বাংলা শব্দতত্ত্ব/বাংলা কথ্যভাষা

উইকিসংকলন থেকে

বাংলা কথ্যভাষা

বাংলা শব্দতত্ত্ব আলোচনা করিতে হইলে বাংলা দেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় প্রচলিত উচ্চারণগুলির তুলনা আবশ্যক। অনেক বাংলা শব্দের মূল অনুসন্ধান করিতে গিয়া কৃতকার্য হওয়া যায় না। বাংলার ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে উচ্চারিত শব্দগুলি মিলাইয়া দেখিলে সেই মূল ধরিতে পারা সহজ হইতে পারে। তাহা ছাড়া উচ্চারণতত্ত্বটি শব্দতত্ত্বের একটি প্রধান অঙ্গ। স্বর ও ব্যঞ্জনের ধ্বনিগুলির কী নিয়মে বিকার ঘটে তাহা ভাষাতত্ত্বের বিচার্য। এজন্যও ভিন্ন জেলার উচ্চারণের তুলনা আবশ্যক। বাংলা দেশের প্রায় সকল জেলা হইতেই আমাদের আশ্রমে ছাত্রসমাগম হইয়াছে। তাঁহাদের সাহায্যে বাংলা ধাতুরূপ ও শব্দরূপের তুলনা-তালিকা আমরা বাহির করিতে চাই। নীচে আমরা যে তালিকা দিতেছি তাহার অবলম্বন কলিকাতা বিভাগের বাংলা। পাঠকগণ ইহা অনুসরণ করিয়া নিজ নিজ প্রদেশের উচ্চারণ-অনুযায়ী শব্দতালিকা পাঠাইলে আমাদের উপকার হইবে।

 কলিকাতা বিভাগের শব্দের উচ্চারণ সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলা আবশ্যক। যখন ‘বালক’ পত্র প্রকাশ করিতাম সে অনেক দিনের কথা। তখন সেই পত্রে বাংলা শব্দোচ্চারণের কতকগুলি নিয়ম লইয়া আলোচনা করিয়াছিলাম।[১] আমার সেই আলোচিত উচ্চারণপদ্ধতি কলিকাতা বিভাগের। স্থলবিশেষে বাংলায় অকারের উচ্চারণ ওকারঘেঁষা হইয়া যায় ইহা আমার বিচারের বিষয় ছিল। ‘করা’ শব্দের ক্‌-সংলগ্ন অকারের উচ্চারণ এবং ‘করি’ শব্দের ক্‌-সংলগ্ন অকারের উচ্চারণ তুলনা করিলে আমার কথা স্পষ্ট হইবে—এ উচ্চারণ কলিকাতা বিভাগের সে কথা পূর্বেই বলিয়াছি। কলিকাতার উচ্চারণে ‘মসী’ শব্দস্থিত অকার এবং ‘দোষী’ শব্দস্থিত ওকারের উচ্চারণ একই। ‘বোল্‌তা’ এবং ‘বলব’ও সেইরূপ। বাংলা উচ্চারণে কোনো ওকার দীর্ঘ কোনো ওকার হ্রস্ব; হসন্ত শব্দের পূর্ববর্তী ওকার দীর্ঘ এবং স্বরান্ত শব্দের পূর্ববর্তী ওকার হ্রস্ব। ‘ঘোর’ এবং ‘ঘোড়া’ শব্দের উচ্চারণ-পার্থক্য লক্ষ্য করিলেই ইহা ধরা পড়িবে। কিন্তু যেহেতু বাংলায় দীর্ঘ-ও হ্রস্ব-ও একই ওকার চিহ্নের দ্বারা ব্যক্ত হইয়া থাকে সেইজন্য নিম্নের তালিকায় এইসকল সূক্ষ্ম প্রভেদগুলি বিশেষ চিহ্ন দ্বারা নির্দেশ করিতে চেষ্টা করিলাম না।  আমরা প্রথমে ক্রিয়াপদের তালিকা দিতেছি। বাংলায় একবচনে ও বহুবচনে ক্রিয়ার প্রকৃতির কোনো পার্থক্য ঘটে না বলিয়াই জানি, এইজন্য নীচের তালিকায় বহুবচনের উল্লেখ নাই। যদি কোনো জেলায় বহুবচনের বিশেষ রূপ থাকে তবে তাহা নির্দেশ করা আবশ্যক।

 এইখানে হসন্ত উচ্চারণ সম্বন্ধে একটা কথা বলা দরকার। বাংলায় সাধারণত শব্দের শেষবর্ণস্থিত অকারের উচ্চারণ হয় না। যেখানে উচ্চারণ হয় সেখানে তাহা ওকারের মতো হইয়া যায়। যেমন ‘বন’, ‘মন’, এ শব্দগুলি হসন্ত। ‘ঘন’ শব্দটি হসন্ত নহে। কিন্তু উচ্চারণ হিসাবে লিখিতে হইলে লেখা উচিত, ঘনো। ‘কত’=কতো। ‘বড়’=বড়ো। ‘ছোট’=ছোটো। প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি বাংলায় দুই অক্ষরের বিশেষণমাত্রই এইরূপ স্বরান্ত। বাংলায় হসন্তের আর-একটি নিয়ম আছে। বাংলায় যে অসংযুক্ত শব্দের পূর্বে স্বরবর্ণ ও পরে ব্যঞ্জনবর্ণ আছে সে শব্দ নিজের অকার বর্জন করে। ‘পাগল্‌’ শব্দের গ আপন অকার রক্ষা করে যেহেতু পরবর্তী ল-এ কোনো স্বর নাই। কিন্তু ‘পাগ্‌লা’ বা ‘পাগ্‌লী’ শব্দে গ অকার বর্জন করে। এইরূপ—আপন—আপ্‌নি, ঘটক—ঘট্‌কী, গরম—গর্‌মি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, অনতিপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দে এ নিয়ম খাটে না, যেমন ঘোটক—ঘোটকী। এইপ্রকার হসন্ত সম্বন্ধে বাংলায় সাধারণ নিয়মের যখন প্রায় ব্যতিক্রম দেখা যায় না তখন আমরা এরূপ স্থলে বিশেষভাবে হসন্তচিহ্ন দিব না—যেমন ‘করেন্‌’ না লিখিয়া ‘করেন’ লিখিব, ‘কোর্‌চেন’ না লিখিয়া ‘কোরচেন’ লিখিব।

আমি কোরি তুই কোরিস  আমি কোরচি  তুই কোরচিস

তুমি করো সে করে তুমি কোরচ সে কোরচে

আপনি করেন  তিনি করেন আপনি কোরচেন তিনি কোরচেন

আমি কোরলুম (কোরলেম) তুই কোরলি

তুমি কোরলে সে কোরল (কোরলে)

আপনি কোরলেন  তিনি কোরলেন

আমি কোরেচি  তুই কোরেচিস আমি কোরেছিলুম (করেছিলেম)

তুমি কোরেচ সে কোরেচে তুমি কোরেছিলে

আপনি কোরেচেন তিনি কোরেচেন  আপনি কোরেছিলেন আমি কোরছিলুম (কোরছিলেম) তুই কোরছিলি

তুমি কোরেছিলে  সে কোরেছিল

আপনি কোরছিলেন তিনি কোরেছিলেন

 আমি কোরতুম (কোরতেম) তুই কোরতিস

 তুমি কোরত সে কোরত

 আপনি কোরতেন তিনি কোরতেন

করা যাক্‌  তুমি করো তুই কর  তিনি কোরুন

করা হোক্‌ আপনি করুন  সে করুক

 আমি কোরব তুই কোরবি

 তুমি কোরবে সে কোরবে

 আপনি কোরবেন  তিনি কোরবেন

 করা হয়, করা যায়, কোরে থাকে, কোরতে থাকে, করা চাই, কোরতে হবে, কোরলোই বা (কোরলেই বা), নাই কোরলো (নাই কোরলে), কোরলেও হয়, কোরলেই হয়, কোরলেই হোলো, করানো, কোরে কোরে, কোরতে কোরতে।

 হোয়ে পড়া, হোয়ে ওঠা, হোয়ে যাওয়া, কোরে ফেলা, কোরে ওঠা, কোরে তোলা, কোরে বসা, কোরে দেওয়া, কোরে নেওয়া, কোরে যাওয়া, করানো।

 কেঁদে ওঠা, হেসে ওঠা, বোলে ওঠা, চেঁচিয়ে ওঠা, আঁৎকে ওঠা, ফস্‌কে যাওয়া, এড়িয়ে যাওয়া, চম্‌কে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, সেরে যাওয়া, সোরে যাওয়া, মোরে যাওয়া।


কর্তৃকারক

 একবচন—রাম হাসে, বাঘে মানুষ খায়, ঘোড়ায় লাথি মারে, গোরুতে ধান খায়।

 এইখানে একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার। ‘রাম হাসে’ এই বাক্যে ‘রাম’ শব্দ কর্তৃকারক সন্দেহ নাই। কিন্তু ‘বাঘে মানুষ খায়’, ‘ঘোড়ায় লাথি মারে’, ‘গোরুতে ধান খায়’, বাক্যে ‘বাঘে’ ‘ঘোড়ায়’ ‘গোরুতে’ শব্দগুলি কর্তৃকারক এবং করণকারকের খিচুড়ি। ‘বাছুরে জন্মায় বা বাছুরে মরে’ এমন বাক্য বৈধ নহে, ‘বাছুরে তাকে চেটেচে’, চলে—অর্থাৎ এরূপ স্থলে কর্তার সঙ্গে কর্ম চাই। ‘ঘোড়ায় লাথি মারে’ বলি কিন্তু ‘ঘোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে’ বলি না। ‘লোকে নিন্দে করে’ বলি, কিন্তু ‘লোকে জমেচে’ না বলিয়া ‘লোক জমেচে’ বলি। আরো একটি কথা বিবেচ্য, বাংলায় কর্তৃকারকের এই প্রকার করণঘেঁষা রূপ কেবল একবচনেই চলে, আমরা বলি না ‘লোকগুলোতে নিন্দে করে’। তার কারণ, লোকে, বাঘে, ঘোড়ায় প্রভৃতি প্রয়োগ একবচনও নহে বহুবচনও নহে, ইহাকে সামান্যবচন বলা যাইতে পারে। ইহার প্রকৃত অর্থ, লোকসাধারণ, ব্যাঘ্রসাধারণ, ঘোটকসাধারণ। যখন বলা হয় ‘রামে মারলেও মরব, রাবণে মারলেও মরব’, তখন ‘রাম ও রাবণ’ ব্যক্তিবিশেষের অর্থত্যাগ করিয়া জাতিবিশেষের অর্থ ধারণ করে।

 কর্তৃকারক বহুবচন=রাখালেরা চরাচ্চে, গাছগুলি নড়চে, লোকসব চলেচে।

 কর্ম—ভাত খাই, গাছ কাটি, ছেলেটাকে মারি।

 এইখানে একটু বক্তব্য আছে। কর্মকারকে সাধারণত প্রাণীপদার্থ সম্বন্ধেই ‘কে’ বিভক্তি প্রয়োগ হয়। কিন্তু তাহার ব্যতিক্রম আছে। যেমন, ‘এই টেবিলটাকে নড়াতে পারচি নে’ ‘সন্ন্যাসী লোহাকে সোনা করতে পারে’ ‘জিয়োমেট্রির এই প্রব্লেমটাকে কায়দা করতে হবে’ ইত্যাদি। অথচ ‘এই প্রব্লেমকে কষো, এই লোহাকে আনো, টেবিলকে তৈরি করো’ এরূপ চলে না। অতএব দেখিতেছি, অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তরে ‘টা’ বা ‘টি’ যোগ করিলে কর্মকারক তদুত্তরে ‘কে’ বিভক্তি হয়, যেমন ‘চৌকিটাকে সোরিয়ে দাও’ (‘চৌকিকে সোরিয়ে দাও’ হয় না) ‘গাছটাকে কাটো’ (গাছকে কাটো’ হয় না)। ইহাতে বুঝা যাইতেছে ‘টি’ বা ‘টা’ যোগ করিলে শব্দবিশেষের অর্থ এমন একটা সুনির্দিষ্টতার জোর পায় যে তাহা যেন কতকটা প্রাণের গৌরব লাভ করে। ‘লোহাকে সোনা করা যায়’, বাক্যে ‘লোহা’ সেইরূপ যেন ব্যক্তিবিশেষের ভাব ধারণ করিয়াছে।

 করণ—ছড়ি দিয়ে মারে, মাঠ দিয়ে যায়, হাত দিয়ে খায়, ঘোলে দুধের সাধ মেটে না, কথায় চিঁড়ে ভেজে না, কানে শোনে না।

 অপাদান—রামের চেয়ে (চাইতে) শ্যাম বড়ো, এ গাছের থেকে ও গাছটা বড়ো, তোমা হোতেই এটা ঘট্‌ল, ঘর থেকে বেরোও।’  সম্বন্ধ—গাছের পাতা, আজকের কথা, সেদিনকার ছেলে।

 অধিকরণ—নদীতে জল, লতায় ফুল, পকেটে টাকা।

 বাংলায় কর্তৃকারক ছাড়া অপর কারকে বহুবচনসূচক কোনো চিহ্ন নাই।

সর্বনাম

 কর্তা—আমি আমরা, তুমি তোমরা, আপনি আপনারা, সে তারা, তিনি তাঁরা, এ এরা, ইনি এঁরা, ও ওরা, উনি ওঁরা, কে কারা, যে যারা, কি কিসব কোন্‌গুলো, যা যা’সব যেগুলো, তা সেইসব সেইগুলো।

 কর্ম—আমাকে আমাদের তোমাকে তোমাদের (দিগকে), আপনাকে আপনাদের, তাকে তাদের, তাঁকে তাঁদের, একে এদের, এঁকে এঁদের, ওঁকে ওঁদের, কাকে কাদের, কোন্‌টাকে কোন্‌গুলোকে, যাকে যাদের, যেটাকে যেগুলোকে, সেটাকে সেগুলোকে।

 করণ—আমাকে দিয়ে, তাকে দিয়ে, কোন্‌টাকে দিয়ে, ইত্যাদি। কেন, কিসে, কিসে কোরে, কি দিয়ে; যাতে, যাতে কোরে, যা দিয়ে; তাতে, তাতে কোরে, তা দিয়ে ইত্যাদি।

 অপাদান—আমার চেয়ে এটা ভালো, আমা হতে এ হবে না, আমার থেকে ও বড়ো, এটার চেয়ে, ওটা থেকে ইত্যাদি।

 সম্বন্ধ—আমার তোমার তার এগুলোর ওগুলোর ইত্যাদি।

 অধিকরণ—আমাতে তোমাতে, এটাতে ওটাতে, আমায় তোমায়, আমাদের মধ্যে, এগুলোতে ইত্যাদি। এখন তখন যখন কখন, এমন তেমন কেমন যেমন অমন, অত তত যত, এখানে যেখানে সেখানে।

 আশ্বিন-কার্তিক ১৩২৬

বাংলায় কথার ভাষা আর লেখার ভাষা নিয়ে যে তর্ক কিছুকাল চলছে আপনি আমাকে সেই তর্কে যোগ দিতে ডেকেছেন। আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত বলে এ কাজে আমি উৎসাহ বোধ করছি নে। সংক্ষেপে দুই-একটা কথা বলব।

 কর্ণ অর্জুন উভয়ে সহোদর ভাই হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যখন জাতিভেদ ঘটেছিল, একজন রইল ক্ষত্রিয় আর-একজন হ’ল সূত, তখনি দুই পক্ষে ঘোর বিরোধ বেধে গেল। বাংলা লেখায় আর কথায় আজ সেই দ্বন্দ্ব বেধে গেছে। এরা সহোদর অথচ এদের মধ্যে ঘটেছে শ্রেণীভেদ; একটি হলেন সাধু, আর-একটি হলেন অসাধু। এই শ্রেণীভেদের কারণ ছিলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। সে কথাটা খুলে বলি।

 এক সময়ে বাংলায় পদ্য সাহিত্যই একা ছিল; গদ্য ছিল মুখে; লেখায় স্থান পায় নি। পদ্যের ভাষা কোনো এক সময়কার মুখের ভাষার কাছ-ঘেঁষা ছিল সন্দেহ নেই—তার মধ্যে ‘করিতেছিলাম’ বা ‘আমারদিগের’ ‘এবং’ ‘কিম্বা’ ‘অথবা’ ‘অথচ’ ‘পরন্তু’র ভিড় ছিল না। এমন-কি, ‘মুই’, ‘করলুঁ’ ‘হৈনু’ ‘মোসবার প্রভৃতি শব্দ পদ্য ভাষায় অপভাষা বলে গণ্য হয় নি। বলা বাহুল্য, এ-সকল কথা কোনো এক সময়ের চলতি কথা ছিল। হিন্দী সাহিত্যেও দেখি কবীর প্রভৃতি কবিদের ভাষা মুখের কথায় গাঁথা। হিন্দীতে আর-একদল কবি আছেন, যাঁরা ছন্দে ভাষায় অলংকারে সংস্কৃত ছাঁদকেই আশ্রয় করেচেন। পণ্ডিতদের কাছে এঁরাই বেশি বাহবা পান। ইংরেজিতে যাকে snobbishness বলে এ জিনিসটা তাই। হিন্দী প্রাকৃত যথাসম্ভব সংস্কৃত ছদ্মবেশে আপন প্রাকৃতরূপ ঢাকা দিয়ে সাধুত্বের বড়াই করতে গিয়েচে। তাতে তার যতই মান বাড়ুক-না কেন, মথুরার রাজদণ্ডের ভিতর ফুঁ দিয়ে সে বৃন্দাবনের বাঁশি বাজাতে পারে নি।

 যা হোক, যখন বাংলা ভাষায় গদ্যসাহিত্যের অবতারণা হল তার ভার নিলেন সংস্কৃত’ পণ্ডিত। দেশের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে প্রতিদিন যে গদ্য বাণী প্রবাহিত হচ্চে তাকে বহুদূরে রেখে সংস্কৃত সরোবর থেকে তাঁরা নালা কেটে যে ভাষার ধারা আনলেন তাকেই নাম দিলেন সাধুভাষা। বাংলা গদ্য সাহিত্যিক ভাষাটা বাঙালির প্রাণের ভিতর থেকে স্বভাবের নিয়মে গড়ে ওঠে নি, এটা ফরমাসে গড়া। বাঙালির রসময় রসনাকে ধিক্কার দিয়ে পণ্ডিতের লেখনী বলে উঠল গদ্য আমি সৃষ্টি করব। তলব দিলে অমরকোষকে মুগ্ধবোধকে। সে হল একটা অনাসৃষ্টি। তার পর থেকে ক্রমাগতই চেষ্টা চলচে কি ক’রে ভাষার ভিতরকার এই একটা বিদ্‌ঘুটে অসামঞ্জস্যটাকে মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বিদ্যাসাগর তাকে কিছু পরিমাণে মোলায়েম ক’রে আনলেন—কিন্তু বঙ্গবাণী তবু বললেন “এহ বাহ্য”। তার পরে এলেন বঙ্কিম। তিনি ভাষার সাধুতার চেয়ে সত্যতার প্রতি বেশি ঝোঁক দেওয়াতে তখনকার কালের পণ্ডিতেরা দুই হাত তুলে বোপদেব অমরের দোহাই পেড়েছিলেন। সেই বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর ভাষাও আজ প্রায় মরা গাঙের ভাষা হয়ে এসেচে—এখনকার সাহিত্যে ঠিক সে ভাষার স্রোত চলচে না। অর্থাৎ বাংলা গদ্যসাহিত্যের গোড়ায় যে একটা original sin ঘটেছে কেবলি সেটাকে ক্ষালন করতে হচ্চে। কৌলিন্যের অভিমানে যে একটা হঠাৎ সাধুভাষা সর্বসাধারণের ভাষার সঙ্গে জল-চল বন্ধ ক’রে কোণ-ঘেঁষা হয়ে বসেছিল, অল্প অল্প ক’রে তার পঙ্‌ক্তিভেদ ভেঙে দেওয়া হচ্চে। তার জাত যায়-যায়। উভয় ভাষায় কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অসবর্ণ বিবাহ হতে শুরু হয়েচে। এখন আমরা চলিত কথায় অনায়াসে বলতে পারি ‘ম্যালেরিয়ায় কুইনীন ব্যবহার করলে সদ্য ফল পাওয়া যায়।’ পঞ্চাশ বছর আগে লোকের সঙ্গে ব্যাভার ছাড়া ব্যবহার কথাটা অন্য কোনো প্রসঙ্গেই ব্যবহার করতুম না। তখন বলতুম, ‘ম্যালেরিয়ায় কুইনীনটা খুব খাটে।’ আমার মনে আছে, আমার বাল্যকালে আমাদের একজন চাকরের মুখে ‘অপেক্ষা’ কথাটা শুনে আমাদের গুরুজনরা খুব হেসেছিলেন। কেননা, কেউ অপেক্ষা করচেন, এ কথাটা তাঁরাও বলতেন না—তাঁরা বলতেন ‘অমুক লোক তোমার জন্যে বসে আছেন।’ আবার এখানকার লেখার ভাষাতেও এমনি করেই মুখের ভাষার ছাঁদ কেবলি এগিয়ে চলছে। এক ভাষার দুই অঙ্গের মধ্যে অতি বেশি প্রভেদ থাকলে সেই অস্বাভাবিক পার্থক্য মিটিয়ে দেবার জন্যে পরস্পরের মধ্যে কেবলি রফা চলতে থাকে।

 এ কথা সত্য ইংরেজিতেও মুখের ভাষায় এবং লেখার ভাষায় একেবারে ষোলো-আনা মিল নেই। কিন্তু মিলটা এতই কাছাকাছি যে পরস্পরের জায়গা অদলবদল করতে হলে মস্ত একটা লাফ দিতে হয় না। কিন্তু বাংলায় চলতি ভাষা আর কেতাবী ভাষা একেবারে এপার ওপার—ইংরেজিতে সেটা ডান হাত বাঁ হাত মাত্র-একটাতে দক্ষতা বেশি আর-একটাতে কিছু কম—উভয়ে একত্র মিলে কাজ করলে বেমানান হয় না। আমি কোনো কোনো বিখ্যাত ইংরেজ লেখকের ডিনার-টেবিলের আলাপ শুনেছি, লিখে নিলে ঠিক তাঁদের বইয়ের ভাষাটাকেই পাওয়া যেত, অতি সামান্যই বদল করতে হত। এই জাতিভেদের অভাবে ভাষার শক্তিবৃদ্ধি হয় আমার তো এই মত। অবশ্য মুখের ব্যবহারে ভাষার যে ভাঙ্‌চুর অপরিচ্ছন্নতা ঘটা অনিবার্য সেটাও যে লেখার ভাষায় গ্রহণ করতে হবে আমি তা মানি না। ঘরে যে ধুতি পরি সেই ধুতিই সভায় পরা চলে কিন্তু কুঁচিয়ে নিতে একটু যত্নের প্রয়োজন হয়, আর সেটা ময়লা হলে সৌজন্য রক্ষা হয় না। ভাষা সম্বন্ধেও সেই কথা।[২]

 বৈশাখ ১৩৫০

  1. “বাংলা উচ্চারণ", বালক, আশ্বিন ১২৯২। বর্তমান গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ।
  2. বিজয়চন্দ্র মজুমদারকে লিখিত পত্র।
    প্রবাসী ১৩৫০ বৈশাখ সংখ্যায় কালিদাস নাগের নিম্নলিখিত মন্তব্যসহ প্রকাশিত হয়: “...চিঠি যে ‘সবুজ-পত্র’ যুগে লেখা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, যদিও এই মূল্যবান চিঠিখানি তারিখ বর্জিত।”