ঞা দিলেন। মন্ত্রী কহিলেন মহারাজ এত ব্যস্ত হইয়াছেন কেন, বােধ হয় সিংহাসনের প্রত্যেক পুত্তলিকা এক এক প্রবন্ধ কহিবে, অতএব তাহা শুনিয়া যাহা কর্ত্ত হয় করিবেন। রাজা সে বাক্যে কর্ণপাত না করিয়া সিংহাসনারূঢ় হইবার জন্য পদ প্রসারণ করিলেন। তখন