বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৯৬

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯৫৬ সালের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের উপর মওলানা ভাসানীর বক্তব্য দৈনিক সংবাদ ১৬ই জানুয়ারী, ১৯৫৬

খসড়া শাসনতন্ত্র পাকিস্তানের নির্যাতিত জনসাধারণকে শৃংখলিত করার এক মহাষড়যন্ত্রঃ পল্টনের সভায় মওলানা ভাসানীর ঘোষণা........
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

 “প্রস্তাবিত খসড়া শাসনতন্ত্র পাকিস্তানের সাত কোটি নির্যাতিত জনসাধারণকে চির-শৃঙ্খলাবদ্ধ করার এক মহাষড়যন্ত্র। কিন্তু সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জাগ্রত পূর্ব বাংলার জনসাধারণ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর এই হীন চক্রান্তকে বরদাশত করিবে না। আমরা জীবনের বিনিময়েও কায়েমী স্বার্থবাদীদের রচিত এই গণরিরোধী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রাচীর গড়িয়া তুলিতে বদ্ধপরিকর।” নির্যাতিত জননেতা মওলানা ভাসানী গতকল্য অপরাহ্নে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সভাপতির ভাষণে উপরোক্ত ঘোষণা করেন।

 মওলানা ভাসানী অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের প্রতিবাদে ১৬ই জানুয়ারী হইতে ২২শে জানুয়ারী পর্যন্ত সাতদিন প্রদেশের ছাত্র, যুবক, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সকল সম্প্রদায়ের জনসাধারণকে কালোব্যাজ ধারণ করিতে বলেন এবং আগমী ২৯শে জানুয়ারী প্রদেশব্যাপী ‘অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রতিরোধ দিবস' পালনের আহবান জানান।

 প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা আতাউর রহমান খান এই খসড়া শাসনতন্ত্রকে কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের মুখে রচিত পূর্ব বাংলায় মৃত্যুপরওয়ানা' বলিয়া অভিহিত করেন।

 সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে এরূপ দফর ভিত্তিতে জনগণের স্বার্থের অনুকূলে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র দাবী করা হইয়াছে-ইহাতে স্পষ্টতঃ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি দান, যুক্ত নির্বাচন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ব্যাপারে সামঞ্জস্য বিধান করিতে হইবে।

 সভায় আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রী দল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র লীগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদ ও যুবলীগ প্রভৃতি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ খসড়া শাসনতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করিয়া বক্তৃতা করেন। বক্তাগণ সকলেই প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনের কথা উল্লেখ করিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন। মওলানা ভাসানী কর্তৃক শাসকচক্রের বিরুদ্ধে জীবনমরণ সংগ্রামের আহবানে উপস্থিত জনসাধারণ সমস্বরে হাত তুলিয়া সম্মতি জ্ঞাপন করেন।

 মওলানা সাহেব তাঁর ভাষণে শাসকচক্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, গত আট বৎসরের কেন্দ্র পূর্ব বাংলাকে শোষণ করিয়া এবং ন্যায্য প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করিয়া অর্থনৈতিক দিক হইতে পঙ্গু করিয়া রাখিয়াছে। ইহার ফলে পূর্ব বাংলায় বেকারত্ব বাড়িয়াছে, শিক্ষিত যুবক রোজগার হইতে বঞ্চিত। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা লোপ পাইতে চলিয়াছে। কৃষক শ্রমিকের রোজগারের পথ রুদ্ধ হওয়ায় তাহারা বর্তমানে বাড়ীঘর বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে; এমনকি আজ তাহারা একসংগে দশ সের ধান ক্রয় করার ক্ষমতা রাখে না। সরকার একশ দফায় ওয়াদা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের চেষ্টা করেন নাই। যে ব্যবস্থা করা হইয়াছে তাহাতে সরকার গরীব জনসাধারণের নিকট হইতে ৬০ কোটি টাকা শোষণ করিয়া জমিদারদের খেসারত দিবেন, বর্তমানে এই প্রদেশে আশি লক্ষ ভূমিহীন কৃষক পরিবার রহিয়াছে।

 মওলানা সাহেব শাসনতন্ত্র সম্পর্কে অভিযোগ করেন যে, কেন্দ্রের হাতে সমস্ত অর্থকরী ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে। পূর্ব বাংলার সেলট্যাক্স, সুপারি, তামাক ও পাটের উপর ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স ও পার্চেজ ডিউটি ব্যবসায় বাণিজ্য সমস্তই কেন্দ্রের হাতে দিয়া পূর্ব বাংলা প্রদেশকে অর্থনৈতিক দিক হইতে আচল করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তিনি আরও বলেন, নৌ-সদর দফতরের ডেপুটি প্রধান সেনাপতির অফিস এই প্রদেশে স্থাপনের দাবী আমরা করিয়াছিলাম- আনসার বাহিনীকে নিয়মিত সৈন্য বাহিনীতে সংযুক্ত করা হয় নাই। সবদিক বিবেচনা করিয়া দেখা যাইবে পূর্ব বাংলাকে সর্বদিক দিয়া স্বায়ত্তশাসন হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে।

 মাওলানা সাহেব দাবী করেন যে, যতদিন পর্যন্ত পূর্ব বাংলার বঞ্চিত অর্থ দেওয়া না হইবে ততদিন পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্র হইতে কোন অর্থ মঞ্জুর করা চলিবে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গত আট বৎসরে কেন্দ্র হইতে ব্যয়ের একটি সমতাহীন তুলনা বর্ণনাকালে শ্রোতৃবর্গ শেম শেম ধ্বনি তুলিতে থাকেন। তিনি শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি না থাকায় সমালোচনা করিয়া বলেন যে, আমি ইউরোপেও বাংলা ভাষার মর্যাদা ও গৌরব দেখিয়াছি। পূর্ব বাংলার জনসাধারণ প্রাণের রক্ত দিয়া যে ভাষাকে ভালবাসিয়াছে, শ্রদ্ধা করিয়াছে তাহাকে কোনক্রমেই ত্যাগ করিতে পারে না।

 মওলানা সাহেব সর্বজনগ্রহণযোগ্য একুশ দফার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় একটি “সর্বদলীয় কনভেনশন’ আহবানের জন্য প্রস্তাব করেন।

 তিনি উদাত্ত কষ্ঠে আহবান জানাইয়া বলেন, আসুন আমরা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের জন্য একটি যুক্ত বৈঠকে বসি- যুক্তফ্রণ্ট, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ আপনারা আসুন একত্রে মিলিয় আমরা একটি মীমাংসামূলক শাসনতন্ত্র রচনা করি।

 তিনি নেতৃবর্গকে সতর্ক করিয়া বলেন যে, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আগুন লইয়া খেলা করিবেন না। জনমত আগ্রাহ্য করার ফলে ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের নেতাদের যাহা ভাগ্যে ঘটিয়াছে তাহা ইতিহাস- পাঠে প্রত্যক্ষ করা উচিত।

 আমি আশঙ্কা করিতেছি, পূর্ব বাংলার উপর যদি নির্যাতন ও শোষণ অব্যাহত থাকে তবে হয়ত দূর ভবিষ্যতে এই প্রদেশের জনসাধারণের ভবিষ্যৎ বংশধর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে চিন্তা করিবে।