বত্রিশ সিংহাসন/১৯

উইকিসংকলন থেকে

তারা ঊনবিংশ পুত্তলিকা

হাস্য করিয়া কহিল, মহারাজ তুমি কি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছ, তুমি এই সিংহাসনে উপবেশন করিলে পাপগ্রস্ত হইবে, ইহা কি একবারও মনে কর না। তুমি রাজা বিক্রমাদিত্যকে কি জ্ঞান করিয়াছ। আমাদের হৃদয়। কমলরূপ, রাজা বিক্রমাদিত্য তাহার মধুকর ছিলেন। তুমি কীট হইয়া কোন সাহসে আমাদের অঙ্গে চরশোত্তোলন করিতে চাহ। রাজা বলিলেন তুমি কোন বিবেচনায় আমাকে কীট বলিয়া ব্যাখ্যা করিলে। পুত্তলী উত্তর করিল তবে এক বিবরণ কহি শ্রবণ কর।

 এক দিবস, সামুদ্রিকশাস্ত্রে সুপণ্ডিত সামুদ্রিক নামে এক ব্রাহ্মণ বন গমন করিতে করিতে দেখিলেন, কোন ব্যক্তি ঐ পথ দিয়া গিয়াছে, তাহার চরণচিহ্ রহিয়াছে। ঐ পদচিহ্নে পদ্ম ও উর্দ্ধরেখা আছে। ভদবলোকনে মনে মনে ভাবিলেন এই পথদিয়া কোন রাজপুরুষ গিয়া থাকিবেন, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে। ইহা ভাবিয়া চিল্লানুগামী হইয়া চলিলেন, ব্রাহ্মণ এক ক্রোশ পথ গমন করিয়া দেখিলেন এক সামান্য মনুষ্য বৃক্ষ হইতে কাষ্ঠ ভগ্ন করিয়া বোর বান্ধিতেছে। বিপ্র তাহার নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি এই বনে কত ক্ষণ আসিয়াছ। সে কহিল আমি রাত্রি দুই ঘটিকা থাকিতে এখানে আসিয়াছি। ব্রাহ্মণ পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসিলেন তুমি আর কোন ব্যক্তিকে এই পথ দিয়া আসিতে দেখিয়াছ কি না। ঐ ব্যক্তি বলিল আমি যে সময়ে আসিয়াছিলাম সে সময়ে, মনুষ্য দুরে থাকুক পশু পক্ষীও দেখিতে পাই নাই। ব্রাহ্মণ কহিলেন তবে তুমি আমাকে তোমার দুই খানি চরণ দেখাও দেখি। এই কথায় সে ব্যক্তি ব্রাহ্মণকে আপনার দুইখানি পদ দেখাইল।

 ব্রাহ্মণ দেখিলেন তাহার চরণ রাজলক্ষণাক্রান্ত বটে, কিন্তু তাহার দুরবস্থা দর্শনে মনে মনে চমৎকৃত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কত দিবস অবধি এই কর্ম্ম করিতেছ। সে কহিল যে অবধি আমার জ্ঞান উৎপন্ন হইয়াছে সেই অবধি আমি এই কর্ম্ম করিয়া উদরান করিতেছি। বিপ্র কহিলেন তুমি অনেক ক্লেশ পাইতেছ। সে কহিল ইহা ভগবানের ইচ্ছা, তাহার ইচ্ছাতে কোন ব্যক্তি গজারোহণ করে, কেহ পদব্রজে চলে, কেহ বিনা আকাঙ্ক্ষায় অতুল ঐশ্বর্য্য প্রাপ্ত হয়, কেহবা ভিক্ষা করিয়াও উদরান করিতে পারে না, কেহ নানা সুখে উল্লাসিত, কেহ বা অতি দুঃখে ব্যাকুলিত। সুখ দুঃখের মূল পরমেশ্বর। তিনি যাহার অদৃষ্টে যাহা লিখিয়াছেন তাহাকে তাহ। ভোগ করিতে হইবে। তাহা খণ্ডন করা মনুষ্যের সাধ্যনহে।

 ব্রাহ্মণ তাহার প্রমুখাৎ এই সকল বাক্য শ্রবণ করিয়া এবং তাহার চরণচিত্ন দর্শন করিয়া মনে মনে কহিলেন হায়, আমি এত পরিশ্রম করিয়া সামুদ্রিক বিদ্যা শিক্ষা করিলাম, সে সকল পরিশ্রম বিফল হইল, আমার জীবনকাল অনর্থক গেল। এইরূপ আক্ষেপ করিতে করিতে ব্রাহ্মণ রাজার সদনে চলিলেন, মনে মনে কহিতে লাগিলেন পুস্তকে যে যে রাজচিত্ন লিখিয়াছে যদি তাহা রাজার চরণে দেখিতে পাই, ভাল, নতুবা সকল পুস্তক ছিন্ন করিয়া অগ্নিতে আহুতি দিব, এবং বৈরাগ্য লইয়া তীর্থে গমন করিব, সংসারের সহিত কোন সম্পর্ক রাখিব না। তিনি আক্ষেপ পূর্ব্বক আরও কহিলেন হায় মিথ্যা কর্ম্মের নিমিত্ত এতকাল বৃথা পরিশ্রম করিলাম, তাহার ফল কিছুই হইল না। এই শাস্ত্রের আলোচনা অপেক্ষা পরমেশ্বরের ভজনা করা উত্তম, তাহাতে যদিও আশু উপকার নাই, কিন্তু চরমে পরম পদার্থ লাভ হইবে।

 এবম্বিধ চিন্তা করিতে করিতে দ্বিজবর রাজসভাতে উপস্থিত হইয়া রাজাকে আশীর্বাদ করিয়া দাড়াইলেন। রাজা দণ্ডবৎ প্রণাম পূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, হে বিপ্ল শ্রেষ্ঠ, তোমার বদন কেন অপ্রফুল্ল দেখিতেছি, তোমার মনে কি দুঃখোদয় হইয়াছে, আমাকে বল। ব্রাহ্মণ কহিলেন, তুমি প্রথমে আমাকে ভোমার দুইখানি চরণ দেখাও, তাহাতে আমার চিত্তের সংশয় দূর হউক। রাজা তৎক্ষণাৎ তাহাকে আপন চরণ দর্শন করাইলেন। তাহাতে কোন রাজলক্ষণাদি দৃষ্টি হইল না। তখন ব্রাহ্মণ অধোবদন হইয়া মৌন থাকিলেন। মনে মনে কহিতে লাগিলেন এখন গ্রন্থ সকল অনলে সমর্পণ করিয়া সংসার পরিত্যাগ পূর্ব্বক সন্ন্যাসী বেশে দেশে দেশে ভ্রমণ করাই কর্ত্তব্য। ইহা চিন্তা করিতেছেন এমত সময়ে রাজা তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলেন, হে পণ্ডিতাগ্রগণ্য, তুমি কি জন্য ক্রোধ করিয়াছ, এবং এ প্রকার অভোবদন হইয়া থাকিবার কারণ কি। তোমার মনের কথা প্রকাশ করিয়া কহ, তুমি কি চিন্তা করিতেছ। ব্রাহ্মণ বলিলেন হে রাজরাজেশ্বর, আমি দ্বাদশ বৎসর সামদ্রিক শাস্ত্র পাঠ করিয়াছিলাম, কিন্তু সে পরিশ্রম আমার নিষ্ফল হইয়াছে, এই জন্য আমার মন বিকল হইয়াছে। রাজা বলিলেন তুমি ইহার প্রমাণ কি প্রকারে পাইলে। ব্রাহ্মণ বলিলেন মহারাজ আমি এক ব্যক্তির চরণে উর্দ্ধরেখা ও পদ্ম চিনু দেখিলাম, কিন্তু সে ব্যক্তি অতি দুঃখী, অরণ্য হইতে কাষ্ঠ আনিয়া উদরপূর্ত্তি করে। অনন্তর তোমারও পদ সৃষ্টি করিলাম, ইহাতেও উত্তম চিত্ন নাই, অথচ তুমি ভূপতি। এই জন্য আমার অন্তঃকরণে ক্রোধোদয় হইয়াছে, আমি পাজি পুথি সকল অনলে সমর্পণ করিয়া সংসার পরিত্যাগ করিব।

 ভূপাল বলিলেন হে বিপ্রবর তুমি ব্যস্ত হইওনা, এই লক্ষণ কোন ব্যক্তির গুপ্ত, কাহারো দৃশ্যমান থাকে। ব্রাহ্মণ কহিলেন ইহা আমি কি প্রকারে জানিব। তখন রাজা অস্ত্র আনাইয়া আপন চরণের চর্ম উঠাইলেন। ব্রাহ্মণ দেখিলেন তাহাতে কমল ও উর্দ্ধরেখা আছে। অনন্তর ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসিলেন, যে ব্যক্তি কাষ্ঠ বিক্রয় করিয়া উদর পালন করে তাহার রাজলক্ষণ থাকিয়াও কেন তাহার দৈন্যদশা দূর হয় নাই। রাজা বলিলেন তাহার আর কোন দোষের চিঃ থাকিবে, তাহাতেই তাহার সৌভাগ্য নাশ করিয়াছে। পরে, এই কথা প্রমাণের জন্য তাহাকে অন্বেষণ করিয়া আনিয়া দেখিলেন তাহার পদে কাকপদ চিহ্ও আছে। ঐ চিয়ে কখন সৌভাগ্যকে নিকটবর্তী হইতে দেয় না, তাহাতে তাহার রাজলক্ষণ বিফল হইয়াছে। ইহাতে ব্রাহ্মণ অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন, এবং বুঝিলেন সামুদ্রিক শাস্ত্র মিথ্যা নহে। পরে রাজাকে আশীর্ব্বাদ করিয়া গৃহে প্রস্থান করিলেন।

 এই বিবরণ সমাপন করিয়া পুত্তলিকা কহিল, হে ভোজরাজ, তুমি এমত কি জ্ঞানাভ্যাস করিয়াছ যে। এই সিংহাসননাপবেশন করিবে। দেখ, রাজা বিক্রমদিত্য কেমন পণ্ডিত ছিলেন এবং ব্রাহ্মণের সন্দেহ ভঞ্জনার্থ আপন শরীর কাটিয়া দেখাইলেন। তোমার এমন গুণ কোথায়, যদি তুমি আপন শরীর কার্টিতে তবে সিংহাসনোপবেশনের যোগ্য হইতে পারিবে। হে ভোজরাজ তুমি আপন মনে চিন্তা করিয়া দেখ, মৃত্যু হইলেও মনুষ্যের নাম ধর্ম্ম ও যশঃ যায়না। সুগন্ধযুক্ত পুষ্প যদিও শুষ্ক হয় তথাপি তাহার সুগন্ধ 'দূর হয় না। অতএব যশঃ উপার্জনই মানব-জন্মের সার কর্ম।

 এই সমস্ত বাক্য শুনিয়া রাজার জ্ঞানোদয় হইল। তিনি কহিলেন এই সংসার মায়া প্রপঞ্চ মাত্র। ছায়া যেমন অনিত্য, পৃথিবী সেইরূপ। মনুষ্যের জীবন মৃত্যু, চন্দ্র সূর্যের গতির ন্যায়। এবং স্বপ্নে যে প্রকার কৌতুক দর্শন করাযায় সংসারও সেইরূপ। মনুষ্যদেহ ধারণে অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়। জ্ঞানোপার্জনই কেবল সুখের সাধন।

 মনোমধ্যে এই সকল জ্ঞানের কথা পর্যালোচনা করিতে করিতে রাজা স্বীয় মন্দিরে গমন করিলেন। সিংহাসনারোহণ করিলেন না। কোন প্রকারে রাত্রি যাপন করিয়া, পর দিবস অরুণোদয়ানন্তর সভায় আসিয়া সিংহাসনারোহণে উদ্যত হইলে,