বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১১১

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত দৈনিক সংবাদ ২৬শে জুলাই, ১৯৫৭

পাকিস্তানের উভয় অংশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সমন্বয় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে নয়া রাজনৈতিক দল গঠিত ঢাকায় অনুষ্ঠানরত গণতান্ত্রিক সম্মেলনের অভূতপূর্ব সাফল্যঃ বারো শতাধিক প্রতিনিধির সমাবেশে জাগ্রত জনমতের অভিব্যক্তি

বিষয় নির্বাচন কমিটিতে খসড়া ম্যানিফেষ্টো গৃহীতঃ প্রতিনিধি সভায় সাময়িকিভাবে অনুমোদন দান

 সারা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকল্য (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামের একটি নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করিয়াছে। সমগ্র পাকিস্তান গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সমন্বয়ে গঠিত এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বের ফলে পাকিস্তানের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল সংগ্রামী অধ্যায় সূচনা হইল।

 গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে পাকিস্তানের উভয় অংশের বারো শতাধিক কর্মী ও নেতা যোগদান করিয়াছেন।

 অসাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি গঠনের প্রস্তাব করা হইয়াছে। সমগ্র পাকিস্তানে ইহাই বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংস্থা। আশা ও আকাঙ্খার আলোকে উদ্ভাসিত প্রতিটি প্রতিনিধি নয়া প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাবটির প্রতি সমবেতভাবে সমর্থন জানাইয়াছেন। গণতন্ত্রী দল, ন্যাশনাল পার্টি এবং ভাসানীপন্থীগণ এই নয়া পার্টিতে যোগদান করিবেন বলিয়া জানা গিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বজনমান্য নেতা আবদুল গফার খান, জি এম সৈয়দ, মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, মাহমুদুল হক ওসমানী, আবদুল মজিদ সিন্ধী, আবদুস সামাদ খান আচাকজারী (আচাকজাই), আবরার আবদুল গফুর, গোলাম মোহাম্মদ লাগারী, হাশিম খান গীলরাই; মাহমুদ আলী কাসুরী, এয়ার কমাণ্ডার ঝাণ্ডুয়া প্রমুখ এক শতাধিক কর্মী উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের মঞ্চটি জনসাধারণের বিভিন্ন দাবী-দাওয়া সম্বলিত বহুসংখ্যক পোষ্টার দিয়া সজ্জিত করা হইয়াছিল। অপরাহ্নের অধিবেশনে সীমান্তের গান্ধী খান আবদুল গফফার খান এবং প্রাদেশিক মন্ত্রী জনাব মাহমুদ আলী যোগদান করেন। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সহিত প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সহস্রাধিক গণতান্ত্রিক কর্মী সদরঘাটস্থ রূপমহল সিনেমা হলে সমবেত হন। জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং কোরান শরীফ তেলাওয়াতের পর সারা পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান অতিথি ও কর্মীদের স্বাগত জানাইয়া দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করিয়া বক্তৃতা দেন। তিনি তাহার বক্তৃতায় বর্তমান আওয়ামী সরকারের কার্যক্রম ও জনাব সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন।

 ইহার পর সভাপতি মওলানা ভাসানী মুহুর্মুহু জিন্দাবাদ ধ্বনির সংগে ভাষণ দান করিতে উঠেন। তিনি বিভাগপূর্ব কাল হইতে শুরু করিয়া আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভ এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করিয়া দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। তাঁহারা বক্তৃতা উর্দুতেও অনুবাদ করিয়া পাঠ করা হয়।

 পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বক্তৃতার পর জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান নয়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। প্রস্তাবটিতে বলা হয়: পাকিস্তানের উভয় অংশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল এবং সকল গণতান্ত্রিক নাগরিকরে প্রতিনিধিবৃন্দদের এই সম্মেলনকে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা পর এবং (১) পাকিস্তানকে সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণমুক্ত একটি শক্তিশালী জাতিতে সংগঠিতকরণ, (২) জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন, (৩) নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশের উভয় অংশে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করার উদ্দেশ্যে দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধী করিয়া সম্মেলনে পাকিস্তানবাসীর সেবায় উৎসর্গীকৃত নতুন একটি জাতীয় দল গঠনের প্রস্তাব করিতেছে। এই নতুন দলটির নাম হইবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি।

 এই পার্টি একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পাকিস্তানের উভয় অংশে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মেলন একটি সংগঠনী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছে।

 উক্ত প্রস্তাবক্রমে গঠিত নয়া পার্টির ম্যানিফেষ্টোতে বলা হইয়াছে যে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন এবং দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিসমুহের সমন্বয়ের এক নয় রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজন রহিয়াছে। পাকিস্তানের উভয় অংশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রতিনিধিবৃন্দের এই সম্মেলন এতদ্বারা ঘোষণা করিতেছে যে, এক নয়া রাজনৈতিক দল গঠিত হইল এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও পূর্বাঞ্চলের গণতন্ত্রী দল এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি এই নতুন দলে যোগদান করিতেছে।

 নয়া দলের ঘোষণাপত্রে পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে বলা হয় আমরা স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করিয়া চলিব। আমাদের জাতীয় স্বার্থের আদর্শে এই পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হইবে এবং আমাদের স্বাধীনতার শক্তি বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মর্যাদা বৃদ্ধি ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাই পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য হইবে।

 এই ম্যানিফেষ্টোতে ভূমি সংস্কার, জমিদারী উচ্ছেদ, শিম্পায়ন, দুর্নীতি বন্ধ, শিক্ষার প্রসার, শ্রম মূল্য দান, ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভাষার ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ ভাগের কথা ঘোষণা করা হইয়াছে।

 বিষয় নির্বাচনী কমিটি ম্যানিফেষ্টোটি গতকল্য অপরাহ্নের এক বিশেষ সভায় সংশোধনীয় গ্রহণ করে এবং সাধারণ প্রতিনিধি সভা কর্তৃক অস্থায়ীভাবে গ্রহীত হইয়াছে। অদ্য সকাল সাড়ে আটটায় পুনরায় সম্মেলন শুরু হইবে। যদি কোন প্রকার দুর্বিপাকে অদ্যকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হয় তবে প্রতিনিধি সম্মেলনে স্থিরীকৃত সময় অনুযায়ী অস্থায়ী অনুমোদিত ম্যানিফেষ্টো এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নয়া পার্টি পরবর্তী সভা পর্যন্ত কাজ করিয়া যাইবে। গতকাল নয় ঘণ্টাকাল অধিবেশন অপরাহ্নে ছয়টা পর্যন্ত চলে। সম্মেলনে গুণ্ডা আক্রমণের তীব্র নিন্দা করিয়া একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হইয়াছে। বিভিন্ন বক্তা এই গুণ্ডামির বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বক্তৃতা

 সম্মেলনে জনাব আব্দুল মজিদ সিন্ধী বলেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের মুক্তির সংগ্রাম নিয়োজিত হইবে। কিন্তু আমরা দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রের হিসাবে থাকিতে চাইনা। সমস্ত প্রকার যুদ্ধজোট আমাদের ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে ঠেলিয়া দিতেছে। আমরা আণবিক যুদ্ধের বিভীষিকা হইতে মানবতাকে রক্ষা করিতে চাই।

 তিনি বলেন, বিরোধী দল আমাদের নেতাদের উপর আজ আক্রমণ করিয়াই আমাদের এই সম্মেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়া দিয়াছে।