বাঁশরী/প্রথম অঙ্ক/দ্বিতীয় দৃশ্য

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় দৃশ্য

 বাগানের কোণে তিনটে ঝাউগাছ চক্র করে দাঁড়িয়ে। তলায় কাঠের আসন। সেই নিভৃতে ক্ষিতীশ। অন্যত্র নিমন্ত্রিতের দল কেউবা আলাপ করছে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে, কেউবা খেলছে টেনিস্‌, কেউবা টেবিলে সাজানো আহার্য ভোগ করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

শচীন

 আই সে, তারক, লোকটা আমাদের এলাকায় পিল্‌পেগাড়ি করেছে, এর পরে পার্মনেণ্ট্‌ টেন্যুরের দাবি করবে। উচ্ছেদ করতে ফৌজদারি।

তারক

 কার কথা বলছ?

শচীন

 ঐ যে নববার্তা কাগজের গল্প-লিখিয়ে ক্ষিতীশ।

তারক

 ওর লেখা একটাও পড়ি নি, সেইজন্যে অসীম শ্রদ্ধা করি।

শচীন

 পড় নি ওর নূতন বই ‘বেমানান’? বিলিতি-মার্কা নব্য বাঙালিকে মুচড়ে মুচড়ে নিংড়েছে।

অরুণ

 দুরে বসে কলম চালিয়েছে, ভয় ছিল না মনে। কাছে এসেছে এইবারে বুঝবে, নিংড়ে ধবধবে সাদা করতে পারি আমরাও। তার পরে চড়াতে পারি গাধার পিঠে।

অর্চনা।

 ওর ছোঁওয়া বাঁচাতে চাও তোমরা, ওরই ভয় তোমাদের ছোঁওয়াকে। দেখছ না দূরে বসে আইডিয়ার ডিমগুলোতে তা দিচ্ছে?

সতীশ

 ও হল সাহিত্যরথী, আমরা পায়ে-হাঁটা পেয়াদা, মিলন ঘটবে কী উপায়ে?

শচীন

 ঘট্‌কী আছেন স্বয়ং তোমার বোন বাঁশরী। হাইব্রৌ দার্জিলিং আর ফিলিস্টাইন্ সিলিগুড়ি এর মধ্যে উনি রেললাইন পাতছেন। এখানে ক্ষিতীশের নেমন্তন্ন তাঁরই চক্রান্তে।

সতীশ

 তাই নাকি? তা হলে ভগবানের কাছে হতভাগার আত্মার জন্যে শান্তি কামনা করি। আমার বোনকে এখনো চেনেন না।

শৈলবালা

 তোমরা যা’ই বল, আমার কিন্তু ওর উপরে মায়া হয়।

সতীশ

 কোন্ গুণে?

শৈল

 চেহারাতে। শুনেছি ছেলেবেলায় মায়ের বঁটির উপর পড়ে গিয়ে কপালে চোট লেগেছিল, তাই ঐ মস্ত কাটা দাগ। শরীরের খুঁত নিয়ে ওকে যখন ঠাট্টা কর, আমার ভালো লাগে না।

শচীন

 মিস্ শৈল, বিধাতা তোমাকে নিখুঁত করেছেন তাই এত করুণা। কলির কোপ আছে যার চেহারায়, সে বিধাতার অকৃপার শোধ তুলতে চায় বিশ্বের উপর। তার হাতে কলম যদি সরু করে কাটা থাকে তা হলে শত হস্ত দূরে থাকা শ্রেয়। ইংরেজ কবি পোপের কথা মনে রেখো।

শৈল

 আহা, তোমরা বাড়াবাড়ি করছ।

সতীশ

 শৈল, তোমার দরদ দেখে নিজেরই কপালে বঁটি মারতে ইচ্ছে করছে। শাস্ত্রে আছে মেয়েদের দয়া আর ভালোবাসা থাকে এক মহলে, ঠাঁই বদল করতে দেরি হয় না।

শচীন

 তোমার ভয় নেই সতীশ, মেয়েরা অযোগ্যকেই দয়া করে।

শৈল

 আমাকে তাড়াতে চাও এখান থেকে।

শচীন

 সতীশ সেই অপেক্ষাই করছে। ও যাবে সঙ্গে সঙ্গে।

শৈল

 রাগিয়ো না বলছি, তা হলে তোমার কথাও ফাঁস করে দেব।

শচীন

 জেনে নাও বন্ধুগণ, আমারও ফাঁস করবার যোগ্য খবর আছে।

সতীশ

 মিস্‌ বাণী, দেখছ লোকটার স্পর্ধা গুজবটাকে ঠেলে আনছে তোমার দিকে। পাশ কাটাতে না পারলে অ্যাক্‌সিডেণ্ট্‌ অনিবার্য।

লীলা

 মিস্ বাণীকে সাবধান করতে হবে না। ও জানে তাড়া লাগালেই বিপদকে খেদিয়ে আনা হয়। তাই চুপচাপ আছে, কপালে যা থাকে। ঐ যে কী গানটা?—‘বলেছিল ধরা দেব না’।

গান

বলেছিল ধরা দেব না, শুনেছিল সেই বড়াই।
বীরপুরুষের সয় নি গুমোর, বাধিয়ে দিয়েছে লড়াই।
 তার পরে শেষে কী যে হল কার,
 কোন দশা হল জয়পতাকার,
কেউ বলে জিত, কেউ বলে হার, আমরা গুজব ছড়াই।

অর্চনা

 আঃ, কেন তোরা বাণীকে নিয়ে পড়েছিস? ও এখনি কেঁদে ফেলবে। সুষীমা, যা তো ক্ষিতীশবাবুকে ডেকে আন চা খেতে।

লীলা

 হায় রে কপাল! মিথ্যে ডাকবে, চোখ নেই দেখতে পাও না!

সতীশ

 কেন, দেখবার কী আছে?

লীলা

 ঐ যে এণ্ডি চাদরের কোণে মস্ত একটা কালীর দাগ। ভেবেছেন চাপা দিয়েছেন কিন্তু স্কুলে পড়েছে।

সতীশ

 আচ্ছা চোখ যা হোক তোমার

লীলা

 বোমা-তদন্তে পুলিশ না এলে ওঁকে নড়ায় কার সাধ্যি।

সতীশ

 আমার কিন্তু ভয় হয়, কোনদিন বাঁশরী ঐ জখ্‌মি মানুষকে বিয়ে করে পরিবারের মধ্যে আতুরাশ্রম খুলে বসে।

লীলা

 কী বল তার ঠিক নেই। বাঁশরীর জন্যে ভয়! ওর একটা গল্প বলি, ভয় ভাঙবে শুনে। আমি উপস্থিত ছিলুম।

শচীন

 কী মিছে তাস খেলছ তোমরা! এসো এখানে, গল্প-লিখিয়ের উপর গল্প! শুরু করো।

লীলা

 সোমশংকর হাতছাড়া হবার পরে বাঁশরীর শখ গেল নখী দন্তী গোছের একটা লেখক পোষবার। হঠাৎ দেখি জোটাল কোথা থেকে আস্ত একজন কাঁচা সাহিত্যিক। সেদিন উৎসাহ পেয়ে লোকটা শোনাতে এসেছে একটা নূতন লেখা। জয়দেব পদ্মাবতীকে নিয়ে তাজা গল্প। জয়দেব দূর থেকে ভালোবাসে রাজমহিষী পদ্মাবতীকে। রাজবধূর যেমন রূপ তেমনি সাজসজ্জা, তেমনি বিদ্যেসাধ্যি। অর্থাৎ একালে জম্মালে সে হত ঠিক তোমারি মতে, শৈল। এ দিকে জয়দেবের স্ত্রী যোলো আনা গ্রাম্য, ভাষায় পানাপুকুরের গন্ধ, ব্যবহারটা প্রকাশ্যে বর্ণনা করবার মতো নয়, যে-সব তার বীভৎস প্রবৃত্তি ড্যাশ্‌ দিয়ে ফুট্‌কি দিয়েও তার উল্লেখ চলে না। লেখক শেষকালটায় খুব কালো কালীতে দেগে প্রমাণ করেছে যে, জয়দেব সুব্‌, পদ্মাবতী মেকি, একমাত্র খাঁটি সোনা মন্দাকিনী। বাঁশরী চৌকি ছেড়ে দাঁড়িয়ে তারস্বরে বলে উঠল, ‘মাস্‌টর্‌পীস্‌!’ ধন্যি মেয়ে! একেবারে সাব্লাইম্ ন্যাকামি!

শচীন

 মানুষটা চুপ্‌সে চ্যাপ্টা হয়ে গেল বোধ হয়?

লীলা।

 উল্টো। বুক উঠল ফুলে। বললে, ‘শ্রীমতী বাঁশরী, মাটি খোঁড়বার কোদালকে আমি খনিত্র নাম দিয়ে শুদ্ধ করে নিই নে, তাকে কোদালই বলি। বাঁশরী বলে উঠল, ‘তোমার খেতাব হওয়া উচিত নব্যসাহিত্যের পূর্ণচন্দ্র, কলঙ্কগর্বিত।’ ওর মুখ দিয়ে কথা বেয়োয় যেন আতসবাজির মতো।

শচীন

 এটাও লোকটার গলা দিয়ে গল? বাধল না?

লীলা

 একটুও না। চায়ের পেয়ালায় চামচ নাড়তে নাড়তে ভাবল, আশ্চর্য করেছি, এবার মুগ্ধ করে দেব। বললে, ‘শ্রীমতী বাঁশরী, আমার একটা থিয়োরি আছে। দেখে নেবেন একদিন ল্যাবরেটারিতে তার প্রমাণ হবে। মেয়েদের জৈবকণায় যে এনার্জি থাকে সেটা ব্যাপ্ত সমস্ত পৃথিবীর মাটিতে। নইলে পৃথিবী হত বন্ধ্যা।’ আমাদের সর্দার নেকি শুনেই এতখানি চোখ করে বললে, ‘মাটিতে! বলেন কী, ক্ষিতীশবাবু! মেয়েদের মাটি করবেন না। মাটি তত পুরুষ। পঞ্চভূতের কোঠায় মেয়ে যদি কোথাও থাকে সে জলে। নারীর সঙ্গে মেলে বারি। স্থূল মাটিতে সূক্ষ্ম হয়ে সে প্রবেশ করে, কখনো আকাশ থেকে নামে বৃষ্টিতে, কখনো মাটির তলা থেকে ওঠে ফোয়ারায়, কখন কঠিন হয় বরফে, কখনো ঝরে পড়ে ঝরনায়।’ যা বলিস ভাই শৈল, বাঁশি কোথা থেকে কথা আনে জুটিয়ে, ভগীরথের গঙ্গার মত হাঁপ ধরিয়ে দিতে পারে ঐরাবত হাতিটাকে পর্যন্ত।

শচীন

 ক্ষিতীশ সেদিন ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছিল বলো!

লীলা

 সম্পূর্ণ। বাঁশি আমার দিকে ফিরে বললে, ‘তুই তো এ্ম্‌-এস্‌সিতে বায়োকেমেস্ট্রি নিয়েছিস। শুনলি তো? বিশ্বে রমণীর রমণীয়তা যে অংশে সেইটিকে কেটে ছিঁড়ে পুড়িয়ে গুঁড়িয়ে হাইড্রলিক্‌ প্রেস দিয়ে দলিয়ে সল্‌ফ্যুরিক্‌ এসিড দিয়ে গলিয়ে তোকে রিসর্চে লাগতে হবে।’ দেখো একবার দুষ্টুমি, আমি কোনো কালে বায়োকেমেস্ট্রি নিই নি। ওর পোষা জীবকে নাচাবার জন্যে চাতুরী। তাই বলছি ভয় নেই, মেয়েরা যাকে গাল দেয় তাকেও বিয়ে করতে পারে কিন্তু যাকে বিদ্রূপ করে তাকে নৈব নৈবচ। সব শেষে বোকাটা বললে, ‘আজ স্পষ্ট বুঝলুম পুরুষ তেমনি করেই নারীকে চায় যেমন করে মরুভূমি চায় জলকে, মাটির তলার বোরা ভাষাকে উদ্ভিদ করে তোলবার জন্যে।’ এত হেসেছি!

তারক

 তুমি ত ঐ বললে। আমি একদিন ক্ষিতীশের তালি-দেওয়া মুখ নিয়ে একটু ঠাট্টার আভাস দিয়েছিলেম। বাঁশরী বলে উঠলেন, ‘দেখো লাহিড়ী, ওর মুখ দেখতে আমার পজিটিভ্‌লি ভালো লাগে। আমি আশ্চর্য হয়ে বললেম, ‘তা হলে মুখখানা বিশুদ্ধ মডার্‌ন্‌ আর্ট। বুঝতে ধাঁধাঁ লাগে।’ ওর সঙ্গে কথায় কে পারবে? ও বললে, ‘বিধাতার তুলিতে অসীম সাহস। যাকে ভালো দেখতে করতে চান তাকে সুন্দর দেখতে করা দরকার বোধ করেন না। তাঁর মিষ্টান্ন ছড়ান ইতর লোকদেরই পাতে।’ বাই জোভ্‌, সূক্ষ্ম বটে!

শৈল

 আর কি কোনো কথা নেই তোমাদের? ক্ষিতীশবাবু শুনতে পাবেন যে।

সতীশ

 ভয় নেই, ওখানে ফোয়ারা ছুটছে, বাতাস উল্টোদিকে, শোনা যাবে না।

অর্চনা

 আচ্ছা, তোমরা সব তাস খেলল, টেনিস্‌ খেলতে যাও, ওই মানুষটার সঙ্গে হিসেব চুকিয়ে আসি গে।

 অর্চনা প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে গেল ক্ষিতীশের কাছে। দোহারা গড়নের দেহ, সাজে সজ্জায় কিছু অষত্ন আছে, হাসিখুশি ঢল্‌ঢলে মুখ, আয়ু পশ্চিমের দিকে এক ডিগ্রি হেলেছে।

অর্চনা।

 ক্ষিতীশবাবু, পালিয়ে বসে আছেন আমাদের কাছ থেকে তার মানে বুঝতে পারি কিন্তু খাবার টেবিলটাকে অস্পৃশ্য করলেন কোন দোষে? নিরাকার আইডিয়ায় আপনারা অভ্যস্ত, নিরাহার ভোজেও কি তাই? আমরা বঙ্গনারী বঙ্গসাহিত্যের সেবার ভার পেয়েছি যে দিকটাতে সে দিকে আপনাদের পাকযন্ত্র।

ক্ষিতীশ

 দেবী, আমরা জোগাই রসাত্মক বাক্য, তা নিয়ে তর্ক ওঠে, আপনারা দেন রসাত্মক বস্তু; ওটা অন্তরে গ্রহণ করতে মতান্তর ঘটে না।

অর্চনা

 কী চমৎকার! আমি যখন থালায় কেক সন্দেশ গোছাচ্ছিলুম আপনি ততক্ষণ কথাটা বানিয়ে নিচ্ছিলেন। সাতজন্ম উপোয় করে থাকলেও আমার মুখ দিয়ে এমন ঝক্‌ঝকে কথাটা বেরোত না। তা যাক গে, পরিচয় নেই, তবু এলুম কাছে, কিছু মনে করবেন না। পরিচয় দেবার মতো নেই বিশেষ কিছু। বালিগঞ্জ থেকে টালিগঞ্জে যাবার ভ্রমণবৃত্তান্তও কোনো মাসিকপত্রে আজ পর্যন্ত ছাপাই নি। আমার নাম অর্চনা সেন। ঐ যে অপরিচিত ছোটো মেয়েটি বেণী দুলিয়ে বেড়াচ্ছে আমি তারই অখ্যাত কাকী।

ক্ষিতীশ

 এবার তা হলে আমার পরিচয়টা-

অর্চনা

 বলেন কী! পাড়াগেঁয়ে ঠাওরালেন আমাকে? শেয়ালদা স্টেশনে কি গাইড্‌ রাখতে হয় চেঁচিয়ে জানাতে যে কলকাতা শহরটা রাজধানী! এই পরশুদিন পড়েছি আপনার ‘বেমানান’ গল্পটা। পড়ে হেসে মরি আর কি। ও কী! প্রশংসা শুনতে আজও আপনার লজ্জা বোধ হয়? খাওয়া বন্ধ করলেন যে? আচ্ছা, সত্যি বলুন, নিশ্চয় খয়ের লোক কাউকে লক্ষ্য করে লিখেছেন। রক্তের যোগ না থাকলে অমন অদ্ভুত সৃষ্টি বানানো যায় না। ঐ যে, যে জায়গাটাতে মিস্‌টার্‌ কিষেন গাপ্টা বি-এ ক্যাণ্টাব্‌ মিস্‌ লোটিকার পিঠের দিকের জামার ফাঁক দিয়ে আঙুটি ফেলে দিয়ে খানাতল্লাসির দাবি করে হোহা বাধিয়ে দিলে। আমার বন্ধুরা সবাই পড়ে বললে, ‘ম্যাচ্‌লেস, বঙ্গসাহিত্যে এ জায়গাটার দেশলাই মেলে না, একটু পোড়া কাঠিও না।’ আপনার লেখা ভয়ানক রিয়লিস্‌টিক্‌, ক্ষিতীশবাবু। ভয় হয় আপনার সামনে দাঁড়াতে।

ক্ষিতীশ

 আমাদের দুজনের মধ্যে কে বেশি ভয়ঙ্কর, বিচার করবেন বিধাতাপুরুষ।

অর্চনা

 না, ঠাট্টা করবেন না। সিঙাড়াটা শেষ করে ফেলুন। আপনি ওস্তাদ, ঠাট্টায় আপনার সঙ্গে পারব না। মোস্ট্‌ ইণ্টারেস্‌টিং আপনার বইখানা। এমন সব মানুষ কোথাও দেখা যায় না। ঐ যে মেয়েটা কী তার নাম কথায় কথায় হাঁপিয়ে উঠে বলে ‘মাই আইজ্‌’, ‘ও গড্‌’-লাজুক ছেলে স্যাণ্ডেলের সঙ্কোচ ভাঙবার জন্যে নিজে মোটর হাঁকিয়ে ইচ্ছে করে গাড়িটা ফেললে খাদে, মৎলব ছিল স্যাণ্ডেলকে দুই হাতে তুলে পতিতোদ্ধার করবে। ছবি তো ই স্যাণ্ডেলের হাতে হল কম্পউণ্ড ফ্র্যাক্‌চার্‌। কী ড্রামাটিক্ রিয়ালিজ্‌মের চূড়ান্ত! ভালোবাসার এতবড়ো আধুনিক পদ্ধতি বেদব্যাসের জানা ছিল না। ভেবে দেখুন, সুভদ্রার কত বড় চান্স্‌ মারা গেল, আর অর্জুনেরও কজি গেল বেঁচে।

ক্ষিতীশ

 কম মডার্‌ন্‌ নন আপনি। আমার মতো নির্লজ্জকেও লজ্জা দিতে পারেন।

অর্চনা

 দোহাই ক্ষিতীশবাবু, বিনয় করবেন না। আপনি নির্লজ্জ! লজ্জায় গলা দিয়ে সন্দেশ গলছে না। কলমটার কথা স্বতন্ত্র।

লীলা

 (কিছু দূর থেকে) অর্চনা মাসি, সময় হয়ে এল, ডাক পড়েছে।

অর্চনা

 (জনান্তিকে) লীলা, আধমরা করেছি, বাকিটুকু তোর হাতে।

অর্চনার প্রস্থান

 লীলা সাহিত্যে ফার্স্ট্‌ ক্লাস্‌ এম্‌-এ ডিগ্রি দিয়ে আবার সায়েন্স্‌ ধরেছে। রোগা শরীর, ঠাট্টা তামাশায় তীক্ষ্ণ, সাজগোছে নিপুণ, কটাক্ষে দেখবার অভ্যাস।

লীলা

 ক্ষিতীশবাবু, নমস্কার! আপনি ‘সর্বত্র পূজ্যতে’র দলে। লুকোবেন কোথায়, পূজারি আপনাকে খুঁজে বের করে নিজের গরজে। এনেছি অটোগ্রাফের খাতা। সুযোগ কি কম!

 কী লিখলেন দেখি। ‘অন্য-সকলের মতো নয় যে-মানুষ তার মার অঙ্গ-সকলের হাতে।’ চমৎকার, কিন্তু প্যাথেটিক্‌। মারে ঈর্ষা ক’রে। মনে রাখবেন, ছোটো যারা তাদের ভক্তিরই একটা ইডিয়ম্ ঈর্ষা, মারটা তাদের পুজা।

ক্ষিতীশ।

 বাগ্‌বাদিনীর জাতই বটে, কথায় আশ্চর্য করে দিলেন।

লীলা

 বাচস্পতির জাত যে আপনারা। যেটা বললেম ওটা কোটেশন। পুরুষের লেখা থেকেই। আপনাদের প্রতিভা বাক্য-রচনায়, আমাদের নৈপুণ্য বাক্য-প্রয়োগে। ওরিজিন্যালিটি আপনার বইএর পাতায় পাতায়। সেদিন আপনারই লেখা গল্পের বই পড়লেম। ব্রীলিয়েণ্ট্‌। ঐ যে যাতে একজন মেয়ের কথা আছে সে যখন দেখলে স্বামীর মন আর-এক জনের উপরে, বানিয়ে চিঠি লিখলে, স্বামীর কাছে প্রমাণ করে দিলে যে সে ভালোবাসে তাদের প্রতিবেশী বামনদাসকে। আশ্চর্য সাইকলজির ধাঁধাঁ। বোঝ শক্ত স্বামীর মনে ঈর্ষা জাগাবার এই ফন্দী না তাকে নিষ্কৃতি দেবার ঔদার্য।

ক্ষিতীশ

 না না, আপনি ওটা—

লীলা

 বিনয় করবেন না। এমন ওরিজিন্যাল্‌ আইডিয়া, এমন ঝক্‌ঝকে ভাষা, এমন চরিত্রচিত্র আপনার আর কোনো লেখায় দেখি নি। আপনার নিজের রচনাকেও বহু দূরে ছাড়িয়ে গেছেন। এতে আপনার মুদ্রাদোষগুলো নেই, অথচ—

ক্ষিতীশ

 ভুল করছেন আপনি। ‘রক্তজবা’—ও বইটা যতীন ঘটকের।

লীলা

 বলেন কী! ছি, ছি, এমন ভুলও হয়! যতীন ঘটককে যে আপনি রোজ দু-বেলা গাল দিয়ে থাকেন। আমার এ কী বুদ্ধি! মাপ করবেন আমার অজ্ঞানকৃত অপরাধ। আপনার জন্যে আর-এক পেয়ালা চা পাঠিয়ে দিচ্ছি- রাগ করে ফিরিয়ে দেবেন না।

লীলার প্রস্থান
 রাজাবাহাদুর সোমশংকরের প্রবেশ। রাঘুবংশিক চেহারা ‘শালপ্রাংশুর্মহাভুজঃ’ রৌদ্রে পুড়ে ঈষৎ স্নান গৌরবর্ণ, ভারি মুখ গাড়ি গোঁফ কামানো, চুড়িদার সাদা পায়জামা, চুড়িদার সাদা আচ্‌কান, সাদা মস্‌লিনের পাঞ্জাবী কায়দার পাগড়ি, শুঁড়তোলা সাদা নাগরা জুতো, দেহটা যে ওজনের কণ্ঠস্বরটাও তেমনি।

সোমশংকর

 ক্ষিতীশবাবু, বসতে পারি কি?

ক্ষিতীশ

 নিশ্চয়।

সোমশংকর

 আমার নাম সোমশংকর সিং। আপনার নাম শুনেছি মিস্ বাঁশরীর কাছ থেকে। তিনি আপনার ভক্ত।

ক্ষিতীশ

 বোঝা কঠিন। অন্তত ভক্তিটা অবিমিশ্র নয়। তার থেকে ফুলের অংশ ঝরে পড়ে, কাঁটাগুলো দিনরাত থাকে বিঁধে।

সোমশংকর।

 আমার দুর্ভাগ্য আপনার বই পড়বার অবকাশ পাই নি। তবু আমাদের এই বিশেষ দিনে আপনি এখানে এসেছেন, বড়ো কৃতজ্ঞ হলুম। কোন এক সময়ে আমাদের শম্ভুগড়ে আসবেন এই আশা রইল। জায়গাটা আপনার মত সাহিত্যিকের দেখবার যোগ্য।  (পিছন থেকে এসে) ভুল বলছ শংকর, যা চোখে দেখা যায় তা উনি দেখেন না। ভূতের পায়ের মতো ওঁর চোখ উল্টো দিকে। সে কথা যাক। শংকর ব্যস্ত হোয়ো না। এখানে আজ আমার নেমন্তন্ন ছিল না। ধরে নিচ্ছি সেটা আমার গ্রহের ভুল নয় গৃহকর্তাদেরই ভুল। সংশোধন করতে এলুম। আজ সুষমার সঙ্গে তোমার এন্‌গেজ্‌মেণ্টের দিন অথচ এ সভায় আমি থাকব না এ হতেই পারে না। খুশি হও নি অনাহুত এসেছি বলে?

সোমশংকর

 খুব খুশি হয়েছি, সে কি বলতে হবে?

বাঁশরী

 সেই কথাটা ভালো কবে বলবার জন্যে একটু বোসো এখানে। ক্ষিতীশ, ঐ চাঁপাগাছটার তলায় কিছুক্ষণ অদ্বিতীয় হয়ে থাকো গে। আড়ালে তোমার নিন্দে করব না।

ক্ষিতীশের প্রস্থান

 শংকর, সময় বেশি নেই, কাজের কথাটি সেরে এখনি ছুটি দেব। তোমার নূতন এন্‌গেজ্‌মেণ্টের রাস্তায় পুরোনো জঞ্জাল কিছু জমে আছে। সাফ কবে ফেললে সুগম হবে পথ। এই নাও।  বাঁশরী রেশমের থলি থেকে একটা পান্নার কষ্ঠী, হীরের ব্রেস্‌লেট্‌, মুক্তোবসানো ব্রোচ্‌ বের করে দেখিয়ে আবার থলিতে পূরে সোমশংকরের কোলে ফেলে দিলে।

সোমশংকর

 বাঁশি, তুমি জান আমার মুখে কথা জোগায় না। যা বলতে পারলেম না তার মানে নিজে বুঝে নিয়ো।

বাঁশরী

 সব কথাই আমার জানা, মানে আমি বুঝি। এখন যাও, তোমাদের সময় হল।

সোমশংকর

 যেয়ো না, বাঁশি। ভুল বুঝে না আমাকে। আমার শেষ কথাটা শুনে যাও। আমি জঙ্গলের মানুষ। শহরে এসে কলেজে পড়ার আরম্ভের মুখে প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা। সে দৈবের খেলা। তুমিই আমাকে মানুষ করে দিয়েছিলে, তার দাম কিছুতেই শোধ হবে না। তুচ্ছ এই গয়নাগুলো।

বাঁশরী

 আমার শেষ কথাটা শোনো শংকর। আমার তখন প্রথম বয়েস, তুমি এসে পড়লে সেই নতুন-জাগা অরুণ রঙের দিগন্তে। ডাক দিয়ে আলোয় আনলে যাকে, তাকে লও বা না লও নিজে তো তাকে পেলুম। আত্মপরিচয় ঘটল। বাস্‌, দুই পক্ষে হয়ে গেল শোধবোধ। এখন দু-জনেই অঋণী হয়ে আপন আপন পথে চললুম। আর কী চাই।

সোমশংকর।

 বাঁশি, যদি কিছু বলতে যাই নির্বোধের মতো বলব। বুঝলুম আমার আসল কথাটা বলা হবে না কোনদিনই। আচ্ছা তবে থাক্।...অমন চুপ করে আমার দিকে চেয়ে আছ কেন? মনে হচ্ছে দুই চোখ দিয়ে আমাকে লুপ্ত করে দেবে।

বাঁশরী

 আমি তাকিয়ে দেখছি একশো বছর পরেকার যুগান্তে। সে দিকে আমি নেই, তুমি নেই, আজকের দিনের অন্য কেউ নেই। ভুল বোঝার কথা বলছ! সেই ভুল বোঝার উপর দিয়ে চলে যাবে কালের রথ। ধুলো হয়ে যাবে, সেই ধুলোর উপরে বসে খেলা করবে তোমার নাতি নাৎনীরা। সেই নির্বিকার ধুলোর হোক জয়।

সোমশংকর

 এ গয়নাগুলোর কোথাও স্থান রইল না; যাক তবে। (ফেলে দিলে ফোয়ারার জলাশয়ে।)

 সুষমার বোন সুবীমার প্রবেশ। ফ্রক্‌ পরা, চষমা চোখে, বেণী দোলানো, দ্রুতপদে-চলা এগারো বছরের মেয়ে।

সুষীমা

 সন্ন্যাসী-বাবা আসছেন, শংকরদা। তোমাকে ডেকে পাঠালেন সবাই। তুমি আসবে না, বাঁশিদিদি?

বাঁশরী

 আসব বৈ কি, আসার সময় হোক আগে। (সোমশংকর ও সুষীমার প্রস্থান) ক্ষিতীশ, শুনে যাও। চোখ আছে? দেখতে পাচ্ছ কিছু কিছু?

ক্ষিতীশ

 রঙ্গভূমির বাইরে আমি। আওয়াজ পাচ্ছি, রাস্তা পাচ্ছি নে।

বাঁশরী

 বাংলা উপন্যাসে নিয়ুমার্কেটের রাস্তা খুলেছ নিজের জোরে, আলকাৎরা ঢেলে। এখানে পুতুলনাচের রাস্তাটা বের করতে তোমারও অফীশিয়াল্‌ গাইড্‌ চাই! লোকে হাসবে যে!

ক্ষিতীশ

 হাসুক-না। রাস্তা না পাই, অমন গাইড্‌কে তো পাওয়া গেল।

বাঁশরী

 রসিকতা! সস্তা মিষ্টান্নের ব্যাবসা! এজন্যে ডাকি নি তোমাকে! সত্যি করে দেখতে শেখো, সত্যি করে লিখতে শিখবে। চারি দিকে অনেক মানুষ আছে, অনেক অমানুষও আছে, ঠাহর করলেই চোখে পড়বে। দেখো দেখো, ভালো করে দেখো।

ক্ষিতীশ

 নাই বা দেখলেম, তোমার তাতে কী?

বাঁশরী

 নিজে লিখতে পারি নে যে, ক্ষিতীশ। চোখে দেখি, মনে বুঝি, স্বর বন্ধ, ব্যর্থ হয় যে সব। ইতিহাসে বলে, একদিন বাঙালি কারিগরদের বুড়ো আঙুল দিয়েছিল কেটে। আমিও কারিগর, বিধাতা বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছেন। আমদানি করা মালে কাজ চালাই, পরখ করে দেখতে হয় সেটা সাঁচ্চা কি না। তোমরা লেখক, আমাদের মতো কলম-হারাদের জন্যেই কলমের কাজ তোমাদের।

 সুষমার প্রবেশ। দেখবামাত্র বিস্ময় লাগে। চেহারা সতেজ সবল সমুন্নত। রঙ যাকে বলে কনকগৌর, ফিকে চাঁপার মতে, কপাল নাক চিবুক যেন কুঁদে তোলা।

সুষমা।

 (ক্ষিতীশকে নমস্কার ক’রে) বাঁশি, কোণে লুকিয়ে কেন?

বাঁশরী

 কুণো সাহিত্যিককে বাইরে আনবার জন্য। খনির সোনাকে শাণে চড়িয়ে তার চেক্‌নাই বের করতে পারি, আগে থাকতেই হাতযশ আছে। জহরতকে দামী করে তোলে জহরী, পরের ভোগরই জন্য, কী বল? সুষী, ইনিই ক্ষিতীশবাবু, জান বোধ হয়।

সুষমা

 জানি বৈ কি। এই সেদিন পড়ছিলুম ওঁর ‘বোকার বুদ্ধি’ গল্পটা। কাগজে কেন এত গাল দিয়েছে বুঝতে পারলুম না।

ক্ষিতীশ

 অর্থাৎ বইখানা গাল দেবার যোগ্য এতই কি ভালো!

সুষমা

 ওরকম ধারালো কথা বলবার ভার বাঁশরী আর ঐ আমার পিস্‌তুতো বোন লীলার উপরে। আপনাদের মতো লেখকের বই সমালোচনা করতে ভয় করি, কেননা তাতে সমালোচনা করা হয় নিজেরই বিদ্যেবুদ্ধির। অনেক কথা বুঝতেই পারি নে। বাঁশরীর কল্যাণে আপনাকে কাছে পেয়েছি, দরকার হলে বুঝিয়ে নেব।

বাঁশরী

 ক্ষিতীশবাবু ন্যাচারুল হিপ্পী লেখেন গল্পের ছাঁচে। যেখানে জানা নেই, দগ্‌দগে রঙ লেপে দেন মোটা তুলি দিয়ে। রঙের আমদানি সমুদ্রের ওপার থেকে। দেখে দয়া হল। বললুম, জীবজন্তুর সাইকলজির খোঁজে গুহা গহবরে যেতে যদি খরচে না কুলোয় অন্তত জুয়োলজিকালের খাঁচার ফাঁক দিয়ে উকি মারতে দোষ কী?

সুষমা

 তাই বুঝি এনেছ এখানে?

বাঁশরী

 পাপমুখে বলব কী করে? তাই তো বটে। ক্ষিতীশবাবুর হাত পাকা, মাল-মশলাও পাকা হওয়া চাই। যথাসাধ্য জোগাড় দেবার মজুরগিরি করছি।

সুষমা

 ক্ষিতীশবাবু, একটু অবকাশ করে নিয়ে আমাদের ও দিকে যাবেন। মেয়েরা সদ্য আপনার বই কিনে আনিয়েছে সই নেবে বলে। সাহস করছে না কাছে আসতে। বাঁশি, ওঁকে একলা ঘিরে রেখে কেন অভিশাপ কুড়োচ্ছ?

বাঁশরী

 (উচ্চহাস্যে) সেই অভিশাপই তো মেয়েদের বর। সে তুমি জান। জয়যাত্রায় মেয়েদের লুটের মাল প্রতিবেশিনীর ঈর্ষা।

সুষমা

 ক্ষিতীশবাবু, শেষ দরবার জানিয়ে গেলুম। গণ্ডি পেরোবার স্বাধীনতা যদি থাকে একবার যাবেন ও দিকে।

সুষমার প্রস্থান

ক্ষিতীশ

 কী আশ্চর্য ওঁকে দেখতে। বাঙালি ঘরের মেয়ে বলে মনেই হয় না। যেন এথীনা, যেন মিনর্ভা, যেন ব্রুন্‌হিল্‌ড্‌।

বাঁশরী

 (তীব্রহাস্যে) হায় রে হায় যত বড় দিগ্‌গজ পুরুষই হোক-না কেন সবার মধ্যেই আছে আদিম যুগের বর্বর। হাড়-পাকা রিয়লিস্‌ট্‌ বলে দেমাক কব, ভাণ কর মন্তর মান। লাগল মন্তর চোখের কটাক্ষে, একদম উড়িয়ে নিয়ে গেল মাইথলজির যুগে। আজও কচি মনটা রূপকথা আঁকড়িয়ে আছে। তাকে হিঁচড়িয়ে উজোন পথে টানাটানি করে মনের উপরের চামড়াটাকে করে তুলেছ কড়া। দুর্বল বলেই বলের এত বড়াই।

ক্ষিতীশ

 সে কথা মাথা হেঁট করেই মানব। পুরুষ জাত দুর্বল জাত।

বাঁশরী

 তোমরা আবার রিয়লিস্‌ট্‌! রিয়লিস্‌ট্‌ মেয়েরা। যত বড় স্থূল পদার্থ হও না, যা তোমরা তাই বলেই জানি তোমাদের। পাঁকে ডোবা জলহস্তীকে নিয়ে ঘর যদি করতেই হয় তাকে ঐরাবত বলে রোমান্স্‌ বানাই নে। রঙ মাখাই নে তোমাদের মুখে। মাখি নিজে। রূপকথার খোকা সব! ভালো কাজ হয়েছে মেয়েদের! তোমাদের ভোলানো! পোড়া কপাল আমাদের! এথীনা! মিনর্ভা! মরে যাই! ওগো রিয়লিস্‌ট্‌, রাস্তায় চলতে যাদের দেখেছ পানওয়ালীর দোকানে, গড়েছ কালো মাটির তাল দিয়ে যাদের মূর্তি, তারাই সেজে বেড়াচ্ছে এথীনা মিনর্ভা।

ক্ষিতীশ

 বাঁশি, বৈদিক কালে ঋষিদের কাজ ছিল মন্তর পড়ে দেবতা ভোলানো- যাঁদের ভোলাতেন তাঁদের ভক্তিও করতেন। তোমাদের যে সেই দশা। বোকা পুরুষদের ভোলাও তোমরা আবার পাদোদক নিতেও ছাড় না। এমনি করেই মাটি করলে এই জাতটাকে।

বাঁশরী

 সত্যি, সত্যি, খুব সত্যি। ঐ বোকাদের আমরাই বসাইটঙের উপরে, চোখের জলে কাদামাখা পা ধুইয়ে দিই, নিজেদের অপমানের শেষ করি, যত ভোলাই তার চেয়ে ভুলি হাজার গুণে।

ক্ষিতীশ

 এর উপায়?

বাঁশরী

 লেখো, লেখো সত্যি করে, লেখো শক্ত করে। মন্তর নয়, মাইথলজি নয়, মিনর্ভার মুখোসটা ফেলে দাও টান মেরে। ঠোঁট লাল করে তোমাদের পানওয়ালী যে মন্তর ছড়ায় ঐ আশ্চর্য মেয়েও ভাষা বদলিয়ে সেই মন্তরই ছড়াচ্ছে। সামনে পড়ল পথ-চল্‌তি এক রাজা, শুরু করলে জাদু। কিসের জন্যে? টাকার জন্যে। শুনে রাখো-টাকা জিনিসটা মাইথলজিব নয়, ওটা ব্যাঙ্কের,ওটা তোমাদের রিয়লিজ্‌মের কোঠায়।

ক্ষিতীশ

 টাকার প্রতি দৃষ্টি আছে সেটা তত বুদ্ধিব লক্ষণ, সেই সঙ্গে হৃদয়টাও থাকতে পারে।

বাঁশরী

 আছে গো হৃদয় আছে। ঠিক জায়গায় খুঁজলে দেখতে পাবে পানওয়ালীরও হৃদয় আছে। কিন্তু মুনফা এক দিকে, হৃদয়টা আর-এক দিকে। এইটে যখন আবিষ্কার করবে তখনি জমবে গল্পটা। পাঠিকারা ঘোর আপত্তি করবে, বলবে মেয়েদের খেলো করা হল, অর্থাৎ তাদের মন্ত্রশক্তিতে বোকাদের মনে খট্‌কা লাগানো হচ্ছে। উঁচু দরের পুরুষ পাঠকও গাল পাড়বে। বল কী, তাদের মাইথলজির রঙ চটিয়ে দেওয়া! সর্বনাশ! কিন্তু ভয় কোবো না ক্ষিতীশ, রঙ যখন যাবে জ্বলে, মন্ত্র পড়বে চাপা, তখনো সত্য থাকবে টিঁকে, শেলের মত, শূলের মতো।

ক্ষিতীশ

 শ্রীমতী সুষমার হৃদয়ের বর্তমান ঠিকানাটা জানতে পারি কি?

বাঁশরী

 ঠিকানা বলতে হবে না, নিজের চোখেই দেখতে পাবে যদি চোখ থাকে। এখন চলো ঐ দিকে। ওরা টেনিস্ খেলা সেরে এসেছে। এখন আইস্‌ক্রীম্‌ পরিবেষণের পালা। বঞ্চিত হবে কেন?

উভয়ের প্রস্থান