বনবাণী/নবীন

উইকিসংকলন থেকে

নবীন

প্রথম পর্ব

বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী,
দিক্‌প্রান্তে, বনবনান্তে,
শ্যাম প্রান্তরে, আম্রছায়ে,
সবোবরতীরে, নদীনীরে,
নীল আকাশে, মলয়বাতাসে
ব্যাপিল অনন্ত তব মাধুরী।

নগরে গ্রামে কাননে,
দিনে নিশীথে,
পিকসংগীতে, নৃত্যগীতকলনে
বিশ্ব আনন্দিত—
ভবনে ভবনে
বীণাতান রণ-রণ ঝংকৃত।

মধুমদমোদিত হৃদয়ে হৃদয়ে রে
নবপ্রাণ উচ্ছ্বসিল আজি,
বিচলিত চিত উচ্ছলি উন্মাদনা
ঝন-ঝন ঝনিল মঞ্জীরে মঞ্জীরে॥


 শুনেছ অলিমালা, ওরা ধিক্কার দিচ্ছে ওই ও পাড়ার মল্লের দল; তোমাদের চাপল্য তাদের ভালো লাগছে না। শৈবালগুচ্ছবিলম্বী ভারী ভারী সব কালো কালো পাথরগুলোর মতো তমিস্রগহন গাম্ভীর্যে ওরা গুহাদ্বারে ভ্রূকুটি পুঞ্জিত করে বসে আছে। কলহাস্যচঞ্চলা নির্ঝরিণী ওদের নিষেধ লঙ্ঘন করেই বেরিয়ে পড়ুক এই আনন্দময় বিশ্বের আনন্দপ্রবাহ দিকে দিগন্তে বইয়ে দিতে, নাচে গানে কল্লোলে হিল্লোলে—চূর্ণ চূর্ণ সূর্যের আলো উদ্‌বেল তরঙ্গভঙ্গের অঞ্জলিবিক্ষেপে ছড়িয়ে ছড়িয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। এই আনন্দ-আবেগের অন্তরে অন্তরে যে অক্ষয় শৌর্যের অনুপ্রেরণা আছে সেটা ও পাড়ার শাস্ত্রবচনের বেড়া এড়িয়ে চলে গেল। ভয় কোরো না তোমরা, যে রসরাজের নিমন্ত্রণে এসেছ তাঁর প্রসন্নতা যেমন আজ নেমেছে আমাদের নিকুঞ্জে ওই অন্তঃস্মিত গন্ধরাজ মুকুলের প্রচ্ছন্ন গন্ধরেণুতে, তেমনি নামুক তোমাদের কণ্ঠে, তোমাদের দেহলতার নিরুদ্ধ নটনোৎসাহে। সেই যিনি সুরের গুরু, তাঁরই চরণে তোমাদের নৃত্যের নৈবেদ্য আজ নির্ঝরিত করে দাও।

সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা,
মোরা সুরের কাঙাল এই আমাদের ভিক্ষা।
মন্দাকিনীর ধারা
উষার শুকতারা
কনকচাঁপা কানে কানে যে সুর পেল শিক্ষা।
তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত
যাব যেথায় বেসুর বাজে নিত্য।
কোলাহলের বেগে
ঘুর্ণি উঠে জেগে,
নিয়ো তুমি আমার বীণার সেইখানেই পরীক্ষা।


তুমি সুন্দর যৌবনঘন
রসময় তব মূর্তি,
দৈন্যভরণ বৈভব তব
অপচয়পরিপূর্তি।

নৃত্য গীত কাব্য ছন্দ
কলগুঞ্জন বর্ণ গন্ধ
মরণহীন চিরনবীন
তব মহিমাস্ফূর্তি॥


 ও দিকে আধুনিক আমলের বারোয়ারির দল বলছে, উৎসবে নতুনকিছু চাই। কোণা-কাটা ত্যাড়াবাঁকা, দুম্‌দাম্‌-করা কড়া-ফ্যাশানের আহেলা বেলাতি নতুনকে না হলে তাদের শুকনো মেজাজে জোর পৌঁচচ্ছে না। কিন্তু যাঁদের রসবেদনা আছে তাঁরা কানে কানে বলে গেলেন, আমরা নতুন চাই নে, আমরা চাই নবীনকে। এঁরা বলেন, মাধবী বছরে বছরে বাঁকা করে খোঁচা মেরে সাজ বদলায় না, অশোক পলাশ একই পুরাতন রঙে নিঃসংকোচে বারে বারে রঙিন। চিরপুরাতনী ধরণী চিরপুরাতন নবীনের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়া জুডন না গেল।’ সেই নিত্যনন্দিত সহজশোভন নবীনের উদ্দেশে তোমাদের আত্মনিবেদনের গান শুরু করে দাও।

আন্ গো তোরা কার কী আছে,
দেবার হাওয়া বইল দিকে দিগন্তরে-
এই সুসময় ফুরায় পাছে।
কুঞ্জবনের অঞ্জলি-যে ছাপিয়ে পড়ে,
পলাশকানন ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে,
বেণুর শাখা তালে মাতাল পাতার নাচে।

প্রজাপতি রঙ ভাসালো নীলাম্বরে,
মৌমাছিরা ধ্বনি উড়ায় বাতাস-’পরে।
দখিনহাওয়া হেঁকে বেড়ায় ‘জাগো জাগো’—

দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানে না গো,
রক্তরঙের জাগল প্রলাপ অশোক গাছে॥

 আজ বরবর্ণিনী অশোকমঞ্জরী তার চেলাঞ্চল-আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে আকাশে রক্তরঙের কিঙ্কিণীঝংকার বিকীর্ণ করে দিলে; কুঞ্জবনের শিরীষবীথিকায় আজ সৌরভের অপরিমেয় দাক্ষিণ্য। ললিতিকা, আমরাও তো শূন্য হাতে আসি নি। মাধুর্যের অতল সমুদ্রে আজ দানের জোয়ার লেগেছে, আমরাও ঘাটে ঘাটে দানের বোঝাই তরীর রসি খসিয়ে দিয়েছি। যে নাচের তরঙ্গে তারা ভেসে পড়ল সেই নাচের ছন্দটা, কিশোর, দেখিয়ে দাও।

ফাগুন, তোমার হাওয়ায় হাওয়ায়
করেছি-যে দান
আমার আপন-হারা প্রাণ,
আমার বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ।
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,
তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান।

পূর্ণিমাসন্ধ্যায়
তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধচোখের রঙিন-স্বপন মাখা।
তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান॥

 ভরে দাও, একেবারে ভরে দাও গো, ‘প্যালা ভর ভর লায়ী রে।’ পূর্ণের উৎসবে দেওয়া আর পাওয়া, একেবারে একই কথা। ঝর্নার এক প্রান্তে কেবলই পাওয়া অভ্রভেদী শিখরের দিক থেকে, আর-এক প্রান্তে কেবলই দেওয়া অতলস্পর্শ সমুদ্রের দিক-পানে। এই ধারার মাঝখানে শেষে বিচ্ছেদ নেই। অন্তহীন পাওয়া আর অন্তহীন দেওয়ার নিরবচ্ছিন্ন আবর্তন এই বিশ্ব। আমাদের গানেও সেই আবৃত্তি, কেননা, গান তো আমরা শুধুকেবল গাই নে, গান যে আমরা দিই। তাই গান আমরা পাই।

গানের ডালি ভরে দে গাে উষার কোলে-
আয় গো তোরা, আয় গাে তােরা, আয় গাে চলে।
চাঁপার কলি চাঁপার গাছে
সুরের আশায় চেয়ে আছে,
কান পেতেছে নতুন পাতা, গাইবি বলে।

কমলবরন গগন-মাঝে
কমলচরণ ঐ বিরাজে।
ঐখানে তাের সুর ভেসে যাক,
নবীন প্রাণের দেশে যাক,
ঐ যেখানে সােনার আলাের দুয়ার খােলে॥

 মধুরিমা, দেখো দেখো, চন্দ্রমা তিথির পর তিথি পেরিয়ে আজ তার উৎসবের তরণী পূর্ণিমার ঘাটে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। নন্দনবন থেকে কোমল আলোর শুভ্র সুকুমার পারিজাতস্তবকে তার ডালি ভরে আনল। সেই ডালিখানিকে ওই কোলে নিয়ে বসে আছে কোন্ মাধুরীর মহাশ্বেতা। রাজহংসের ডানার মতো তার লঘু মেঘের শুভ্র বসনাঞ্চল স্রস্ত হয়ে পড়েছে ওই আকাশে, আর তার বীণার রুপোর তন্তুগুলিতে অলস অঙ্গুলিক্ষেপে থেকে থেকে গুঞ্জরিত হচ্ছে বেহাগের তান।

নিবিড় অমা-তিমির হতে
বাহির হল জোয়ারস্রোতে
শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।
ভরিল ভরা অরূপ ফুলে,
সাজালাে ডালা অমরাকুলে
আলাের মালা চামেলিবরণী—
শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।

তিথির পরে তিথির ঘাটে
আসিছে তরী দোলের নাটে,
নীরবে হাসে স্বপনে ধরণী।

উৎসবের পশরা নিয়ে
পূর্ণিমার কূলেতে কি এ
ভিড়িল শেষে তন্দ্রাহরণী-
শুক্লরাতে চাঁদের তরণী॥

 দোল লেগেছে এবার। পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝখানে এই দোল। এক প্রান্তে মিলন, আর-এক প্রান্তে বিরহ, এই দুই প্রান্ত স্পর্শ করে করে দুলছে বিশ্বের হৃদয়। পরিপূর্ণ আর অপূর্ণের মাঝখানে এই দোলন। আলোতে ছায়াতে ঠেকতে ঠেকতে রূপ জাগছে জীবন থেকে মরণে, বাহির থেকে অন্তরে। এই ছন্দটি বাঁচিয়ে যে চলতে চায় সে তো যাওয়া-আসার দ্বার খোলা রেখে দেয়। কিন্তু, ওই-যে হিসাবি মানুষটা দ্বারে শিকল দিয়ে আঁক পাড়ছে, তার শিকল নাড়া দাও তোমরা। ঘরের লোককে অন্তত আজ এক দিনের মতো ঘর-ছাড়া করো।

ওরে গৃহবাসী, তোরা খোল্‌ দ্বার খোল্
লাগল-যে দোল।

স্থলে জলে বনতলে
লাগল-যে দোল।
খোল্‌ দ্বার খোল্‌।

রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
খোল্‌ দ্বার খোল্‌।

বেণুবন মর্মরে দখিনবাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে-
মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।
খোল্‌ দ্বার খোল্‌॥


আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়,
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।
যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে,
ভালােবাসে আড়াল থেকে,
আমার মন মজেছে সেই গভীরের
গােপন ভালােবাসায়॥


 সর্বনাশের ব্রত যাদের তাদের ভয় ভাঙিয়ে দাও। কারো কারো যে দ্বিধা ঘোচ না। ওই দেখো-না পাতার আড়ালে মাধবী। ওই অবগুণ্ঠিতাদের সাহস দাও। শুনছ না, বকুলগুলো ঝরতে ঝরতে বলছে ‘যা হয় তা হোক গে’, আমের মুকুল বলে উঠছে ‘কিছু হাতে রাখব না’। যারা কৃপণতা করবে তাদের সময় বয়ে যাবে।

হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি-
আঙিনাতে বাহিরিতে মন কেন গেল ঠেকি৷
বাতাসে লুকায়ে থেকে
কে-যে তােরে গেছে ডেকে,
পাতায় পাতায় তােরে পত্র সে-যে গেছে লেখি।

কখন্ দখিন হতে কে দিল দুয়ার ঠেলি,
চমকি উঠিল জাগি চামেলি নয়ন মেলি।
বকুল পেয়েছে ছাড়া,
করবী দিয়েছে সাড়া,
শিরীষ শিহরি উঠে দূর হতে কারে দেখি॥


তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে, সুপ্ত রাতে
আমার ভাঙল যা তাই ধন্য হল চরণপাতে॥

নন্দিনী, ওই দেখে নাও শিশুর লীলা, ওই-যে কচি কিশলয়—

শ্যামল কোমল চিকন রূপের নবীন শােভা— দেখে যা-
কল-উতরােল চঞ্চলদোল ঐ যে বােবা॥

 শিশু হয়ে এসেছে চিরনবীন, কিশলয়ে তার ছেলেখেলা জমাবার দোসর হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিল ওই সূর্যের আলো, সেও সাজল শিশু, সারাবেলা সে কেবল ঝিকিমিকি করছে। সেই তো তার কলপ্রলাপ। ওদের নাচে নাচে মুখরিত হয়ে উঠল প্রাণগীতিকার প্রথম ধুয়োটি।

ওরা অকারণে চঞ্চল।
ডালে ডালে দোলে বায়ুহিল্লোলে
নবপল্লবদল।
ছড়ায়ে ছড়ায়ে ঝিকিমিকি আলাে
দিকে দিকে ওরা কী খেলা খেলালাে;
মর্মরতনে প্রাণে ওরা আনে
কৈশোরকোলাহল।

ওরা কান পেতে শােনে গগনে গগনে।
নীরবের কানাকানি,
নীলিমার কোন্ বাণী।
ওরা প্রাণঝরনার উচ্ছল ধার
ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার,
চিরতাপসিনী ধরণীর ওরা
শ্যামশিখা হােমানল॥

 দীর্ঘ শূন্য পথটাকে এতদিন ঠেকেছিল বড়ো কঠিন, বড়ো নিষ্ঠুর। আজ তাকে প্রণাম। পথিককে সে তো অবশেষে এনে পৌঁছিয়ে দিলে। কিন্তু, ভুলব কেমন করে যে, যে পথ কাছে নিয়ে আসে সেই পথই দূরে নিয়ে যায়- তাই মনে হয়, ঘরের মধ্যে নিশ্চল হয়ে মিলন স্থায়ী হয় না, পথে বেরিয়ে পড়লে তবেই পথিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ এড়ানো যায়। তাই আজ পথকেই প্রণাম।

মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার
করুণ রঙিন পথ।
এসেছে এসেছে অঙ্গনে, মোর
দুয়ারে লেগেছে রথ।

সে-যে সাগরপারের বাণী
মোর পরানে দিয়েছে আনি,
তার আঁখির তারায় যেন গান গায়
অরণ্য পর্বত।

দুঃখসুখের এ পারে ও পারে
দোলায় আমার মন,
কেন অকারণ অশ্রুসলিলে
ভরে যায় দু’নয়ন।
ওগো নিদারুণ পথ, জানি,
জানি, পুন নিয়ে যাবে টানি
তারে, চিরদিন মোর যে দিল ভরিয়া
যাবে সে স্বপনবৎ॥


বাতাসের চলার পথে
যে মুকুল পড়ে ঝ’রে
তা নিয়ে তােমার লাগি
রেখেছি ডালি ভ’রে।

 টুকরো টুকরো সুখদুঃখের মালা গাঁথব— সাতনরী হার পরাব তোমাকে মাধুর্যের মুক্তোগুলি চুনে নিয়ে। ফাগুনের ভরা সাজির উদ্বৃত্ত থেকে তুলে নেব বনের মর্মর, বাণীর সূত্রে গেঁথে বেঁধে দেব তোমার মণিবন্ধে। হয়ত আবার আর-বসন্তেও সেই আমার দেওয়া ভূষণ পরেই তুমি আসবে। আমি থাকব না, কিন্তু কী জানি, আমার দানের ভূষণ হয়তো থাকবে তোমার দক্ষিণ হাতে।

ফাগুনের নবীন আনন্দে
গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে।
দিল তারে বনবীথি
কোকিলের কলগীতি,
ভরি দিল বকুলের গন্ধে।

মাধবীর মধুময় মন্ত্র
রঙে রঙে রাঙালাে দিগন্ত।
বাণী মম নিল তুলি
পলাশের কলিগুলি,
বেঁধে দিল তব মণিবন্ধে।

দ্বিতীয় পর্ব

কেন ধরে রাখা, ও-যে যাবে চলে
মিলনলগন গত হলে।
স্বপনশেষে নয়ন মেলাে,
নিবু নিবু দীপ নিবায়ে ফেলো,
কী হবে শুকানাে ফুলদলে।

 এখনো কোকিল ডাকছে, এখনো শিরীষবনের পুস্পাঞ্জলি উঠছে ভরে ভরে, তবু এই চঞ্চলতার অন্তরে অন্তরে একটা বেদনা শিউরিয়ে উঠল। বিদায়দিনের প্রথম হাওয়া অশথগাছের পাতায় পাতায় ঝর্‌ ঝর্‌ করে উঠছে। সভার বীণা বুঝি নীরব হবে, দিগন্তে পথের একতারায় সুর বাঁধা হচ্ছে- মনে হচ্ছে, যেন বসন্তী রঙ ম্লান হয়ে গেরুয়া রঙে নামল।

চলে যায়, মরি হায়, বসন্তের দিন।
দূর শাখে পিক ডাকে বিরামবিহীন।
অধীর সমীরভরে
উচ্ছ্বসি বকুল ঝরে,
গন্ধ-সনে হল মন সুদূরে বিলীন।

পুলকিত আম্রবীথি ফাল্গুনেরই তাপে,
মধুকরগুঞ্জরণে ছায়াতল কাঁপে।
কেন জানি অকারণে
সারাবেলা আনমনে
পরানে বাজায় বীণা কে গাে উদাসীন॥

বিদায় দিয়ো মােরে প্রসন্ন আলােকে,
রাতের কালাে আঁধার যেন নামে না ঐ চোখে॥

 হে সুন্দর, যে কবি তোমার অভিনন্দন করতে এসেছিল তার ছুটি মঞ্জুর হল। তার প্রণাম তুমি নাও। তার আপন গানের বন্ধনেই চিরদিন সে বাঁধা রইল তোমার দ্বারে। তার সুরের রাখী তুমি গ্রহণ করেছ আমি জানি; তার পরিচয় রইল তোমার ফুলে ফুলে, তোমার পদপাতকম্পিত শ্যামল শস্পবীথিকায়।

বসন্তে বসন্তে তােমার কবিরে দাও ডাক;
যায় যদি সে যাক।
রইল তাহার বাণী, রইল ভরা সুরে,
রইবে না সে দূরে;
হৃদয় তাহার কুঞ্জে তােমার
রইবে না নির্বাক্।

ছন্দ তাহার রইবে বেঁচে
কিশলয়ের নবীন নাচে নেচে নেচে।
তারে তােমার বীণা
যায় না যেন ভুলে,
তােমার ফুলে ফুলে।
মধুকরের গুঞ্জরণে বেদনা তার থাক্॥





তবে শেষ করে দাও শেষ গান,
তার পরে যাই চলে।
তুমি ভুলাে না গাে এ রজনী
আজ রজনী ভাের হলে।

 এর ভয় হয়েছে সব কথা বলা হল না। এ দিকে বসন্তের পালা সাঙ্গ হল। ত্বরা কর্‌ গো ত্বরা কর্‌- বাতাস তপ্ত হয়ে এল, এই বেলা রিক্ত হবার আগে অঞ্জলি পূর্ণ করে দে— তার পরে আছে করুণ ধূলি তার আঁচল বিছিয়ে।

যখন মল্লিকাবনে প্রথম ধরেছে কলি
তােমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু,
বেঁধেছিনু অঞ্জলি।
তখনাে কুহেলিজালে,
সখা, তরুণী উষার ভালে
শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা
উঠিতেছে ছলছলি।

এখনাে বনের গান,
বন্ধু, হয় নি তাে অবসান,
তবু এখনি যাবে কি চলি।
ও মাের করুণ বল্লিকা,
তোর শ্রান্ত মল্লিকা
ঝরােঝরাে হল, এই বেলা তাের
শেষ কথা দিস বলি॥

 ‘শুক্‌নো পাতা কে যে ছড়ায় ঐ দূরে।’ বসন্তের ভূমিকায় ঐ পাতাগুলি একদিন আগমনীর গানে তাল দিয়েছিল, আজ তারা যাবার পথের ধূলিকে ঢেকে দিল, পায়ে পায়ে প্রণাম করতে লাগল বিদায়পথের পথিককে। নবীনকে সন্ন্যাসীর বেশ পরিয়ে দিয়ে বললে, ‘তোমার উদয় সুন্দর, তোমার অস্তও সুন্দর।’

ঝরা পাতা গাে, আমি তােমারি দলে।
অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে
ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র
আমার হিয়াতলে।

ঝরা পাতা গাে, বসন্তী রঙ দিয়ে
শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ!
খেলিলে হােলি ধুলায় ঘাসে ঘাসে
বসন্তের এই চরম ইতিহাসে।
তােমারি মতাে আমারাে উত্তরী
আগুন রঙে দিয়াে রঙিন করি,
অস্তরবি লাগাক পরশমণি
প্রাণের মম শেষের সম্বলে॥


সে-যে কাছে এসে চলে গেল তবু জাগি নি।
কী ঘুম তােরে পেয়েছিল হতভাগিনী॥

 মন ছিল সুপ্ত, কিন্তু দ্বার ছিল খোলা, সেইখান দিয়ে কার নিঃশব্দ চরণের আনাগোনা। জেগে উঠে দেখি, ভুঁইচাঁপাফুলের ছিন্ন পাপড়ি লুটিয়ে আছে তার যাওয়ার পথে। আর দেখি, ললাটে পরিয়ে দিয়ে গেছে বরণমালা, তার শেষ দান, কিন্তু এ-যে বিরহের মালা।

কখন দিলে পরায়ে
স্বপনে বরণমালা, ব্যথার মালা।
প্রভাতে দেখি জেগে-
অরুণ মেঘে
বিদায়বাঁশরি বাজে অশ্রু-গালা।

গােপনে এসে গেলে,
দেখি নাই আঁখি মেলে।
আঁধারে দুঃখডােরে
বাঁধিলে মােরে,
ভূষণ পরালে বিরহবেদন-ঢালা॥

 হে বনস্পতি শাল, অবসানের অবসাদকে তুমি দূর করে দিলে। তোমার অক্লান্ত মঞ্জরীর মধ্যে উৎসবের শেষবেলাকার ঐশ্বর্য, নবীনের শেষ জয়ধ্বনি তোমার বীরকণ্ঠে। অরণ্যভূমির শেষ আনন্দিত বাণী তুমি শুনিয়ে দিলে যাবার পথের পথিককে, বললে ‘পুনর্দর্শনায়’। তোমার আনন্দের সাহস বিচ্ছেদের সামনে এসে মাথা তুলে দাঁড়ালো।

ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল,
মাধবী ঝরিল ভূমিতলে অবসন্ন,
সৌরভধনে তখন তুমি হে শাল,
বসন্তে করাে ধন্য।
সান্ত্বনা মাগি দাঁড়ায় কুঞ্জভূমি,
রিক্তবেলায় অঞ্চল যবে শূন্য।
বনসভাতলে সবার ঊর্ধ্বে তুমি,
সব-অবসানে তােমার দানের পুণ্য॥

 এইবার শেষ দেওয়া-নেওয়া চুকিয়ে দাও। দিয়ে যাও তোমার বাহিরের দান, উত্তরীয়ের সুগন্ধ, বাঁশির গান, আর নিয়ে যাও আমার অন্তরের বেদনা নীরবতার ডালি থেকে।

তুমি কিছু দিয়ে যাও
মাের প্রাণে গােপনে গাে-

ফুলের গন্ধে, বাঁশির গানে,
মর্মরমুখরিত পবনে।
তুমি কিছু নিয়ে যাও
বেদনা হতে বেদনে-
যে মোর অশ্রু হাসিতে লীন,
যে বাণী নীরব নয়নে॥

 দূরের বাণীকে জাগিয়ে দিয়ে গেল পথিক। এমনি করেই বারে বারে সে কাছের বন্ধন আলগা করে দেয়। একটা অপরিচিত ঠিকানার উদ্দেশ বলে দিয়ে যায় কানে কানে, সাহসের সুর এসে পৌঁছয় বিচ্ছেদসমুদ্রের পরপার থেকে- মন উদাস হয়ে যায়।

বাজে করুণ সুরে,
হায় দূরে,
তব চরণতলচুম্বিত পন্থবীণা।
এ মম পান্থচিত চঞ্চল
জানি না কী উদ্দেশে।

যুথীগন্ধ অশান্ত সমীরে
ধায় উতলা উচ্ছ্বাসে,
তেমনি চিত্ত উদাসী রে
নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে॥