বন-ফুল/প্রথম সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

বন-ফুল।

১ম সর্গ।

চাইনা জেয়ান, চাইনা জানিতে
সংসার, মানুষ কাহারে বলে
বনের কুসুম ফুটিতাম বনে
শুকায়ে যেতাম বনের কোলে!


“দীপ নিব্বার্ণ।”

নিশার আঁধার রাশি করিয়া নিরাস
রজত সুষমাময়, প্রদীপ্ত তুষার চয়
হিমাদ্রি-শিখর-দেশে পাইছে প্রকাশ
অসংখ্য শিখর মালা বিশাল মহান্;
ঝর্ঝরে নির্ঝর ছুটে, শৃঙ্গ হ’তে শৃঙ্গ উঠে
দিগন্ত সীমায় গিয়া যেন অবসান।
শিরোপরি চন্দ্র সূর্য্য, পদে লুটে পৃথ্বীরাজ্য
মস্তকে স্বর্গের ভার করিছে বহন;

তুষারে আবরি শির, ছেলেখেলা পৃথিবীর
ভুরুক্ষেপে যেন সব করিছে লোকন
কত নদী কত নদ, কত নির্ঝরিণী হ্রদ
পদতলে পড়ি ভার করে আস্ফালন!
মানুষ বিস্ময়ে ভয়ে, দেখে রয় স্তব্ধ হয়ে
অবাক্‌ হইয়া যায় সীমাবদ্ধ মন!


চৌদিকে পৃথিবী ধরা নিদ্রায় মগন,
তীব্র শীত-সমীরণে, দুলায়ে পাদপগণে
বহিছে নির্ঝর-বারি করিয়া চুম্বন,
হিমাদ্রি শিখর শৈল করি আবরিত
গভীর জলদরাশি, তুষার বিভায় নাশি
স্থির ভাবে হেথা সেথা রহেছে নিদ্রিত।
পর্ব্বতের পদতলে, ধীরে ধীরে নদী চলে
উপল রাশির বাধা করি অপগত,
নদীর তরঙ্গকুল, সিক্ত করি বৃক্ষ-মূল
নাচিছে পাষাণ-তট করিয়া প্রহত!
চারি দিকে কতশত, কলকলে অবিরত
পড়ে উপত্যকা মাঝে নির্ঝরের ধারা।

আজি নিশীথিনী কাঁদে, আঁধারে হারায়ে চাঁদে
মেঘ ঘোমটায় ঢাকি কবরীর তারা।


কল্পনে! কুটীর কার তটিনীর তীরে
তরুপত্র ছায়ে ছায়ে, পাদপের গায়ে গায়ে
ডুবায়ে চরণ-দেশ স্রোতস্বিনী নীরে?
চৌদিকে মানব-বাস নাহিক কোথায়
নাহি জন-কোলাহল, গভীর বিজন-স্থল
শান্তির ছায়ায় যেন নীরবে ঘুমায়।
কুসুম-ভূষিত-বেশে, কুটীরের শিরোদেশে
শোভিছে লতিকা-মালা প্রসারিয়া কর,
কুসুমস্তবক রাশি, দুয়ার উপরে আসি
উঁকি মারিতেছে যেন কুটীর ভিতর!
কুটীরের একপাশে, শাখা-দীপ[১] ধূমশ্বাসে
স্তমিত আলোক শিখা করিছে বিস্তার।
অস্পষ্ট আলোক তায় আঁধার মিশিয়া যায়
মান ভাব ধরিয়াছে গৃহ-ঘর দ্বার!

গভীর নীরব ঘর, শিহরে যে কলেবর।
হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে বয়—
বিষাদের অন্ধকারে, গভীর শোকের ভারে
গভীর নীরব গৃহ অন্ধকার ময়!
কেওগো নবীনা বালা, উজলি পরশ-শালা
বসিয়া মলিন ভাবে তৃণের আসনে?
কোলে তার সঁপি শির, কে শুয়ে হইয়া স্থির,
থেক্যে থেকে দীর্ঘশ্বাস টনিয়া সঘনে,
সুদীর্ঘ ধবল কেশ, ব্যাপিয়া কপোল দেশ
শ্বেতশ্মশ্রু ঢাকিয়াছে বক্ষের বসন,
অবশ জ্ঞেয়ান হারা, স্তিমিত লোচনতারা
পলক নাহিক পড়ে নিস্পন্দ নয়ন।
বালিকা মলিন মুখে, বিশীর্ণা বিষাদ দুখে
শোকে, ভয়ে অবশ সে সুকোমল হিয়া
আনত করিয়া শির, বালিকা হইয়া স্থির
পিতার বদন পানে রয়েছে চাহিয়া;
এলোথেলো বেশবাস, এলোথেলো কেশপাশ
অবিচল আঁখি পার্শ্ব করেছে আবৃত!
নয়ন পলক স্থির, হৃদয় পরাণ ধীর
শিরায় শিরায় রহে স্তবধ শোনিত

হৃদয়ে নাহিক জ্ঞান, পরাণে নাহিক প্রাণ
চিন্তার নাহিক রেখা হৃদয়ের পটে!
নয়নে কিছুনা, দেখে, শ্রবণে স্বর না ঠেকে
শোকের উচ্ছ্বাস নাহি লাগে চিত্ততটে,
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলি, সুধীরে নয়ন মেলি
ক্রমে ক্রমে পিতা তাঁর পাইলেন জ্ঞান,
সহসা সভয় প্রাণে, দেখি চারিদিক পানে
আবার ফেলিল শ্বাস ব্যাকুল পরাণ
কি যেন হারিয়ে গেছে, কি যেন আছেনা আছে
শোকে ভয়ে ধীরে ধীরে মুদিল নয়ন
সভয়ে অস্ফুট স্বরে সরিল বচন
“কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী?”
চমকি উঠিল যেন নীরব রজনী!
চমকি উঠিল যেন নীরব অবনী!
উর্ম্মিহীন নদী যথা ঘুমায় নীরবে
সহসা করণ ক্ষেপে সহসা উঠেরে কেঁপে
সহসা জাগিয়া উঠে চল উর্ম্মি সবে!
কমলার চিত্তবাপী সহসা উঠিল কাঁপি
পরাণে পরাণ এলে হৃদয়ে হৃদয়।
স্তবধ শোণিত রাশি, আস্ফালিল হৃদে আসি

আবার হইল চিন্তা হৃদয়ে উদয়!
শোকের আঘাত লাগি, পরাণ উঠিল জাগি
আবার সকল কথা হইল স্মরণ।
বিষাদে ব্যাকুল হৃদে নয়ন যুগল মুদে
আছেন জনক তাঁর, হেরিল নয়ন;
স্থির নয়নের পাতে পড়িল পলক,
শুনিল কাতর স্বরে ডাকিছে জনক
“কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী।”
বিষাদে যোড়শী বালা চমকি অমনি
(নেত্রে অশ্রুধারা ঝরে) কহিল কাতর স্বরে
পিতার নয়ন পরে রাখিয়া নয়ন!
“কেন পিতা! কেন পিতা! এই যে রয়েছি হেতা”
বিষাদে নাহিক আর সরি বচন!
বিষাদে মেলিয়া আঁখি, বালার বদনে রাখি
এক দৃষ্টে স্থিরনেত্রে রহিল চাহিয়া।
নেত্রপ্রান্তে দর দরে, শোক অশ্রুবারি ঝরে
বিষাদে সন্তাপে শোকে আলোড়িত হিয়া!
গভীর নিশ্বাসক্ষেপে হৃদয় উঠিল কেঁপে
ফাটিয়া বা যায় যেন শোণিত-আধার!
ওষ্ঠ প্রান্ত থর থরে কাঁপিছে বিষাদ ভরে।

নয়ন পলক পত্র কাঁপে বার বার
শোকের স্নেহের অশ্রু করিয়া মোচন
কমলার পানে চাহি কহি তখন।
“আজি রজনীতে মাগো! পৃথিবীর কাছে
বিদায় মাগিতে হবে, এই শেষ দেখা ভবে
জানিনা তোমার শেষে অদৃষ্টে কি আছে;
পৃথিবীর ভালবাসা পৃথিবীর সুখ আশা,
পৃথিবীর স্নেহ প্রেম ভক্তি সমুদায়
দিনকর, নিশাকর, গ্রহ তারা চরাচর
সকলের কাছে আজি লইব বিদায়;
গিরিরাজ হিমালয়, ধবল তুষারচয়
অয়িগো কাঞ্চন শৃঙ্গ মেঘ-আবরণ!
অয়ি নিঝরিণীমালা, স্রোতস্বিনী শৈলবালা
অয়ি উপত্যকে! অয়ি হিমশৈল-বন!
আজি তোমাদের কাছে মুমুর্ষু বিদায় যাচে
আজি তোমাদের কাছে অন্তিম বিদায়।
কুটীর পরণ-শলা, সহিয়া বিষাদ জ্বালা
আশ্রয় লইয়াছিনু বাহার ছায়ায়
স্তিমিতদীপের প্রায়, এতদিন যেথা হায়
অন্তিম জীবন রশ্মি করেছি ক্ষেপণ;

আজিকে তোমার কাছে মুমুর্ষু বিদায় যাচে
তোমারি কোলের পরে সঁপিব জীবন!
নেত্রে অশ্রুবারি ঝরে নহে তোমাদের তরে
তোমাদের তরে চিত্ত ফেলিছেনা শ্বাস,
আজি জীবনের ব্রত উদযাপন করিবত
বাতাসে মিশাবে আজি অন্তিমনিশ্বাস!
কাঁদিনা তাহার তরে হৃদয় শোকের ভরে
হতেছেনা উৎপীড়িত তাহারো কারণ
আহাহা! দুখিনী বালা সহিবে বিষাদ জ্বালা
আজিকার নিশিভোর হইবে যখন?
কালি প্রাতে একাকিনী, অসহায়া, অনাথিনী,
সংসার সমুদ্র মাঝে ঝাঁপ দিতে হবে!
সংসারযাতনাজ্বালা কিছুনা জানিস্ বালা
আজিও!—আজিও তুই চিনিস্ বিভবে!
ভাবিতে হৃদয় জ্বলে, মানুষ কারে যে বলে
জানিস‍্নে কারে বলে মানুষের মন।
কারদ্বারে কালপ্রাতে, দাঁড়াইবি শূন্য-হাতে
কালিকে কাহার দ্বারে করিবি রোদন!
অভাগা পিতার তোর—জীবনের নিশা ভোর
বিষাদ নিশার শেষে উঠিবেক রবি

আজ রাত্রি ভোর হ’লে—কারে আর পিতা বলে
ডাকিবি, কাহার কোলে হাসিবি, খেলিবি?
জীবধাত্রী বসুন্ধরে!—তোমার কোলের পরে
অনাথা বালিকা মোর করিনু অর্পণ।
দিনকর। নিশাকর! আহা এ বালার পর
তোমাদের স্নেহদৃষ্টি করিও বর্ষণ!
শুন সব দিক‍্বালা! বালিকা না পায় জ্বালা
তোমরা জননীস্নেহে করিও পালন!
শৈলবালা! বিশ্বমাতা! জগতের স্রষ্টা পাতা!
শত শত নেত্রবারি সঁপি পদতলে
বালিকা অনাথা বোলে, স্থান দিও তব কোলে
আবৃত করিও এরে মেহের আঁচিলে!
মুছ মাগো অশ্রুজল! আর কি কহিব বল!
অভাগা পিতারে ভোল জম্মের মতন।
আটকি আসিছে স্বর!—অবসন্ন কলেবর
ক্রমশঃ মুদিয়া মাগো! আসিছে নয়ন!
মুষ্টিবদ্ধ করতল,—শোনিত হইছে জল,
শরীর হইয়া আসে শীতল পাষাণ।
এই—এই শেষবার—কুটারের চারিধার
দেখে লই! দেখে লই মেলিয়া নয়ান!

শেষবার নেত্রভোরে—এই দেখে লই তোরে
চিরকাল তরে আঁখি হইবে মুদ্রিত!
সুখে থেকো চিরকাল।—সুখে থেকো চিরকাল!
শান্তির কোলেতে বালা থাকিও নিদ্রিত!”
স্তবধ হৃদয়োচ্ছ্বাস! স্তবধ হইল শ্বাস!
স্তবধ লোচন তারা! স্তবধ শরীর!
বিষম শোকের জ্বালা—মূর্চ্ছিয়া পড়িল বালা
কোলের উপরে আছে জনকের শির!
গাইল নির্ঝর বারি বিষাদের গান
শাখার প্রদীপ ধীরে হইল নির্বাণ!


  1. হিমালয়ে এক প্রকার বৃক্ষ আছে, তাহার শাখা অগ্নিসংযুক্ত হইলে দীপের ন্যায় জ্বলে তথাকার লোকেরা উহা প্রদীপের পরিবর্ত্তে ব্যবহার করে।