বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১০৮

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
কাগমারী সম্মেলন সম্পর্কে মুসলিম লীগ সমর্থক ‘দৈনিক আজাদ’- এর সম্পাদকীয় মন্তব্য দৈনিক ‘আজাদ’ ১২ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৭

কাগমারী সম্মেলন

 সম্প্রতি মোমেনশাহীর কাগমারীতে আওয়মী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হইয়া গেল। তার সাথে একটা তথাকথিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনের অধিবেশনও হইয়া গিয়াছে বলিয়া প্রকাশ। “তথাকথিত' বলিয়া অভিহিত করিলাম এই জন্য যে, পাক-বাংলার সাহিত্য তমুদ্দন লইয়া যাঁরা চর্চা করিয়া থাকেন তাঁদের অধিকাংশই এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগদান করিতে পারেন নাই। কারণ তাহাদিগকে যোগদানের আহবান জানানো হয় নাই। যে কিছুসংখ্যক সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী এ-সম্মেলনে যোগদানের সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন, তাঁদের আবার বেশীর ভাগই ছিলেন এক বিশেষ দল ও মতের ধারক ও বাহক। কাজেই এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনকে কিছুতেই পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিনিধিমূলক বলা চলে না।

 পাক-বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি যত উপেক্ষা দেখানো হোক না কেন, ভারতীয় বাংলায় সাহিত্যসেবীদের প্রতি সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের শ্রদ্ধাভক্তি দেখিয়া পুলকিত হইতে হয়। মনে হয় সম্ভব হইলে ভারতীয় বাংলা উজাড় করিয়া সাহিত্যিকদিগের কাগমারী লইয়া আসিতেও তাঁদের দ্বিধা ছিল না। কিন্তু তা তো সম্ভব ছিল না, তাই গুটি কয়েকজনকে আনিয়াই দুধের সাধ ঘোলে মিটাইতে হইয়াছে।

 যাহা হোক “সাংস্কৃতিক সম্মেলন সম্পর্কে আমরা অন্যদিন আলোচনা করি। আজ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সম্পর্কেই আমরা কিঞ্চিৎ আলোচনা করিতে চেষ্টা করিব। অবশ্য এই আওয়ামী কাউন্সিলে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে, সেইসব প্রস্তাবের যৌক্তিকতা বা সময়োপযোগিতা সম্পর্কে আমরা কিছু বলিতে চাই না। আমরা শুধু এই অধিবেশনের কার্যক্রমের ভিতর দিয়া যে সুর ফুটিয়াছে সে সম্পর্কে কিছু বলিতে বাধ্য হইতেছি এই কারণে যে, এই সুরটি বড় ভয়ানক, ইহাতে পাকিস্তানের অশুভ পরিনামের ইংগিতই ফুটিয়া উঠিয়াছে।

 সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের যে মারাত্মক চেষ্টা করা হইয়াছিল সুখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দীর হস্তক্ষেপে এবং তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। যারা এই অপচেষ্টা করিয়াছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য করিয়া জনাব সোহরাওয়ার্দী সুস্পষ্ট ভাষা ঘোষণা করেনঃ “দেশের বৃহত্তম স্বার্থে, সময় ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করিয়া পররাষ্ট্র নীতি পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে। কূটনীতির উপরই পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে। এই কারণেই পররাষ্ট্রনীতির নির্ভর করে। এই কারণেই পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ১৯৫০ সালে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বছরের পর বছর ধরিয়া আকড়াইয়া থাকিতে হইবে, এমন কোন কথা নাই। এই বিশ্বাসে বলীয়ান হইয়া পররাষ্ট্র বিষয়ক ব্যাপারে বর্তমান সরকার যে নীতি গ্রহণ করিয়াছেন, হাতে হাতে তার ফল পাওয়া গিয়াছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান আজ যথেষ্ট গুরুত্ব ও মর্যাদা অর্জন করিয়াছে।”

 বলাবাহুল্য, জনাব সোহরাওয়ার্দীর এই ঘোষণায় প্রতিবাদীদের সমস্ত চেষ্টা ভাসিয়া গিয়াছিল। ইহার সমর্থনে আট শতাধিক কাউন্সিলারের করতালিতে অধিবেশন কক্ষ মুখরিত হইয়া উঠিয়াছিল বলিয়া প্রকাশ। কিন্তু তুব এই অপচেষ্টাকারীরা দমিয়া গিয়াছিলেন কি? মনে তো হয় না। “ষ্টেটসম্যানের রিপোর্ট যদি সত্য হইয়া থাকে তাহা হইলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ইহারা আবার মাথা জাগাইয়াছিলেন এবং তাঁদের অপচেষ্টার সমর্থনে একটি প্রস্তাবও পাস করাইয়া লইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। এ কথা সত্য হইয়া থাকিলে এবং এ প্রস্তাব কার্যকরী করার চেষ্টা হয়, তাহা হইলে আওয়ামী লীগে ভাঙন রোধ করা কঠিন হইয়া পড়িবে বলিয়া মনে করার কারণ আছে।

 আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গবেষণা করা অবশ্য আমাদের কাজ নয়, এই ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য শুধু এইটুকু যে, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যাঁরা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি বদলাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাঁরা পাকিস্তানকে কোথায় লইয়া যাইতে চান? পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা মানে বন্ধুহীনতা, শুধু তাই নয়, জনাব সোহরাওয়ার্দীর ভাষায় ‘ব্ল্যাকমেলিং। এই বাদুড়নীতি আজ ভারতকে বন্ধুহীন করিয়াছে, কাশ্মীর প্রশ্নের আজ একজনও তার সমর্থক নাই। এসব দেখিবার পরও তারা পাকিস্তানকে ভারতের অনুসরণ করিতে বলিতেছেন কোন সদুদ্দেশ্যে? কাশ্মীর সমস্যার সুসমাধান যতদিন না হইতেছে, ততদিন প্রতিবেশী হইলেও, ভারতকে পাকিস্তান বন্ধুরাষ্ট্র বলিয়া স্বীকৃতি দিতে পারে না। কাজেই এই সময় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারতের বাদুড়নীতির অনুকরণ করিতে যারা বলেন, পাকিস্তানের মঙ্গল তাদের কতটুকু কাম্য?

 তাছাড়া মওলানা ভাসানীর ভাষণে এমন কতকগুলি উক্তি আছে, যাতে সত্যভাবে পাকিস্তানী মাত্রই শঙ্কিত হইয়া পারেন না। মোছলেম লীগের নিন্দায় মওলানা ভাসানী তার ভাষণে একেবারে পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছেন। তা হোন, কিন্তু বেসামল হইয়া তিনি এমন কথাও বলিয়া ফেলিয়াছেনঃ “প্রাক- স্বাধীনতা যুগেরও মোছলেম লীগের কোন অস্তিবাচক জীবনদর্শন ছিল না। প্রধানতঃ বিদ্বেষকে অবলম্বন করে সেদিন আমাদের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে। জীঘাংসার নিবৃত্তি হলে আমরা কি গড়ে তুলব সেদিন একথা আমাদের কোন নেতা চিন্তা করেননি এবং চিন্তা করেননি বলেই পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত সত্যকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল না।”

 উপরোক্ত উক্তির সোজা অর্থ এই দাঁড়ায় যে কায়েদে আজমের নেতৃত্বে যে পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালিত হইয়াছিল তাহা ছিল নিতান্তই নেতিবাচক হট্টগোল মাত্র, জীবনদর্শন বলিয়া কেন গঠনমুলক ব্যাপার তাতে ছিল, আর বিয়ে ছিল এই হট্টগোলের ভিত্তি। এবং মার-কাটের ভিতর দিয়া পাকিস্তান আসিয়াছে বলিয়াই পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইল না।

 পাকিস্তান আন্দোলন এবং সে আন্দোলনের নেতা কায়েদে আজম সম্পর্কে ভারতীয় কংগ্রেসীরা অনেক কুকথা বলিয়াছেন বটে কিন্তু এমন কথা তারাও বলিতে পারেন নাই। কায়েদে আজমের মোছলেম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবী, মওলানা ভাসানীর মতে ছিল নেতিবাচক কথামাত্র। কায়েদের আজম চাহিয়াছিলেন বড়- ছোটর ভেদাভেদ ঘুচাইয়া শোষণহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করিতে। তাঁর এ উক্তিও তাহা হইলে জীবনদর্শনহীন বাজে কথামাত্র। বস্তুতঃ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা সম্পর্কে এমন প্রশস্তি (!) আর কোন দেশে কখনো উচ্চারিত হইয়াছে কিনা সন্দেহ। পাকিস্তানের উৎপত্তি সম্পর্কে এমন ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য উক্তি শুনিবার দুর্ভাগ্য আমাদের হইবে এরূপ কল্পনাও আমাদের ছিল না। পাকিস্তান সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করেন বলিয়াই কি মওলানা ভাসানী ইহাকে আজ রসাতলে লইয়া যাইবার মতলব আঁটিয়াছেন?

 তাঁর এই মতলব ধরা পড়িয়াছে তাঁর আর একটি উত্তিতে। তিনি বলিয়াছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ যদি বন্ধ না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসিবে, যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাইবে ‘আসসালামো আলায়কুম। অর্থাৎ পাকিস্তান হইতে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। পাকিস্তান সম্পর্কে কোন পাকিস্তানীর মুখে পাকিস্তান বিচ্ছেদের মারাত্মক কথা যে এমন হালকাভাবে উচ্চারিত হইতে পারে, ইহা কে কবে ভাবিতে পারিয়াছিল? এমন কথা মুখে উচ্চারণ করিতে পারেন মাত্র তাঁরাই, যাঁরা পাকিস্তানের সংহতির কোন গুরুত্বই উপলব্ধি করিতে পারেন না। পাকিস্তানের উভয় অংশ যদি খোদা না করুন, পৃথক হইয়া পড়ে, তাহা হইলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকিবে কি? আর থাকিলেও বিশ্ব রাজনীতিতে তার কোন গুরুত্ব থাকিবে কি? পশ্চিম পাকিস্তান-বিদ্বেষে এমন কথা কোন পাকিস্তানী উচ্চারণ করিলে তাতে তার পূর্ব পাকিস্তান নীতি হয়ত প্রকাশ পাইতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রতি ইহা রাষ্ট্রদ্রোহকর উক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া মওলানা ভাসানীর দলই যখন বর্তমানে রাষ্ট্রতরণীর কর্ণধার তখন এমন উক্তির মাত্র একটি অর্থই হইতে পারে, এবং তা হইতেছেঃ যিনি এমন উক্তি করেন, পাকিস্তান হিসাবে এই রাষ্ট্রের টিকিয়া থাকা তাঁর কাম্য নয়।