বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১১৩

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের ভাষণ পূর্ব পাকিস্তান সরকার ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৫৮

পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক দুর্গতি

 পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান এক মারাত্মক রকমের আর্থিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগে আসছে, তা থেকে সে আজও মুক্ত হতে পারেনি। বর্তমানে তার অবস্থা আরও চরমে গিয়ে পৌঁছেছে। বস্তুতঃ পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক জীবনের কতকগুলি সমস্যাকে মূলধন করে কোন কোন পত্রিকা ও রাজনৈতিক দল এমন সব প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে করে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকেবহাল নন তাঁরাও স্বভাবতঃ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। তাই, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যাগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে কি, জনসাধারণ সহজেই যাতে তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন, তার জন্য আজ পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে চাই।

 ম্মিলিখিত খাতগুলি মোট ১৪ কোটি ১৬ লাখ টাকার দেনার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদেশ হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হয়:

(১) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে দেনা,
(২) প্রভিডেণ্ট ফাণ্ড,
(৩) বে-সামরিক আমানতাদি,
(৪) অনাদায়ী ট্রেজারী বিলসমূহ,
(৫) খাদ্য ক্রয় খাতে ঘাটতি জমা ও
(৬) সরকারী চাকুরীয়াদের পাওনাসহ চুক্তিগত দেনা।

 অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই পাওনা ও অবিভক্ত বাংলার অনাদায়ী ট্রেজারী বিল বাবদ আমাদের যে দেনা ছিল, তা পরিশোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার গোড়াতেই ৪ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেন। কিন্তু অন্যান্য খাতের দেনা থেকেই যায়। ফলে, কার্যভার গ্রহণের পর থেকে প্রাদেশিক সরকারকেই বছরের পর বছর ধরে এসব খাতের দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা করে যেতে হয়। সেই সংগে প্রাদেশিক সরকারকে প্রদেশের রাজধানীতে সদর দফতরসমূহের স্থান সঙ্কুলানের জন্য বহু সংখ্যক দালান-কোঠা নির্মাণ করতে হয়।

 ৪ কোটি ১৯ লক্ষ লোকের বাসভুমি পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব খাতে ১৯৪৮-৮৯ সালের বার্ষিক আয় ছিল ১৬ কোটি ৯১ লক্ষ টাকা। অপর পক্ষে ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজস্ব বাবদ আয় ছিল সে সময় ২৭ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা।

কেন্দ্রের সাহায্য

 সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, শুরু থেকেই কেন্দ্রের কাছ থেকে পশ্চিম অংশের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানেরই অনেক বেশী আর্থিক সাহায্য পাওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এই সত্যটি কার্যক্ষেত্রে সর্বদাই উপেক্ষিত হয়েছে এবং গত ক'বছরে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সময়ে উভয় অংশের জন্য যে সাহায্য মঞ্জুর করেছেন, দুই অংশের আনুপাতিক প্রয়োজনের সংগে তার কোন সঙ্গতি নেই। ১৯৫৮-৫৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে অর্থ সাহায্য করেছেন, তা থেকেই এ কথার সত্যতা নিরূপণ করা যায়। আলোচ্য সময় পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানকে যে ক্ষেত্রে ৫২ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা সরাসরি সাহায্য দিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানকে সে ক্ষেত্রে দিয়েছেন ২৬ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা।

 প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দেশ বিভাগের আগে পূর্ব পাকিস্তানেও কয়েকটি উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজ চলছিল। বাংলা প্রদেশের এ সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য তদানীন্তন ভারত সরকার ৭০ কোটি টাকা সাহায্য মঞ্জুর করেন। এই অর্থের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য হতো অন্যূন ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহের জন্য অর্থ সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে বলেন যে, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাবদ প্রাদেশিক সরকারকে ঋণ মঞ্জুর করা হবে।

 ঋণ দানের ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। ১৯৫৭-৫৮ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ কার্যকরী করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান যেখানে ঋন পেয়েছে ৯৮ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা, পূর্ব পাকিস্তান সেখানে পেয়েছে মাত্র ৪৫ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কিভাবে বণ্টন করা হয়েছে, তার আনুপাতিক হার সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যে সকল আভাস পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে যে, এ ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান তার ন্যায্য অংশ পায়নি। প্রকৃতপক্ষে শূন্যের কোঠা থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জীবনযাত্রার শুরু। এমতাবস্থায়, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্নমুখী ঘাটতি পূরণের জন্য এখানকার জনসংখ্যা এবং বৈষয়িক ও আর্থিক অসচ্ছলতার কথা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত সরাসরি সাহায্য, বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন খাতে মঞ্জুরীকৃত ঋণের অন্যূন শতকরা ৫০ ভাগের বেশী পূর্ব পাকিস্তানেরই পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হওয়া তো দূরের কথা- এই প্রদেশ কেবল অবহেলাই পেয়ে এসেছে। প্রদেশের বর্তমান শোচনীয় আর্থিক অবস্থা এই অবহেলারই ফল।

 কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব খাতের ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা হয়েছে। ১৯৫৬-৫৭ সাল পর্যন্ত এই খাতের ব্যয় বরাদ্দের তুলনামূলক বিবরণ থেকে এটা পরিস্কার হয়ে পড়েছে। আলোচ্য সময় পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যেখানে ব্যয় করা হয় মাত্র ৬৩ কোটি টাকা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হয় ৮১ কোটি টাকা।

দেশরক্ষা-

 দেশরক্ষা খাতের ব্যয় বরাদ্দের চিত্র আরও নৈরাশ্যজনক। ১৯৫৬-৫৭ সাল পর্যন্ত দেশরক্ষা বাবদ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় কিঞ্চিদধিক ১৮ কোটি টাকা, অপরপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৪৮০ কোটি টাকা। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, দেশ বিভাগকালে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা সব দিক দিয়েই সন্তোষজনক ছিল। সুতরাং এ প্রদেশের দেশরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়ন ও শক্তিশালী করার দিকে আরও বেশী নজর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পূর্ব পাকিস্তানকে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কঠোর সংগ্রামের পথেই ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ফলে, তার পক্ষে জাতি গঠনমূলক কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ ক’বছরে পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোন বড় রকমের উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকরী না হওয়ায় এখানকার আর্থিক অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। আমি আগেই বলেছি, এ সব অসুবিধা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন খাতের আয় বৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকার বিগত ১০ বছরে ৩০টি নয়া কর ধার্য করেছেন অথচ সাধারণের আর্থিক মানের উন্নতি না হওয়ায় অধিক করভার বহনের ক্ষমতাও তাদের নেই। যে পরিমাণ সাহায্য করা উচিত ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তা করেননি। সিএসপি অফিসারদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি এবং গভর্ণরকে আর বেশী সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের উপর কতিপয় ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ায়  প্রাদেশিক কোষাগার থেকে বৎসরে কয়েক লক্ষ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের উৎসগুলির বিলি বণ্টনের ক্ষেত্রে সুবিচারের জন্য প্রাদেশিক সরকার দাবী জানিয়ে এসেছে। এতদসত্ত্বেও ১৯৪৮-৮৯ সালে রাজস্বের একমাত্র সম্প্রসারণশীল উৎস “বিক্রয়-কর” ও কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় নেয়া হয়। রাজস্বউৎসগুলির পুনবিন্যাসের জন্য বারংবার দাবী জানাতে থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫২-৫৩ সালে এ সম্পর্কে একটি কমিটি গঠনে সম্মত হন, যাকে রেইসম্যান কমিটি বলা হয়। দুঃখের বিষয়, এই কমিটিও প্রদেশকে সাহায্য করে কেন্দ্রকেই জোরদার করে গেছেন। পাট রফতানী শুক্ষের অংশ বণ্টন ব্যাপারে রেইসম্যান কমিটির রোয়েদাদ প্রদেশের সত্যিকার কোন উপকারের পরিবর্তে বরং অপকারই করেছে। ১৯৫০-৫১ ও ১৯৫১-৫২ সালে পাট শুদ্ধ খাতে প্রদেশের আর ছিল যথাক্রমে ৬ কোটি ৭২ লক্ষ ও ৬ কোটি টাকা। কিন্তু রেইসম্যান রোয়েদাদের পর ১৯৫২-৫৩ ও ১৯৫৩-৫৪ সালে তার পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪ কোটি ৩২ লক্ষ ও ৪ কোটি টাকা।

 প্রদেশের আর্থিক অবস্থার ক্রমাগত এই অবনতির আর একটি কারণ হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য প্রাদেশিক সরকার যে সব কাজ করেছেন, সে সকল ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দায়িত্ব পুরাপুরিভাবে পালন করেননি। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও সীমান্ত পুলিশ বাহিনীর জন্য মোট যা ব্যয় হয়, কেন্দ্রীয় সরকার তার শতকরা ৬০ ভাগ বহন করতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার উক্ত টাকা দেননি। ফলে, এই একটি খাতেই বর্তমান সময় পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা।

 বেসামরিক দেশরক্ষা বাবদ যা ব্যয় হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের তারও শতকরা ৭৫ ভাগ বহন করার কথা। এ খাতেও পূর্ব পাকিস্তানের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫৩ লক্ষ টাকা। বারংবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রী সরকার এই খাতে কোন সাহায্যই মঞ্জুর করেননি।

 তা হলে দেখা যাচ্ছে, যে সব কারণে পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে সঙ্কটজনক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, তা আজও বিদ্যামান রয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে “অধিক খাদ্য ফলাও আন্দোলন জোরদার করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত সাহায্য ও ঋণের অংশ যদি পর্যাপ্ত হতো, তা হলে অধিকাংশ অসুবিধাই আমরা এড়িয়ে যেতে পারতাম। রাজস্বের ক্ষেত্রে আমাদের এই যে ক্রমাগত ঘাটতি এরও অন্যতম কারণ কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে রাজস্ব উৎস বণ্টনের ব্যাপারে অনুসৃত অসম ব্যবস্থা।

ব্যয় সঙ্কোচ

 কেন্দ্রীয় সরকার রাজস্ব খাতের আয় পরীক্ষা ও ব্যয়-হ্রসের জন্য আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আগেই আমি বলেছি যে, গত ১০ বছরে আমরা ৩০টি নয়া কর ধার্য করেছি। কিন্তু প্রদেশবাসীর বৈষয়িক অবস্থা অতীব শোচনীয় হওয়ায় আমাদের রাজস্ব খাতে আয় তেমন বাড়েনি। পক্ষান্তরে ব্যয় কমানোও সম্ভব হয়নি। কেননা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উচ্চমূল্য এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে সরকারী চাকুরিয়াদের আয় বা বেতনের সামঞ্জস্য নেই। অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যয় আনুপাতিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সে সব-ক্ষেত্রেও ব্যয় সঙ্কোচ করা সম্ভব হয়নি। আর্থিক সাহায্য দানের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অতীতে যে সব অবিচার করা হয়েছে তার আস্ত প্রতিকার এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে রাজস্ব আদায়ে উৎসগুলির ন্যায্য ও সুষম বণ্টনের মধ্যেই পুর্ব পাকিস্তানের এসব অভাব-অসুবিধার বাস্তব সমাধান নিহিত।

 রিলিফের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমরা যে সাহায্য চেয়েছি সে সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন মনে করি।

 বিশেষ করে খাদ্য মূল্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত-এই চার মাস পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সব সময়ই সঙ্কটকাল বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ সময় অবস্থা বিশেষে খাদ্যশস্যের মূল্য কম-বেশ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তদুপরি ১৯৫৪, ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালের সর্বগ্রাসী বন্যা প্রদেশের অবস্থা আরও সঙ্গীন করে তোলে। এরপর ১৯৫৭ সালে অনাবৃষ্টির ফলে প্রদেশের কতকগুলি জেলায় আউস আমন ও রবিশস্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং অপর কতকগুলি জেলায় আংশিক শস্যহানি, উপকূল এলাকায় লোনাপনির প্লাবন ও কীটের উপদ্রবে অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।

 এর উপর আবার মড়কে বিভিন্ন জেলায় বহু গবাদিপশুর মৃত্যু হয়। আর সেই সঙ্গে কালেরা ও বসন্তের ভয়াবহ মহামারী সমগ্র প্রদেশ ছেয়ে ফেলে। এর দরুন-গ্রামাঞ্চলের জনসাধারণের কর্মসক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

 এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ধান, চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে এখন জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। ফলে, এখন সর্বত্র শোচনীয় দুরবস্থা বিরাজ করছে। দুর্গত এলাকায় বিপন্ন জনসাধারণ জান বাঁচানরো তাগিদে গরু, বাছুর, বীজ এমনকি কৃষি যন্ত্রপাতি পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এখন তাদের কাছে এমন কোন সম্পদই নেই, যার উপর তারা নির্ভর করে থাকতে পারে। এ অবস্থায় এখন সরকারকে কেবল এদের চাষাবাদের ব্যবস্থা করে দিলেই চলবে না। বরং এই সঙ্কটকালে তাদের বেঁচে থাকবার মত সংস্থানও করে দিতে হবে।

 এসব প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে প্রদেশের শতকরা সাড়ে ১২ জন অর্থাৎ মোট প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মারাত্মক রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের সকলেরই সাহায্যের দরকার এবং তাদের তা পাওয়া উচিত। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৩০ লক্ষ লোকের (৬ লক্ষ পরিবার) কৃষি ঋণ প্রয়োজন। এই ৬ লক্ষ পরিবারের মধ্যে ৫ লক্ষ পরিবারকে পরিবার প্রতি ৫০ টাকা হারে কৃষি ঋণ ও পরিবার প্রতি ১৫০ টাকা হারে দুই লক্ষ পরিবারকে গবাদিপশু ক্রয় ঋণ মঞ্জুর করতে হবে। এ বাবদ প্রয়োঞ্জন হবে সাড়ে ৫ কোটি টাকা।

টেষ্ট রিলিফ-

 ভূমিহীন যে সব শ্রমিক সহজে কাজ পাচ্ছে না, টেষ্ট রিলিফের মারফত তাদের কাজ দিতে হবে। দুর্গত জনসাধারণের মধ্যে ১৫ লক্ষ লোক অর্থাৎ ৩ লক্ষ পরিবারের জন্য এই ধরনের রিলিফের প্রয়োজন। টেষ্ট রিলিফের কাজ জুন মাসের শেষ কিংবা জুলাই মাসের মাঝামাঝি এমনকি, কোন কোন জেলায় এর পরেও চালু রাখতে হবে। পরিবার পিছু দুইজন হিসাবে মাথাপ্রতি ২ টাকা করিয়া হিসাব করিলে ছয় লক্ষ লোকের এক মাসের কর্মসংস্থান করিতে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী এবং বগুড়া জেলার একফসলী অঞ্চলের প্রায় এক লক্ষ লোকের সাহায্যার্থে টেষ্ট রিলিফের কাজ নভেম্বর মাসের শেষভাবে আমন ফসল ওঠা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে এবং এজন্য অতিরিক্ত ৩ কোটি টাকা প্রয়োজন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, টেষ্ট রিলিফের জন্য মোট প্রয়োজন প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ভূমিহীন অক্ষম লোকদেরও খয়রাতি সাহায্য দিয়ে যেতে হবে। আগষ্টের প্রথমভাগে আউস কাটা শুরু হলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে। এ ধরনের লোকের সংখ্যা প্রদেশে ৫ লক্ষের মত। স্বাভাবিক হারে মাসপ্রতি মাথাপিছু ১০ সের চাল জোগালেও দু'মাসে (জুন ও জুলাই) চাল প্রয়োজন হবে ২,৫০,০০০ মণ যার দাম হবে যাবতীয় খরচসহ মোট ৫৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা অর্থাৎ মনপ্রতি ২২ টাকা ৮ আনা। এ ছাড়া এক-ফসলী এলাকার ১ লক্ষ লোককেও আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ৪ মাস খয়রাতি সাহায্য দিতে প্রয়োজন হবে ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এ নিয়। খয়রাতি সাহায্যের জন্য মোট দরকার ৭৮ লক্ষ টাকা।

 চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও অন্যান্য জায়গায় ঘূর্ণিবতায় ক্ষতিগ্রস্ত ২ লক্ষ পরিবারকে তাদের ঘরবাড়ী মেরামতের জর্ন গৃহনির্মাণ সাহায্য মঞ্জুর করতে হবে। পরিবার-পিছু স্বাভাবিক হবে ৩০ টাকা করে ধরে হলেও ৬০ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। ঘূর্ণিঝড়ে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও দাতব্য চিকিৎসালয় ভূমিসাৎ হয়েছে। এগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও মেরামতের জন্য এককালীন দান ৬১৯ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড হিসেবে কমপক্ষে ১৫ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করা দরকার। নানা দুর্বিপাকে উত্তরবঙ্গের ছাত্র সমাজ খুবই অসুবিধায় পড়েছে। স্কুল-কলেজের বেতন পরিশোধের সামার্থ্য তাদের নেই। এদের সাহায্য দেওয়া জন্য কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকার মত প্রয়োজন।

 এসব মিলিয়ে বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মোট সাড়ে ১৩ কোটি টাকারও অধিক প্রয়োজন। তন্মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছেন। কিঞ্চিদধিক সাড়ে ১১ কোটি টাকার এখনও বিশেষ প্রয়োজন। অবিলম্বে এ টাকা যদি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পাওয়া না যায়, তা হলে জনসাধারণের দুর্গতির সীমা থাকবে না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত জানুয়ারী মাস থেকে এ ক'মাসে পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাদের নিজ তহবিল থেকে বিভিন্নমুখী সাহায্য ব্যবস্থা বাবদ ৬০ লক্ষ টাকার মত ব্যয় করেছেন।

খাদ্য আমদানী-

 ১৯৫৬-৫৭ ও ১৯৫৭-৫৮ সালে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানীর মোট ব্যয়ের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকার বহন করে এসেছেন, কিন্তু বর্তমানে তাঁরা এ ধরনের আর কোন সাহায্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত করায় প্রদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। আলোচ্য দু'বছরে এ বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার যথাক্রমে ২ কোটি ২৯ লক্ষ ও ৯ কোটি ৪১ টাকা মঞ্জুর করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের এ সাহায্য সত্ত্বেও প্রাদেশিক সরকারকে ১৯৫৬৫৭ সলে ১ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা এবং ১৯৫৭-৫৮ সালে ২ কোটি ২ লক্ষ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ধান-চাল সংগ্রহের ব্যাপারেও কতিপয় অনাবশ্যক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবাসায়গণ লারকান, দাদু, জ্যাকোবাদ ও শুককুরের স্থানীয় মোকামে মাল ডেলিভারী দিয়েই খালাস পাচ্ছে। সেখান থেকে সেই মাল আবার স্বতন্ত্র ব্যবস্থাধীনে করাচীতে চালান দিতে হচ্ছে।

 এভাবে একই মাল দুবার উঠানো-নামানো প্রয়োজন হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারকে এজন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগই রাখতে হচ্ছে। এর জন্য আনুষঙ্গিক যে ব্যয় হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তা গিয়ে প্রাদেশিক সরকারেরই উপর চাপছে। সাবেক সিন্ধু সরকারের আমলে এবং যখন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করতেন তখন ঐসব এলাকায় ধান-চাল সরাসরি করাচী বন্দরেই ডেলিভারী দেয়া হতো এবং সেখানে জাহাজে বোঝাই করা হতো। সে সময় মণপ্রতি আট আনার বেশী অতিরিক্ত ব্যয় পড়ত না। কিন্তু বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আমাদের কাছ থেকে এ বাবদ মণপ্রতি ১ টাকা আদায় করছেন। এর ফলে, পশ্চিম পাকিস্তানী চাল কিনতে গিয়ে আমাদের বর্মার চাল অপেক্ষা মণপ্রতি ৩ টাকা বেশী দাম দিতে হচ্ছে। মণপ্রতি এই ১ টাকা বাড়তি খরচ আদায় করে প্রকৃত ১ প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের গরীব ক্রেতাদের স্বার্থের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকেই প্রকারান্তরে সাহায্য করা হচ্ছে।

ত্রুটিপূর্ণ নীতি-

 কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসৃত এই ত্রুটিপূর্ণ সংগ্রহ নীতির দরুন তাদের অনাবশ্যক কতকগুলো খরচের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। আর সেই অস্বাভাবিক রকমের বাড়তি খরচের চাপ গিয়ে পড়ছে পূর্ব পাকিস্তানেরই দরিদ্র ক্রেতাদের উপর। এর আগে সিন্ধু সরকারের সংগৃহীত চালের স্টক পূর্ব পাকিস্তানকে যে চাল সরবরাহ করা হত। তার বাবদ তাঁরা টনপ্রতি মাত্র ১ টাকা ২ আনা হবে তদারকী ফিস আদায় করতেন। এতে করে মণপ্রতি বাড়তি খরচ পড়তো তিন পয়সাও কম।

 এদিকে, আমদানীকৃত ও সংগৃহীত চালের আনুষঙ্গিক খরচসহ মণপ্রতি গড়ে মূল্য দাঁড়ায় ২৩ টাকা ১৫ আনা ৭ পাই। বিক্রয় করা হয় মণপ্রতি ২১ টাকা ৫ আনা মূল্য। ফলে, মণপ্রতি সরকারের লোকসান হয় ২ টাকা ১০ আনা ৭ পাই। এই হিসেবে বার্ষিক অনুমান ১,০৮,৮৮,৮০৯ মণ চাল ক্রয়-বিক্রয় বাবদ সরকারকে মোট লোকসান দিতে হয় ২,৮৯,৮০,৩২৪ টাকা।

সমাধানের উপায়-

 যে ব্যাপক ও মারাত্মক রকমের দুরবস্থা প্রদেশবাসীকে গ্রাস করেছে তাতে করে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত চালের বিক্রয় মূল্য কোন ক্রমেই বৃদ্ধি করা সম্ভব না হওয়ায় এবং জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যেসব প্রস্তাব করা যেতে পারে সেগুলি হচ্ছেঃ

(১) প্রদেশের জন্য চাল সংগ্রহ বাবদ যে মোট ব্যয় হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে তদ্দরুন ২ কোটি টাকার মত সাহায্য করতে হবে। অবশ্য, লোকসানের পরিমাণ যদি প্রকৃতপক্ষে কম হয় তবে এই সাহায্যের পরিমাণ কিছুটা কমও করা যেতে পারে। অথবা, বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৫৭-৫৮ সালের ন্যায় যে কোন স্থানে সংগৃহীত হোক না কেন সে চাল চট্টগ্রামে মণপ্রতি ১৮ টাকা দরে ডেলিভারী দিতে হবে।

(২) পশ্চিম পাকিস্তান সরকার চালের উপর যে বাড়তি খরচ আদায় করেন, হয় তা প্রত্যাহার করতে হবে নতুবা সাবেক সিন্ধু সরকারের মত এই খরচ মণপ্রতি ৮ আনা ধার্য করতে হবে।

(৩) কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসৃত ত্রুটিপূর্ণ সংগ্রহনীতির দরুন যে আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রাদেশিক সরকারকে বহন করতে হয়, কেন্দ্রীয় সরকারকে তা প্রত্যাহার করতে হবে। অতীতে তদারকী ফিস হিসেবে টনপ্রতি ১ টাকা ২ আনা হারে যে খরচ আদায় হতো, বড়জোর কেন্দ্রীয় সরকার সেই হারেই আদায় করতে পারেন।

অসত্য প্রচারণা-

 এবার আমি পূর্ব পাকিস্তানের মহামারীজনিত পরিস্থিতি উপর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। পূর্ব পাকিস্তানের বসন্ত ও কলেরার প্রাদুর্ভাব বরাবরই ঘটে আসছে। ১৯৫১-৫২ সালে এই রোগে মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশী। কিন্তু এ বছর পূর্ব পাকিস্তানে মহামারী এমন ভয়াবহরূপ পরিগ্রহ করে যে, প্রাদেশিক সরকার সম্ভাব্য সকল চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও বহু লোকের মৃত্যু ঘটে। গত বছরের শেষ দিকে বসন্ত দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাদেশিক সরকার উপদ্রুত এলাকার স্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মচারীদের সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়াও সবরকমের প্রতিষেধক ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এই রোগ মহামারী আকারে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার জাতীয় জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে তার মোকাবেলা করতে সর্ব-প্রযত্নে প্রয়াস পান। এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমন্ত্রণ জানান হয়। সরকারী কর্মচারী ও রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক, স্বাস্থ্য ও মেডিকেল প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রাদেশিক মহামারী প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে যে, মহামারী পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক মূলধন হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে জনাব ইউসুফ আলি চৌধুরী যে দলে আছেন, সেই দলসহ কতিপয় রাজনৈতিক দল এই কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে থাকেন। এখন দেখছি জনাব চৌধুরী এই পরিস্থিতির পুরা সুযোগই গ্রহণ করছেন। পূর্ব পাকিস্তানে মহামারীতে এক লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি যে হিসাব দিয়েছেন তা কেবল অতিরঞ্জিতই নয় আজগুবিও বটে। সরকারী সংখ্যাতত্ত্বের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করেও একথা সরাসরি বলা যায় যে, সংখ্যাতত্ত্ব সংগ্রহের মত কোন ব্যবস্থাই জনাব ইউসুফ আলি চৌধুরীর হাতে নেই। অবশ্য কল্পনার বশবর্তী হয়ে ইচ্ছামত তিনি যে কোন সংখ্যাই উল্লেখ করতে পারেন। গত দশ বছরে প্রদেশে বসন্ত ও কলেরায় কত লোকের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব প্রাদেশিক সরকারের কাছে আছে এবং অতীতের যে ব্যবস্থাধীনে এই সংখ্যাতত্ত্ব সংগ্রহ করা হতো, আজও তাই চালু আছে। মজার বিষয় এই যে, কিছুদিন আগে জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী ও অপর দুজন কেএসপি নেতা প্রাদেশিক মহামারী নিয়ন্ত্রণ কমিটির কয়েকজন সদস্যের সামনে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে টিকা বীজ চান। আলাপ-আলোচনার পর আমি তাঁকে জানাই যে কমিটির কাছ থেকে কিছু টিকাবীজ আদায় করে বিক্ষিপ্তভাবে জনকয়েক স্বেচ্ছাসেবক কোথাও পাঠান আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। পাল্টা প্রস্তাব হিসেবে আমি তাঁর দলের কতিপয় সদস্যকে মহামারী নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে পাঠাতে বলি। কেননা, এই কমিটির অভিযান পরিচালনা বোর্ডটি প্রত্যেক দিনই বৈঠকে মিলিত হয়ে প্রদেশের মহামারীজনিত সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করায় তাঁর দলের সদস্যগণও দৈনন্দিন অবস্থা সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। আমি তাঁকে তাঁর দলের স্বেচ্ছাসেবকদের একটা তালিকা পাঠানের জন্যও অনুরোধ করি এবং বলি যে, এসব স্বেচ্ছাসেবককে মহামারী নিয়ন্ত্রণ কমিটির পরিচালনাধীনে উপদ্রুত এলাকায় পাঠানো যাবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী মহামারী নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে তাঁর দলের কোন সদস্যের নাম তো দাখিল করেনইনি-এমনকি, স্বেচ্ছাসেবকদের কোন তালিকাও পাঠাননি। এতে করে আমি পরিস্কারভাবে বুঝতে পারি যে, প্রদেশের মহামারী পরিস্থিতিকে তিনি রাজনৈতিক মূলধনই করতে চেয়েছিলেন- সত্যিকার জনসেবার কোন উদ্দেশ্যই তাঁকে তখন প্রেরণা যোগায়নি। সমাজ সেবার ব্যাপারে তাঁর আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ করবার কিছু না থাকলেও আমার মতে, এ ধরনের কোন কাজে আত্মনিয়োগের মত কোন ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান তাঁর নেই।

 প্রদেশের সাম্প্রতিক মহামারীজনিত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে একটি রিপোর্ট পেশের জন্য আমি ইতিমধ্যেই একজন বিভাগীয় কমিশনারকে নিয়োগ করেছি। তাঁর কাছ থেকে এই রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা স্থির করব এ সম্পর্কে আরও ব্যাপকভাবে তদন্তের জন্য একটি পূর্ণ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়ত আছে কিনা। এ প্রসঙ্গে আমি বিগত কয়েক বছরের সংখ্যাতত্ত্ব পেশ করতে চাই। কলেরা ও বসন্তে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৩ সালে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৭,৯২০ ১৯৫৪ সালে ১০,৯১২, ১৯৫৫ সালে ১৫,০৭৫, ১৯৫৬ সালে ২০,৭৯৯, ১৯৫৭ সালে ১৬,২৫০ ও ১৯৫৮ সালে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ১৯,০০৬। বিভিন্ন সময়ে প্রদেশে কি পরিমাণ টিকা বীজ বিতরণ করা হয়েছে তারও একটি তুলনামুলক হিসাব দেয়া যেতে পারে। ১৯৫৪-৫৫ সালে যে টিকাবীজ সরবরাহ করা হয় তার পরিমাণ ছিল ১৪,১১৯,৩০০ মাত্র, ১৯৫৫-৫৬ সালে ১৫,৯৪৪,৪৩০ মাত্রা ১৯৫৬-৫৭ সালে ১৮,৪৮৯,৯১০ মাত্র, ১৯৫৭ সালে ২৭,৮১৯,৯৭০ ও এ বছর ২৪ মে পর্যন্ত ২৬,০৫৭,৬২০ মাত্র। এস হিসাব থেকে প্রদেশের মহামারী ব্যাপকতা ও তা নিরসনের জন্য অতীত ও বর্তমান সরকার কতদূর কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তার পরিচয় পাওয়া যাবে। টিকাবীজ বিতরণের সংখ্যাতত্ত্ব থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, মহামারী পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য বর্তমান সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা পূর্ববর্তী যে কোন সরকারের ব্যবস্থাকে ছাড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া বিদেশ থেকে প্রাপ্ত টিকাবীজ ও দেশের অভ্যন্তরে টিকাবীজ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে প্রদেশের অন্যূন ৪ কোটি লোকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। মহকুমা সদর দফতরগুলিতে টিকাবীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও আমরা করেছি। ঢাকা থেকে বিশেষ বাহকের মারফত এ সকল কেন্দ্রে টিকাবীজ পৌঁছে দেয়া হবে।

 ভবিষ্যতে মহামারীর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সরকার নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করেছেনঃ সরকার জেলা বোর্ডের পরিচালনায় প্রতি দুইটি ইউনিয়নের জন্য একজন করে হেলথ এ্যাসিষ্ট্যাণ্ট, প্রতি থানার জন্য একজন স্যানিটারী ইনসপেক্টর ও ৩ জন হেলথ এ্যাসিষ্টেণ্ট নিয়োগ করেছেন। জেলা বোর্ডের কর্মচারী ও ভ্রাম্যমাণ ইউনিটগুলিকে সাহায্যের জন্য ৪৭৮ জন গভর্ণমেণ্ট হেলথ এ্যাসিষ্ট্যাণ্ট নিয়োগ করা হয়েছে। ১৯৫৭ সালের মে মাস থেকে অতিরিক্ত ২০০ হেলথ এ্যাসিষ্ট্যাণ্ড এবং ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে আরও ৩০০ হেলথ এ্যাসিষ্ট্যাণ্ট কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ৫০ জন সাব-ডিভিশনাল হেলফ অফিসার ও ১০টি ভ্রাম্যমাণ ইউনিটও নিয়োগ করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলা, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়নেও মহামারী প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের পরিচালনাধীন শত শত স্বেচ্ছাসেবক উপদ্রুত এলাকায় গিয়ে দুর্গত মানবতার সেবায় ঝাপিয়ে পড়েছেন।

 অতীব পরিতাপের বিষয়, জনস্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মচারীগণ যখন গ্রামে গ্রামে গিয়ে টিকাদান অভিযান পরিচালনা করেন তখন গ্রামবাসীদের অনেকেই টিকা নিতে অসম্মত হন। আমরা রিপোর্ট পেয়েছি যে যারাই টিকা নিয়েছেন, তাঁরা হয় এই রোগে আদৌ আক্রান্ত হয়নি, অথবা আক্রান্ত হলেও তাদের মৃত্যু ঘটেনি। কিন্তু যাঁরা টিকা নেননি তাঁদের প্রায়ই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ও শেষ পর্যন্ত অনেকে মারা গিয়াছেন। আগেই বলেছি, পূর্ববর্তী বছরগুলির তুলনায় গত ও বর্তমান বছরে অনেক বেশী পরিমাণ টিকাবীজ সরবরাহ করা হয়েছে। ১৯৫১ সালে, যখন বসন্ত ও কলেরা মহামারীতে মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশী (যথাক্রমে ৩৮,৮৭১, ও ১৭,৮১৭) তখন সংশ্লিষ্ট ৪ মাসে টিকা দেয়া হয় মাত্র ৭০ লক্ষ লোককে। অপরপক্ষে, ১৯৫৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে মোট ২ কোটি ৫১ লক্ষ মাত্রা টিকাবীজ সরবরাহ করা হয় ও টিকা দেয়া হয় মোট ১ কোটি ৭০ লক্ষ লোককে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মহামারী প্রতিরোধের জন্য প্রাদেশিক সরকার সকল প্রকার ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছেন।


[পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী জনাব আউর রহমান খান কর্তৃক করাচীতে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনের প্রদত্ত ভাষণঃ তারিখ ৪ঠা জুন, ১৯৫৮]