বাংলাভাষা-পরিচয়/১৪

উইকিসংকলন থেকে

১৪

 বাংলা বিশেষ্যপদে বহুবচনের প্রভাব অল্পই। অধিকাংশ স্থলেই ‘সব’ ‘গুলি’ ‘সকল’ প্রভৃতি শব্দ জোড়া দিয়ে কাজ চালানো হয়। এ ভাষায় সর্বনাম শব্দে বহুবচনের বিভক্তি যতটা চলে অন্যত্র ততটা নয়। বহুবচনে ‘মানুষেরা’ ব’লে থাকি অথচ 'ঘোড়ারা’ বলতে কানে ঠেকে অথচ 'ঘোড়াদের’ বলা চলে। মোটের উপর এ কথা খাটে যে সচেতন জীবদের নিয়ে বহুবচনে রা এবং সম্বন্ধে ও কর্মকারকে দের চিহ্ন ব্যবহার হয়ে থাকে। ‘মোষেরা খুব বলবান জীব’ বা 'ময়ূরদের পুচ্ছ লম্বা’ এটা নিয়মবিরুদ্ধ নয়। এই রা চিহ্ন সাধারণ বিশেষ্যে লাগে। বিশেষ বিশেষ্যে ওর প্রয়োগ কানে বাধে। বলতে পারি ‘ঐ মোষরা পাঁকে ডুবে আছে’, কিন্তু ‘ঐ মোষগুলো পাঁকে ডুবে আছে’ বললেই মানানসই হয়। ‘মোষরা’ বললে মোষজাতিকে মনে আসে, মোষগুলো বললে মনে আসে বিশেষ মোষের দল।

 মানুষরা নিষ্ঠুরতায় পশুকে হার মানালো’ ঠিক শোনায়, এও ঠিক শোনায়: কুলিগুলো নির্দয়ভাবে গাড়িতে বোঝা চাপিয়েছে। কিন্তু ‘মানুষগুলো পশুকে হার মানায়’ অশুদ্ধ। সাধারণ বিশেষ্যে রা চলে কিন্তু বিশেষ বিশেষ্যে গুলো। ‘মানুষরা ওখানে জটলা করছে’ বললে মনে হয় যেন জানানো হচ্ছে অন্য কোনো জীব করে নি। এখানে ‘মানুষগুলো’ বললেই সংশয় থাকে না।

  ‘টেবিলরা' ‘চৌকিরা’ নিষিদ্ধ। জড়পদার্থের ‘গুলো’ ছাড়া গতি নেই। আর-একটা শব্দ আছে, কথার পূর্বে বসে সমষ্টি বোঝায়, যেমন ‘সব’: সব চৌকি, সব জন্তু, সব মানুষ। কিন্তু এখানে এই শব্দ কেবলমাত্র বহুবচন বোঝায় না, সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝোঁক দেয়। সব চৌকি সরিয়ে দাও, অর্থাৎ একটাও বাকি রেখো না। সব ভিখিরিই বাঙালি, অথাৎ নির্বিশেষে বাঙালি। ‘সব’ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ‘গুলো’ প্রয়োগটাও যোগ দিতে চায়, যেমন: সব চৌকিগুলোই ভাঙা, সব ভিখিরিগুলোই চেঁচাচ্ছে। এখানে ‘সব’ বোঝাচ্ছে একান্ততা, আর ‘গুলো’ বোঝাচ্ছে বহুবচন। বহুবচনে এক সময়ে ‘সব’ ব্যবহৃত হত। কবিতায় এখনো দেখা যায়, যেমন: পাখিসব তোমাসব ইত্যাদি। আমরা বলি: কাফ্রিরা সব কালো। বহুবচনের রা বিভক্তির সঙ্গে জোড়া লাগে ‘সব’ শব্দ: এরা সব গেল কোথায়। শুধু ‘এরা গেল কোথায়’ বললেই চলে, কিন্তু সব’ শব্দের দ্বারা সমটির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই ‘সব’ শব্দ একবচনকে বহুবচন করে না, বহুবচনকে সুনির্দিষ্ট করে। ‘সবাই’ শব্দে আরও বেশি জোর লাগে: এরা যে সবাই চলে গেছে, কিংবা চৌধুরীদের সবাইকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। ‘সব’ শব্দের সমাথক হচ্ছে ‘সকল’: এরা সকলেই চ’লে গেছে, কিংবা, চৌধুরীদের সকলকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু ‘সকল’ শব্দের প্রয়োগ ‘সব’ শব্দের চেয়ে সংকীর্ণ।

 এই প্রসঙ্গে আমাদের ভাষার একটা বিশেষ ভঙ্গীর কথা বলি। ‘সব’ শব্দের অথে কোনো দুষণীয়তা নেই, ‘যত’ সর্বনাম শব্দটাও নিরীহ। কিন্তু দুটোকে এক করলে সেই জুড়িশব্দটা হয়ে ওঠে নিন্দার বাহন। ‘মূর্খ’ ‘কু’ড়ে’ কিংবা 'লক্ষ্মীছাড়া’ প্রভৃতি কটুস্বাদ বিশেষণ ঐ “যত সব’ শব্দটাকে বাহন ক’রে ভাষায় যেন মখে সিটকোতে আসে, যথা: যত সব বাঁদর, কিংবা কুড়ে, কিংবা লক্ষ্মীছাড়া। এখানে বলা উচিত ঐ ‘যত’ শব্দটার মধ্যেই আছে বিষ। “যত বাঁদর এক জায়গায় জুটেছে’ বললেই যথেষ্ট অকথ্য বলা হয়। লক্ষ্য করবার বিষয়টা এই যে, ‘যত’ শব্দটা একটা অসম্পূর্ণ সর্বনাম, ‘তত’ দিয়ে তবে এর সম্পণূর্তা। ‘তত’ বাদ দিলে ‘যত’ হয়ে পড়ে বেকার, লেগে যায় অনর্থক গালমন্দর কাজে।

 বাংলা ভাষায় সর্বনামের খুব ঘটা। নানা শ্রেণীর সবনাম, যথা ব্যক্তিবাচক, স্থানবাচক, কালবাচক, পরিমাণবাচক, তুলনাবাচক, প্রশ্নবাচক।

 ‘মুই’ এক কালে উত্তমপুরুষ সর্বনামের সাধারণ ব্যবহারে প্রচলিত ছিল, প্রাচীন কাব্যগ্রন্থে তা দেখতে পাই। ‘আমহি’ ক্রমশ ‘আমি’ রূপ ধরে ওকে করলে কোণঠেসা, ও রইল গ্রাম্য ভাষার আড়ালে। সেকালের সাহিত্যে ওকে দেখা গেছে দীনতাপ্রকাশের কাজে, যেমন: মুঞি অতি অভাগিনী।

 নিজের প্রতি অবজ্ঞা স্বাভাবিক নয় তাই ওকে সংকোচে সরে দাঁড়াতে হল। কিন্তু মধ্যমপুরুষের বেলায় যথাস্থানে কুণ্ঠার কোনো কারণ নেই, তাই ‘তুই’ শব্দে বাধা ঘটে নি, নীচের বেঞ্চিতে ও রয়ে গেল। ‘তুহি’ ‘তুমি’-রূপে ভর্তি হয়েছে উপরের কোঠায়। এরও গৌরবার্থ অনেকখানি ক্ষয়ে গেল, বোধকরি নির্বিচার সৌজন্যের আতিশয্যে। তাই উপরওয়ালাদের জন্যে আরও একটা শব্দের আমদানি করতে হয়েছে, ‘আপহি’ থেকে ‘আপনি’। আইনমতে মধ্যমপুরুষের আসন ওর নয়, ওর অনুবর্তী ক্রিয়াপদের রূপ দেখলেই তার প্রমাণ হয়। ‘তুমি’র বেলায় ‘আছ’; ‘আপনি’র বেলায় ‘আছেন’, এই শব্দটি যদি খাঁটি মধ্যমপুরুষ-জাতীয় হত তা হলে ওর অনুচর ক্রিয়াপদ হতে পারত ‘আপনি আছ’ কিংবা ‘আছ’।

 ‘আপনি’ শব্দের মলে হচ্ছে সংস্কৃত ‘আত্মন্‌’। বাংলায় প্রথমপুরুষেও ‘স্বয়ং’ অর্থে এর ব্যবহার আছে, যেমন: সে আপনিই আপনার প্রভু। আত্মীয়কে বলা হয় ‘আপন লোক’। হিন্দিতে সম্মানসূচক অর্থে প্রথমপুরুষ মধ্যমপুরুষ উভয়তই ‘আপ’ ব্যবহৃত হয়।

 বাংলা ভাষায় উত্তমপুরুষে ‘আম’-প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াপদের ব্যবহার চলে, সে সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য আছে। তার তিনরকম রূপ প্রচলিত: করলাম, করলুম, করলেম। ‘করলাম’ নদিয়া হতে শুরু করে বাংলার পূর্বে ও উত্তরে চলে থাকে। এর প্রাচীন রূপ দেখেছি: আইলাঙ কইলাঙ। আমরা দক্ষিণী বাঙালি, আমাদের অভ্যস্ত ‘করলুম’ ও ‘করলেম’। উত্তমপুরুষের ক্রিয়াপদে সানুনাসিক উকার পদ্যে এখনো চলে, যেমন: হেরিনু করিনু। কলকাতার অপভাষায় ‘করনু’‘খেনু’ ব্যবহার শোনা যায়। ক্রিয়াপদে এই সানুনাসিক উ প্রাচীন সাহিত্যে যথেষ্ট পাই: কেন গেলু কালিন্দীর কূলে, দুকুলে দিলুঁ দুখ, মলুঁ মলুঁ সই। ‘করলেম’ শব্দের আলোচনা পরে করা যাবে। কৃত্তিবাসের পুরাতন রামায়ণে দেখেছি ‘রাখিলোম প্রাণ’। তেমনি পাওয়া যায় ‘তুমি’র জায়গায় ‘তোমি’। বাংলা ভাষায় উকারে ওকারে দেনাপাওনা চলে এ তার প্রমাণ।

 প্রথমপুরুষের মহলে আছে ‘সে’ আর ‘তিনি’। রামমোহন রায়ের সময়ে দেখা যায় ‘তিনি’ শব্দের সাধুভাষার প্রয়োগ ‘তেঁহ’। মেয়েদের মুখে ‘তেনার’ ‘তেনরা’ আজও শোনা যায়, ওটা ‘তেঁহ’ শব্দের কাছাকাছি। প্রাচীন রামায়ণে ‘তাঁর’। ‘তাঁহার’ শব্দ নেই বললেই হয়, তার বদলে আছে ‘তান’ ‘তাহান’। ন’কারের অনুনাসিকটা বহুবচনের রূপ। তাই সম্মানের চন্দ্রবিন্দুতিলকধারী বহুবচনরূপী ‘তেঁহ’ ও ‘তিঁহো’ (পুরাতন সাহিত্যে) হয়েছে ‘তিনি’। গৌরবে তার রূপ বহুবচনের বটে, কিন্তু ব্যবহার একবচনের। তাই পুনর্বার বহুবচনের আবশ্যকে রা বিভক্তি জড়ে ‘তাঁহা’ শব্দের রাস্তা দিয়ে ‘তাঁহারা’ শব্দ সাজানো হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে যে ক্রিয়াপদটি তার দখলে তাতে আছে প্রাচীন ন’কারান্ত বহুবচনরূপ, যেমন ‘আছেন’। আমাদের সৌভাগ্যক্রমে পরবতী বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদে বহুবচনের চিহ্ন থাকলেও তার অর্থ হয়েছে লোপ। সংস্কৃতে বহুবচনে ‘পতন্তি’ শব্দ আছে প্রথমপুরুষের পতন বোঝাতে। বাংলায় সেই অন্তি’র ন রয়েছে ‘পড়েন’ শব্দে, কিন্তু এ ভাষায় ‘তিনি‘ও পড়েন ‘তাঁরা’ও, পড়েন। এই ন’কারধারী ক্রিয়াপদ কেবল ‘আপনি’ আর ‘আপনারা’, ‘তিনি’ ও ‘তাঁরা’, এঁদের সম্মান রক্ষার কাজেই নিযুক্ত। প্রাচীন রামায়ণে এইরূপ স্থানে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় ‘পড়েন্ত’ ‘দেখিলেন্ত’ প্রভৃতি ন্ত-বিশিষ্ট ক্রিয়াপদ একবচনে এবং বহুবচনে, প্রথমপুরুষে।

 সদ্যঅতীত কালের প্রথমপুরুষ ক্রিয়াপদে বিকল্পে ইল এবং ইলে প্রয়োগ হয়, যেমন: সে ফল পাড়ল, সে ফল পাড়লে। এই একার প্রয়োগ প্রাচীন পদাবলীতে দৈবাৎ দেখেছি, যথা: বিঁধিলে বাণ। কিন্তু অনেক দেখা গেছে ময়নামতীর গানে, যেমন: বিকল দেখি হাড়িপা রহিলে। এ সম্বন্ধে একটা সাধারণ নিয়ম এই যে, অচেতনবাচক শব্দের ক্রিয়াপদে ‘এ’ লাগে না। অসমাপিকাতে লাগে, যেমন: পা ফুললে ডাক্তার ডেকো। ‘তার পা ফুলল’ হয়, ‘পা ফুললে’ হয় না। নির্বস্তুক শব্দ সম্বন্ধেও সেই কথা: তাঁর কলকাতায় যাওয়া ঘটল না। ‘ঘটলে না’ হতে পারে না। এ ছাড়া নিম্নলিখিত কয়েকটি ক্রিয়াপদে ‘এ’ খাটে না: এল গেল হল, প’ল (পড়ল), ম’ল (মরল)। দুই অক্ষরের ক্রিয়াপদমাত্রে এই ব্যতিক্রম হয় এমন যেন মনে করা না হয়। তার প্রমাণ: খেল নিল দিল শুল ধুল। ইতে-প্রত্যয়যুক্ত জোড়া ক্রিয়াপদে ‘এ’ লাগে না, যেমন: করতে থাকল, হাসতে লাগল। কিন্তু ইয়া-প্রত্যয়যুক্ত জোড়া ক্রিয়াপদে লাগে, যেমন: সে হেসে ফেললে। এ ছাড়া আরও দুই-এক জায়গায় কানে সন্দেহ ঠেকে, যেমন ‘ভোর বেলায় সে মরলে’ বলি নে, ‘মরল’ ই ঠিক শোনায়। কিন্তু ‘তিনি মরলেন’ নিত্যব্যবহৃত। ‘কলকাতায় সে চললে’ বলি নে, কিন্তু ‘তিনি চললেন’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

 প্রাচীন রামায়ণে দেখা গেছে প্রথমপুরুষের সদ্যঅতীত ক্রিয়াপদে প্রায় সর্বত্রই ক-প্রত্যয়-সমেত একার, যেমন: দিলেক লইলেক। আবার একারের সম্পর্ক নেই এমন দৃষ্টান্তও অনেক আছে, যেমন: চলিল সত্বর, পাঠাইল ত্বরিত। আধুনিক বাংলায় এইরূপ ক্রিয়াপদে কোথাও ‘এ’ লাগে কোথাও লাগে না, কিন্তু অন্তস্থিত ক-প্রত্যয়টা খসে গেছে।

 প্রথমপুরুষ ইল-প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াপদে এই-যে একার প্রয়োগ, এরই সঙ্গে সম্ভবত ‘করলেম’ ‘চললেম’ শব্দের একার-উচ্চারণের যোগ আছে। করলেন (করিল তিনি), আর, করলেম (করিল আমি): এক নিয়মে পাশাপাশি বসতে পারে। আরও একটা কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে, সে হচ্ছে স্বরবিকারের নিয়ম। ই’র পর আ থাকলে দুইয়ে মিলে ‘এ’ হয় তার অনেক দৃষ্টান্ত মেলে। যেমন ‘ঈশান’ থেকে ‘ঈশেন’, ‘বিলাত’ থেকে ‘বিলেত’, ‘নিশান’ থেকে ‘নিশেন’।

 এক কালে ‘মুই’ ভদ্র সমাজে ত্যাজ্য ছিল না। প্রাচীন রামায়ণে পাওয়া যায় ‘মুঞি নরপতি’। কর্মকারকে ‘মোকে’, কোথাও বা ‘মোখে’। বহুবচনে ‘মোরা’। আজ ‘মোরা’ রয়ে গেছে কাব্যলোকে। কবির কলমে ‘আমরা’ শব্দের চেয়ে ‘মোরা’ শব্দের চলন বেশি প্রাচীন বাংলায় ‘আমরা তোমরা’র পরিবতে ‘আমিসব’ ‘তুমিসব’ শব্দের ব্যবহার প্রায়ই দেখা গেছে।

 আমি তুমি আপনি তিনি: ব্যক্তিবাচক সর্বনাম, মানুষ সম্বন্ধেই খাটে। ‘সে’ কেবলমাত্র মানুষ নয় জন্তু সম্বন্ধেও খাটে, যেমন: কুকুরটাকে মারতেই সে চেঁচিয়ে উঠল। ‘সে’ থেকে বিশেষণ শব্দ হয়েছে ‘সেই’। এর প্রয়োগ সর্বত্রই: সেই মানুষ, সেই গাছ, সেই গোরু। ‘এ’ থেকে হয়েছে ‘এই’। ‘এ’ বোঝায় কাছের বর্তমান পদার্থকে,‘সে’ বোঝায় অবর্তমানকে। সম্মানার্থে ‘এ’ থেকে হয়েছে ‘ইনি’।

 বাংলা ভাষার একটা বিশেষত্ব এই যে, সর্বনামে লিঙ্গভেদ নেই। ইংরেজিতে প্রথম পুরুষে he পুংলিঙ্গ, she স্ত্রীলিঙ্গ, it ক্লীবলিঙ্গ। ইংরেজিতে যদি বলতে হয়, সে পড়ে গেছে, তবে সেই প্রসঙ্গে he, she বা it বলাই চাই। বাংলায় ক্লীবলিঙ্গের নির্দেশ আছে, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গের নেই। সে এ ও তিনি ইনি উনি: স্ত্রীও হয়, পুরুষও হয়। ক্লীবলিঙ্গে ‘সে’ ‘এ’ ‘ও’ শব্দে নির্দেশক চিহ্ন যোগ করা চাই, যেমন: সেটা ওটা সেখানা ওখানা। বাংলা কাব্যে এই প্রথমপুরুষ সর্বনামে যখন ইচ্ছাপূর্বক লিঙ্গ নির্দেশ করা হয় না তখন তার ইংরেজি তর্জমা অসম্ভব হয়। ‘যে’ সর্বনাম পদের সঙ্গে কোনো না কোনো বিশেষ্য ঊহ্য বা ব্যক্ত রূপে থাকেই। ‘যে গান গাচ্ছে’ বলতে বোঝায়, যে মানুষ। অন্যত্র: যে ঘড়ি চলছে না, যে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

 ‘যেই' শব্দের একটি প্রয়োগ আছে, তাতে ‘মুহূর্তে’ বা ‘ক্ষণে’ উহ্য থাকে, যথা: যেই এল অমনি চলে গেল, যেই দেখা সেই আর মুখে কথা নেই। এখানে ‘যেই আর সেই’ শব্দের পিছনে ঊহ্য আছে ‘ক্ষণে’। অন্যত্র ‘যেই’ বা ‘সেই’ শব্দের প্রয়োগে ঊহ্য থাকে ‘মানুষ’, যেমন: যেই আসকে সেই মার খাবে। ‘যাই’ শব্দের সঙ্গে ঊহ্য থাকে দুটি বিশেষণের দ্বন্দ্ব, যেমন: সে যাই বলুক। অর্থাৎ, এটাই বলুক বা ওটাই বলুক, ভালোই বলুক বা মন্দই বলুক। আর-এক প্রকার প্রয়োগ আছে ‘যেই কথা সেই কাজ', অথাৎ কাজে কথায় প্রভেদ নেই— এখানে ই প্রত্যয় নিশ্চয়ষতা অথে ঝোঁক দেবার জন্যে।

 ‘যে’ অসম্পূর্ণার্থক সর্বনাম বিশেষণ, মানবার্থে তার পূরণ হয় ‘ও’ এবং ‘সে’ দিয়ে। অন্য জীব বা বস্তুর সম্বন্ধে যখন তার প্রয়োগ হয় তখন সেই বস্তু বা জীবের নাম তার সঙ্গে জুড়তে হয়, যেমন: যে পুকুর, যে ঘটি, যে বেড়াল। নির্বস্তুক শব্দেও সেই নিয়ম, যেমন: যে স্নেহ শিশুর অনিষ্ট করে সে স্নেহ নিষ্ঠুরতা।

 কখনো কখনো বাক্যকে অসম্পূর্ণ রেখে ‘যে’ শব্দের ব্যবহার হয়, যেমন: যে তোমার বৃদ্ধি। বাকিটুকু ঊহ্য আছে বলেই এর দংশনের জোর বেশি। বাংলা ভাষায় এইরকম খোঁচা-দেওয়া বাঁকা ভঙ্গীর আরও অনেক দৃষ্টান্ত পরে পাওয়া যাবে।

 মানুষ ছাড়া আর কিছুকে কিংবা সমুহকে বোঝাতে গেলে ‘যে’ ছেড়ে ‘যা’ ধরতে হবে, যেমন: যা নেই ভারতে (মহাভারতে) তা নেই ভারতে। কিন্তু ‘যারা’ শব্দ ‘যা’ শব্দের বহুবচন নয়, ‘যে’ শব্দেরই বহুবচন, তাই ওর প্রয়োগ মানবার্থে। ‘তা’ বোঝায় অচেতনকে, কিন্তু ‘তারা’ বোঝায় মানুষকে। ‘সে’ শব্দের বহুবচন ‘তারা’।

 শব্দকে দুনো করে দেবার যে ব্যবহার বাংলায় আছে, ‘কে’ এবং ‘যে’ সর্বনাম শব্দে তার দৃষ্টান্ত দেখানো যাক: কে কে এল, যে যে এসেছে। এর পূরণার্থে ‘সে সে লোক’ না বলে বলা হয় ‘তারা’ কিংবা ‘সেই সেই লোক’। ‘যেই যেই লোক’ এর ব্যবহার নেই। সম্বন্ধপদে ‘যার যার’ ‘তার তার’ মানবার্থে চলে। এইরকম দ্বৈতে বহুকে এক এক ক’রে দেখবার ভাব আছে। ভিন্ন ভিন্ন তুমি’কে নির্দেশ, ক’রে ‘তুমি তুমি’ ‘তোমার তোমার’ বললে দোষ ছিল না, কিন্তু বলা হয় না।

 ষে বাক্যের প্রথম অংশে দ্বৈতে আছে যে তার পূরণার্থক শেষ অংশে সমগ্রবাচক বহুবচন ব্যবহারটাই নিয়ম, যেমন: যে যে লোক, বা যাঁরা যাঁরা এসেছেন তাঁদের পান দিয়ো।

 যত এত তত অত কত শব্দ পরিমাণবাচক। এদের মধ্যে ‘তত’ শব্দ ছাড়া আর সবগুলিতে দ্বিত্ব চলে।

 এখন তখন যখন কখন কালবাচক। ‘কখন’ শব্দ প্রায়ই প্রশ্নসূচক, সাধারণভাবে ‘কখন’ বলতে অনিশ্চিত বা দূরবতী সময় বোঝায়: কখন যে গেছে। কিন্তু ‘কখনো’ প্রশ্নার্থক হয় না। প্রশ্নের ভাবে যখন বলি ‘সে কখনো এ কাজ করে’ তখন ‘কি’ অব্যয় শব্দ ঊহ্য থাকে। দ্বিত্বে ‘কখনো’ শব্দের অর্থ ‘মাঝে মাঝে’। ‘কখনোই’ একটা ‘না’ চায়: কখনোই হবে না।

 ‘কখন’ শব্দের ‘কী খেনে’-ভঙ্গীওয়ালা রূপ কাব্যসাহিত্যে পাওয়া যায়।

 ‘কভু’ শব্দের অথও ‘কখনো’। এখন দৈবাৎ পদ্যে ছাড়া আর কোথাও কাজে লাগে না। ওর জুড়ি ছিল ‘তবু’ শব্দটা, কিন্তু ওর সময়বাচক অর্থটা নেই। ‘তবু’ শব্দের দ্বারা এমন কোনো সম্ভাবনা বোঝায় যেটা ঠিক উপযুক্ত বা আকাঙ্ক্ষিত নয়: যদিও রৌদ্র প্রখর তবু সে ছাতা মাথায় দেয় না, আমি তো বারণ করেছি তবু যদি যায় দুঃখ পাবে। কালবাচক ক্রিয়াবিশেষণে বহুবচন বা কর্মকারক নেই। সম্বন্ধপদে: এখনকার তখনকার কখনকার, কোন্‌ সময়কার, কোন্‌ সময়টার। অধিকরণে: কোন্‌ সময়ে, যে সময়ে। পদ্যে ‘কোন্‌ খনে’, গ্রাম্য ভাষায় ‘কী খেনে’ এবং অধিকাংশ স্থলেই শুভ অশুভ লক্ষণসূচনায় এর প্রয়োগ হয়। অপাদান: যখন থেকে, কোন্‌ সময় থেকে।

 কালবাচক ক্রিয়াবিশেষণ আরও একটা বাকি আছে ‘কবে’। ওর দুটি জুড়ি ছিল: এবে যবে। তারা পদ্যে আশ্রয় নিয়েছে। ‘তবে’ একদা ওদেরই দলে ছিল, কিন্তু এখন ‘তবু’ শব্দের মতো সেও অর্থ বদলিয়েছে। একটা সন্তাবনার সঙ্গে আর-একটা সম্ভাবনাকে সে জোড়ে, যেমন: যদি যাও তবে বিপদে পড়বে। তবে এক কাজ করো: ‘তবে’ শব্দের পূর্ববর্তী ঊহ্য ব্যাপারের প্রসঙ্গে কোনো কাজ করার পরামর্শ।

 এই প্রসঙ্গে ‘সবে’ শব্দটার উল্লেখ করা যেতে পারে। বলে থাকি: সবে এইমাত্র চলে গেছে, সবে পাঁচটা বেজেছে। এখানে ‘সবে’ অব্যয়, ওতে মাত্রা বোঝায়, সকল ক্ষেত্রেই পরিমাণের সীমা বোঝাতে তার প্রয়োগ: সবে পাঁচজন। সবে ভোর হয়েছে: অর্থাৎ সময়ের মাত্রা ভোরে এসে পৌঁচেছে। সেইরকম: সবে এক পোওয়া দুধ।

 যেমন তেমন অমন এমন কেমন তুলনাবাচক। ‘কেমনে’ শব্দের ব্যবহার পদ্যে করণকারকে। ‘কেমন’ শব্দের দ্বৈতে সন্দেহ বোঝায়: কেমন কেমন ঠেকছে। গা কেমন কেমন করছে: একটা অনির্দিষ্ট অসুস্থ ভাব। ‘কেমন’ শব্দের সঙ্গে ‘যেন’-যোগে সংশয় ঘনীভূত হয়, আর সে সংশয়টা অপ্রিয়। লোকটাকে কেমন যেন ঠেকছে: অর্থাৎ ভালো ঠেকছে না। ভঙ্গীওয়ালা ‘কেমন’ শব্দটা আছে খোঁচা দেবার কাজে: কেমন জব্দ, কেমন মার মেরেছে, কেমন জুতো, কেমন ঠকানটাই ঠকিয়েছে।

 অধিকরণের বাহনরূপে ‘এমনি’ শব্দের ব্যবহার আছে: এমনিতেই জায়গা পাই নে। খোঁচা দেবার ভঙ্গীতেও এই শব্দটার যোগ্যতা আছে: এমনিই কী যোগ্যতা।

 ‘যত’ শব্দ তার জুড়ি হারালে টিটকারির কাজে লাগে সে কথা পূর্বেই বলেছি। ‘অত’ কথাটারও তীক্ষ্মতা আছে, যেমন: অত চালাকি কেন, অত বাবুগিরি তোমাকে মানায় না, অত ভালোমানুষি করতে হবে না।

 এ জাতীয় আরও দৃষ্টান্ত আছে, যথা ‘যে’ এবং ‘যেমন’। ‘সে’ এবং তেমন’এর সঙ্গে যদি বিচ্ছেদ ঘটানো যায়, তবে মুখ বাঁকানোর ভঙ্গী আনে, যথা: যে মধুর বাক্য তোমার। ‘তেমন’ এর সঙ্গবর্জিত ‘যেমন’ শব্দটাও বদমেজাজি: যেমন তোমার বুদ্ধি।

 এই ধরনেরই আর-একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়ে: কোথাকার মানুষ হে। এ বাক্যটার চেহারা প্রশ্নেরই মতো, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা রাখে না। এতে যে সংবাদ ঊহ্য আছে সে নিবাসঘটিত নয়, সে হচ্ছে লোকটার ধৃষ্টতার বা মূর্খতার পরিচয় নিয়ে। কোথাকার সাধুপুরুষ এসে জুটল: লোকটার সাধুতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ হচ্ছে না।

 ‘যেমতি’ ‘তেমতি’ পদে আশ্রয় নিয়েছে। ‘সেইমতো’ ‘এইমতো’ এখনো টিঁকে আছে। কিন্তু ‘এর মতো’ ‘তার মতো’র ব্যবহারটাই বেশি। করণকারকে রয়ে গেছে ‘কোনোমতে’। অথচ ‘কোনোমতো’ বা ‘কোনমতো’ শব্দটা নেই।

 ‘কেন’ শব্দটা সর্বনাম। এর অর্থ প্রশ্নবাচক, এর রূপটা করণ-কারকের। ঘটনা ঘটল কেন: অর্থাৎ ঘটল কী কারণের দ্বারা। ‘কেনে বা’ প্রাচীন কাব্যেও পড়েছি, গ্রাম্য লোকের মুখেও শোনা যায়।

 কেন, কেন বা, কেনই বা। ‘লোকটা কেন কাঁদছে’ এ একটা সাধারণ প্রশ্ন। ‘কেন বা কাঁদছে’ বললে কান্নাটা যে ব্যর্থ বা অবোধ্য সেইটে বলা হল। কেন বা এলে বিদেশে: অর্থাৎ বিদেশে আসাটা নিষ্ফল। কেনই বা মরতে এখানে এলুম: এ হল পরিতাপের ধিক্কার। এর মধ্যে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, এই প্রয়োগগুলির সবগুলোই অপ্রিয়তাব্যঞ্জক। কেন তিনি তিব্বতি পড়ছেন তা নিজেই জানেন না: এ সহজ কথা। যেই বলা হল ‘কেনই বা তিনি তিব্বতি পড়তে বসলেন’ অমনি বোঝা যায়, কাজটা সুবুদ্ধির মতো হয় নি।

 ‘কেন’ শব্দের এক বর্গের শব্দ ‘যেন’ ‘হেন’। ‘যেন’ সাদৃশ্য বোঝাতে। ‘হেন’ শব্দের প্রয়োগ বিশেষণে, যথা: হেন রূপ দেখি নাই কভু, হেন কাজ নেই যা সে করতে পারে না, সে-হেন লোকও তেড়ে এল। হেন কাজ=এমন কাজ। সে হেন=তার মতো।

 ‘যেন’ শব্দটাতে বিদ্রুপের ভঙ্গী লাগানো চলে: যেন নবাব খাঞ্জে খাঁ, যেন আহ্মাদে পুতুল। যেন কাত্তিকটি, যেন ডানাকাটা পরী। বাংলায় বিদ্রূপের ভঙ্গীরীতি অত্যন্ত সুলভ।

 ‘তেন’ শব্দের ব্যবহার লোপ পেয়েছে। ‘হেন’ শব্দের অর্থ ‘মতো’ কিংবা ’এইমতো’। এর সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় ‘তেন’ শব্দের অথ ‘সেইমতো’। ‘হেন-তেন’ জোড়া শব্দ এখনো চলিত আছে। হেন-তেন কত কী ব’কে গেল: অর্থাৎ, ব’কল কখনো এরকম কখনো সেরকম, অসংলগ্ন বকুনি। প্রাচীন বাংলায় দেখেছি ‘যেন কন্যা তেন বর’। এখানে ‘যেন’ শব্দের ‘যে-হেন’ অর্থ।

 ‘যেন’ শব্দটা ‘হেন’ শব্দের জুড়ি। পদাবলীতে পাওয়া গেছে, ‘যেহ্ন’ (যে-হেন)। বোঝা যায় এই ‘হেন’ শব্দের যোগেই ‘যেন’ শব্দ চেহারা পেয়েছে। আধুনিক বাংলায় ‘যেন’ শব্দটা তুলনা-উপমার কাজেই লাগে, কিন্তু পুরাতন বাংলায় তার অর্থের বিকৃতি হয় নি। তখন তার অর্থ ছিল ‘যেমন’: যেন যায় তেন আইসে, যেন রাজা তেন দেশ।

 ‘হেন’ শব্দটা রয়ে গেছে ভাষার মহদাশ্রয় পদ্যে। কিন্তু ‘সে’ কিংবা ‘এ’ শব্দের যোগে এখনো চলে, যেমন: সে-হেন লোক। এই ‘হেন’ শব্দের যোগে ঐ ‘সে’ শব্দে অক্ষমতা বা অসম্মানের আভাস দেয়। যেমন: সে-হেন লোক দৌড় মারলে। ‘হেন’ শব্দের যোগে ‘এ’ শব্দে অসামান্যতা বোঝায়, যেমন: এ-হেন লোক দেখা যায় না, এ-হেন দুর্দাশাতেও মানুষ পড়ে।

 ‘কেন’র সঙ্গে ‘যে’ যোগ করলে পরিতাপ বা ভর্ৎসনার ভঙ্গী আসে, যেমন: কেন যে মরতে আসা, কেন যে এতগুলো পাস করলে। ‘কী করতে’ শব্দটারও ঐরকম ঝোঁক, অর্থাৎ তাতে আছে ব্যর্থতার ক্ষোভ ৷

 শুধু ‘কী’ শব্দের মধ্যেও এই রকমের ভঙ্গী। এই কাজে ওর সঙ্গে যোগ দেয় ‘ই’ অব্যয়: কী চেহারাই করেছ; কী কবিতাই লিখেছেন, কী সাধুগিরিই শিখেছ। ঐ ‘কী’এর সঙ্গে ‘বা’ যোগ করলে ঝাঁজ আরও বাড়ে। ‘কী বা’কে বাঁকিয়ে ‘কী বে’ করলে ভঙ্গীতে আরও বিদ্রুপ পৌঁছয়। ‘ই’র সহযোগিতা বাদ দিলে ‘কী’ বিশুদ্ধ বিস্ময় প্রকাশের কাজে লাগে: কী সুন্দর তার মুখ।

 সম্মান খর্ব করবার বিশেষ প্রত্যয় বাংলাভাষায় যথেষ্ট পাওয়া গেল, সর্বনামের প্রয়োগেও বক্রোক্তি দেখা গেছে। কিন্তু শ্রদ্ধা বা প্রশংসা -প্রকাশের প্রয়োজনে ভাষায় কেবল একটা বিশেষ ভঙ্গী আছে ‘আহা’ অব্যয় শব্দটার যোগে, যেমন: আহা মানুষটি বড়ো ভালো। করুণা প্রকাশেও এর ব্যবহার আছে। অথচ ‘আহামরি’ শব্দের পরিণামটা ভালো হয় নি। গোড়ায় এর উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, এখন এ শব্দটার যে প্রকৃত স্বভাব সেইটাই গেছে বিপরীত হয়ে। এটা হয়েছে বিদ্রূপের বাহন। ওটাকে আরও একটু প্রশস্ত ক’রে হল ‘আহা ম’রে যাই’; এর ঝাঁজ আরও বেশি। পদে পদে বাংলায় এই বাঁকা ভঙ্গীটা এসে পড়ে: ভা-রি তো পণ্ডিত, ম-স্ত নবাব। এদের কণ্ঠস্বর উৎসাহে দীর্ঘকৃত হয়ে গাল পাড়ে যথার্থ মানেটাকে ডিঙিয়ে। ‘হাঁদারাম’ ‘ভোঁদারাম’ ‘বোকারাম’ ‘ভ্যাবাগঙ্গারাম’ শব্দগুলোর ব্যবহার চূড়ান্ত মূঢ়তা প্রকাশের জন্যে। কিন্তু ‘সুবুদ্ধিরাম’ ‘সুপটুরাম’ বলবার প্রয়োজনমাত্র ভাষা অনুভব করে না। সবচেয়ে অদ্ভুত এই যে ‘রাম’ শব্দের সঙ্গেই যত বোকা বিশেষণের যোগ, ‘বোকা লক্ষ্মণ’ বলতে কারও রুচিই হয় না।

 ‘কি’ যেখানে অব্যয় সেখানে প্রশ্নের সংকেত। ঊহ্য বিশেষ্যের সহযোগে বিশেষণে ওর প্রয়োগ আছে। তুমি কী করছ: অর্থাৎ ‘কী কাজ’ করছ। আর-একটা প্রয়োগ বিস্ময় বোঝাতে, যেমন: কী সুন্দর। পূর্বেই বলেছি তীক্ষ্মধার স্বরবর্ণ ‘ই’ সঙ্গে না থাকলে এর সৌজন্য বজায় থাকে। বিশেষণ-প্রয়োগে ‘কী’, যথা: কী কাজে লাগবে জানি নে। ‘কী’ বিশেষণ শব্দে অচেতন বা নির্বস্তুক বা অনিদিষ্ট বোঝায়: ওর কী দশা হবে, কী হতে কী হল। বিকল্প বোঝাতে ওর প্রয়োগ আছে, যেমন: কী রাম কী শ্যাম কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। ‘কোন্‌’ বিশেষণ জড় চেতন দুইয়েই লাগে।

 সর্বনামের কর্মকারকে সাধারণত ‘কে’ বিভক্তি: আমাকে তোমাকে। ‘সে’র বেলায় ‘তাকে’ কিংবা ‘সেটিকে’ ‘সেটাকে’।

 বাংলা সর্বনাম করণকারকে একটা বিভক্তির উপরে আর-একটি চিহ্ন জোড়া হয়। বিভক্তিটা সম্বন্ধপদের, যেমন ‘আমার’, ওতে জোড়া হয় ‘দ্বারা’ শব্দ: আমার দ্বারা। আর-একটা শব্দচিহ্ন আছে ‘দিয়ে’। তার বেলায় মূলশব্দে লাগে কর্মকারকের বিভক্তি: আমাকে দিয়ে।

 ‘কী’ শব্দের করণকারকের রূপ: কিসে, কিসে ক’রে, কী দিয়ে, কিসের দ্বারা। অধিকরণেরও রূপ ‘কিসে’, যথা: এ লেখাটা কিসে আছে। এ-সমস্তই একবচনের ও অজীববাচকের দৃষ্টান্ত, এরা বহুবচনে হবে: এগুলোকে দিয়ে, সেগুলোকে দিয়ে, কোন্‌গুলোকে দিয়ে। অসম্মানে মানুষের বেলা হয়; নচেৎ হয়: এদের দিয়ে, তাদের দিয়ে, ওদের দিয়ে।

 সাধারণত বাংলায় বিশেষণপদের বহুবচনরূপ নেই। ওদের অধিকৃত বিশেষ্য শব্দগুলিতে বহুবচনের ব্যবস্থা করতে হয়, যথা: বুনো পশুদের, পিতলের ঘটিগুলোর। বলা বাহুল্য ‘ঘটিদের’ হয় না, ‘পশুদের’ হয়। ‘রা’ এবং ‘দের’ বিভক্তি জড়বাচক শব্দের অধিকারে নেই। তার পক্ষে ‘গুলো’ শব্দই বৈধ। অথচ ‘গুলো’ অপর পক্ষের ব্যবহারেও লাগে। কিন্তু পরিমাণবাচক ‘এত’ ‘তত’ ‘যত’ ‘কত’ বিশেষণের সঙ্গে বহুবচন-বিভক্তি গুলো যুক্ত হয়। তা ছাড়া ‘এ’ সে’ ‘যে’ ‘ও’ ‘ঐ’ ‘সেই’ ‘কোন্‌’ শব্দের সঙ্গে বহুবচনে কর্তৃপদে ‘গুলো’ ও কর্মকারকে বা সম্বন্ধে ‘দের’ যোগ করা হয়।

 বাংলা সর্বনামশব্দ-প্রয়োগে একটা খটকার জায়গা আছে।

 ‘আমাকে তোমাকে খাওয়াতে হবে’ এমন কথা শোনা যায়। কে কাকে খাওয়াবে তর্কটা পরিষ্কার হয় না। এমন স্থলে যিনি খাওয়াবার কর্তা তাঁকে সম্বন্ধ-আসনে বসালে কথাটা পাকা হয়। আর সেটা যদি ক্রিয়াপদের পূর্বেই থাকে তা হলে দ্বিধা মেটে। ‘আমাকে তোমার খাওয়াতে হবে’ বাক্যটা স্পষ্ট। গোল বাধে বহুবচনের বেলায়। কেননা বহুবচনে সম্বন্ধপদের ‘দের’ আর কর্মকারকের ‘দের’ একই চেহারার। এর একমাত্র উপায় ‘কে’ বিভক্তি দ্বারা কর্মকারককে নিঃসংশয় করা। ‘আমাদেরকে তোমাদের খাওয়াতে হবে’ বললে নিশ্চিন্ত মনে নিমন্ত্রণে যাওয়া যায়। সম্বন্ধকারকের চিহ্নে কর্মকারকের কাজ চালিয়ে নেওয়া ভাষার অমার্জনীয় ঢিলেমি।