বনলতা সেন/শিকার (সংলাপ কবিতা)

উইকিসংকলন থেকে

শিকার (সংলাপ কবিতা)

একজন শিকারি
মিছেমিছি কেন অই শিকারির সাথে
আমরা শিকারে যাই?

আর জন
শিকার জানে না সে কি?

এক জন
ধলা এক ঘােড়া শুধু আছে;

আর জন
দুধের ভিতর থেকে সেই যে মাখন তােলে
গয়লার ধলা মেয়ে ভােরের বেলায়
ফেনার ধোঁয়ায় তার দুই চোখ ঘােলা হয়ে আসে;
তাদের সবার কথা মনে হয় যেন
ঘােড়ার পিঠের দিকে চেয়ে,
আমরা ঘােড়ার মুখ দেখিনাকো

একজন
কেবল সে চ’লে যেতে আছে;

আর জন
কোথায় সে যায়?
আমরা জানি না কেউ!
তবু তার পিছে যেতে হবে?
স্বপ্নের ভিতরে যেন চলিতেছি!

আমাদের লাল ঘােড়া;

আমাদের ঘােড়া এত লাল—,
তাহাদের নােম যেন কালাে হয়ে আসে!

ওদের গায়ের রং আমাদের ক্ষুধার মতন;
পৃথিবীর জল থেকে ফিরে
মিছেমিছি অন্য দিকে যায় এরা;
কোন্ ঘাস কোন্ জল এদের সান্ত্বনা দেবে?
এরা মরে যাবে,—আমরাও;
আমরা রয়েছি বেঁচে পৃথিবীতে তবু,
সেইখানে আমাদের খুঁজে পাবে—দেখ;
বুড়াে পাখিদের মতাে সেইখানে থাকি না আমরা;
হাঁসের ছানার মতাে পাখনায় ভিজে
ছােটো এক পুকুরের পাড়ে
আমরা সেখানে থাকি;

তারপর বড় হই;
আমরা হইনা তবু বুড়াে;

হাঁসের মতন ডিম পাড়ে সেইখানে।
আমাদের হৃদয়ের আশা!

হাঁসের মতন ডিম,
তবুও সােনার ডিম নয়।
খড়ের কুটার মাঝে অনেক ময়লা ডিমে অন্ধকারে বসে
ভেবেছি অনেকদিন এই কথা,—
এই ডিমে ব্যথা পাই!

এর চেয়ে বেশি ব্যথা আছে,—

জানি আমি;
কোনাে দিন কড়ি ফেলে তেল আমি নেই নাই,
তবু কোনাে কুনাে ব্যাঙ কানাকড়ি দেবে?
কানাকড়ি ছাড়া তবু তেল পাবে না কি?
তাই আমি হিজলের গাছে
এবার লয়েছি নাও বেঁধে।

দাও ছাড়া কথা নেই;
সাড়ে সাত চোর যদি মরে বেঁচে ওঠে
আমি সেই আধখানা চোর হব।
মেয়েমানুষের ব্যথা,
আমার মদের মুখ নাই!
মদের পিপার পরে সারারাত একা বসে থেকে
আমি তবু মাংসের মাংসের কথা ভেবে-ভেবে
মেয়েমানুষের স্বাদ চাই আমি শুধু;
এর চেয়ে কম কিছু নয়!

গাছের খােড়লে থেকে সারা দিন বসে
পেঁচানীর কাছ থেকে পেঁচার মতন
চুমাে খেয়ে তােমরা হয়েছ ক্লান্ত,—জানি—;
কিন্তু আমি কিছু পাই নাই।

আমরা হইনি ক্লান্ত;

তােমরা অনেক চুমাে পেয়েছ তবুও;
পেঁচার মতন তবু,ঘুঘুর মতন কিছু নয়;

জানি আমি,—চুমা তবু চুমা;
তােমরা পেয়েছ চুমা, আর সব চুমার সন্তান
তােমরা পেয়েছ;
আমি তবু একদিন ঘুম থেকে উঠে
রাতের বিছানা ধরে শুয়ে থাকি;
তবুও দেখিতে হবে চূনের মতন আলাে এসে
চুন শাদা করে গেছে জুলপির কাছে;
কাদাখােচা জলপিপি আবার এসেছে।
চোখের ঘুমের পাতা খুড়ে-খুড়ে খেতে;
নষ্ট বিড়ালের মতাে সারাদিন মন
শুকনাে পাতার পিছে ছুটে-ছুটে অবসন্ন হয়!

পৃথিবীতে ক্লান্ত হয়ে আমরা তাে বেঁচে থাকি তবু;

চুমাে পেয়ে বেঁচে থাকি;
তবু জানি অন্য দিকে কোনাে এক চুমাে বেঁচে থাকে
আমাদের সব মেয়েমানুষেরা মরে গেলে!...
রুপার হাঁসের পাখা দেখি নাই,
তবুও রুপার হাঁস আছে
কোনাে এক পালকের বিছানার পরে;
সাত দিন সাত রাত শেষ হলে বনের ভিতরে
যে মানুষ মরেনাকো তার মেয়েমানুষ সে আছে—।

আমরা কি সেই দিকে চলিতেছি?

ধাল ঘােড়া সেই দিকে যায়;

আমরাও?
পিছে পিছে যাই;
তবুও এদিকে গিয়ে কেউ খুসি হয়?

আমি খুসি হবনাকো আর;

কেন তুমি?

আইবুড়াে;
দেশে ফিরে গিয়ে
আমার করিতে হবে বিয়ে

হাঃ! হাঃ! হাঃ!

আমি এসবেরই নই;

আমিও না;

আমাদের হিজল গাছ সেখানেও আছে;

হয়তাে;

ওর ঘােড়া চলে যাক ওর চাঁদকপালের দিকে;

যেই দিকে যায় চলে যাক;
(শিকারি দুজন ফিরে চলে গেল।

তুমি
তােমার পিছনে কারা?

আমি
আমার পিছনে আমি এতদিন ঘুমে-জেগে কি কয়েছি কথা
কেউ তুমি শুনেছ কি?
চাঁদের আলােয় এসে যেন কোন্ চিতাবাঘ হয়ে
ঘাড় ধরে কামড়ায়ে গিয়েছে আমারে আকাশের চাঁদ যেন!
ব্যথা পেয়ে তবুও দেখেছি
চিতার উজ্জ্বল ছালে রূপ লেগে আছে!

চোখে তার পৃথিবীর কোনাে এক মেয়ের মতন
ভালােবাসা আছে।
তাই আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।

তুমি

কোথায় যেতেছ তুমি? পৃথিবীর শেষে?
তুমি খুসি হবেনাকি পৃথিবীতে থেকে?
অন্য সকলের মতাে ডিমের হলুদ খেয়ে তুমি
স্বাদ তবু পাবেনাকি?
জলের পদ্মের বড় পাতার নিচেতে
ছায়া খুঁজে থাকিবে না মাছের মতন?
—মাছের আঁশটে গায়ে লেগে
কোথাও পুঁটির মুখে রূপ খুঁজে!
তুমি ধান ভানিবার উঠোনের পরে
ইঁদুরের শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে এসে
রবেনাকি ছােট এক ইদুরের সাথে
সকল ভয়ের থেকে ছুটি নিয়ে ভালােবেসে?
কমলালেবুর মতাে লাল রােদ গিলে?
—অশথ বটের গাছে পাখিদের মতাে
বসে থেকে দুই ঠোট বাঁকা হবেনাকি!
বুড়াে পাখিদের মতাে হবেনাকি আর
পৃথিবীতে বসে থেকে!

আমি
বেহালার মতাে তবু সেই সব পড়ে আছে;
তবুও কোথাও কানে দোষ;
তাই আমি অশথ বটের গাছে বাঁকা ঠোট লয়ে
পাখিদের মতাে বেঁচে বুড়াে হবনাকো!

তবুও শেখাও
গাছের ছালের পরে ঠোট ভেঙে ফেলে
পাখিরা কি মরে যায়?
অনেক দেখেছি মেয়ে পড়শিনীদের;
তাদের বুকের থেকে ক্ষুদের মতন ঘ্রাণ পেয়ে
কেউ যেন একবার গিয়েছিল খেয়ে
মুখের স্বাদের মতাে তাহাদের স্বপ্নের হৃদয়
তারে তারা একদিন মশারির জালের ভিতরে।
মাথার স্বপ্নের মতাে
কাছেপেতে চেয়েছিল।
কিন্তু তবু এক ভােরে পচা এক ডিমের মতন
সেইসব ভেঙে ফেলে চলে গেছে তারা;
মাংস আর রক্তের বিছানার পরে—তারপর
সন্তানের জন্ম তারা দিয়েছে সকলে;
...আমি তবু তাহাদের মতাে নাই।

স্বপ্ন নয়,—কিন্তু তবু যাদের হৃদয় জ্ঞান আছে
তাহাদের ঠোট বাঁকা!

জানি আমি;

পৃথিবীতে বসে থেকে তাহাদের রােম সব শাদা হয়ে গেছে,
তাদের কপালে শিঙ পেঁচার মতন জেগে ওঠে;
অনেক রাতের বেলা জেগে থেকে তাহারা তারার কাছ থেকে
ফিতা আর চাখড়ির শাদা লাঠি ধার করে আনে;
তারপর পৃথিবীর মানুষের হৃদয় মেপে ফেলে।
তাহাদের কথা তবু সকলেই মানে।

—জানি;

স্বপ্ন নয়,—তাদের হৃদয়ে বােধ আছে।
পাকের জলের মতাে তারা নয়,—তাহাদের গভীরতা আছে।
তবু তারা ভালােবাসে!
তবুও তারার মতো আমি কোনাে সবুজ পাহাড়ে
অন্ধকারে তাহাদের দেখি নাই!
তারা পাহাড়ের নিচে তারার আলাের মতাে আছে;
সেইখানে? ঘােড়া আর কুকুরের সাথে?

চাঁদের শিঙের দিকে চেয়ে
পাহাড়র পাথরের গায় মাথা খুঁড়ে
তাহারা অলস নয়—!
ছােট মেয়েদের মতাে হয়ে গেছে আমার হৃদয়!
পৃথিবীর অন্ধকারে ভয় পেয়ে তবুও সে পারেনি ঘুমােতে,
লুকাতে চেয়েছে মুখ বিছানার কাপড়ের তলে;
সেইখানে স্বপ্ন খুঁজে ভুলিতে চেয়েছে ব্যথা,
তবু তার বুড়ােরা তাে ঘুমায়েছে;
তাহারা ঘুমায়।

কোন্ এক ইদুর এসে ঘুম ভেঙে গেছে?
কোন্ ভয়?

আমি এক বােতলের মতাে করে তােমার নিকটে যদি রাখি
আমার এ হৃদয়েরে,
তুমি তার ছিপি খুলে দেখাে;
কিছু কি দেখিতে পার?
ছিপি তুমি খুলে দাও;
আমি এক কাচের গেলাসে সব হৃদয়েরে ঢেলে
তােমার ঠোটের কাছে তুলে ধরি যদি;

সেই জলে কার যেন মুখ ভেসে ওঠে।
চেয়ে দেখ,—
তবু তারে কোথাও কি দেখা যায়?
...কোথাও সে চলে যেতে আছে!
ইঁদুরেরা খুঁজে গেছে সব সব-শেষ শিষ,
ছড়ায়ে-ছড়ায়ে ছিড়ে ইদুরেরে খুঁজে গেছে পেঁচা,
তারে তবু দেখে নাই কেউ!

আমার হৃদয়ে তারে তবুও দেখেছ;
সেখানে পেঁচার পাখা রুপার মতন,
তাদের কপাল থেকে দুই শিঙ উঠে
চাদের শিঙের সাথে মিশে গেছে যেন?
সেই সরু পপালের উপর ছিয়ে হেঁটে
সেই রূপের মতাে কারা সব আসিতেছে যেন!
মুখের রূপ তাই বেড়ে গেল এত!

—তবু তারে পৃথিবীতে চাই আমি।

যারা চায় তাদের বিষন্ন হ’তে হয়।

সব বিষাদের স্বাদ জানি;

তবু তারে পাবে না তাে;

হৃদয়ে অনেক স্বপ্ন আছে!

পাখার মতন স্বপ্ন তাহার পায়ের চারিপাশে,—

স্বপ্নের ওপর দিয়ে তবুও সে চ’লে যায়।

গেলাসে গেলাসে আমি হৃদয়েরে ঢেলে দিয়ে
সেই জলে ছবি খুঁজে-খুঁজে
অবসন্ন হ’য়ে গেছি;

অবসন্ন হ’তে হয়;

চাঁদের আলোয় এক সমুদ্রের নৌকার মতো
আমার হৃদয়;
ভূতের নাওয়ের মতো,— আমি তবু একা তার হালে;
কোনোদিকে কোনোখানে কেউ নাই আর!
সমুদ্রের বড় সেই শাদা পাখি চ’লে গেছে উড়ে
যেইখানে জ্যোৎস্নায় ছাওয়া থাকে হয়তো সে দিকে;
অথবা যে মরে গিয়ে রয়েছে পিছনে;
ময়লা আলোর তার ডানা যেন দেখিয়াছি আমি
মাঝ-সাগরের ঢেউ ভেঙে-ভেঙে আসিতেছে কাছে;
আমারে সে নিয়ে যাবে;
শান্ত ঘুঘুর মতো এক রাতে তবুও হৃদয়
শেষের চাঁদের শীতে বইঠার পরে
একাই ঘুমায়ে থাকে;
সেই ঘুম ভেঙে দিয়ে তবু
কোলের ছেলের মতো কেঁদে ওঠে ঢেউ!
মাঝ রাতে মোম জ্বেলে কে তুমি এসেছ!
চোখ কচ্‌লায়ে উঠে দেখি নাই আর,—
বাতাসে মোমের গন্ধ পড়ে থাকে পিছের সাগরে!...
অস্পষ্ট ভূতের ছাওয়া দেখা যায় ঢের
মাঝসাগরের পথে চাঁদের আলোয়!

—তোমায় হৃদয় মরে গেলে তবু এ সব থাকে না।

আমার হৃদয় তবু বেঁচে আছে;
খােলা পাখা তবু তার রয়েছে পিছনে;

কখনাে সুমুখে;
কখনাে বা ডান ধারে,—কখনাে বা বাঁয়ে;
ঢেউ ভেঙে বার-বার সে আমার কাছে এসে পড়ে;
কোথায় সে নিয়ে যাবে?

কোথাও সে নিয়ে যেতে পারে;

তবু তার ঢেউ ভাঙা হয়নাকো শেষ;
একদিন শেষ হবে,—কেউ জানে?
তবু তার পাখা যেন পৃথিবীর মতাে নয়;
কাচা চোখে উঠে
ময়লা আলাের ঢেউয়ে দূরে
তারে দেখে মাঝসাগরের ঢেউ ভয় পেয়ে ওঠে।
তবু তার মােহ আছে,
ভয় হয়—আমি তারে একদিন ভালােবাসি যদি!

তারে ভালােবেসে তুমি ঢের দূরে চলে যেতে পার,
সেখানেও সুখ আছে;
সেইখানে হৃদয়ের স্বপ্নের শিশুরা সব বড় হয়ে বেড়ে গেছে,
ঢের বড়াে সুন্দরীর মাংসের মতন।
সেইখানে রূপসীর মাংসে শুধু রূপসীর মাংস জন্ম লয়,
তারপর মাংসে পােকা পড়ে যায়!
সবচেয়ে রূপ যারা ভালােবাসে
তাহারা রূপের স্বপ্ন ভালােবাসে সব চেয়ে!
তবুও সেখানে সব স্বপ্ন নষ্ট হয়!

কারা তবু সেইখানে যায়?

পৃথিবীতে বিবাহের বিছানায় শুয়ে
যাহারা অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে।
—তাহাদের ঢের অবসাদ,
তবু তারা আরও ক্লান্তি চায়;
তাহাদর মাংস ছুঁয়ে দেখেছে কি?

দেখি নাই;

হয়তাে দেখিবে তুমি একদিন!
আমি মাঝ-সাগরের চাদের আলােয় একা আছি;
কিন্তু চাদ হেলে পড়ে গেলে
কপাল ঘামায়ে পড়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে,
তখন ব্যথার জন্ম হয়;
পৃথিবীর মানুষেরা সেই ক্ষুধা জানে!
বুড়াে মরা পাখিদের গলার নলির মতাে নষ্ট মনে হয়
সকল মাংসের কথা এইখানে।

স্বপ্নের নাড়ির সাথে হৃদয়ের নাভি যারা বাঁধে
তারা কি হয় না নিঃসহায়।
...ভেবে দেখ তবু তুমি।
এখানে হালে বসে।
পৃথিবীর মেয়েদের রূপ তবু আমার পড়েছে মনে;
তাদের মাড়িতে আর দাঁত নেই;
তাদের নাকের ডাশা ভেঙে পড়ে গেছে;
তাহাদের পেট থেকে অনেক সন্তান
কৃমির মতন করে খেয়ে গেছে তাহাদের;

কোনােদিন যারা আর মরেনাকো তাহাদের মনের ভিতর
রূপ হয়ে বেঁচে আছে তারা তবু!

অনেক বয়েসের মেয়ে
তােমাদের সব কথা আমিও শুনেছি,
ঘুমাতে-ঘুমাতে তাই জেগে বসে আছি;
হয়তাে আমার মুখ ধনেশ পাখির মতাে হবে;
তাহার তেলের মতাে মন তবু;
আমার হৃদয়ে আছে অসুখের তবুও ওষুধ!

তুমি
কোনাে এক মেয়েলােক?

আমি
পৃথিবীর বিছানায় শুয়ে
মানুষের বুক থেকে সেই সব ভালােবাসা ফুরায় না;
ভােরের আলাের মতাে আঁশটে জালের থেকে ফেঁসে
তবু আমি চ’লে গেছি।

অনেক-বয়সের মেয়ে
তবু তুমি রূপ ভালােবাসা!

'আমি
মাছের আঁশের মতাে তবু তুমি;

অনেক-বয়সের মেয়ে
আমার পেটের থেকে যাহারা হয়েছে?—

আমি
তারাও তােমার মতাে হবে;

অনেক-বয়সের মেয়ে
তাদের মতন কেউ সুন্দরী কি আছে?

আমি
মন্ত্রী-কোটালের সাথে তাহাদের বিয়ে হয়ে যাবে;
পৃথিবীর মানুষেরা তাহাদের নিয়ে ক্লান্ত হবে,
তাহাদের মতাে আমি কেউ নই;

অনেক-বয়সের মেয়ে
রূপ নয়—রূপ নয়—কোনাে এক ডাইনীর হাতে
কাপাশ তুলার মতাে হৃদয় তােমার ধরা পড়ে গেছে।
চরকায় সব শেষ সূতা কেটে তােমারে সে ছেড়ে দেবে,
তারপর হৃদয়ের রবে কিছু?

তুমি
কে জানে হয়তাে তারা ঠিক কথা বলে
পৃথিবীর এই সব মেয়েমানুষেরা!

আমি
এরা শুধু পৃথিবীর মানুষেরে দেখেছে যে,
সেখানে হৃদয় তবু অনেক সহজে খুশি হয়!
সবুজ তােতার মতাে মটরশুটির ক্ষেতে থেকে
দুই ঠোট লাল করে তারা আর চায়নাকো কিছু!
কিন্তু আমি পৃথিবীর মটরের ক্ষেতে গেলে মরে যাব,—
দু-ঠোট হলুদ হবে,—তারপর শাদা হয়ে যাবে;
বল তুমি, এমন বিষন্ন মুখ দেখেছ কি!

আমি তবু পারি না কি খুশি হতে
পৃথিবীর পথে গিয়ে?

পৃথিবীতে কে তােমারে দেখেছিল?

হয়তাে দেখেছে কেউ,
একজন থাকে, দেখে ফেলে,—

হয়তাে সে পৃথিবীর গর্ভের ভিতর আজও এসে জন্মে নাই,
কিংবা তার জরায়ুতে সােনার ডিমের মতাে উঠিতেছে ফুলে!...
অথবা,
মাংস আর রক্তের জীবাণুর ঢেউয়ে
কোথাও অনেক স্বপ্ন বেঁচে থাকে।
(সমুদ্রের ভেতর দামি জাহাজ ডুবে যাচ্ছে।

তুমি
ঐখানে কারা?

আমি
কোনাে এক রানী হবে,
আর তার মেয়েমানুষেরা;
কোথায় চলেছে তারা?

ওদের জাহাজ অই সমুদ্রের হীরেকষ ফেনার ভিতরে
ডুবে যায়;—চেয়ে দেখ!

তুমি (অবাক হয়ে)
জাহাজের অই সব পুরুষেরা এই-এই মেয়ে নিয়ে ছিল!..
পৃথিবীর শেষ গিয়ে কোথাও তবুও
অই সব মানুষেরা আবার বাঁচিতে পারে।
মরে যায়;—
ওদের মেয়েরা তবু এদের এখন ভালােবাসে?

আমি
মখ্মল্ পেটারার থেকে লাল রেশমের রুমালের মতাে
এ সব মেয়েরা;
সাগরের সবুজ চোখের রঙে তাহাদের ভয় নেই,
‘এলডােরেডাের’র থেকে সােনা খোঁজে যারা
তাহাদের হৃদয়েরে জুতাের হিলের তলে রেখে
তাদের সােনার থলি এরা ভালােবাসে—

তবুও ডাকাত যদি রাজা হয়?
বেদে আর ডাকাতেরা তবুও অনেকবার রাজা হয়,
তা না হলে পৃথিবীতে রুপার পেয়ালা সব চুরি যাবে;
পৃথিবীতে রূপ আর রবে না তাে কিছু!
দাঁত থেকে এনামেল নষ্ট হ’লে
সেখানে রুপার দাঁতে রূপ তবু থাকে?

রূপা আর রূপ!...
চাদ হেলে চলে গেলে অন্ধকারে জলের ভিতরে
মুখ তার,
সে কাহার মেয়ে!

যখন সে চ’লে যাবে
এক মুখ বাতাস সে রেখে যাবে
পাখির মুখের মতাে মুখ থেকে;
আর কিছু থাকিবে না;
দেখেছি অনেকবার;
তবুও বুঝেছি—আমারে সে ধরা দেবে!

সময়ের শেষে গিয়ে তারে পাওয়া যাবে!

আমার হৃদয়ে তবু সময়ের শেষ আছে;

তবে তুমি বেঁচে থেকে দেখাে,—
সব পেঁচা মরে গেছে জ্যোৎস্নায় হিমশিম হ’য়ে।
ইঁদুরেরা মরে গেছে আগে;
সকল চাঁদের শিঙ খসে গেছে আকাশের থেকে
ভেড়ার শিঙের মতাে বুড়াে হ’য়ে;
ফুটোননা জলের থেকে ধোঁয়ার মতন
আমার হৃদয় তবু ভাসিতেছে!

সব ধোঁয়া কোথায় যেতেছে?

জল হয়ে ফিরে আসে সব!

যকন ভেঙেছে সব, হারায়েছে, গেছে সব চুরি
তােমার হৃদয় এক বাসনের মতাে তুমি রেখেছ গুছায়ে;
আমার চোখের জল মাংসের মতাে তার!
তাই খেয়ে বেঁচে থাকে!