বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১০৬

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
কাগমারী সম্মেলনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপর উপস্তাপিত মওলানা ভাসানীর বক্তব্য দৈনিক সংবাদ ৬ই ও ৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৭

স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি পাকিস্থানের জনগণের প্রকৃত মুক্ত ও শাস্তির প্রস্তাব করিবে বিশ্বশাস্তির পরিপন্থী যে-কোন প্রকার যুদ্ধজোট পরিত্যাগ ও যুদ্ধচুক্তি বাতিলের দাবী

(সংবাদের বিশেষ প্রতিনিধি)

 কাগমারী (টাংগাইল), ৫ই ফেব্রুয়ারীঃ- মওলানা আবদূল হামিদ খান ভাসানী অদ্য সন্ধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “আমি কোন প্রকার যুদ্ধাজোটে বিশ্বাস করিনা। বিশ্ব শাস্তির পরিপন্থী যে-কোন প্রকার যুদ্ধজোট মানব সভ্যতা ও মুক্তির পথে বাধাস্বরূপ”।

 তিনি ঘোষণা করেন, “যত কঠিন বাধাই আসুক না কেন আমি পাকিস্তানের জনগণের ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির জন্য সংগ্রাম করে যাব। কারণ আমি বিশ্বাস করি, এই শক্তিই পাকিস্তানের জনগণের প্রকৃত মুক্তি ও শান্তির পথ প্রশস্ত করিবে"।

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৫৬ সালের ২০শে মে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বপ্রকার যুদ্ধজোটের বিরোধিতা করা হইয়াছিল এবং বাগদাদ, সিয়াটো ইত্যাদি যুদ্ধ-চুক্তির বাতিল দাবি করা হইয়াছিল।

‘সংবাদ’ ৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৭

৭ই ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানীঃ

 দীর্ঘ নয় বৎসর ধরে ক্রমাগত সংগ্রাম করার পর এই সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগ কেন্দ্র ও পূর্ণ পাকিস্তানে ক্ষমতা পেলো। এ-ক্ষমতা নিরংকুশ নয়, অন্যান্য পার্টির সহযোগিতা নিতে হয়েছে এ ক্ষমতা পেতে, তবু অনেকের মনে হতে পারে, আমরা বিরাট জয়লাভ করেছি, মন্ত্রীরা দেশ শাসন করুক, আমরা বাড়ীতে বিশ্রাম নেই।

 যদি কারও ধারণা হয়ে থাকে তবে তা সম্পূর্ণ ভূল। এ ভূল যত শিগগির ভাংগে ততই মঙ্গল। আপনারা মুসলিম গীগের ইতিহাস বিস্মৃত হবেন না। একদা মুসলিম লীগ ছিল পাক-ভারতের মুসলমানের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান কায়েম হবার পর তার ক্ষমতা ও মান-মর্যাদা আর ও বৃদ্ধি পায়। বস্তুত ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট তারিখে পাকিস্তান কায়েম হবার সময় পাকিস্তানে অন্য রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই ছিল না। আমি নিজে বটেই, আজ যারা এখানে সমবেত হয়েছেন তাদেরও অধিকাংশ মুসলিম লীগের সভ্য ছিলেন। জনসাধারণের অগাধ বিশ্বাস ছিল তখন মুসলিম লীগের উপর। পাকিস্তানকে শক্তিশালী, সুন্দর ও দূর্নীতি- কালোবাজারী প্রভৃতি সর্বপ্রকার কলুষ থেকে মুক্তি করার অপরিসীম আগ্রহ ও কর্মপন্থা সকলদেশের সকল শ্রেনীর জনসাধারণের মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু মাত্র ৯টি বংসর না যেতেই আজ মুসলিম লীগ জনসাধারণের মন থেকে ধুয়ে মুছে গেল। এত বড় একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এরূপ অবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিগত সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের যে হার হয়েছে সে রূপ হার পৃথিবীর কোন দেশে কোন কালে কোন ক্ষমতাসীন দলের হয়নি।

 কেন এমন হলো? কেন মুসলিম লীগের এমন শোচনীয় মৃত্যু হলো? আওয়ামী লীগ কর্তৃক কেন্দ্রে ও প্রদেশে আংশিক ক্ষমতা অধিকারের পর বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে যে, অতন্দ্র দুষ্টি এবং সর্বদা তীক্ষ প্রহরাধীন না রাখলে ক্ষমতা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু যত শিগগির ডেকে আনে তত শিগগির আর কিছুতে আনে না। বিরোধী দল হিসাবে দু'একটা ভুল করলে সর্বসাধারণ অনেক সময় ক্ষমা করে থাকে, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল হিসাবে ভূল করলে সে ভূলের ক্ষমা নেই।

 মুসলিম লীগ কি কি ভুল করেছিল তার একটি হিসাব নিলেই আমাদের পক্ষে সাবধান হওয়া সহজ হবে। বলে নিম্নে আমার জ্ঞান বুদ্ধিমত মুসলিম লীগের ভূলগুলি একে একে বলছিঃ

 প্রথমঃ ক্ষমতা তাদের মাথা গুলিয়ে দিয়েছিল। তার প্রমাণ পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি লোকের মতামত না নিয়ে মুসলিম লীগ করাচীতে রাজধানী নিয়ে গেল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা করল এবং সর্বোপরি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থ ও চাকরি বণ্টনে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে চললো।

 দ্বিতীয়তঃ তারা ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনলেন। নিছক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে যার জন্ম সেই মুসলিম লীগের দোষত্রুটির ন্যায্য সমালোচনাকে তারা ইসলাম বিরোধিতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা প্রভৃতি আখ্যায় আখ্যায়িত করে জনমনে একটা ত্রাসের সঞ্চার করার প্রচেষ্টায় মত্ত হলো।

 তৃতীয়তঃ মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের অনুশাসন রক্ষিত হওয়ার নামমাত্র চিহ্ন পরিলক্ষিত না হলেও তারা রাজনৈতিক সভাসমিতিকে প্রধানতঃ ধর্মমূলক ওয়াজ-নসিহতের জলসায় পরিণত করলেন।

 চতুর্থতঃ মুসলমানের আল্লাহ এক, ধর্ম এক, রসূল এবং এবং কেতার এক-এই যুক্তিতে রাজনৈতিক দলও হবে এক বলে প্রচার চালালেন তারা। একই যুক্তিতে তারা বলে যেতে লাগলেন বিরোধী দল মাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী।

 পঞ্চমতঃ মুসলিম লীগের কর্ণধারগণ পাকিস্তানকে তাদের ব্যক্তিগত জমিদারী মনে করে নিজেদের ব্যাংক ব্যালেন্স এবং সম্পত্তি ইত্যাদির জন্য রাষ্ট্রের ধন ও সম্পদ নির্লজ্জ লুণ্ঠনে মত্ত হলেন। লীগের উপরের স্তরের লোকগণ চরম দুর্নীতি, চোরাকারবারি এবং স্বজনপ্রীতিতে গা ভাসিয়ে দিলেন, এ অবস্থা যখন সরকারী কর্মচারীগণের কাছে ধরা পড়লো তখন তাদেরও অনেকে পাকিস্তান লুণ্ঠনের কার্যে অবতীর্ণ হলেন (গোলাম মুহম্মদের জামাতা হোসেন মালিক ফ্রান্স থেকে ওয়াগন কেনার নামে কেন্দ্রীয় সরকারের ৪৬লাখ টাকা ৭/৮ বৎসর ধরে ব্যাক্তিগত অহবিলভুক্ত করে রেখেছেন)। পাকিস্তান হবার পর মুসলিম লীগের নেতা, উপনেতা ও সরকারী কর্মচারীদের অনেকেই আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তাদের সম্পত্তি কিভাবে অর্জিত হলো যদি তার তদন্ত কোন দিন হয় তবে পাকিস্তান লুণ্ঠনের যে চিত্র জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পড়বে, তা অতীতের সমস্ত রাজনৈতিক অসততা, দুর্নীতি, ফেরেববাজি ও চুরিচামারিকে হার মানাবে।

 ষষ্ঠতঃ পাকিস্তানের মালিক হওয়ামাত্র মুসলিম লীগ নেতাগণ নিজেদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার সীমারেখা ভূলে গেলেন। একথা অস্বীকার করা চলে না যে, পাক-ভারত উপমহাদেশে থেকে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর মুসলমানদের সমাজ জীবন গোমরাহী ও মূর্থতায় নিমজ্জিত হয়। সেই গোমরাহী ও মূর্থতা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা প্রচেষ্টা করতে থাকে মাত্র বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে। ভারতীয় মুসলমানদের সমাজ জীবনে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠতে থাকে মাত্র বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে। সে গড়া আজও শেষ হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে যদিও তা আজ অনেকটা সুদৃঢ়; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তা আজও গড়েনি। মুসলিম লীগ নেতাগণ এই ঐতিহাসিক সত্য ভুলে গেলেন, তারা নিজেদের মনে করতে লাগলেন পরম ও চরম বিজ্ঞতার অধিকারী ও নির্ভুল। ফলে মূর্খতার সংগে অহমিকা বা ইংরেজীতে যাকে বলে এরোগেল, তার মিশ্রণ হলো। মূর্থ নিজের মূর্থতা স্বীকার করে কার্যে অবতীর্ণ হলে এবং অপরের গঠনমূলক উপদেশাদি গ্রহণে রাজী হলে তা তেমন দৃষ্টিকটু হয় না। কিন্তু মূর্খতা ও আত্মম্ভরিতার মিশ্রণ একেবারেই অসহ্য।

 সপ্তমঃ মুসলিম লীগ অর্থনৈতিক রাজনীতি সংগে মিশিয়ে ফেললেন। রাজনীতিতে অনেক সময় জনগণের ভাবালুতা কাজে লাগাতে হয়। কিন্তু অর্থনীতি বর্তমানে জগতে বিজ্ঞানের একটি শাখা। সুতরাং ভাবালুতাভিত্তিক অর্থনীতি আধুনিক জগতে একেবারেই অচল। বাণিজ্যের মূল কথাই হলো লাভ-লোকসান। চরম শত্রর সংগেও লাভ হলে ব্যবসা করতে হয়। কিন্তু লীগ কর্ণধাররা বাণিজ্যের মূলনীতি বিস্মৃত হয়ে ভারতের সংগে কায়কারবার প্রায় বন্ধ করে দিলেন। স্বাধীনতার পর ভারত পাকিস্তান থেকে ৪০ লাভ বেল পাট ও ১৫ লাখ বেল তুলা কিনত, কিন্তু আজ কেনে মাত্র দশ লাখ বেল পাট। ভারত পাট উৎপাদন বৃদ্ধি করল, আমরা অবলম্বন করলাম “পাট উৎপাদন কমাও নীতি”। মুসলিম লীগ সরকার চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের সংগে বাণিজ্যিক সম্পর্কে স্থাপনে বহুকাল ইতস্ততঃ করেছে। এখানেই শেষ নয়, দুনিয়ার সব দেশ যখন মুদ্রার মূল্যমান কমিয়ে দেয় তখন এই একাউণ্টেট অর্থনীতি বিশারদরা পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্যমান পূর্ব হারেই রেখে দেন, কিন্তু এর থেকে যে লাভ হলো তার এতটুকুও দেশের জনসাধারণকে পাইয়ে দেবার কোন ব্যবস্থা করলেন না। এরা দেশের দুই অংশের মধ্যে স্বর্ণের দু'রকম মূল্য নির্ধারণ করে কার্যত পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বীকার করেও, নিজেদের স্বার্থোদ্ধার ও পূর্ব পাকিস্তানকে লণ্ঠনের জন্যে উভয় পাকিস্তানকে এক অর্থনীতির জোয়ালে আবদ্ধ করে লাঙ্গল ধরলেন। এই অশ্রুতপূর্ব মূর্খতার ফলে আজ পাকিস্তানী অর্থনীতি বিপর্যস্ত জনসাধারণ আজ অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন, পূর্ব পাকিস্তান আজ ভিখারীর দেশে পরিণত: অপর যে-কোন সভ্য দেশে রাষ্ট্র পরিচালকগণের মধ্যে মূর্খতা ও আত্মম্ভরিতার এরূপ সমাবেশ হলে দেশের লোকের বিচারে তাদের গুরুতর শাস্তি হতো।

 অষ্টমতঃ ইংরেজ আমলে মাথাভারি শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা দূরের কথা, মুসলীম লীগ তাকে পূর্বাপেক্ষাও মাথাভারি করতে প্রস্তুত হলেন। যে দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় এখন পর্যন্ত সম্ভবতঃ একশত টাকার উর্ধ্বে নয়, সেই দেশে বার্ষিক দু'তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের পদ রাখার নজীর বর্তমান দুনিয়ায় নেই। গ্রেট বৃটেনের মত উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রীর বেতনের চাইতে বেশী এদেশের অনেকের মাসিক বেতন। পাকিস্তানের মত দরিদ্র দেশের বৈদেশিক দূতাবাস, ট্রেড কমিশন, ডেলিগেশন প্রভৃতির সংখ্যা কানাডা ও বৃটেনের মত উন্নত রাষ্ট্রের চাইতেও সম্ভবতঃ অনেক বেশী, অথচ অতি সহজেই একটি বৈদেশিক দূতাবাস থেকে অনেক ক্ষেত্রে একাধিক দেশে কাজ করতে পারে।

 মোট কথা, মুসলিম লীগ মুখে ধর্মের জিগির এবং কার্যত দেশের জনসাধারণকে ইংরেজ আমল অপেক্ষাও দারিদ্র নিমজ্জিত করে দেশকে ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করার যে অদম্য উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় মত্ত হলো, তার নজীর কোন ইতিহাসে নেই। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে দেশ আজ দৈনন্দিন খরচের জন্য পরমুখাপেক্ষী। বিদেশের অর্থ সাহায্য ছাড়া আজ পাকিস্তান অচল। এজন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার মত অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে দেশ।

 বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের জন্যে সরকারী দলের মতই সমান প্রয়োজন বলে মনে করতে হবে। বিরোধী দলের ‘শির কুচল’ দেওয়ার কল্পনা পরিত্যাগ করতে হবে। বিরোধী দলের কারও দেশপ্রেমে সন্দেহ প্রকাশ করার নীতি বর্জন করতে হবে। মোট কথা, পূর্ণ পালামেণ্টারী শাসন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হবে আমাদের লক্ষ্যস্থল।

 ইতিহাস সাক্ষী, কোন দেশের জনসাধারণ কোন কালেই ভুল করেনি। যারা বলেন যে, নিরক্ষরতা বা অজ্ঞতার জন্য জনসাধারণ ভুল করতে পারে, সুতরাং জনসাধারণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না, তাদের সংগে জনসাধারণের কোন পরিচয় কোন পরিচয় নেই। সমবেতভাবে জনসাধারণ যদি ভুলই করত, তবে তারা পাকিস্তান আনতে পারত না। পূর্ব বাংলার বিগত সাধারন নির্বাচনে জনতা যে অপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছে, তার তুলনা নেই।

 এখন পর্যন্ত আমাদের অনেক কাজ বাকী। একুশ দফা ওয়াদার মূল দফা এবং আওয়ামী লীগ ম্যানিফেষ্টোরও প্রধান কথা হল পররাষ্ট্র, মুদ্রা এবং দেশরক্ষা বিভাগ ছাড়া আর সকল বিভাগের ভার প্রদেশকে দিতে হবে। কারণ যতদিন না পূর্ব পাকিস্তান তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার পূর্ণ ক্ষমতা পাচ্ছে, যতদিন না শিল্প ও বাণিজ্য, রেলওয়ে, পোষ্ট অফিস প্রভৃতি বিভাগগুলির পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে আসছে, যতদিন না পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক বিচারে দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইউনিট বলে স্বীকার করা হচ্ছেততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সম্ভব নয়।

 বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদ আর একটি ওয়াদা। সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের খেসারত দিতে হলে পূর্ব পাকিস্তানকে অন্ততঃ ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ স্বরূপই দিতে হবে, টাকা দেওয়ার মতো ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নেই। যে টাকা জমিদার-তালুকদারকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দেওয়ার ব্যবস্থা বর্তমান আইনে আছে, সে টাকা দ্বারা এদেশে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কর্মক্ষম জমিদার-তালুকদারদের যোগ্যতামত নিয়োগ করা যেতে পারে। সংগত মনে হলে ঐ সকল শিল্পের কিছু শেয়ারও তাদের দেয়া যেতে পারে।

 শিক্ষা-পূর্ব পাকিস্তানে ১৬% মাত্র অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার ওয়াদার আমরা আবদ্ধ। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ হাজার এখন ৩০-৩৫ হাজার; হাইস্কুল ও হাই-মাদ্রাসা মিলে ছিল প্রায় ২ হাজার, এখন কাগজেপত্রেই মাত্র ১৪ শত। মধ্যে ইংরেজী ও জুনিয়র মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল প্রায় ২,৫০০ এখন নেই বললেই চলে। শিক্ষকের সমস্যা আরো গুরুতর- প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন সরকারী ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের চেয়েও কম।

 সামরিক বিভাগ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন থাকবে আমরা বলেছি: কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সামরিক বিভাগের নিয়োগ থেকে পূর্ব পাকিস্তানী যুবকরা চিরকালের জন্য বঞ্চিত থাকবে। সামরিক বিভাগের ২ লক্ষ কর্মচারীর মধ্যে ৫% জনও পূর্ব পাকিস্তানী নয়। পাকিস্তান সরকার দেশরক্ষা খাতে বৎসরে রাজস্ব খাত থেকেই প্রায় সত্তর কোটি টাকা ব্যয় করেন, এছাড়া বৈদেশিক সাহায্য তো আছেই। এই টাকার পনেরো আনাই ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। অথচ দেশ রক্ষার অধিকার সকলের সমান। জাপান ও চীনাদের মত খর্বকায় ব্যক্তিরা যুদ্ধের উপযোগী হতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানী যুবকরা সামরিক বিভাগের জন্য উপযোগী কেন হবে না তা বুঝে ওঠা কঠিন। আমরা সংখ্যাসাম্য মেনে নিয়েছি দেশের সকল ব্যাপারে সংখ্যাসাম্য ভোগ করব বলে- কেন্দ্রীয় সরকারের মোট খরচের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ থেকে বঞ্চিত হবার জন্যে নয়।


 পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বর্গমাইলে প্রায় নয়শত লোক বাস করে; পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে এই সংখ্যা এক শতেরও কম। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানে শত ইচ্ছা করলেও কৃষির খুব উন্নতি করা সম্ভব নয়। সুতরাং বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা হল পশ্চিম পাকিস্তানে যান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ব্যাপকভাবে শিম্পায়িত করা। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে শিম্পায়িত করার কার্যে এ পর্যন্ত চরম অবহেলা প্রদর্শন করে আসছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তারা সমস্ত ভারী শিল্প কেন্দ্রীভূত করেছেন।

 পূর্ব পাকিস্তানকে শিম্পায়িত এবং এখানকার ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানীদের কর্তৃত্বাধীন একটি বৃহদাকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজন। প্রাদেশিক সরকারের উদ্যোগেই এই শ্রেণীর একটি ব্যাংক অনতিবিলম্বে সহাপিত হওয়া দরকার।

 পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সদর অফিস করাচীতে করে অনেক ব্যবসায়ী ইনকামট্যাক্স ফাঁকি দেবার সুযোগ পাচ্ছে। অপর দিকে পূর্ব বাংলার ছোটখাটো শিল্প ও ব্যবসায়ের মালিকগণ একতরফা ইনকামট্যাক্সের চাপে নিষ্পিষ্ট হয়ে অনেকে কারবার গুটাতে বাধ্য হচ্ছে। এরূপ অবস্থার প্রতিকার দরকার। যাতে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প গড়ে ওঠে তজ্জন্য পূর্ব পাকিস্তানী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে—প্রয়োজনমতো বিশেষ সুবিধাও দিতে হবে।


 পাকিস্তানের গণতন্ত্রও পূর্ব পাকিস্তানের অনুকুল হ’ল না। ইহা সংশোধনের জন্য আওয়ামী লীগকে সক্রিয় হতে হবে।

 আমলাদের বেতন ৪-৫ হাজার টাকা। এর প্রতিকারের জন্য আওয়ামী লীগকে আন্দোলন চালাতে হবে। এ আন্দোলন গণতন্ত্র কায়েমের আন্দোলন, শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের হাত থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা নেওয়ার আন্দোলন।

 পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য- ‘বিভেদ সৃষ্টি কর এবং শাসন কর’- শত শত বৎসরের এই সাম্রাজ্যবাদী নীতি এশিয়া, আফ্রিকার ব্যর্থ হউক- দুনিয়ার নিরবচ্ছিন্ন শান্তি স্থাপনের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠুক।[১]


  1. ভাষণটিকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।