বিষয়বস্তুতে চলুন

বাখতিন/কার্নিভাল: লোকায়তের প্রত্যাঘাত

উইকিসংকলন থেকে

কার্নিভাল: লোকায়তের প্রত্যাঘাত

সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও স্বভাব আধিপত্যবাদের দীর্ঘায়ত প্রশ্রয়ে এত দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত যে এদের আস্তিত্বিক সংগঠনে প্রচ্ছন্ন লোকায়ত উপাদান সম্পর্কে প্রায় কেউই অবহিত থাকে না। সাংস্কৃতিক রাজনীতির অভিঘাত কীভাবে সত্য ও মিথ্যার সংজ্ঞা পালটে দেয়, এ বিষয়ে অসচেতনতা প্রায় সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন নয় যে আধুনিক যুগেই সরকারি সন্দর্ভ প্রাধান্য বিস্তার করেছে। প্রাক্-আধুনিক সময়পর্বের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবেদনেও সরকারি অবস্থানই একাত্তিক মান্যতা পেয়েছে। তা ঘটেছে লোকায়ত জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে পুরোপুরি নিরাকৃত করে। তবু ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে প্রাতিষ্ঠানিক একাধিপত্যের অচলায়তন ভেঙে দিয়ে প্রান্তিক অস্তিত্বের উপস্থিতি তির্যকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাখতিন যখন লোকায়ত জীবনে জনপ্রিয় কৌতুকের বিস্মৃত পরম্পরা নিয়ে কথা বলেন, দ্বিবাচনিক অপর পরিসরের অনস্বীকার্য প্রতিস্রোত সম্পর্কে তাঁর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়। Rabelais and his world ও Problems of Dostoevsky’s Poetics—এই দুটি বইতে বাখতিন তাঁর বিখ্যাত কার্নিভাল-ভাবনা উপস্থাপিত করেছেন। যোল শতকের বিখ্যাত সাহিত্যিক রাবেলের রচনায় তিনি খুঁজে পেয়েছেন সন্দর্ভের বিকল্প একটি ধরন যা সরকারি ভাবাদর্শ ও উপস্থাপনা রীতির বিরোধিতা করে। এমনকী ডস্টয়েভস্কির মতো বহুস্বরিক সন্দর্ভ রচয়িতার পাঠকৃতিতেও তিনি দূরবর্তী কার্নিভাল-অতীতের অবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। জনপ্রিয় ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে কার্নিভাল যখন বয়ানের পাঠতন্তুতে রূপান্তরিত হয়, তাতে যুগপৎ ধরা পড়ে বিকল্প চিন্তন-অভিজ্ঞতা-অনুভূতির চিহ্নায়ন প্রকরণ। জুলিয়া ক্রিস্তেভার মতে কার্নিভাল শুধু চিহ্নায়ক নয়, তা চিহ্নায়িতও বটে। তা-ই কোনো পাঠকৃতিতে যুগপৎ উপস্থাপনার বিষয় ও পদ্ধতি।

 কোনো পাঠকৃতির চিত্রকল্প, ভাষা ও কথাবস্তুর মধ্যে কার্নিভালের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। একে বলা যেতে পারে মঞ্চ-ছাড়া দৃশ্যসজ্জা; এতে যোগ দেয় যে সে যুগপৎ অভিনেতা ও দর্শক। প্রান্তিক লোক-উপাদান কীভাবে পাঠতন্তুতে রূপান্তরিত হবে, তার কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই এবং তা সরাসরিও ঘটে না। মান্য বয়ানে পৌঁছানোর পথে বেশ কিছু অন্তর্বর্তী স্তর পেরিয়ে যেতে হয় বলে প্রাকরণিক ও শৈলীগত রূপান্তর অন্তর্বস্তুর তাৎপর্যেও যথেষ্ট স্বরান্তর ঘটিয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে কার্নিভালের যে-ভূমিকা থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের প্রচ্ছায়ায় তার অনেকখানি বদলে যায়। আধিপত্যবাদী প্রতাপের দৃশ্য ও অদৃশ্য বিচ্ছুরণের বিরুদ্ধে যাদের প্রতিবাদী ভূমিকা ছিল সমান্তরাল অপরতার প্রকৃত অভিজ্ঞান, তা প্রাগুক্ত রূপান্তরের ফলে অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে না। তবু শিলাস্তরে নিহিত আদিমযুগের ভূতাত্ত্বিক অবশেষের মতো সাহিত্যিক প্রতিবেদনেও প্রচ্ছন্ন থাকে বিগত কালের সাংস্কৃতিক উপাদান, যা প্রতিস্রোতপন্থী লোকায়ত জীবনের ইশারা বয়ে আনে। বাখতিন দেখিয়েছেন, মধ্যযুগে সাধারণ মানুষের জীবনে কার্নিভাল অনেক বেশি প্রকট ছিল। কেননা তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে ছিল দ্বৈততা। একদিকে রাষ্ট্র ও ধর্মতন্ত্রের কর্তৃত্ব খচিত সরকারি বয়ান, সামন্ততান্ত্রিক বিধি প্রণোদিত কৃত্যের বিশাল চাপ এবং অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবনপ্রণালীর হাসি, গান, কৌতুক, প্যারডি এবং বিপ্রতীপায়ন। এই ভাবনাসূত্রের নিরিখে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য যদি পুনঃপাঠ করি, দেখব, নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক জনমানস ও নারী সমাজের অপ্রাতিষ্ঠানিক বয়ান পরবর্তীকালে আধিপত্যবাদী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র দ্বারা অধিকৃত হওয়ার ফলে মঙ্গলকাব্যের ধারা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নিবিড় পাঠের সাহায্যে আমরা বুঝতে পারি, বহু স্তরে রূপান্তরিত ঐসব পাঠকৃতির মধ্যে লোকায়ত কার্নিভালের আদিস্তরের অবশেষ রয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সাংস্কৃতিক রাজনীতির অভিঘাত সত্ত্বেও বিপ্রতীপায়নের প্রবণতা দুর্লক্ষ্য নয়।

 বস্তুত এ কেবল মধ্যযুগীয় সাহিত্যের বিষয় নয়। ধনতান্ত্রিক যুগেও অত্যন্ত পরিশীলিত ও বৌদ্ধিক চাতুর্য খচিত পাঠকৃতিতে এধরনের কার্নিভালীকরণ দেখা যায়। কোথাও তা স্পষ্ট আর কোথাও তত স্পষ্ট নয়, এইমাত্র তফাত। ডস্টয়েভস্কির নন্দন সম্পর্কিত বিখ্যাত বইতে বাখতিন লিখেছেন যে সাহিত্যের কার্নিভালীকরণ প্রক্রিয়া খুবই সৃষ্টিশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে আমরা গ্রহণ করতে পারি—‘As a means for capturing in art the developing relationship under capitalism, at a time when previous forms of life, moral principles and beliefs were being turned into rotten cords and the previously concealed, ambivalent and unfinalised nature of man and human thought was being nakedly exposed.’ (১৯৮৪: ১৬৬)।

 ঔপনিবেশিক আধুনিকতার একমাত্রিক আধিপত্যের পর্যায়ে বাংলা সাহিত্যেও দেখেছি কীভাবে সমস্ত প্রাক্-আধুনিক জীবনপ্রণালী, নৈতিকতার বোধ এবং সামাজিক ও নান্দনিক ভাবাদর্শ অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক দীপায়নের ভেতরকার রাজনীতিকে উনিশ শতকের মধ্যস্বত্বভোগী নব্য বিদ্বৎসমাজ অনুধাবন করতে পারেননি। আসলে ঐতিহাসিক সময়ের গণ্ডি তাঁদের রুদ্ধ করে রেখেছিল শ্রেণীস্বার্থের পিঞ্জরে। ‘বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়, কোথায় কারার দ্বার’—এমন বলা যায় না, যেহেতু এই কারাগার তাঁদের স্বযাচিত। জায়মান ধনতন্ত্র যে উপনিবেশের আয়ুধ, তা বোঝার দরকার ছিল না; কেননা তখন তাঁদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল বৈষয়িক সমৃদ্ধির সম্ভাবনায়, অভিনব জ্যোতিরুচ্ছ্বাসের সহগামী শক্তির প্রত্যাশায়। অতএব এঁরা সর্বস্তরে সরকারি বীক্ষা ও প্রতিবেদনকে মান্যতা দেবেন; এজন্যে নিজেরা অণুবীক্ষণ-লভ্য হয়েও, বিপুল জনসমাজের ঐতিহ্য-বিশ্বাস-মূল্যবোধকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সমস্ত প্রাক্তন জীবনপ্রণালী তাঁদের কাছে অতীতের প্রেতচ্ছায়া বলে গণ্য হলো। তাই উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলা সাহিত্যের প্রতিবেদনে উচ্চবর্গীয়দের কৃত্রিম নির্মিতি আধুনিকতার শিরোপা পেতে থাকল। কিন্তু তার মানে কি এই যে অনাগরিক ব্রাত্য জীবন পুরোপুরি মুছে গেল যেহেতু তারা ইংরেজিতে লিখতে-পড়তে-বলতে-ভাবতে পারে না? সাহিত্যের ভালো-মন্দ বিচার কিংবা পাঠ-প্রকরণ যদিও সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি অনুযায়ী নির্ণীত হলো, লোকায়ত জীবনের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি এবং হস্তক্ষেপ কিন্তু খারিজ করা গেল না। কেননা মানুষ আর তার চিন্তাবিশ্ব চূড়ান্তীকরণ প্রতিহত করে; পীড়ন যত সর্বগ্রাসী, প্রতিরোধও তত অনিবার্য। নতুন-নতুন পথে তার আবিষ্কার ঘটতে থাকে।

দুই

তাই প্রতীচ্যায়িত উপন্যাসের দর্পণে উনিশ শতকের নব্য আলোকপ্রাপ্ত বর্গ যখন নিজেদের কাঙ্ক্ষিত প্রসাধনধন্য ও অলংকৃত চেহারা দেখতে পেয়ে তৃপ্ত, কল্পিত আকাশে ইচ্ছাপূরণমূলক ভ্রমণের বিবরণে মুগ্ধ—বিস্মৃত ভূমির সঙ্গে সংলগ্ন সামূহিক জীবনের পরম্পরার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে ঐতিহাসিক ভাবেই অনিবার্য হয়ে পড়েছিল লোকায়তের প্রত্যাঘাত। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতী (১৮৯২) সেই পাঠকৃতি যার কোষে-কোষে ‘folk carnival humour’ -এর প্রগাঢ় উপস্থিতি লক্ষ করি। রাবেলের অণুবিশ্বে বাখতিন যেমন দেখতে পেয়েছেন ‘boundless world of humourous forms and manifestations (which) opposed the official and serious tone of medieval ecclesiastical and feudal culture’—তেমনি আমরাও কঙ্কাবতী-র অণুবিশ্ব জুড়ে একদিকে দেখতে পাই সামন্ততন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মতন্ত্রের বীভৎস গলিত প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র। অন্যদিকে দেখি তাদের নিষ্ঠুর বেপরোয়া আধিপত্যবাদী আকরণের প্রতিস্পর্ধী অজস্র অস্তিত্বের মিছিল। ফাঁপা সরকারি অবস্থানের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায়, তাদের কেউ মানুষ নয়। যেন মানুষের অবয়বে অতিব্যক্ত পাশবিকতার প্রতি তর্জনি সংকেত করার জন্যে হাসির আড়ালে জীবনের মর্মসত্য (‘প্রতিটি সত্তাই সহযোগী সত্তা’: বাখতিন) প্রকাশ করেছে জন্তু-সরীসৃপ-কীট-পতঙ্গ-ভূত-পেত্নীর ছদ্মবেশধারী কুশীলবেরা। এরা সবাই আকারে-প্রকারে স্বভাবে-অভিব্যক্তিতে কার্নিভালের অন্তহীন হাস্যময় ভুবনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। বাখতিন-কথিত বিপ্রতীপায়নের অসামান্য দৃষ্টান্ত পাচ্ছি ত্রৈলোক্যনাথের প্রতিবেদনে। মানুষ ও মানবেতর প্রাণীর (এবং, বাস্তব ও প্রকল্পনার) এমন পারস্পরিক ভূমিকা-বদল কার্নিভালের সৃষ্টিশীল সম্ভাবনারই প্রমাণ।

 ঠিক ১০১ বছর পরে প্রকাশিত নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট (১৯৯৩) যেন বাংলা সাহিত্যে অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদ ও উন্মুখ আধুনিকোত্তরবাদের সন্ধিলগ্নে ‘urban carnival humour’-এর দৃষ্টান্ত। ত্রৈলোক্যনাথে ছিল উনিশ শতকীয় ঔপনিবেশিক আধুনিকতার কাহিনী-গ্রন্থনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ছিল বাস্তবতার নামে ছদ্ম-বাস্তব চাপিয়ে দেওয়ার সুবিধাবাদী রীতির বিরুদ্ধে দ্রোহ। আর, নবারুণ বিশ শতকের উপার্জন বলে প্রচারিত যাবতীয় ধূর্ততা-কৃত্রিমতা-অন্তঃসারশূন্যতা ভরা কাহিনি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে অস্বীকার করেছেন। নয়া-ঔপনিবেশিক প্রতাপকে প্রত্যাঘাত জানানোর জন্যে তিনি বেছে নিয়েছেন হার্বার্ট সরকার নামক এক নাগরিক অন্তেবাসীকে। তার জীবন যতটা গোলমেলে ও শ্লেষগর্ভ, মৃত্যু তার চেয়েও বেশি। ‘কাহিনি’ শব্দটাই যখন চরম অবাস্তব, নবারুণ তাকে পুরোপুরি বিনির্মাণ নয় কেবল—তীব্র পরিহাসেও বিদ্ধ করেছেন। তাঁর এই আকরণোত্তর গ্রন্থনার অন্তঃস্বর সম্পর্কে লেখক কতখানি সচেতন, তা হারবার্টের মৃত্যু ও পরবর্তী বর্ণনায় স্পষ্ট: ‘হঠাৎ তালে তালে হাততালি দেওয়া শুরু হয়। সঙ্গে সিটি ও নানারকম বিদ্‌ঘুটে আওয়াজ। এইভাবে শোক অন্তিম রিচুয়ালের মাধ্যমে ব্যাপকতর আনন্দময় কোলাহলে পরিণত হতে থাকে। ... গেটের পাশেই ক্রন্দনশীলা শোভারানীর পাশে বিমূঢ় ললিতকুমার দাঁড়িয়েছিলেন। আনন্দধ্বনি শুনে তিনি বলে উঠলেন, শোভা, তুমি কাঁদছ? এ তো দেখছি কার্নিভাল।’ (পৃ. ৫৫) যেভাবেই উচ্চারিত হোক না কেন শব্দটি, যাবতীয় যথাপ্রাপ্তকে বিনির্মাণ করার মতো বিস্ফোরক এর মধ্যে মজুত রয়েছে। কেন্দ্রীয় কুশীলবের কথায় ও কাজে বহির্বৃত অপর পরিসরের নিরন্তর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ব্যক্ত হয়েছে। নিছক উন্মাদের পাঠক্রম রচনা যে করেনি হারবার্ট, তা লেখকের এই ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপনায় স্পষ্ট: ‘এল. টি. টি. ই-র লাইভ হিউম্যান বম্‌ব ধানুর সঙ্গে তুলনীয় হারবার্ট ছিল একটি ডেড্ হিউম্যান বম্‌ব। …গত দুই দশক ধরে এই বিস্ফোরক সমাহার তোষকের মধ্যে শীতঘুম ঘুমোচ্ছিল যা চুল্লির উত্তাপে জেগে ওঠে। …হারবার্টের রক্তহীন মৃতদেহ দাহ করার সময় জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল তা অবধারিত ভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়ে চলে যে কখন, কোথায়, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।’ (পৃ. ৫৭)।

 এই বিন্দুতে এসে মনে হয়, কার্নিভাল কেবল সাহিত্যিক কৃৎকৌশল নয়; কার্নিভালের ধারণায় রয়েছে মুক্ত পরিসর, রয়েছে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক অন্তঃস্বর। সর্বত্র-ব্যাপ্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা জানাতে গিয়ে ঐ মুক্ত পরিসরের সম্ভাবনাকেই কাজে লাগাতে হয়। পাঠকৃতির নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকতার নানা আয়োজন। সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হলে মনে রাখতে হয় যে পাঠকৃতিও যুদ্ধক্ষেত্র; লেখা ও পড়া—দু’টি ক্রিয়াই মূলত যুদ্ধ। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমস্ত তাৎপর্য অর্জনীয় বলেই লেখার কার্নিভালীকরণ যা ঘটিয়ে দেয়, তা যুগপৎ নান্দনিক ও রাজনৈতিক উন্মোচন। নবারুণ হারবার্ট-এ কার্নিভালের নাগরিক প্রয়োগ সম্পন্ন করেছেন। সাম্প্রতিক তাত্ত্বিকেরা আধুনিকোত্তর কার্নিভাল, প্যারডি, শ্লেষ ও হাসি সম্পর্কে যে-সব আলোচনা করেছেন, সেই নিরিখে বলা যায়, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পুরোপুরি নতুন স্তর আবিষ্কার করতে পারি তাতে। একটু আগেই লক্ষ করলাম যে কার্নিভালের ধারণা শুধুমাত্র মধ্যযুগীয় অনুষঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকে না; আধুনিক এবং আধুনিকোত্তর কালপর্বেও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পাঠের অভিনব পদ্ধতিকে ব্যবহার করা সম্ভব। তাই বাখতিনের আদি প্রেরণা থেকে সময় ও পরিসরের বিচারে বহু দূরবর্তী বয়ানেও কার্নিভালীকরণের ভাববীজ ব্যবহার করা যাচ্ছে। এপ্রসঙ্গে চার্লস জেঙ্কস-এর একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে পারি: ‘The Carnivalesque in postmodern literature is the crossing of boundaries, the breakdown of all categories of class, sex and genre that occurs in any carnival worthy of the name’ (১৯৯১: ১৭)।

 বিভিন্ন বর্গায়তনের মধ্যবর্তী সীমান্ত যখন মুছে যায়, প্রান্তিকায়িত স্তরের উপেক্ষিত উপাদান শ্লেষ ও পরিহাসের অন্তর্ভেদী শক্তি নিয়ে অবতল থেকে ঊর্ধ্বায়িত হয়ে ওঠে। আধুনিকোত্তর সাহিত্য যেহেতু যুগপৎ উপস্থাপিত বক্তব্যকে সমর্থন দেয় ও প্রশ্নে বিদ্ধ করে—আপাতদৃষ্টিতে কার্নিভালের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রবণতার সঙ্গে কূটাভাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। কেউ কেউ এমনও ভাবতে পারেন যে কার্নিভালের প্রধান উপজীব্য হাসি তাতে গোপন বিষণ্ণতার চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। বাখতিনের মৌল অভিপ্রায় থেকে বিচ্যুত হলে বিদ্রূপগর্ভ বা পরিহাসপ্রবণ বিপ্রতীপায়ন কীভাবে কার্নিভাল বলে বিবেচিত হতে পারে? আসলে খুব সতর্কভাবে বিষয়টির মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। সরকারি কর্তৃত্ব ও প্রতিষ্ঠিত বিধি-বিন্যাস যে জীবনে মননে নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপ আরোপ করে—তাকে প্রত্যাহ্বান জানাতে প্রান্তিক অবতল থেকে উঠে আসে কার্নিভালের প্রতিস্রোত। অতি-উদ্ভাসন যে বিপুল অন্ধতাকে আবৃত করে রেখেছিল, সেদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় আমাদের। লোকায়ত জ্ঞান ও অনুভূতি সরাসরি নয়, নানা ছদ্মবেশ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের রৈখিকতায় আঘাত করে। সাংস্কৃতিক প্রভুত্ববাদের দেওয়াল তাতে ভেঙে না পড়ুক, বেশ কিছু পাথর অন্তত খসে পড়ে। আর, এই গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হয় আমাদের, একমাত্রিক জাতীয় সংস্কৃতি বা মূল্যবোধ সত্য হতে পারে না কখনও। প্রান্তিকায়িত অপর পরিসরের মধ্যে অনাবিষ্কৃত রইল কিনা জনমানসের প্রকৃত নির্যাস, সামূহিক অস্তিত্বের খাঁটি প্রাণপ্রবাহ—সে-বিষয়ে আমাদের অবহিত করে বলেই তো ‘Bakhtin’s carnival idea had the thrill of a cultural and biological universal.’ (Caryl Emerson: 1997: 163)। সামাজিক জীবনের মর্মমূলে যাঁরা বহুত্ববাদী দার্শনিক বীক্ষাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করেন, সরকারি বক্তব্যকে নির্বিকল্প মান্যতা দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভবই নয়। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতির গবেষণায় এখন প্রমাণিত যে বৃহৎ ঐতিহ্য ও লঘু ঐতিহ্য সম্মিলিত ভাবে জাতীয় সংস্কৃতির জন্ম দেয়। কিন্তু উদ্ধত আধিপত্যবাদ এই সত্যকে অস্বীকার করতে চায় বলে সমস্ত অপর পরিসরের অস্তিত্বই মুছে ফেলে এবং কোথাও কোনো বিকল্পের সম্ভাবনাও স্বীকার করে না। চূড়ান্ত এই একবাচনিকতা ও রুদ্ধতাকে মোকাবিলা করতে দেখা দেয় কার্নিভালের বিপ্রতীপায়ন। দ্রোহাত্মক এই প্রবণতাকে কেউ কেউ বলেছেন সংযোগের নতুন আকল্প; বলেছেন, এ আসলে ‘Carnival dynamics’ (তদেব)।

 এই ‘dynamics’-এর নিরিখে আপাত-প্রাতিষ্ঠানিক লিখনপ্রণালীর মধ্যেও আমরা আবিষ্কার করতে পারি ভূমিসংলগ্ন জীবনের দ্রোহ, ক্ষমতা-দম্ভ মোকাবিলার জন্যে লোকায়ত চেতনার অন্তর্ঘাত। হয়তো এতে সাময়িক কৌণিকতার চেয়ে বেশি কিছু তৈরি হয় না; তবু একবাচনিক সরকারি বয়ানই যে শেষ কথা নয়—এই উপলব্ধি অন্তত নিয়ে আসে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক প্রকরণ থেকে উৎসারিত বেসরকারি রচনাপুঞ্জ। তার প্রকাশ হয়তো পিনদ্ধ নয়, প্রণালীবদ্ধও নয়; তবু প্রাতিষ্ঠানিক বাচনের অভ্যস্ত ও রুদ্ধ অচলায়তনে প্রতিস্পর্ধা জানাতে এর জুড়ি নেই। একে বাখতিন বলেন কার্নিভালীকৃত লিখন-প্রয়াস—‘which has taken the carnival spirit into itself and thus reproduces within its own structures and by its own practice, the characteristic inversions, parodies and discrownings of carnival proper,’ (Simon Dentith: 1995: 65)। বাখতিনের দৃষ্টিকোন অনুসরণ করে সমালোচকেরা লক্ষ করেছেন যে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কিছু কিছু বিশেষ পর্যায়ে কর্তৃত্ববাদ-বিরোধী প্রবণতা আলাদা ভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তখন সরকারি বয়ান যত দাপটের সঙ্গে উচ্চবর্গীয় অবস্থানকে পুষ্ট করুক না কেন, প্রায় অপ্রত্যাশিত ভাবেই অনালোকিত পরিসর থেকে উঠে আসে সমান্তরাল অস্তিত্বের বার্তা। তখন কোনো-একটি বিশিষ্ট সাহিত্য-প্রকরণ একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করলেও তারই ভেতর থেকে দেখা দেয় ভিন্ন ধরনের অন্তর্বয়নের ঘোষণা।

 উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে তাই কখনও কখনও চোখে পড়ে সম্ভাব্য ‘carnival spirit’-এর উপস্থিতি। বিষবৃক্ষ, রজনীরাজসিংহ-এর মতো নিশ্ছিদ্র গাম্ভীর্যপূর্ণ প্রতিবেদনেও ঐ ব্যতিরেকী উপস্থিতির ইশারা রয়েছে। আর, ইন্দিরার পরিহাস, আখ্যানের বিশিষ্ট চলনে লক্ষ করি সেই বিপ্রতীপায়নের প্রকাশ। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃপ্ত আবির্ভাবের ঠিক আগে আলালের ঘরের দুলালহুতোম প্যাঁচার নকশা নামক দুটি প্রতিবেদনে কার্নিভালের প্রবল উপস্থিতি নিঃসন্দেহে সংকেতগর্ভ। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের নাগরিক সমাজ যখন আত্মদৃষ্ট দর্পণে আলোর উদ্ভাসনের বদলে সহগামী ছায়ার পরিসরই বেশি মাত্রায় দেখতে পাচ্ছিল, আখ্যানে ইচ্ছাপূরণের আয়োজন সত্ত্বেও ‘carnival imagery’-এর চলমান প্রবাহে সমান্তরাল পরিসর প্রবলভাবে ব্যক্ত হয়েছিল। জীবনের বয়ান তৈরি করতে গিয়ে সংবেদনশীল লেখকেরা সমাজ-জীবনে যেসব অসঙ্গতি লক্ষ করেছিলেন, তাদের প্রচলিত কমেডির ধরন কিংবা ব্যঙ্গ-পরিহাস দিয়ে উপস্থাপিত করলে প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-শৃঙ্খলায় কার্যকরী ভাবে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয় না। এখানেই কার্নিভালীকরণের প্রসঙ্গ আমাদের মনোযোগ দাবি করে।


তিন

না লিখলেও চলে, হাসি শুধু হাসি নয়, ব্যঙ্গ-পরিহাস-প্যারডিও নিছক কৌতুক নয়। যেহেতু আধিপত্যেবাদের বিরুদ্ধে অপ্রাতিষ্ঠানিক লোকজীবনের নিরবচ্ছিন্ন উৎস থেকে সঞ্চালিত হয় জনমানসের প্রত্যাঘাত, তার সাংস্কৃতিক রাজনীতিগত তাৎপর্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সত্যের ওপর সুবিধাভোগী উচ্চবর্গীয়দের দখলদারি মেনে নিতে পারে না বলেই প্রান্তিকায়িত জনের নিজস্ব প্রতিবাদ আরোপিত কাঠামোকে বিদ্রূপে-শ্লেষে-হাসির তরঙ্গে বিদ্ধ করে। ক্রিস্টফার স্টোন তাঁর Parody নামক বইতে মন্তব্য করেছিলেন: ‘ridicule is society’s most effective means of curing inelasticity. It explores the pompous, corrects the well-meaning eccentric, cools the fanatical and presents the incompetent from achieving success. Truth will prevail over it, falsehood will cower under it.’ (১৯৯৪: ৮)। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মন্তব্য। বাখতিনের কার্নিভাল বিষয়ক তত্ত্ববীজে এই ভাবনা আরও গভীর ও সুদূরপ্রসারী হয়ে পরিহাসকে অনেকার্থদ্যোতক করে তুলেছে। সমাজের নিচুতলার যে-পরিসরে সাধারণত আলো পড়ে না, তাদের জনপ্রিয় উৎসব-হুল্লোড়-মজা-পরিহাসের মধ্যেও যে প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে বৃহত্তর সমাজের পক্ষে আবশ্যিক শুদ্ধীকরণের কৃৎকৌশল—তা সাধারণভাবে নজরে পড়ে না। যেখানে গর্বোদ্ধত আধিপত্যবাদীরা নিজেদের বীক্ষণ ও প্রকাশে কোনো ধরনের পরিবর্তন মেনে নিতে চায় না এবং ফলে নিজেদের বিভিন্ন প্রতিবেদনকে চরম রক্ষণশীল অচলায়তনে পরিণত করে—সেখানে ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে সর্বতোভাবে মুক্ত পরিসরের সূত্রধার নিম্নবর্গীয় সমাজ। সামাজিক আয়তনের অনমনীয়তা ব্যাধির মতো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে গতির আকল্পগুলিকে পরাভূত করে এবং পঙ্গুতা হয়ে ওঠে সর্বগ্রাসী। ঐ অনমনীয়তার প্রতিষেধক হিসেবে দেখা দেয় কার্নিভালের হাসি। উচ্চবর্গীয় বয়ানের অলঙ্কৃত ও প্রসাধিত অবয়ব যে দুর্বল ও শিথিল মুখোশমাত্র, ঐ সত্য উদ্ঘাটিত করে দেয় কার্নিভালের কৃৎকৌশল। যে-সমস্ত পরিসরে আরোগ্য বিধান সম্ভব, সেখানে অশুদ্ধতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী হতে পারে নিম্নবর্গীয় লোকবৃত্ত থেকে উৎসারিত চেতনার প্রতিস্রোত।

 প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোেধ যে গড়ে তুলতে পারে কার্নিভাল, তার কারণ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরম্পরা থেকে বিচ্ছেদ রচনা করে কর্তৃত্ববাদীরা। পর্যায়ে পর্যায়ে অত্যন্ত সুকৌশলে, প্রচারের চাতুর্যে, মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থানুকূল প্রবণতাকে সর্বজনীন বলে উপস্থাপিত করে তারা। তবু উদ্ভাসনের আতিশয্য সত্ত্বেও মিথ্যার এই প্রগল্‌ভতাকে ধরিয়ে দিতে পারে কার্নিভাল। কেননা ঐতিহ্যের চিরায়তনে লোকসমাজের শিকড় অত্যন্ত দৃঢ়, সাময়িক আঁধি সত্ত্বেও সেখানে ব্যাপক বিচ্ছেদের কোনো অবকাশ নেই। বাখতিন যাকে ‘collective ancestral body of all the people’ (১৯৮৪: ১৯) বলেছেন, ব্যতিরেকী দৃষ্টিভঙ্গির উৎস সেখানেই। ষোল শতকে রচিত রাবেলের উপন্যাসে তিনি যে জনপ্রিয় উৎসব-মুখরতার ওপর সর্বাত্মক নির্ভরতা লক্ষ করেছেন, তাতে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অর্জিত সামূহিক বয়ানের পরম্পরার প্রতি মান্যতা ফুটে উঠেছে। গোষ্ঠীগত ধারাবাহিকতার বোধ ছাড়া এই মান্যতা সম্ভব নয়। কার্নিভালমূলক চিত্রকল্প ও চিহ্নায়কের বিপুল ভাণ্ডার থেকে রাবেলে ঋণ গ্রহণ করেছেন এবং মধ্যযুগের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির রুদ্ধতার বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করেছেন। জনপ্রিয় আনন্দ ও ইতিবাচকতার প্রেরণা হিসেবে বাখতিন শারীরিক অনুষঙ্গের বস্তুতান্ত্রিক স্বভাবের বিশেষ গুরুত্ব লক্ষ করেছেন। বিমূর্তায়নের প্রতি উচ্চসংস্কৃতির যে ঝোঁক রয়েছে, এর কারণ একে মনস্তাত্ত্বিক প্রেরণায় অভিজাত বলে ধরে নেওয়া হয়। কৃত্রিম নির্মিতির প্রতি একরৈখিক আনুগত্য থাকায় অকৃত্রিম স্বতঃস্ফূর্ত শারীরিক অভিব্যক্তির বস্তুতন্ত্রকে উচ্চসংস্কৃতি চিরকালই তাচ্ছিল্য দেখিয়েছে এবং অবদমিত করেছে। রাবেলে মূলত এই অবদমনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিকল্প নন্দন ও বিকল্প প্রতিবেদনের প্রস্তাবনা করেছিলেন। বাখতিন তাঁর বইতে নিঃসন্দেহে এমন-এক নন্দনের কথা জানিয়েছেন যা ‘celebrates the anarchic, body-based grotesque elements of popular culture, and seeks to mobilize them against the humanless seriousness of official culture.’ (ডেন্‌টিথ: প্রাগুক্ত: ৬৬)।

 জনপ্রিয় সংস্কৃতির মধ্যে ইন্দ্রিয়ঘন দৈহিকতা ও উদ্ভট উপাদানের প্রতি যে আকর্ষণ দেখা যায়, তাতে নৈরাজ্যের বৈশিষ্ট্য থাকলেও সরকারি মনোভঙ্গি প্রত্যাখ্যানের তাগিদই আসল। প্রতিবাদী নন্দন গড়ে ওঠে এই প্রবণতা থেকেই। উদ্ভট বা আতিশয্য লোকবৃত্তে নিহিত অসঙ্গতির প্রমাণ নয়, এদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি বয়ানের বিরুদ্ধে হাসিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে গণমন। ‘Grotesque realism’ নামক বিশেষ পারিভাষিক শব্দবন্ধ দিয়ে রাবেলের রচনাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বস্তুতন্ত্র ও শারীরিক অনুষঙ্গের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে দেখানো হয়েছে কীভাবে এরই প্রভাবে লিখনশৈলী কার্নিভালীকৃত হয়ে যায়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর করার মধ্য দিয়ে যে ধরনের জৈবিক বৃত্তি ব্যক্ত হয়, তাকে আড়াল করার পরিবর্তে কার্নিভাল-অনুপ্রাণিত লেখক শারীরিক উপস্থিতিকে যেন উৎসবে রূপান্তরিত করেন। এইজন্যে লেখককে সতর্ক মাপজোখ ও পরিশীলনের পথ ছেড়ে দিয়ে আদিমতা, আতিশয্য ও উদ্ভটের পথ গ্রহণ করতে হয়।

 তাই বাখতিনকে লিখতে হয়েছে: ‘The essential principle of grotesque realism is degradation.’ (তদেব: ১৯)। তবে এই আপাতস্থূলতা বা অবনমন নিছক নেতিবাচক প্রক্রিয়ামাত্র নয়। খনি থেকে তুলে-আনা আকাটা হিরের মতো লোকায়ত জীবনে উদ্ভট ও অসঙ্গত বলে প্রতীয়মান বস্তু আসলে মূল্যবান চিহ্নায়ক। এই বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় যে প্রসাধন ও পরিচ্ছদের আড়ম্বর আমাদের বিভ্রান্ত করে। মানুষ মূলত বিমূর্ত ও বায়বীয় নয়; রক্ত-মাংস-হাড়-মজ্জার বাস্তবতাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। তাই বিমূর্তায়নের ‘অভিজাত’ পথ অনুসরণ না করাতে আপাত-দৃষ্টিতে যে অবনমন ঘটেছে, তা ইতিবাচক অস্তিত্বের ঘোষণা। ইতিবাচক এইজন্যে বলছি যে কার্নিভালের উৎসাহ ও সজীবতা লালিত চিত্রকল্পে ও চিহ্নায়কে মানুষের নির্মল ও অকৃত্রিম অস্তিত্ব পুনর্জীবিত ও পুনর্নবায়িত হয়ে থাকে। রাবেলের রচনায় এটাই ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যের পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে আমরাও অনুরূপ সিদ্ধান্তে আসতে পারি।

 তথাকথিত শিষ্ট সাহিত্য যখন স্পর্শভীরু দূরত্বে গিয়ে কোলাহল-মুখর জনারণ্য সম্পর্কে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে, কার্নিভালের উপাদান সব নিষেধের গণ্ডি ভেঙে দেয়। হাটে-বাজারে, জনারণ্যে যেসব ভাষা ও ভঙ্গি প্রচলিত, তাদের স্বচ্ছন্দে বয়ানে নিয়ে আসে। উচ্চসংস্কৃতির অহংকার ও শুচিতাবোধ চূর্ণ করে যেন পাতাল থেকে তুলে আনে লোকায়ত জীবনের সুপ্ত প্রস্রবণ। অপরিচিতকে পরিচিত করার ফলে প্রেক্ষিত ও প্রসঙ্গের মধ্যে অজস্র বিনিময় ও বিকল্পায়ন যুগপৎ সম্ভব হয়ে ওঠে। প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসগুলির মধ্যে অন্তর্ঘাত করে নানা ধরনের প্রতিন্যাস। পুরোনো আকরণ এমন ভাবে বিনির্মিত হয়ে যায় যে পাঠকৃতির বহির্বৃত ঐক্য ধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আবার পরক্ষণেই জেগে ওঠে অভিনব পুনর্নির্মাণের সম্ভাবনা। ইতিহাসকে যারা ভয়াবহ ভাবে খণ্ডিত করতে চাইছিল, তাদের চক্রান্ত প্রতিহত করে কোনো জনগোষ্ঠীর সার্বিক ইতিহাসের অসামান্য ব্যাপ্তি ও গভীরতা ব্যক্ত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় কার্নিভালের হাসি ও শ্লেষ অভাবনীয় তাৎপর্যের দ্যোতনা বয়ে আনে। সরকারি অবস্থানের উদ্ধত একমাত্রিকতা ও সীমাবদ্ধতা জনিত নিরানন্দ পরিসর কার্নিভালের ধারাবাহিক উপস্থিতিতে কেটে যেতে থাকে। সুতরাং একটু আগে যাকে অবনমন বলেছি, তা আসলে প্রতীয়মান মাত্র; অমোঘ ও নিবিড় দ্বিবাচনিকতার সূত্রে জীবন পুনরাবিষ্কৃত হয় বলেই আমরা বরং লক্ষ করি ঊর্দ্ধায়নের প্রক্রিয়া! তবে তাকে অনুভব করতে হয় কার্নিভালের দ্বিবাচনিক উদ্ভাসনের সূত্রে। সরকারি অবস্থান যেহেতু চরিত্রগত ভাবে আধিপত্যবাদী, জগৎ ও জীবনের একবাচনিক আকল্প চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তা প্রবল উৎসাহী ও অনমনীয়। এর মোকাবিলা করায় লোকসমাজের উদ্যম এইজন্যে সাংস্কৃতিক রাজনীতির আওতায় পড়ে।


চার

ডস্টয়েভস্কির নন্দন সংক্রান্ত আলোচনায় বাখতিন দ্বিবাচনিকতার পরম্পরার উৎস খুঁজে পেয়েছেন সুদূর অতীতে, যখন লোকবৃত্ত থেকে স্বত-উৎসারিত শ্রুতি সাহিত্য আদিম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরের অজস্র উপাদান বয়ে নিয়ে যেত মোহনার দিকে ধাবমান স্রোতধারাকে পুষ্ট ও ঋদ্ধ করার জন্যে। তিনি লক্ষ করেছেন, সক্রেটিসের দ্বিরালাপমূলক প্রতিবেদনে এই প্রক্রিয়ার আদি সংরূপ পাওয়া যাচ্ছে। লোকায়ত কার্নিভাল দ্যোতক বিতর্ক থেকে সক্রেটিস তাঁর দ্বিরালাপ গড়ে তোলার প্রেরণা পেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে বাখতিনের মন্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ: ‘Folk-carnival debates between life and death, darkness and light, winter and summer etc. permeated with the pathos and change and the joyful relativity of all things, debates which did not permit thought to stop and congeal in an one-sided seriousness or in a stupid fetish for definition or singleness of meaning—all this lay at the base of the original core of the genre’. (১৯৮৭: ১৩২)। এই বক্তব্য অন্তত দার্শনিকতা ও তাৎপর্যের অনেকান্তিকতার ওপর উদ্ভাসনী আলো নিক্ষেপ করে। বহুস্বরিক উপন্যাসের ‘কার্নিভাল’ শিকড় সম্পর্কিত তাঁর আলোচনায় প্রকাশ-মাধ্যমের ঐ মৌল কেন্দ্রের ভিত্তি সম্পর্কিত ধারণা বিশদ করা হয়েছে। বাখতিন প্রাগুক্ত মন্তব্যে আরও জানিয়েছেন, ‘This distinguishes the Socratic dialogue from the purely rhetorical dialogue as well as from tragic dialogue.... The Socratic discovery of the dialogic nature of thought, of truth itself, presumes a carnivalistic familiarization of attitudes toward the object of thought itself, however lofty and important, and toward truth itself.’ (তদেব)। এই যে বলা হলো চিন্তার উদ্দিষ্টের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কার্নিভালসুলভ পরিচিতীকরণ—তাতে আসলে আরোপিত আভিজাত্যের প্রত্যাখ্যান ও প্রতিষেধ বোঝানো হলো। শেষ পর্যন্ত মূল প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে, সত্য কী এবং সত্যে পৌঁছানোর পথ-ই বা কী!

 সত্য-সম্পর্কিত মানুষের চিন্তা এবং সত্য সন্ধানের পদ্ধতি স্বভাবে দ্বিবাচনিক—এই কেন্দ্রীয় উপলব্ধির সূচনা করেছিলেন সক্রেটিস, বাখতিন তা লক্ষ করেছেন। সক্রেটিসের ভাবনাবিশ্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে সত্য সন্ধানের প্রকরণ সরকারি একবাচনিকতার প্রতিস্পর্ধী। নির্দিষ্ট কোনো সত্যের উপর নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির দখলদারি অগ্রাহ্য করে সক্রেটিস জানিয়েছিলেন, কোনো ব্যক্তি-মানুষের মস্তিষ্কে সত্য জন্ম নেয় না কিংবা তাকে সেখানে খুঁজেও পাওয়া যায় না। তাঁর মতে ‘it is born between people collectively searching for truth, in the process of their dialogic interaction.’ (তদেব: ১১০)। সত্যের সামূহিক সন্ধান যেহেতু মূর্ত সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে সম্ভব, লোকায়ত জীবনের অনভিজাত স্বতঃস্ফূর্ততায় উদ্ভূত হতে পারে অনেকার্থ-দ্যোতনার প্রক্রিয়া। জনপ্রিয় সংস্কৃতির মধ্যে যে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভট উপাদান থাকতে পারে, তা আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করেছি। ঐসব উপাদানের অতিব্যক্ত শারীরিক অনুষঙ্গ ও আতিশয্য থাকা সত্ত্বেও এদের অপরিহার্য বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই জগতের পদে পদে দ্বৈততা ও দ্বিচারিতা রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে আত্মবিদারক শ্লেষ ও বলিষ্ঠ পরিহাস। সর্বব্যাপ্ত উন্মুক্ততায় সবই মানিয়ে যায় কেননা এদের সবচেয়ে বড়ো শক্তি প্রচ্ছন্ন রয়েছে অকৃত্রিমতায় ও সাবলীলতায়। বস্তুত কার্নিভালের প্রধানতম শক্তি এখানেই যে, তা হলো ‘a site in which multiple cultural forms combine’ (ডেন্‌টিথ: ১৯৯৫: ৭০)। এই স্থিতিস্থাপকতা একবাচনিক সরকারি প্রতিবেদনে অকল্পনীয়।

 বাখতিন যে কার্নিভালের হাসিকে পুনর্জীবন দানে সক্ষম ইতিবাচক শক্তি হিসেবে ভেবেছিলেন, তার যাথার্থ্য আমাদের পাঠঅভিজ্ঞতা দিয়ে সমর্থন করা সম্ভব। বাখতিনের রাবেলে পাঠ আমাদের প্রচুর ব্যঞ্জনা-গর্ভ চিন্তাসূত্র উপহার দিয়েছে। আপাতত নতুন দৃষ্টান্ত আহরণ না-করে আমরা লক্ষ করতে পারি, কোনো পাঠকৃতির অন্তর্বয়নে নিহিত অন্যোন্য-সম্পর্কগুলি বৌদ্ধিক আভিজাত্য দিয়ে পুরোপুরি নির্মিত হয় না। প্রতিটি পাঠকৃতিকে ঘিরে রাখে যে দৃশ্য ও অদৃশ্য সাংস্কৃতিক বলয়, তার লোকায়ত উৎস খুঁজে নিতে পারলে বুঝব, কার্নিভালের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিচ্ছুরণ পাঠকৃতির কতটা গভীরে সঞ্চারিত হতে পারে। এই বিচ্ছুরণ আসলে বয়ানের ‘historical density’-এর প্রমাণ।

 এই প্রসঙ্গে অবশ্য বাখতিন-বিশেষজ্ঞদের নধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। একটু আগে যাকে কার্নিভালের বিচ্ছুরণ বলেছি, তার পরিধি কতদূর ব্যপ্ত কিংবা কর্তৃত্ববাদ-বিরোধিতাকে কী কী ভাবে ব্যাখ্যাকরা সম্ভব, এ বিষয়ে বিতর্কের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। রাবেলে-পাঠ কি আসলে স্ট্যালিনের জমানায় সরকারি মতবাদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে ব্যবহৃত প্রত্যাঘাত? কার্নিভালের হাস্য পরিহাস যেভাবে চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্দেরা দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল, তেমনি বাখতিনও কি মধ্যযুগীয় সাহিত্যপাঠের অজুহাতে সমসাময়িক স্ট্যালিনপন্থী প্রাতিষ্ঠানিকতাকে বিদ্রূপে বিদ্ধকরার অস্ত্র তুলে দিতে চাইছিলেন সাধারণ মানুষের হাতে? এইসব প্রশ্নও স্পষ্টত সমসাময়িক ইতিহাস নিষ্পন্ন। এটা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রতীচ্য দুনিয়ায় বাখতিন যাদের মধ্যে দিয়ে আবিষ্কৃত ও বিশ্লেষিত হয়েছেন, তারা সাধারণভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরোধী এবং মার্ক্সবাদেরও প্রতিপক্ষ। যেহেতু ইংরেজি-জানা তৃতীয় বিশ্বের কাছে বাখতিন এদের দ্বারাই পরিবেশিত হয়েছেন, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁর চিন্তাবিশ্বের ভাষ্যসমূহ গ্রহণ করতে হয় আমাদের। কেননা এইসব ভাষ্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীদের রণকৌশল সম্পৃক্ত সত্যের রাজনীতি।

 উমবের্তো একো ভিন্ন-একটি প্রসঙ্গে আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন অতিভাষ্যের বিপদ সম্পর্কে, সেকথা মনে পড়ে। লোকায়তের প্রতিস্পর্ধাকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করি, এরকম মনে হয় না যে বাখতিন সত্য উচ্চারণের জন্যে কোনো মধ্যযুগীয় সাহিত্যিককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবেন। সক্রেটিসের দ্বিরালাপ মূলক বাচনিক পদ্ধতিকে যিনি পুনরাবিষ্কার করে মার্ক্সীয় দ্বন্দ্ববাদকেই আরও একটু বিকশিত ও প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন, তিনি কার্নিভালকেও প্রান্তিকায়িত লোকসমাজের নান্দনিক প্রতিরোধমূলক পুনর্নির্মাণের কৃৎকৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অতএব বাখতিনের রাবেলে বিষয়ক বইটিকে পড়তে হবে ‘As a hidden polemic against the regime’s cultural politics’—সাইমন ডেনটিথের এই মন্তব্যে আমাদের সায় নেই। কিংবা হাসি ও কৌতুককর রচনা সামাজিক দ্বন্দ্ব ও আততির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া রোধ করার একটি কৌশলমাত্র, বলশেভিক বুদ্ধিজীবী লুনাচারস্কির এই ব্যাখ্যা বাখতিনকে কার্নিভালের ধারণা তৈরি করতে কিছুটা প্রভাবিত করেছিল—এই মন্তব্যও সঠিক মনে হয় না। কেননা একটু আগেই আমরা লক্ষ করেছি, গ্রিক শ্রুতিসাহিত্য যখন লিখিত সাহিত্যে রূপান্তরিত হচ্ছিল, সেইসময়কার প্রান্তিক লোকসমাজের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ থেকে সক্রেটিসর দ্বিরালাপ গড়ে উঠেছিল। সঞ্চরমান লোকশ্রুতির বিপুল সমৃদ্ধি থেকে কীভাবে যুগে যুগে গড়ে ওঠে। উচ্চবর্গীয় সাহিত্যিক প্রতিবেদনের বিভিন্ন ধারা—তা বাখতিনের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। রাবেলে-পাঠ এই প্রক্রিয়ারই ফসল।

 ব্যক্তিগত জীবনে যাই ঘটে থাকুক, বাখতিনের মতো মৌলিক চিন্তাবিদ কখনও বিরূপ অভিজ্ঞতার বৌদ্ধিক প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে নিজের মননবিশ্বকে সংগঠিত করেন না। অতএব সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিরক্ত হয়ে ‘inplict rejoinder’ (তদেব) হিসেবে কার্নিভাল প্রণোদিত উদ্ভট বাস্তবতাবাদের বয়ান তৈরি করেছিলেন—এই অভিমত নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়। তাঁর চিন্তাজীবনের প্রধানতম আধেয় ও অবলম্বন যে দ্বিবাচনিকতার দর্শন, তারই প্রেরণায় কর্তৃত্ববাদ ও একবাচনিকতার যথার্থ বিকল্প হিসেবে তিনি অভিন্ন চিন্তাবীজের প্রস্তাবনা করেছিলেন। মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে নয়, তাকে আরও সংহত পরিশীলিত ও পূর্ণতর করে তোলার জন্যে বাখতিন লোকসমাজের অনাবিল জীবনপ্রবাহে নিহিত প্রতিরোধ ও বিকল্পয়ানের অমিত শক্তির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। প্রান্তিকায়িত অপর পরিসরের সমবায়ী উপস্থিতিকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়ার জন্যেই সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা পত্তন হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক পুনর্নির্মাণের পর্যায়ে এই অপর পরিসর নিরবিচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম পরিচালিত করে কর্তৃত্ববাদের শেষ প্রচ্ছায়াও মুছে নেবে, এই ছিল ঈপ্সিত। কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠন ও রাষ্টের সমীকরণ যদি সম্পন্ন না হয়, অপর পরিসরের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই হবে ইতিহাসের কাছে দায় পালন। কার্নিভালের হাসি-শ্লেষ-কৌতুকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শুদ্ধীকরণের নিষ্কর্ষই আজ লক্ষ করতে হবে আমাদের। তাই আবারও লিখছি, বাখতিনের মতো অনন্য মানুষ প্রচ্ছন্ন ভাবেও ব্যক্তিগত বৌদ্ধিক প্রতিশোধ স্পৃহা মেটানোর জন্যে কোনো কিছু করতে পারেন না। তাছাড়া তাঁর লিখনবিশ্ব কিংবা চিন্তাবিশ্বের সরলীকৃত ব্যাখ্যা বা তাদের সম্পর্কে পূর্বনির্ধারিত ধারণার নিরিখে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অর্থ হলো বাখতিনের প্রতি চরম অবিচার।


পাঁচ

প্রতীচ্যের দুর্ধর্ষ পণ্ডিতেরা যেহেতু এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় বৌদ্ধিক সেনাপতি, বাখতিনের চিন্তাপ্রণালী থেকে বৈপ্লবিক নিষ্কর্ষ মুছে নেওয়ার জন্যে তাঁদের আগ্রহ স্বাভাবিক। সমস্যা হলো, তাঁদের বিশ্লেষণের পেছনে যে সাংস্কৃতিক রাজনীতি রয়েছে—সে-বিষয়ে অভিনিবেশ না-দিয়ে অনেক প্রগতিপন্থী আলোচক (প্রতীচ্যে এবং এদেশে) বাখতিনকে খারিজ করতে চান। কার্নিভালের তত্ত্ববীজ যেহেত প্রান্তিকায়িত বর্গের সাহসী প্রত্যাঘাত বলে বিবেচিত হতে পারে, এর অপব্যাখ্যা সবচেয়ে বেশি হয়েছে। বাখতিন কেন লোকসমাজকে জগৎসম্পর্কিত দ্বিতীয় (অর্থাৎ বিকল্প) সত্যের ভাণ্ডারী বলেছেন, এর তাৎপর্য গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। হলক্যুইস্টের মতো প্রসিদ্ধ বিশেষজ্ঞ কেন বাখতিনের কার্নিভাল সম্পর্কিত বিশ্লেষণে ‘a strong element of idealization, even utopian visionariness’ (১৯৮৪: ৩১০) দেখতে পান—তা বোঝা খুব একটা শক্ত নয়। যিনি সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দ্বান্দ্বিক সংগ্রামকে তাচ্ছিল্যসূচক চিহ্ন (ঊর্ধ্বকমাযুক্ত struggle: তদেব) দিয়ে উপস্থাপিত করেন, লোকসমাজের সমৃদ্ধ সাহিত্যিক বয়ানকে নস্যাৎ করার জন্যে তিনি বাখতিনের দৃষ্টিভঙ্গিকে আদর্শায়িত বলবেন—এটাই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, ‘Bakhtin consistently idealises the folk as an untamable, rebellious, and regenerative force that will destroy the status quo, but from the ashes will rise newer and finer worlds.’ (তদেব: ৫১০-৫১১), এমন যদি ভেবে থাকেন বাখতিন, তাকে বিশেষজ্ঞ ‘আদর্শায়ন’ বলে লঘু করছেন কেন? স্থিতাবস্থা যেহেত চিরকাল আধিপত্যবাদের স্বার্থরক্ষার পক্ষে সহায়ক, কার্নিভাল তো সেখানেই আঘাত করবে। আর এটাই তার ‘রাজনৈতিক’ অন্তঃসার। বহু শতাব্দীব্যাপী শোষণ রুশ সমাজকে কতটা নিরেট ভাবে একবাচনিক করে তুলেছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। ১৯১৭ সালে শুরু হয়েছিল চির-উপেক্ষিত অন্তেবাসী জনের ক্রমিক ঊর্ধ্বায়ন। কার্নিভাল এই দুরূহ প্রক্রিয়ার ইতিহাস-নির্দিষ্ট তত্ত্ববীজ: এই সত্য অস্বীকার করার অর্থ হলো বিপ্লব-পূর্ববর্তী আধিপত্যবাদী শক্তির সমর্থন-যোগানো যুক্তিশৃঙ্খলা তৈরি করা।

 রাবেলেকে উপলক্ষ করে পরিবর্তনের ভাবাদর্শ ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রতি বাখতিন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই সূত্রে পাঠকৃতি আর বাচনও যে বিশেষ মনোযোগের আকর, তা তাঁর বয়ান থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বস্তুত রাবেলে-পাঠে কার্নিভাল ও উদ্ভট বাস্তবতাবাদ দুটি গৌণ পাঠ হিসেবে গণ্য। কার্নিভাল হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও শেষোক্তটি হলো সাহিত্যিক প্রকরণ। প্রতিবেদনে সামাজিক ও সাহিত্যিক নিষ্কর্ষ ও উপাদান কীভাবে মিথষ্ক্রিয়ার আকর, বাখতিন তা দেখিয়েছেন। সেই সঙ্গে সামূহিক ভূমিকায় নিষ্পন্ন লোকায়ত জীবন-চর্যা ও সক্রিয়তা এবং শারীরিক প্রকরণগুলির অর্থবহত্বও বিশ্লেষণ করেছেন। উচ্চ সংস্কৃতি ও নিম্ন সংস্কৃতির চিরাগত ব্যবধানকে সরকারি ও বেসরকারি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের সূত্রে ব্যাখ্যা করে প্রতাপের পীড়ন ও অবদমনকে তিনি বাচনের সোচ্চার ও নিরুচ্চার, উদ্ভাসিত ও নিরালোক পরিসরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়েছেন। কর্তৃত্ববাদের দ্বারা অনুমোদিত ভাষা, সত্য, নৈতিকতা ও উপস্থাপনা যদিও ধারাবাহিক ভাবে ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, বাখতিন দেখিয়েছেন কীভাবে প্রতিটি স্তরে প্রচ্ছন্ন থাকে কর্তৃত্ববাদের প্রতিস্পর্ধী হাসি ও কৌতুক—‘A boundless world of humourous forms’ (১৯৮৪: ১১)। একমাত্রিক, একরৈখিক ও একবাচনিক রুদ্ধ জগতের সর্বাত্মক আরোপের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবাদ মূলত প্রান্তিক সমাজ থেকেই উঠে আসে। এটাই মানুষের ইতিহাস, তার সংস্কৃতির ইতিহাস।

 বাখতিন জানিয়েছেন: ‘every age has its own norms of official speech and propriety. And every age has its own type of words and expressions that are given as a signal to speak freely, to call things by their own means, without any mental restrictions and euphemism.’ (তদেব: ১৮৮)। এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে বাখতিন রাবেলেকে উপলক্ষ করে মূলত সমসাময়িক রাশিয়া সম্পর্কে এই কথাগুলি বলেছিলেন। হোমার-ভার্জিল-দান্তে-শেক্সপীয়র-গ্যয়ঠে এবং এঁদের মতো অন্য সব কালোত্তর স্রষ্টার সমকালে সরকারি বয়ান ও বিধিবিন্যাস অবশ্যই প্রকট ছিল। কিন্তু প্রতিভার অর্থই হলো সমস্ত রুদ্ধ পরিসরের বিনির্মাণ করে মুক্ত বাচনের প্রতীতিতে পৌঁছানোর ক্ষমতা। এঁদের প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো ভাবে সমকালীন জনসমাজের সামূহিক বাচন থেকে সৃষ্টির উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, সমান্তরালভাবে উপস্থিত অপর পরিসরের উপকরণ দিয়ে তাঁরা প্রচলিত সরকারি বয়ানের রুদ্ধতাকে প্রতিহতও করেছেন। নইলে চিন্তা ও অনুভূতির নবীন স্থাপত্য গড়ে উঠতে পারত না।

 ১৯১৭-এর পূর্ববর্তী রাশিয়ার সাহিত্যে পুশকিন-টলস্টয়-ডস্টয়েভস্কি-গোগোল-টুর্গেনিভ প্রমুখ স্রষ্টা জারতন্ত্রের সরকারি বয়ানকে প্রতিহত করেই নিজেদের স্বতন্ত্র অভিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় গোর্কি কি তখনকার সরকারি বয়ানকে অন্ধভাবে অনুগত্য দেখিয়ে গেছেন? আধিপত্যবাদের কাছে সমর্পিত সাহিত্য-সমালোচকেরা যা-ই বলুন না কেন, বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় যে-ভাবাদর্শ বহুস্বরিক ও অনেকার্থদ্যোতক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে—সর্বাত্মক মুক্তি-ই তার অন্বিষ্ট। ইতিহাসের চলমান ধারাকে যারা রচনা করে আবার নিজেরাই ঐ ধারা দ্বারা রচিত হয়—সেই প্রান্তিকায়িত নিম্নবর্গজনের নিত্যজায়মান প্রতিবেদন ভাবাদর্শকে কখনও রুদ্ধ হতে দেয় না। প্রতিভাবান স্রষ্টারা এই প্রক্রিয়াকে সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে অনুধাবন করেন বলেই সমসাময়িক সরকারি বয়ান তাদের চেতনাকে গ্রাস করতে না পারে না কখনও। কার্নিভালের সূক্ষ্ম ও নিবিড় উপস্থিতি তাদের সঞ্জীবিত রাখে। পুশকিন বা ডস্টয়েভস্কির ক্ষেত্রে তা যতটা সত্য, গোর্কি ও ব্রেখটের ক্ষেত্রে ততটাই সত্য। শুধু নিজস্ব সময়ের অভিঘাতে তাদের পথ পরস্পর-ভিন্ন।

 বিভিন্ন উৎস-জাত প্রতিবেদনের মধ্যে যে-সব সীমান্ত সাধারণভাবে স্বীকৃত, কার্নিভাল তাদের মান্যতা দিতে অস্বীকার করে বলে সমাজের অবতল থেকে উঠে-আসা উপাদানের অভিঘাতে সেসব ক্রমাগত ভেঙে যায়। তত্ত্ববস্তু, অবভাস ও মূল্যমানের মধ্যে প্রচলিত অনড় সরকারি জলবিভাজন রেখা মুছে যায় ক্রমশ। বিভিন্ন শব্দের আন্তঃসম্পর্ক ও বাচনিক অভিব্যক্তির মধ্যে নতুন ধরনের দোলাচল দেখা দেয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক জগতের হওয়া ও হয়ে ওঠা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা, শ্লেষ ও বিষাদের মতো আপাত-বিপরীত প্রবণতাকেও অন্যোন্য-সম্পৃক্ত করে তোলে। ফলে পাঠকৃতির আস্তিত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যা নতুনভাবে নির্ধারিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। সরকারি বয়ানের রক্ষণশীলতায় যেসব অপূর্ণতা ও রুদ্ধতা অনাবিষ্কৃত ছিল, সেসব উদ্ঘাটিত হতে থাকে। আর, পাঠকৃতির মধ্যে অজ্ঞাতপূর্ব মুক্ত পরিসরের অস্তিত্ব প্রকট হতে শুরু করে। আভিজাত্য ও প্রতাপের মায়ায় মুগ্ধজনদের কাছে এই সত্য উন্মোচিত হয় যে—‘all peoples…have enormous spheres of speech that had not been made public and are non-existent from the point of view of literary written language.’ (তদেব: ৪২১)। লিখিত ভাষার যে মান্যতাপ্রাপ্ত সংরূপকে ‘সাহিত্যিক’ বলা হয়ে থাকে, সেই সাহিত্যিকতার স্বেচ্ছাকৃত নির্মিতি পুনরাবৃত্ত অভ্যাসে পরিণত হওয়ার ফলে কখন তা একবাচনিক মিথ্যার স্থাপত্য হয়ে উঠেছে, আমরা লক্ষই করি না। বরং তার অভিজাত অবস্থান থেকে অজ্ঞাত জীবনের বিপুল পরিধিকে মনে করি অস্তিত্বহীন। যাবতীয় অপর পরিসর ঐ সাহিত্যিকতার কাছে পুরোপুরি অবান্তর হয়ে পড়ে।

 তাই সেই পরিসর থেকে যখন আশ্চর্য বৈচিত্র্যযুক্ত বাচনের উপস্থিতি অপ্রত্যাশিতভাবে আবিষ্কৃত হয়, সযত্নরচিত সুবিধাজনক সামঞ্জস্যের বোধ আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়। আরোপিত গাম্ভীর্যের প্রতিষেধক হিসেবে যেন হাসি-পরিহাস-শ্লেষ-উদ্ভট আতিশয্য-প্রবণ গণআঙ্গিক ব্যবহৃত হয়। কার্নিভাল-চেতনাই এদের তাৎপর্যের নিয়ামক! এদের মধ্যে কোনো আনুগত্য বা চাহিদা থাকে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবন-প্রণালীর স্বতঃস্ফূর্ত হর্ষ-পুলক থেকে এদের উদ্ভব বলে গণমানসের মুক্ত পরিসরে যেন ‘আমরা সবাই রাজা’। প্রত্যেকেই কার্নিভালের নির্মাতা, আসলে প্রত্যেকেই স্বয়ং কার্নিভাল। যতক্ষণ কার্নিভাল আছে, এর বাইরে অন্য কোনো জীবন থাকে না। কার্নিভালের সময়ে ও পরিসরে জীবন নিজের নিয়ম নিজেই তৈরি করে। সেই নিয়ম স্বাধীনতার, মুক্তির, বাধাবন্ধনহীনতার। তাই বাখতিন বলেছেন: ‘Carnival is not a spectacle seen by the people; they live in it, and every one participates because its very idea embraces all the people.’ (১৯৮৪: ৩০০)। অর্থাৎ প্রান্তিক পৌরসমাজে কার্নিভাল-চেতনা সর্বত্র ও সর্বদা উপস্থিত। কোনো-একটি নির্দিষ্ট উৎসবে তাই তা সম্পৃক্ত নয়।

 বিস্ময়বোধ সৃষ্টির নিত্যনবায়মান ক্ষমতা কার্নিভালের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বিস্ময়ের প্রবল শক্তিতে তা আস্তিত্বিক অনেকার্থদ্যোতনার বার্তা বয়ে আনে। সরকারি বয়ানে বিস্ময়ের কোনো অবকাশ নেই। চিরন্তন, অবিচল, চরম, অপরিবর্তনীয় প্রভৃতি বর্গের মধ্যে লোকমন শুধু পীড়নের অজুহাত খুঁজে পায়। তাই কার্নিভালের হাসি দিয়ে এইসব ধারণায় হস্তক্ষেপ করে পরিবর্তন-পুনর্নবায়ন-মুক্তি-চূড়ান্তহীনতার আনন্দকে চিন্তাপ্রণালীতে ও প্রতিবেদনে প্রতিস্থাপিত করে। রাবেলের ভাববিশ্ব থেকে সূত্র নিয়ে বাখতিন কার্নিভালের যে-সমস্ত অনুষঙ্গকে নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের মধ্যে সময়ের প্রকল্প সম্পর্কিত ধারণা লক্ষ করার মতো। সময়ের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ আধিপত্যপ্রবণ ভাবাদর্শসমূহ যেসব অনমনীয়, নিয়মতান্ত্রিক ও রুদ্ধ পরিসর ঐতিহাসিক আকল্পদের আরোপ করে থাকে—কার্নিভালের সময়-ভাবনা তা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এতে নেতিবাচক পলায়নমনস্কতা নিহিত রয়েছে। কেননা কার্নিভাল অনাবিল ও সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা দিয়ে সময়কে পুনরুজ্জীবিত করতে চায় এবং ইতিহাসকেও মুক্তি দেয় আরোপিত আকরণের প্রতি অনুগত্য থেকে।

 বাখতিনের কার্নিভাল-মূলক ভাবনা নিঃসন্দেহে আমাদের সাহিত্যিক ও সামাজিক প্রতিবেদনের নতুন পাঠে প্রাণিত করে। সার্থক উপস্থাপনায় কীভাবে প্রচ্ছন্ন থাকে বহুরৈখিকতা ও অজস্র অন্তর্বয়ন, তা আবিষ্কারের নতুন নতুন পথ আমরা খুঁজে নিতে পারি। শুধু সরকারি ও বেসরকারি ভাবাদর্শের গ্রন্থনাই নয়, আমরা লক্ষ করতে শিখি বাচনের প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন দ্বিরালাপের উৎস ও বিস্তারের পটভূমিও। নানা ধরনের আততিপূর্ণ উপন্যাসের বয়ানেও খুঁজতে শিখি কার্নিভালের লোকায়তদ্যুতি, শ্লেষ-পরিহাসের প্রতিভাবাদর্শ ও প্রতিসন্দর্ভের প্রত্যাঘাত। আরোপিত আভিজাত্য সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শিখি আমরা, প্রতাপ-পীড়ন-কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মধ্যে অনুভব করি লোকায়ত পৌরুষের উপস্থিতি। অতি সাম্প্রতিক আধুনিকোত্তর পৃথিবীতে প্রতীত বাস্তবতা ও অধিপরিসরের গ্রন্থনা যখন এককেন্দ্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থার পরাক্রান্ত সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে অনতিক্রম্য করে তুলেছে—অতিপরিশীলিত বিজ্ঞাপনের মাদকে প্রতিষ্ঠিত সত্যের একমাত্র দখলদারদের (‘sole possessor of truth’) প্রতিস্পর্ধা জানাতে পারে বাখতিনের কার্নিভাল-তত্ত্ব। শুধু তত্ত্ব হিসেবে নয়, প্রায়োগিক সামর্থ্যের জোরে। বিশ শতকের একজন বিখ্যাত সমাজনির্মাতা শতফুল বিকশিত হওয়ার সামূহিক স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই মানুষটি আরো বলেছিলেন, ক্ষমতার সদরদপ্তরে কামান দাগতে হবে। কার্নিভাল-ভাবনায় তাঁর এই দুটি কথাই প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। বর্তমান দুনিয়ায় প্রতাপ-মদমত্তদের অতিকেন্দ্রিকতার পর্যায়েও অসংখ্য জনগোষ্ঠীর সমান্তরাল পুষ্পায়নে এবং প্রান্তিকায়ত পরিসর থেকে তুলে-আনা নিরন্তর প্রত্যাঘাতের শক্তিতে সার্থক হতে পারে কার্নিভালের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। বলা ভালো, হতে পারে নয়, হয়ে চলেছে।