বাখতিন/তত্ত্ববিশ্ব, মার্ক্সীয় প্রেক্ষণে

উইকিসংকলন থেকে

তত্ত্ববিশ্ব, মার্ক্সীয় প্রেক্ষণে

প্রতিটি উচ্চারণ মূলত সামাজিক ক্রিয়া আর কোনো অস্তিত্বই কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়—এমন কথা যিনি বলেন, তাঁর প্রতিবেদনে বৌদ্ধিক বিদ্যুচ্চমক থাকে না কেবল। থাকে চেতনার সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ও, একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়া চেতনা মানে অপরতা যাঁর কাছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর যাবতীয় প্রতিবেদনে থাকবে মাটি ও আকাশের দ্বিবাচনিক বিনিময়—এও প্রত্যাশিত। তিনি, মিখায়েল মিখায়েলোভিচ বাখতিন, নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে প্রত্যক্ষ জেনেছেন প্রতীয়মান বাস্তবের মধ্যে অজস্র সমান্তরাল বাস্তবের অস্তিত্ব। জেনেছেন, জীবনের প্রতিবেদন কখনো একটিমাত্র স্বরের বিন্যাস নয়; স্বর থেকে স্বরান্তরে যেতে যেতে নানা উচ্চাবচতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে সুরসংহতি, সমবায়ী উচ্চারণের সামাজিক প্রত্যয়। জীবনের তাৎপর্য সম্পর্কে যে দার্শনিক বীক্ষা বাখতিন প্রস্তাব করেছেন, তাতে দেখি, কোনো তাৎপর্য পুরোপুরি হারিয়ে যায় না কখনো। একদিন না একদিন নতুন প্রতীতি, নতুন উপলব্ধির আকরণ নিয়ে ফিরে আসে। তাঁর মতে, এ যেন নীড়ে-ফেরার উৎসব। বৃন্তহীন পুষ্পের মতো কোনো কিছু বিকশিত হতে পারে, একথা বাখতিন মানেন না। তিনি যখন বলেন, প্রতিটি সত্তা সহযোগী সত্তা আর জীবন মানে সত্তার সহযোগিতার নিরন্তর ঘটনা-পরম্পরা এবং সংগঠন—সেসময় তাঁর সামাজিক প্রেক্ষণের আদল স্পষ্ট হয়ে ওঠে আরো। রাবেলে ও তাঁর জগৎ বইতে বাখতিন এই প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন, যে, হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শেষ হয় না কখনো, সম্পূর্ণ হয় না পরিধি। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তা গড়ে ওঠে, মুখর হয় নতুন সৃষ্টিতে। এক পরিধি থেকে অনবরত তৈরি হতে থাকে আরেক পরিধি। এই সংগঠন একদিকে শুষে নেয় জগৎকে, আবার অন্যদিকে জগৎও শুষে নেয় সত্তার সংগঠনকে। জীবনের সূচনা ও সমাপ্তি নিবিড়ভাবে পরস্পর-সম্পর্কিত এবং অন্তর্বয়নের সূত্রে অন্যোন্য-সম্পৃক্ত।

 অস্তিত্বের প্রতিটি স্তরে ভিন্ন-ভিন্ন পদ্ধতিতে চলেছে দ্বিরালাপ। সত্তার সংগঠনে জাগতিক অনুপুঙ্খগুলির দ্বিবাচনিক বিনিময় থেকে একই সঙ্গে ফুটে উঠছে ঐক্য ও অনৈক্য, সঙ্গতি ও বিসঙ্গতি। মানবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাচনই প্রকাশের ভিত্তি—একথা না লিখলেও চলে। ভাষার মধ্য দিয়ে জীবন ও জগতের সঙ্গে অহরহ যে-সম্পর্ক গড়ে তুলছি, বাচনের মধ্যে তার স্পষ্ট আদল ফুটে ওঠে। এই বাচন হয় দুইয়ের মধ্যে; নিজে-নিজে তা কখনো ব্যক্ত হতে পারে না। অপর অস্তিত্ব দর্পণের মতো সত্তাকে প্রতিফলিত করে; কিংবা প্রতিফলিত-ই করে না কেবল, একে অপরকে প্রমাণিতও করে। অপরের ধারণা না-থাকলে সত্তার প্রতীতিও অসম্ভব। প্রতিদিনের সামাজিক ব্যবহারে সংলাপের মধ্য দিয়ে যেমন একে অপরের কাছে উন্মোচিত হই এবং সেই সূত্রে জগৎ ও জীবনের তাৎপর্য পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করি, যাচাই করে নিই—তেমনি এই সংলাপের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে আমাদের কথনবিশ্ব। বাখতিন এই অতিপরিচিত ব্যবহারিক অনুপুঙ্খকে পারিভাষিক মর্যাদা দেননি কেবল, একে তাঁর তত্ত্ববিশ্বের মুখ্য আকল্প করে তুলেছেন। দু’জন মানুষের সংলাপে কথক ও শ্রোতার কথা বলা ও কথা শোনার মধ্যে বিনিময়ের সেতু গড়ে ওঠে। দুজনের সমান্তরাল অস্তিত্ব তাতে স্বীকৃত হচ্ছে যেমন, তেমনি দুইয়ের অবস্থানগত পার্থক্যও স্পষ্ট। স্বভাবত তাদের উচ্চারণও পরস্পর থেকে আলাদা হবে। দেরিদা যাকে ‘পার্থক্য-প্রতীতি’ বলেন, বাখতিনও সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন। সংলাপের পারিভাষিক রূপান্তরের ফলে যা হয়ে উঠল দ্বিবাচনিকতার দার্শনিক ভূমি, তাতে বিনিময়ের গভীরতর বিচ্ছুরণ থেকে নানা ধরনের সম্ভাবনার উপকূলরেখা জেগে উঠেছে। এইসব সম্ভাবনার মধ্যে চলেছে আন্তঃসম্পর্কের বিন্যাস যাকে বাখতিন ‘mutuality of differences’ বলতে চেয়েছেন। নিরবচ্ছিন্ন বিন্যাসের মধ্য দিয়ে বিপুল সমগ্রের আয়তনে পৌঁছাতে হয় বলে কোনো একক সত্তার আধারে তাকে সম্পূর্ণ ধারণ করা অসম্ভব। সত্তা ও অপরতার সম্পর্ক বারবার ছেদহীন নির্মাণের প্রক্রিয়ায় যখন গৃহীত ও পুনর্গৃহীত হয়—কেবলমাত্র তখনই তাৎপর্যের দ্বিবাচনিক গ্রন্থনা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

 এই যে গ্রন্থনার কথা বলছি, ধারাবাহিক বিনিময়ের ভিত্তিতে তা গড়ে ওঠে। স্বভাবত তাৎপর্যও একাত্তিক নয়, অনেকান্তিক। অপরতার উপলব্ধি ছাড়া চেতনা যেহেতু অপ্রতিষ্ঠ, সত্তা কখনো স্বনির্ভর প্রকল্প নয়। জীবন ও জগতের সমস্ত অনুপুঙ্খের মতো অস্তিত্বও আসলে এক নির্মিতি; কিন্তু তা নিজে-নিজে পূর্ণ হয়ে ওঠে না। কেন্দ্র ও পরিধির টানাপোড়েনে ব্যক্ত পার্থক্যভিত্তিক সম্পর্ক অর্থাৎ সম্পর্কের দ্বিবাচনিকতা ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরকে অনবরত নির্মাণ করে চলেছে। বাখতিন মনে করেন এই পার্থক্য যেমন আপেক্ষিক তেমনি দীর্ঘায়ত। দ্বিবাচনিক দর্শন অনুযায়ী তাই সমস্ত তাৎপর্য আপেক্ষিক এবং প্রতিবেদনের উপসংহার আসলে আপাত-সমাপ্তি। পরবর্তী কালে ও পরিসরে তাৎপর্য পুনর্নবায়িত হয় বলে মুক্ত উপসংহারের প্রতীতি সাম্প্রতিক তত্ত্ববিশ্বে এত গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যিক সন্দর্ভে, নান্দনিক প্রেক্ষিতে, সামাজিক চর্যায় রাজনৈতিক প্রতিবেদনে এই সত্যই সমর্থিত হচ্ছে বারবার। বাখতিন জানিয়েছেন, অস্তিত্বে অন্তর্বৃত পার্থক্য দূর করা যায় না কখনো কেননা ‘Separateness and simultaneity are basic conditions of existence’ (১৯৯০: ২০)। ধারাবাহিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে কোনো-একটি ঐতিহাসিক পর্যায়ের তাৎপর্য যখন অন্য আরেকটি পর্যায়ে পৌঁছে যায়, ঐ প্রক্রিয়ায় দুটি স্তর যুগপৎ সত্য হয়েও পৃথক পরিসরে বিরাজ করে। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বাখতিনের ভাববিশ্বে পুনর্নির্মিত হয়েছে। আইনস্টাইনের মতো বাখতিনও পর্যবেক্ষকের অবস্থানকে মৌলিক বলে ভেবেছেন, কারণ, আন্তঃসম্পর্কের তাৎপর্যে দ্বিবাচনিক বিন্যাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ঐ সম্পর্কে উপলব্ধির জন্যেও চাই উপযুক্ত প্রেক্ষণবিন্দু। সমান্তরালতার সম্পর্ক বিন্যাসে ঐ পর্যবেক্ষকও নিরাসক্ত দ্রষ্টা নন, সক্রিয় সহযোগী। তার মানে, তিনি যেমন পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনই নির্মীয়মান সন্দর্ভের অংশভাক হয়ে নিজেও তাৎপর্য উপপত্তির অন্যতম প্রকরণ হয়ে ওঠেন। সুতরাং দ্বিবাচনিক পদ্ধতিতে সত্তা এবং সত্যের প্রতীতি থেকে আমরা এই বুঝি যে, বাস্তবতার নিষ্কর্ষ কেবলমাত্র পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না। তাকে সর্বদা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। আর, এই অর্জন সম্ভব কেবল নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে: ‘Everything is perceived from a unique position in existence’ (তদেব: ২১)।

 যখন একথা বলি, মার্ক্সীয় প্রেক্ষণের সঙ্গে এই ভাবনার সাযুজ্য চোখে পড়ে। কারণ ‘নির্দিষ্ট অবস্থান’ আর কিছুই নয়, ভাবাদর্শগত অবস্থান। আধিপত্যবাদী বর্গের স্থিতি যখন বিনা দ্বিধায় মেনে নিই, প্রতাপের ভাবাদর্শ আমাদের মধ্য দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক আর সোনার পাথরবাটি একই কথা। ইতিহাসের মানুষ হিসেবে যখন ঐতিহাসিক সন্দর্ভে হস্তক্ষেপ করি, নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই গড়ে তুলি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে ভাবাদর্শের উপযোগিতা পরখ করে না-নেওয়া পর্যন্ত সত্যের স্ফুরন হতে পারে না। ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সত্তার মধ্যে পার্থক্য ও সমান্তরালতার দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়াকে বুঝি কেবল ভাবাদর্শগত প্রেক্ষণবিন্দু থেকে। সুতরাং বাখতিনের কাছে যদি এই পাঠ নিই যে সত্তা হলো আকরণযুক্ত ঘটনার অন্য নাম এবং সত্তার আকরণ বিন্যস্ত হতে পারে কেবল সময় ও পরিসরের বর্গায়তনে—তাহলে বুঝতে পারি, মার্ক্সবাদ প্রস্তাবিত দ্বন্দ্বমূলক দর্শন এবং বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রায়োগিক উপলব্ধির নির্যাস এই ভাবনায় উপস্থিত। অপরতার প্রেক্ষিত ছাড়া ব্যক্তিগত বা সামাজিক বা ঐতিহাসিক সত্য নিরূপিত হতে পারে না। এই বাখতিনীয় আকল্পের সঙ্গে মার্ক্সীয় তাৎপর্যবাদের আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। তিনি বলেছেন, ‘There is no figure without a ground’: তদেব: ২২)। আরো বলেছেন, মানুষের মনের কাঠামোটা এরকম যে জগৎকে বিপ্রতীপ দর্পণে না-দেখা পর্যন্ত অর্থপ্রতীতি হয় না। মার্ক্সবাদও প্রসঙ্গ বিচ্যুত সত্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে না; জানে যে সত্য অচল অনড় নয় বলেই পরিস্থিতি অনুযায়ী তার রূপান্তর হয়। এই পরিস্থিতি নিছক যান্ত্রিক অবস্থান নয়, ইতিহাসনিয়ন্ত্রিত ভাবাদর্শ এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। অজস্র দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে চলেছে জীবন। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ইয়ুরি খারিন লিখেছেন, ‘The world is not a chaotic agglomeration of isolated things but an integral totality of interacting phenomena. The relations between objects and their properties, manifested in their mutual determinacy, conditionallity and dependency, are expressed in the concept of connection.’ (১৯৮১: ১১১)। এই বক্তব্য থেকে বাখতিনের ভাববিশ্ব খুব বেশি দূরে নয় নিশ্চয়।

 বাখতিনের অন্যতম প্রধান আকল্প হলো, যেসব ক্রিয়া আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারে এবং সামাজিক সংযোগের সেতু গড়তে পারে—শুধুমাত্র তাদেরই রয়েছে তাৎপর্য বহনের যোগ্যতা। নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ ও পরিস্থিতি তাদের প্রেরণা দেয় ও শক্তিমান করে তোলে। মানুষের জীবন, চিন্তা এবং উচ্চারণ: সমস্তই যেন বহুস্বরিক সংযোগ ক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন আয়তন। অর্থোপপত্তি যা-থেকে হয় না, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে এমনও হতে পারে যে, সাধারণ প্রচলিত পরিধির মধ্যে তাৎপর্য-প্রতীতি হলো না। সেক্ষেত্রে পরিধি-বহির্ভূত কোনো প্রেক্ষণবিন্দু থেকে অর্থবোধ হওয়া সম্ভব। এও আসলে অপরতার দর্শন। যেমন, ধরা যাক, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারো জীবনের নিষ্কর্ষ চূড়ান্তভাবে বুঝতে পারি যখন মৃত্যুর দর্পণে ঐ জীবনবৃত্তকে প্রতিফলিত হতে দেখি। তেমনি কোনো সমাজে একটি পর্যায় যখন শেষ হয়, সেসময় ঐ পরিসরের বাইরে গিয়ে তার যথার্থ পরিমাপ করতে পারি। সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পরে যেমন এখন বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার আলো ছায়ার অর্থোপপত্তি হচ্ছে। এখানেও অবশ্য পর্যবেক্ষকের ভাবাদর্শগত অবস্থান এবং তাঁর উচ্চারণের প্রকৃত তাৎপর্য ও নিহিত শক্তি অনুধাবন করা সম্ভব হলো সময় ও পরিসরের ভিন্ন পর্যায়ক্রমে গিয়ে। অর্থাৎ বাখতিনের মৃত্য-পরবর্তী বিশ্বে—প্রতীচ্যে এবং প্রাচ্যে, আধুনিকোত্তর এবং উপনিবেশোত্তর সমাজে—ভাবাদর্শগত অবস্থান অনুযায়ী তাঁর ভাবনা গৃহীত, পরীক্ষিত ও পুনরুদ্ভাসিত হচ্ছে। তেমনি আমাদের নজরে পড়ছে, বাখতিনের জীবৎকালে স্বদেশে তিনি কিন্তু ঈপ্সিত মাত্রায় গহীত হননি কেননা তাঁর রচনা প্রকাশিত হওয়াই কঠিন ছিল। এমনকি, দীর্ঘকাল সোভিয়েত সমাজে তিনি প্রত্যাখ্যাত অপর হিসেবে নির্বাসিত, কার্যত মৃত, হয়েই ছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার বিশেষ অবস্থানের বিচারে ধনবাদী প্রতীচ্যের যে-সমস্ত দেশ ছিল বহুদূরবর্তী অপর তাদের মধ্যেই নবজন্ম ঘটল বাখতিনের। তাঁর রচনা অনূদিত, প্রকাশিত, ব্যাখ্যাত হওয়ার পরে নতুন তাৎপর্যে পুনরাবিষ্কৃত হলো। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যাঁদের তিক্ত অনীহা সর্বজনবিদিত, তাঁরা বাখতিনের উচ্চারণে নিজেদের অভিপ্রায় অনুযায়ী অন্তর্ঘাতের প্রতিসন্দর্ভ খুঁজে পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলেন। দ্বিবাচনিকতার প্রতিবেদন তাঁদের কাছে কার্যত ট্রয় যুদ্ধের কাঠের ঘোড়া বলে বিবেচিত হলো।

 তার মানে, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সমর্থকদের কাছে বাখতিনের তত্ত্ববিশ্ব সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রতিস্পর্ধী আয়ুধের যোগানদার। এঁরা এই দাবি পেশ করলেন যে মহান তাত্ত্বিকের স্বদেশে স্বকালে যেসব উচ্চারণ পিঞ্জরাবদ্ধ ছিল—তাঁরা তাদের মুক্তি দিয়েছেন। তাঁরা এই সহজ সত্য মনে রাখলেন না (কিংবা, বলা ভালো, রাখতে চাইলেন না) যে বহুবিধ দ্বিবাচনিকতায় সমৃদ্ধ সোভিয়েত ইতিহাসের নির্যাস অর্থাৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন সত্যের উদ্ভাসন অসম্ভব। এ ধরনের চিন্তা করার অর্থ বাখতিনের যুক্তিশৃঙ্খলাকে নস্যাৎ করে দেওয়া। কোনো বাচনের আয়ুষ্কাল উচ্চারণের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার ওপর নির্ভরশীল, একথা যিনি ভাবতেন, তাঁকে ইতিহাস-নির্ধারিত অবস্থান বিশ্লেষণ করেই বুঝতে হবে। প্রতিটি পর্যায়ে বাচনের তাৎপর্য উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ, পরীক্ষিত, সম্প্রসারিত হয়েছে। এই ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মেডভেভেভ ও ভোলোশিনোভের নামে প্রচলিত রচনাকেও বাখতিনের বহুস্বরিক ভাববিশ্বের ফসল বলে গ্রহণ করছি। তাছাড়া, ধনবাদী প্রতীচ্যে সোভিয়েত ইতিহাস যতটা একবাচনিক ভাবে অবিশ্লেষনাত্মক ভঙ্গিতে গৃহীত হয়ে থাকে, তাকে মেনে না-নিয়ে বরং সমাজতন্ত্রের অন্তর্বর্তী দ্বিবাচনিক পরিসরকে পুনঃপাঠ করা উচিত। বাখতিনের উচ্চাবচতাময় জীবনের বিচিত্র সন্দর্ভ তো ঐ দ্বিবাচনিকতার প্রমাণ। অন্যভাবে বলা যায়, সময় ও পরিসরের বিশিষ্ট পর্যায়ক্রমেই বাখতিন-মেডভেভেভ-ভোলোশিনোভের সমান্তরাল উদ্ভব সম্ভবপর। এই পর্যায়ক্রমকেই প্রথম বুঝতে হবে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার মতো; নইলে বাখতিনের ভাববিশ্ব-সঞ্চালক ‘mutuality of differences’ এর তাৎপর্য হারিয়ে যাবে আমাদের বিশ্লেষণ থেকে। তাঁর অভিপ্রেত প্রতিবেদন থেকে আমরা ইতিহাসের সামীপ্যের বদলে কেবলই আবিষ্কার করব মিথ্যা আত্মতার অন্তর্ঘাত। তাই বাখতিনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে আধুনিকোত্তর বা উপনিবেশোত্তর জগতের অধিবাসী হিসেবে, আমরা যত দূরবর্তী অপর হই না কেন—ইতিহাসের নির্দিষ্টতাকে বুঝতে হবে সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য পূর্ণতায়।

দুই

একটি বিখ্যাত চীনা প্রবাদে এই শুভেচ্ছা প্রকাশ করা হয়: ‘তোমাদের কাউকে যেন গুরুত্বপূর্ণ বা ঘটনাবহুল বা আগ্রহোদ্দীপক সময়ে বাঁচতে না হয়।’ তাহলে, ঝড়ের মুখে কুটোর মতো বা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নৌকোর মতো তাকে হারিয়ে যেতে হবে—এই হলো মোদ্দা আশঙ্কা। মিখায়েল বাখতিনের মতো আর ক’জন চিন্তাবিদকে এত বেশি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে বাঁচতে হয়েছিল, তা বলা কঠিন। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যখন রুশ সমাজে ইতিহাসের রৈখিকতা ভেঙে দিচ্ছিল, তখন বাখতিন বাইশ বছরের তরুণ। বিপ্লবের আগে এবং পরে দ্বিধা-সংশয়-প্রত্যয়ের দোলাচল এবং ঘাত-প্রতিঘাত তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে শুষে নিয়েছিলেন। লেনিনের গঠনমূলক নেতৃত্ব থেকে স্ট্যালিনের একান্তিক নেতৃত্বে বিবর্তন এবং তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য তিনি পর্যবেক্ষণ করেননি কেবল, তাঁকে ভুক্তভোগীও হতে হয়েছিল। তাঁর আকল্প অনুযায়ী বলা যায়, যুগান্তকারী ইতিহাসের অনিবার্য তাড়নায় তাঁকে নিতে হয়েছিল সক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা। তিনি গৃহযুদ্ধ দেখেছেন, নাজি আক্রমণের ভয়াবহতা দেখেছেন। বিপ্লবোত্তর কালে তরুণ বুদ্ধিজীবীদের নতুন জীবনস্বপ্ন ও উৎসাহের উত্তাপ অনুভব করেছেন এবং ত্রিশের দশকে স্বপ্নভঙ্গের শৈত্য, মতান্ধতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও প্রত্যক্ষ করেছেন। ফ্যাসিবাদ দেখেছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিরোধও দেখেছেন; হিমযুদ্ধের আমলে সাংস্কৃতিক অবসাদ, ক্রুশ্চেভ জমানার সংশোধনবাদ, ব্রেজনেভ পর্বের আদর্শচ্যুতি—একাদিক্রমে এই সব কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার এমন অভাবনীয় ভাবে যাঁর কাছে উন্মুক্ত হতে পারে, তিনি তো গভীর অনুভূতি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব লক্ষ করবেন সমাজে-ইতিহাসে। বহ্নিমান সময়পর্বে যিনি ভেবেছেন এবং লিখেছেন, তাঁকে কেবল ব্যক্তি-সত্তা হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে। তিনি আসলে সময়-প্রতীকী অস্তিত্ব; ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে তাঁর নিরন্তর সংগঠিত দ্বিবাচনিক সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। জীবন ও মনন অন্যোন্যসম্পৃক্ত তাঁর; আধুনিকোত্তরবাদের পক্ষে এক্ষেত্রে বাখতিন প্রভূত সমস্যার কারণ। শৈশব ও কৈশোরের অভিজ্ঞতা তাঁকে বহুভাষায় পারঙ্গম করে তুলেছিল; আর পরবর্তী পর্যায়ের ঘটনা-প্রবাহ থেকে তিনি অর্জন করেছিলেন বহুস্বরিকতার অস্খলিত প্রত্যয়।

 ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত নেভেল ও ভিটেব্‌স্ক শহরে এবং ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত লেনিনগ্রাদে বাখতিন যে নিবিড় বৌদ্ধিক মিথষ্ক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন—কার্যত তাই তাঁর চিন্তাবিশ্বের গোড়াপত্তন করেছে। তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই তখন মার্ক্সবাদী ভাবপ্রকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসু এবং পরবর্তী স্ট্যালিন-আমলের মতো মতান্ধতা না-থাকাতে সব বিষয়ে তর্কবিতর্কে তাঁরা আগ্রহী। একদিকে ধর্ম ও দর্শন, অন্যদিকে ভাষাতত্ত্ব-মনস্তত্ত্ব-সমাজতত্ত্ব-সাহিত্যতত্ত্ব—সব কিছুকে তাঁরা অণুবীক্ষণের বিষয় করে তুলেছিলেন। কোনো সংশয় নেই যে ব্যবহারিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বাখতিন তাঁর তত্ত্ববিশ্বের অন্যতম প্রধান আকল্পে পৌঁছেছিলেন: প্রতিটি সত্তা সহযোগী সত্তা এবং কোনো কিছু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। চেতনা মানে যে অপরতার উপলব্ধি এবং সত্তা হলো আসলে এক নির্মিতি—এই বিশ্বাস তাঁর মনে দৃঢ়মূল হয়েছিল অবশ্যই এই পর্বে। জীবনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ এগারো বা বারো বছর বাখতিনকে স্বপ্ন থেকে স্বপ্নভঙ্গের দিকে নিয়ে গিয়েছিল হয়তো; কিন্তু অন্য অনেক চিন্তাবিদের মতো তিনি পলায়নবাদ বা আত্মরতিতে আশ্রয় খোঁজেননি। পার্থক্য ও সমান্তরালতার বোধ কীভাবে দ্বিবাচনিক আন্তঃসম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা দেয়, তিনি নিবিষ্টভাবে লক্ষ করেছিলেন। একদিকে কঠোর দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যহানি এবং অন্যদিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতাপের নতুন বিন্যাস জনিত সম্ভাব্য অস্বস্তি বাখতিনকে নিশ্চয় পীড়ন করছিল। কিন্তু পাশাপাশি আভাঁগার্দ চিত্রকলার উত্থান, প্রশ্নমুখর বুদ্ধিবাদ, দার্শনিক অন্বীক্ষা, নন্দনতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসার উত্তাপ বাখতিনকে দিচ্ছিল নতুন-নতুন চিহ্নায়কের সন্ধান। বলা যায়, এই পর্বে যেন ভিত্তি তৈরি হলো পরবর্তী অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধতর আরেকটি মৌলিক উপলব্ধির: প্রতিটি তাৎপর্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়। বলা বাহুল্য, মার্ক্সবাদী বীক্ষায় সংগ্রাম হলো মানববিশ্বের আধারশিলা।

 বিশের দশকে বাখতিন ‘নান্দনিক প্রক্রিয়ায় লেখক ও নায়ক’ বিষয়ে যে-রচনাটি লেখেন, আদি পর্যায়ের সেই লেখার প্রচ্ছায়া পরবর্তী পর্যায়েও অনুভব করা যায়। নন্দনচিন্তার সঙ্গে জ্ঞানতত্ত্ব ও নীতিতত্ত্বকে তখন তিনি সমন্বিত করতে চেয়েছেন। পরিণত পর্যায়ে তিনি যে জানালেন, ‘কোনো তাৎপর্য পুরোপুরি হারিয়ে যায় না কখনো’—সেই সূত্র অনুযায়ী আদিরচনায় ব্যক্ত বেশ কিছু ভাববীজ এবং জিজ্ঞাসা তিনি পরবর্তী কালে পুনরুত্থাপন করেছিলেন। তরুণ বয়সেও তাঁর মনে এই বোধোদয় হয়েছিল যে জীবনের বৃত্তকে ভেতর থেকে দেখলে কখনো সম্পূর্ণ মনে হয় না। নিজেদের জন্ম এবং মৃত্যু পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করি না কখনো; কেবলমাত্র অপর কোনো ব্যক্তির জীবনবৃত্ত আমাদের চোখে সম্পূর্ণ হতে পারে। এইজন্যে আমরা কিছুতেই নিজেদের জীবনকথার নায়ক হতে পারি না। নায়কোচিত সম্পূর্ণতার প্রাক্‌শর্ত এই যে, অন্য কেউ তাকে পর্যবেক্ষণ করবে, বাইরে দাঁড়িয়ে। সেই অপর সত্তার অবস্থান নায়কের জীবনবৃত্তের মধ্যে হবে না কখনো। বাখতিনের আকল্প অনুযায়ী প্রতিটি তাৎপর্য সমাজের দ্বারা নির্মিত ও নির্ধারিত, অতএব স্বয়ং বাখতিনও তখন ঐতিহাসিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং নির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক আয়তনের মধ্যে থেকে প্রস্তাবিত নতুন জীবনস্বপ্ন ও সামূহিক পুনর্গঠনের প্রস্তাবনাকে সঠিক তাৎপর্য বুঝতে চাইছিলেন। সম্ভবত এইজন্যে তাঁকে উপযুক্ত তাত্ত্বিক আকরণ খুঁজে নিতে হলো। এতে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে নির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক বর্গায়তনের ভেতরে থেকে যদি সম্পূর্ণ তাৎপর্য বোঝা না যায়—অন্তত সম্ভাবনায় যেতে হবে তার বাইরে। কিন্তু এর মানে কি এই যে বাখতিন সমাজতান্ত্রিক আকরণকে অস্বীকার করতে চাইছিলেন? না, একথা বলা যায় না। অতি সরলীকৃত এই ব্যাখ্যা পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছে খুবই গ্রাহ্য হলেও সম্ভাব্য সহজ বিশ্লেষণটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। বাখতিন আসলে ঈপ্সিত তাৎপর্যে পৌঁছানোর জন্যে প্রেক্ষণবিন্দুর পরীক্ষা করে দেখছিলেন। সমাজতান্ত্রিক অণুবিশ্বের প্রতি প্রচ্ছন্ন কোনো প্রত্যাখ্যান তাঁর বক্তব্যে বিম্বিত হয়নি। সত্যকে আমার নির্মাণ করি নিশ্চয়; কিন্তু তা করি দ্বিবাচনিকতার মধ্য দিয়ে। এই মহাসূত্রে অবশ্য বাখতিন পৌঁছেছেন আরো কিছুকাল পরে। আপাতত তিনি লক্ষ করছিলেন, ইতিহাস-নির্দেশিত মুহূর্ত ও পরিসর সত্যের উদ্ভাসনের জন্যে অপর মুহূর্ত ও পরিসরের দর্পণের ওপর নির্ভরশীল। কী ব্যক্তিজীবনে কী সামূহিক জীবনে—এই আকল্পের প্রায়োগিক উপযোগিতা অসামান্য।

 চিন্তাজীবনের শুরুতেও তাহলে বাখতিন চেতনাকে একান্তিক বলে ভাবতে চাননি। অপরতার দার্শনিক, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নান্দনিক ব্যঞ্জনাকে স্তরে-স্তরে গঠন করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ধান তখন থেকেই আবশ্যিক নৈতিক মান্যতা অর্জন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অপর ব্যক্তিদের অপরতার স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্বকে মর্যাদা দিতে হবে—এই হলো বাখতিনের মৌল বার্তা। সোভিয়েত সমাজের রাজনৈতিক পুনর্গঠনে আলোর সঙ্গে ছায়াঞ্চলও যে প্রসারিত হচ্ছিল, তা অনুভব করেই কি তিনি গভীর সংবেদনশীলতা দিয়ে মানবস্বরূপের সম্পূর্ণ পরিসর প্রতিষ্ঠার উপায়ের দিকে তর্জনি সংকেত করলেন? এবিষয়ে সার্থক আলোচনা এখনই হতে পারে যেহতু মৃত্যুর দর্পণে তাঁর সমগ্র জীবনের কৃতি ও চিন্তার বিবর্তন প্রতিফলিত হচ্ছে। বাখতিনের জীবনবৃত্তের ভেতর থেকে নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে তাৎপর্য অর্জনের বহুস্বরিক প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করতে পারছি। ভোলোশিনোভ ও মেডভেডেভের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গ্রথিত বাখতিনের চিন্তাজীবনে সময় ও পরিসরের পর্যায়ক্রম কীভাবে ব্যক্ত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে যেমন তাৎপর্য-সন্ধানের তাৎপর্য বুঝতে পারি, তেমনি মার্ক্সীয় প্রেক্ষণের প্রাসঙ্গিকতাও অনুভব করি। এখানে বলা প্রয়োজন, ১৯৭০ সালে রুশ ভাষাবিদ ভিয়াচেশ্লাভ ইভানভ প্রথম ভোলোশিনোভ ও মেডভেভেভ রচিত বইগুলিকে বাখতিনের লেখা বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এবিষয়ে বিতর্ক এখনো অব্যাহত। তবু বাখতিনের মুখ্য আকল্প অনুযায়ী সমকালীন সমাজের প্রধান উচ্চারণ হিসেবে মার্ক্সবাদী ভাবনাপ্রস্থানের সঙ্গে অন্য সব উচ্চারণের দ্বিবাচনিক বয়নকে আমরা নিশ্চয়ই উপযুক্ত মর্যাদা দেব। এই সূত্রে প্রাগুক্ত প্রতিবেদনগুলিকে বাখতিনের নির্মীয়মান চিন্তাবিশ্বের বহুস্বরিকতার অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে বাধা নেই কোনো। তাছাড়া অভিন্ন চিন্তাবৃত্তের শরিকদের মধ্যে দশকব্যাপী ঘনিষ্ঠ বিনিময় যখন ঐক্যবোধকে গড়ে তুলেছিল, তখনও বাখতিনের বৌদ্ধিক অস্তিত্বই যে ছিল কেন্দ্রীয় সংবেদনার আকর—এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। তাৎপর্যের মতো তাৎপর্যধারকও তো মূলত সামাজিক সত্তা; অতএব ভোলোশিনোভ/মেডভেডেভ-কে বাখতিন নামক সূত্রধার-অস্তিত্বের নির্ভরতাদায়ী দ্বিবাচনিক অপর হিসেবে গ্রহণ করতে বাধা নেই কিছু। মুক্ত ভাবনার পরিসরকে যতটা বেশি সম্ভব নির্বিঘ্ন রাখার প্রয়োজনেই সম্ভবত বাখতিন প্রতিকল্প সত্তার আড়ালে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখেছিলেন। দ্বিরালাপের মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছাই সমবায়ী সত্যের উপকূলে, এই সংকেত দেওয়ার জন্যেই যেন ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিজস্ব লেখকসত্তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে নিয়েছিলেন তিনি।


তিন

১৯২৯ সালে বাখতিনের চিন্তাজীবনের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হলো। ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে যৌথ নির্মাণের বদলে এবার তাঁকে এগিয়ে যেতে হলো একক পরিক্রমায়। অবশ্য এই আপাত-সঙ্গহীনতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বহুস্বরসঙ্গতির উপার্জনও। মার্ক্সীয় প্রেক্ষণ এই পর্যায় থেকে মঞ্চসাজের আড়ালে চলে যাবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে দ্রুত এমন কিছু ঘটনা ঘটবে, যা ব্যক্তি-বাখতিন ও চিন্তাবিদ বাখতিনের দ্বিবাচনিক গ্রন্থনায় বিচিত্র উচ্চাবচতা ও তীক্ষ্ণ জটিলতা যুক্ত করবে। লেনিন-পরবর্তী রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের অন্ধকার অপর অবয়বটি ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়েছে। রাষ্ট্রকে ভাবাদর্শগত অন্তর্ঘাত থেকে রক্ষার প্রয়োজনে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিকল্পিত হয়েছিল। কিন্তু যৌথ কর্মোদ্যোগে ব্যক্তির ‘স্বাধীন’ অবস্থানের দার্শনিক, রাজনৈতিক ও প্রায়োগিক তাৎপর্য কতখানি—এবিষয়ে যথার্থ পরিশীলিত উপলব্ধি না-থাকাতে অচলায়তনের দুর্লক্ষণগুলি প্রকট হতে শুরু করল। লেনিনগ্রাদে ধর্মজিজ্ঞাসুদের মধ্যে যেহেতু সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ কোনো গুরুত্ব পায়নি, ভেতরে ও বাইরে অসংখ্য শত্রুর মোকাবিলায় ক্লান্ত প্রশাসন এদের সংশয়ের চোখে দেখত। সুতরাং ইতিহাসের অনিবার্য নিষ্ঠুর কৌতুকে নির্দিষ্ট জীবিকাহীন বাখতিন ঐ সংশয়ের শিকার হয়ে পড়লেন। তরুণ চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যমণি হিসেবে তাঁর সঙ্গে তখনকার বিভিন্ন ভাবমণ্ডলীর নিয়মিত যোগযোগ ছিল। জীবনকে যিনি তত্ত্বের প্রায়োগিক অভিব্যক্তি বলে জানেন এবং তাৎপর্যের বহুস্বরিকতায় যাঁর অখণ্ড বিশ্বাস—তাঁর পক্ষে এই যোগাযোগ খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে বাখতিনের মতো মুক্তমতি মানুষ কোনো গোপন ধর্মীয় প্রেরণা দ্বারা চালিত হয়েছিলেন। জীবন যাঁর কাছে অন্তহীন অনাবিষ্কৃত পরিসরের বিস্তার, জীবনাতিরিক্ত পরাপাঠ দ্বারা তাঁকে উদ্বুদ্ধ মনে করলে বুঝতে হবে যে তাঁর তত্ত্ববিশ্বের নির্যাস আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। সাম্প্রতিক প্রতীচ্যের কোনো-কোনো ব্যাখ্যাতা বাখতিনের কৃতি থেকে মার্ক্সীয় প্রেক্ষণের ক্ষীণতম ইশারাও মুছে ফেলতে ব্যগ্র বলে অতিসরলীকরণ করেন। এটা কম কৌতুককর নয় যে ঠিক বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন রুশ-প্রশাসন বাখতিনের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ বিকৃতির অভিযোগ তুলে ধরেছিল, তার মানে দুটি দ্বিমেরুবিষম দৃষ্টিকোন থেকে বাখতিনের তাত্ত্বিক অণুবিশ্ব আক্রান্ত, অন্তত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি।

 ১৯২৯ এল সার্বিক পর্বান্তরের আভাস নিয়ে। সবচেয়ে দুরূহ পরীক্ষা বাখতিনকে দিতে হয়েছিল নিজেরই কাছে। একদিকে ডস্টয়েভস্কির নন্দন বিষয়ে তাঁর বই বেরোচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পীড়নের শিকার হচ্ছেন তিনি। নির্দিষ্ট জীবিকার অভাবে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান ছিল না, সুতরাং মননের ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য শেকলের বাধ্যবাধকতা থেকে তিনি পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন। জীবন ও জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা-কিছু মানবিক, বাখতিন সে-সমস্তকে বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণের বিষয় করে তুলেছিলেন। লক্ষণীয় ভাবে, লেনিনের সংকেত অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির সৌধ গড়ে উঠতে পারে কেবল মানবিক উত্তরাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে: ‘We must take the entire culture that capitalism left behind and build socialism with it. We must take all its science, technology, knowledge and art. Without these all be unable to build communist society.’ এই যে ‘সমগ্র সংস্কৃতি গ্রহণ করা’র কথা বলেছেন লেনিন, বাখতিন তাঁর স্বতন্ত্র পথে এই নীতিই মেনে চলেছেন। এই হলো তাঁর বিখ্যাত পারিভাষিক সূত্র ‘heteroglossia’ বা অনেকার্থদ্যোতনার ভিত্তি। কিন্তু লেনিন-পরবর্তী রাশিয়ায় মতান্ধতা সমাজতান্ত্রিক চেতনার মৌল ঔদার্যকে হনন করেছিল। প্রতিটি পরবর্তী যুগ দ্বন্দ্ববাদের ভিত্তিতে যথাপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক উপকরণকে কিছুটা গ্রহণ কিছুটা বর্জন কিছুটা পরিমার্জন করে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা, পরিশীলন এবং সংযোজনের মধ্য দিয়ে তার প্রায়োগিক যথার্থতা যাচাই করে নেয়। এই মার্ক্সীয় আকল্প থেকে বাখতিনের বহুস্বরিক তাৎপর্যের সন্ধান খুব দূরবর্তী নয় নিশ্চয়। সোভিয়েত তাত্ত্বিক ই. বালের লিখেছেন: ‘In every new historical epoch humanity always critically evaluates, supplements, develops and enrichs its inherited cultural values in the light of the new opportunities and new objectives standing before society and in accordance with the requirements of the specific social forces.’ (Communism and Cultural Heritage: Moscow: 1984: 66).

 এই বক্তব্যের মধ্যে যে-সূত্রগুলি রয়েছে (সর্বদা বিশ্লেষণী মূল্যায়ন, সংযোজন, বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটানো)—এর প্রতিটি স্পষ্টত বাখতিন সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক। সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রতিটি সত্তাকে তিনি সহযোগিতার আধার ও আধেয় বলে জানতেন এবং তাৎপর্যকে সামাজিক গ্রন্থনা ও সম্ভাবনা বলে ভাবতেন। এতে মার্ক্সীয় চেতনারই নির্যাস উপস্থিত। যান্ত্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শকে অনুসরণ করার অর্থ মান্যতার ছদ্মবেশে তাতে অন্তর্ঘাত করা। বাখতিন সারা জীবন এই যান্ত্রিকতার বিরোধিতা করে গেছেন। ইতিহাসের নিষ্ঠুর কৌতুকে ত্রিশের দশকে এই যান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মতান্ধতা তাঁকে মূল স্রোত থেকে নির্বাসন দিয়ে ‘প্রত্যাখ্যাত অপর’-এর অভিধা আরোপ করেছে। অথচ স্বয়ং লেনিন জানিয়েছিলেন, ‘guarding the heritage does not mean confining oneself to the heritage,’ (Collected works: Vol 2: 1977:526), এই চমৎকার সূত্রটি বিস্মৃত হয়েছিল তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অত্যুৎসাহীরা, রাষ্ট্রীয় প্রতাপের ধ্বজ বহন করে এরা লেনিনীয় আকল্পটি উপেক্ষা করেছিল। অথচ এই একই সূত্র অনুযায়ী, বাখতিন সূক্ষ্ম ও গভীর সংবেদনশীলতা দিয়ে মার্ক্সীয় প্রেক্ষণেরই ধারাবাহিক বিকাশ ঘটিয়ে গেছেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবনচর্যা ছিল তাঁর মননের শক্তি ও লাবণ্যের উৎস। তা যদি না হত, রাষ্ট্রীয় পীড়ন তাঁকে স্তব্ধ করে দিতে পারত; অন্তত বহুমাত্রিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিত নিশ্চয়। ১৯৩০-এর শুরুতে লেনিনগ্রাদ ছেড়ে তাঁকে পাড়ি দিতে হলো কাজাখস্তানের অন্তর্গত কুস্তানাই শহরের অন্তরীণ-জীবনে। বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী লুনাচারস্কি যদি ডস্টয়েভস্কি বিষয়ক বইয়ের ইতিবাচক সমালোচনা না করতেন এবং ম্যাক্সিম গোর্কির পত্নী সহ আরো কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী চেষ্টা না করতেন, তাহলে কাজাখস্তানের বদলে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন ভোগ করতে হতে বাখতিনকে। সেক্ষেত্রে তিনি হারিয়ে যেতেন অস্তগোধূলির ওপারে এবং মানুষের তত্ত্ববিশ্বও কখনো মৌলিক পুনর্লিখনের সম্ভাবনায় উত্তীর্ণ হত না।

 ত্রিশের দশক থেকে আরো ত্রিশ বছর তাঁর কোনো বই ছাপা হয়নি। কিন্তু পীড়ন ও চরম অনিশ্চয়তার সেই দশকেও বাখতিন ছিলেন সবচেয়ে বেশি সৃষ্টিশীল এবং মননের দিক দিয়ে সদাজাগ্রত। সে-সময় তিনি শিক্ষাবিষয়ক উপন্যাস সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন; উপন্যাসের ইতিহাস সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গ্রন্থাকৃতি সম্পন্ন নিবন্ধ লেখেন এবং রাবেলে বিষয়ে অভিসন্দর্ভ ডক্টরেট ডিগ্রির জন্যে প্রস্তুত করেন। এও আসলে জীবনের অন্তর্বৃত দ্বিবাচনিকতার বৌদ্ধিক অভিব্যক্তি। কুস্তানাই শহরে অবশ্য এই দশকের পুরো সময়টা বাখতিনকে কাটাতে হয়নি। নির্বাসনের পালা শেষ হওয়ার পরে মোর্ডোভিয়ার সারান্‌স্ক শহরে শিক্ষকপ্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে তিনি চাকরি পেয়ে যান। কিন্তু মস্কো থেকে চারশ’ মাইল পূর্বের সেই ছোট্ট শহরেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে তিনি নিস্তার পেলেন না। এক বছর চাকরি করার পরে ১৯৩৭ সালে যখন আবার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হলো, পদত্যাগ করে বাখতিন চলে এলেন মস্কোর উত্তরে সাভেলোভো নামে ছোট্ট শহরে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তিনি ওখানেই ছিলেন। কিন্তু বারবার স্থান পরিবর্তন করার ফলে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়াতে বহির্জগতের কাছে বাখতিন কার্যত মৃত হয়ে পড়লেন। তাঁর অস্তিত্বও ধীরে ধীরে বর্তমানের পরিধি থেকে মুছে গেল। এর কারণ, সহযোগী সত্তার অভাবে কোনো সত্তা কখনো বিকশিত হয় না; হয়ে ওঠার নিরন্তর প্রক্রিয়া যেহেতু স্বভাবে সামাজিক, এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রসঙ্গচ্যুত সত্যভ্রমের আস্ফালন অনিবার্য। গতি জীবনেরই প্রকাশ এবং তা দ্বিবাচনিকতার নামান্তর; নিঃসঙ্গ তা তেমনি একবাচনিক এবং স্থবিরতার মধ্য দিয়ে আত্ম-অবলুপ্তির সূচক। বাখতিনের জীবনে তথ্য ও তত্ত্বের যুগলবন্দি অবিস্মরণীয়। তাই দেখি, তাঁর উচ্চারণ গড়ে ওঠে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যখন তাঁর জীবিকা অনিশ্চিত এবং জীবন অস্থির, সে-সময় নিত্যনতুন মননের বয়ন চলেছে; আবার যখন তিনি মোটামুটি স্থিতিশীল চাকরি করছেন—সে-সময় তাঁর রচনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। বিল্‌ডুঙ্গ্‌স্‌রোমান বা শিক্ষাকেন্দ্রিক উপন্যাস সম্পর্কিত বইয়ে কেন্দ্রীয় সত্তার ধারাবাহিক অগ্রগতির কথা যিনি বলেন, তিনিই আবার চরম খামখেয়ালির পরিচয় দিয়ে সিগারেটের কাগজ হিসেবে ব্যবহার করে খসড়া পাণ্ডুলিপির অধিকাংশ পুড়িয়ে ফেলেন। এই বইয়ের পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি প্রকাশন-সংস্থার ঘরবাড়ি সহ ধ্বংস হয়ে যায় জার্মান হানাদারদের বোমা-বর্ষণে। বারবার নতুন হয়ে-ওঠা প্রতিবেদনের কথা যিনি বলেছেন, তাঁর জীবনেও পুনর্নির্মাণের পালা এসেছে অসংখ্যবার।

 যুদ্ধের পর সারান্‌স্ক শহরের চাকরিটা ফিরে পেয়েছিলেন বাখতিন। ১৯৬১ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি সক্রিয় শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সঙ্গে। বহুস্বরিক জীবনের তাৎপর্য কীভাবে ক্রমশ তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, তার একটা সংকেত যেন পাওয়া যাচ্ছে এখানে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় বিভিন্ন বাক্‌মাধ্যম (speech-genres) সম্পর্কে চমৎকার দীর্ঘ নিবন্ধ লেখা ছাড়া নতুন কোনো তাত্ত্বিক প্রসঙ্গের অবতারণা তিনি করেননি। ১৯৫২ সালে ডক্টরেট ডিগ্রির বদলে বাখতিনকে ক্যাণ্ডিডেট্‌স ডিগ্রি দেওয়া হয়, তাও দীর্ঘ টালবাহানার পরে। ১৯৬০ সালে মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউটের কয়েকজন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের গবেষক বাখতিনকে আশ্চর্যজনক ভাবে পুনরাবিষ্কার করেন। ঐ প্রতিষ্ঠানের মহাফেজখানায় তাঁরা ডস্টয়েভস্কি সম্পর্কে বাখতিনের বইটি দেখতে পান এবং তার কিছুদিন পরে রাবেলে বিষয়ক অভিসন্দর্ভও খুঁজে পান। প্রথম তাঁরা লেখককে মৃত বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর কিছু কিছু সূত্রে জানতে পারেন, বাখতিন তখনও জীবিত; স্বভাবত, গভীর কৌতুহলে তাঁরা এই আশ্চর্য তাত্ত্বিকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর যা ঘটল, তা যেন আলাদিনের মায়াপ্রদীপের কাহিনি। বহু বাধা পেরিয়ে এঁদেরই চেষ্টায় ১৯৬৫ সালে রাবেলে ও তাঁর জগৎ বইটি প্রকাশিত হলো। সঙ্গে সঙ্গে বিদগ্ধজনের মধ্যে অভূতপূর্ব আলোড়ন দেখা দিল; অতি দ্রুত বাখতিন সোভিয়েত রাশিয়ার বৌদ্ধিক মহলে কিংবদন্তিতে পরিণত হলেন। তরুণ বয়সের মতো প্রবীণ বয়সেও তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠল নতুন ভাবমণ্ডল। ১৯৭৫ সালের ৭ মার্চ তাঁর কায়িক মৃত্যু হওয়ার পরেও বাখতিন-ভাবমণ্ডল ক্রমশ প্রসারিত হলো। প্রমাণিত হলো, জীবনচক্র আবর্তিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাৎপর্যের প্রতীতিও ফিরে আসে নদীর জলের মতো। কোনো কিছুই একেবারে হারিয়ে যায় না; একদিন-না-একদিন সব কিছু ফিরে যায় উৎসে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পরবর্তী বারো বছরে গড়ে-ওঠা বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের আবহ হিসেবে প্রকট ছিল নতুন জীবনস্বপ্ন, নবনির্মাণের উত্তাপ, ভাবাদর্শের শক্তি ও লাবণ্য। অন্যদিকে, স্ট্যালিন-পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শিথিলতার পর্বে নতুন ভাবে যখন চিন্তাবৃত্ত গড়ে উঠেছিল—তার মধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায়ে চল্লিশ বছর। সুতরাং এই নবায়ন আসলে সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ। তবুও, তাৎপর্য-সন্ধানের প্রয়াস যে বৃত্তাকার পথে ফিরে এল নবায়িত দিশা নিয়ে—এটাই লক্ষণীয়।

 সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রবন্ধগুলি যখন সংকলিত হয়ে ছাপা হতে লাগল, বাখতিনের অসামান্য জীবন ও মননের দ্বিবাচনিকতা থেকে অর্থ খোঁজার প্রয়াসও শুরু হলো। বিচ্ছেদ ও ধারাবাহিকতার দ্বন্দ্ব পর্ব থেকে পর্বান্তরে কত বিচিত্র ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তাদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উত্থাপিত হলো। আগেই লিখেছি, ভোলোশিনোভ ও মেডভেডেভের সঙ্গে বাখতিনের নাম জড়িয়ে যাওয়াতে জটিল বিতর্কের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। বিশের দশকের শেষে এবং ত্রিশের দশকের গোড়ায় মেডভেডেভ, বিশেষত সাংবাদিক ও প্রকাশন-সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে, লেনিনগ্রাদে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। আর, বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের সক্রিয় সদস্য ও তত্ত্বজিজ্ঞাসু হিসেবে ভোলোশিনোভও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের নামে যেসব বই বেরিয়েছিল, তার সঙ্গে ত্রিশের দশকে বাখতিন-রচিত অপ্রকাশিত নিবন্ধগুলির যৌক্তিক সাযুজ্য খুব প্রকট। এবং, এই তথ্যও খুব লক্ষণীয় যে মেডভেডেভ ও ভোলোশিনোভের বক্তব্যে মার্ক্সীয় ভাবাদর্শ ও বাচন নিয়ন্তা ভূমিকা নিয়েছে। তুলনামূলক ভাবে বাখতিনের স্বনামে রচিত প্রতিবেদনগুলিতে এই ভূমিকা আভাসিত; তবে একে গৌণ বলা যায় না। কারণ, বেশ কিছু মৌলিক ভাবকল্পের ক্ষেত্রে তিনি নিঃসন্দেহে মার্ক্সীয় চেতনায় প্রেরণার উৎস খুঁজে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে, ভোলোশিনোভ, মেডভেডেভ ও বাখতিন ঐতিহাসিক বাস্তবের দ্বারা নির্ধারিত এমন ত্রিস্রোত অস্তিত্ব—যাদের আপাত-ভিন্নতা সত্ত্বেও ভাবাদর্শের ঐক্য ও সংহতি অনস্বীকার্য। বাখতিন মার্ক্সবাদী ছিলেন কি ছিলেন না—এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। গভীর অন্তর্বৃত ঐক্যের ভিত্তিতে প্রাগুক্ত ত্রিস্রোত অস্তিত্বকে যদি এক ও অভিন্ন সত্যোপলব্ধির বিচ্ছুরণ বলে বুঝতে পারি, তাহলে একদিকে বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের বিশিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক অবচেতনা যেমন স্পষ্ট হয় তেমনি বিতর্কিত বইগুলির লেখকসত্তা সম্পর্কিত সমস্যাও তত পীড়িত করে না। আমাদের শুধু লক্ষ করতে হবে, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বাখতিন যেসব নতুন আকল্প প্রস্তাব করেছেন কিংবা ভাষা-সাহিত্য-সমাজ-নন্দন সম্পর্কে যেভাবে উদ্ভাসনী আলো দিয়ে নতুন তত্ত্ববিশ্বের আদল গড়ে তুলেছেন—তাতে মার্ক্সবাদের সৃজনশীল পুনর্বিন্যাস হচ্ছে কিনা।

চার

প্রতীচ্যের বিশ্লেষণ-নিপুণ বাঘা-বাঘা পণ্ডিতেরা খুব সুবিধাজনক ভাবে যে-কথাটা এড়িয়ে গিয়ে মার্ক্সবাদী ভাবনাপ্রস্থানকে নস্যাৎ করেন, তা হলো এই মৌল মার্ক্সীয় প্রস্তাবনা—‘মার্ক্সবাদ কোনো আপ্তবাক্য নয়, তা আসলে কার্যক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক।’ জীবন তো তত্ত্বের মাপে তৈরি হয় না, তত্ত্বই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠে এবং প্রয়োজনের তাগিদে ক্রমাগত বদলে যায়। অতএব বাখতিন যদি মার্ক্সীয় প্রেক্ষণ স্বীকার করে নিয়ে তাঁর সন্দর্ভে মার্ক্সবাদী চেতনার সুরে-লয়ে বাঁধা পরিসরকে বারবার পুনরাবিষ্কার, পরিশীলিত ও সমৃদ্ধতর করেন—তাহলে, বুঝতে হবে, এই তাঁর ভাবনাপ্রস্থানের অন্যতম ধ্রুবক। তিনি যে বহুমাত্রিক চিন্তাবীজকে ক্রমশ অনেকার্থ-দ্যোতনায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার সূচনাবিন্দু এবং মৌল সঞ্চালক হলো এই চেতনা। সোভিয়েত চিন্তাবিদ অধ্যাপক ই. বালের এই প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন: ‘Undoubtedly, in his creativity, each scientist, writer, artist or composer has to answer the questions posed by life, yet how and when he answers them is determined by his talent and his ability to comprehend the present sooner and better than the others and to foresee the future.’ (১৯৮৪: ৫৬)। এই সূত্র অনুযায়ী, বাখতিন জীবনের দ্বারা উত্থাপিত প্রশ্নমালার মীমাংসাপ্রয়াস অক্ষুণ্ণ রেখেছেন বলেই পর্ব থেকে পর্বান্তরে তাঁর প্রতিভা ও ক্ষমতা ধরা পড়েছে। সাম্প্রতিক কাল ও পরিসরের বহুবিধ বিচ্ছুরণকে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক মার্ক্সবাদীর তুলনায় তিনি বেশি সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। ভাববিশ্বের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতি যে-ইশারা তিনি করে গেছেন—আজ বিশ্বব্যাপ্ত বাখতিন-চর্চার মধ্যে তার অসামান্য গুরুত্ব প্রমাণিত হচ্ছে। মার্ক্সীয় চেতনার সৃজনশীল পুনর্বিন্যাস করতে পেরেছিলেন বলেই কোনো অশ্মীভূত আপ্তবাক্যের কবলে তাঁর সন্দর্ভ পড়েনি; প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তিনি নিতে পেরেছেন উজ্জ্বল পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। এই চেতনার উত্তরাধিকারকে তিনি ছেদহীন, উচ্চাবচতাহীন যান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় গ্রহণ করেননি। দ্বিবাচনিকতার শর্ত অনুযায়ী চিন্তার রৈখিকতা ভেঙে দিয়েছেন এবং ভেঙে দিয়ে, ‘সাংস্কৃতিক বিকাশের জটিল, পরস্পরবিরোধী ও দ্বান্দ্বিক’ (তদেব: ৬৬) চরিত্রকে প্রকাশ করেছেন। আর, এভাবে প্রমাণ করেছেন, মার্ক্সবাদীরা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় যে ‘invariably deal with a progressive form of continuity only’ (তদেব: ৭৭) এর কথা বলেন—ধারাবাহিকতার সেই প্রগতিশীল চরিত্র বাখতিন তাঁর সংবেদনশীল কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। নিজের ইতিহাস নিজেই নির্মাণ করার যে মহাসূত্র এঙ্গেলস্ দিয়েছেন (দ্রষ্টব্য:—Selected Correspondence: 395), বাখতিনের জীবন ও মননের দ্বিবাচনিকতা তার চমৎকার দৃষ্টান্ত।

 বিশের দশকের শেষে বাখতিন টলস্টয় সম্পর্কে দুটি ছোট্ট নিবন্ধ লেখেন, যাতে মার্ক্সীয় ঘরানার ছাপ খুব স্পষ্ট। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে তাঁর দার্শনিক বিবর্তনে এই পর্যায়টি নেহাত আকস্মিক ও পারম্পর্যহীন অর্থাৎ বাখতিনীয় ভাববিশ্ব গড়ে উঠেছে এমন কিছু উপাদানের সমন্বয়ে যা জরুরি নয় তত এবং যা সুবিধাবাদের পোষক। একথা ভাবার মানে যে বাখতিনের বৌদ্ধিক সততাকে খারিজ করে দেওয়া, তা না লিখলেও চলে। প্রচলিত ও বাঁধা-ধরা পথে চলেননি বলে ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীরা তাঁর উপর ক্ষুব্ধ, বিরক্ত ও সন্দিহান—আবার সম্ভাব্য মার্ক্সীয় অনুষঙ্গের জন্যে প্রতীচ্যের ধুরন্ধর পণ্ডিতেরা প্রাণপণে সেই ‘স্পর্শদোষ’ কাটানোর চেষ্টায় ব্রতী। সত্যকে যিনি দ্বিবাচনিক বলে জেনেছেন, সময়ের বিচিত্র কৌতুকে তাঁর মননবিশ্বকে দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে একবাচনিক বলে প্রমাণ করার জন্যে কী উদগ্র ব্যাকুলতা! সমস্ত বিশ্লেষণ যে মূলত ভাবাদর্শ ভিত্তিক, এতে তার প্রমাণ পাচ্ছি। বাখতিনের উদার মানবতন্ত্রী উচ্চারণের সঙ্গে মার্ক্সবাদের বিরোধ কল্পনা করে যাঁরা সন্তুষ্ট কিংবা বিক্ষুব্ধ—তাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই অপরতার উপলব্ধি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। অন্ধের হাতি দেখার পুরোনো রূপকটি হয়তো মনে পড়বে কারো কিংবা উপনিষদের ধরনে বলতে ইচ্ছে করবে—‘অবিজ্ঞাতং বিজানতাম্, বিজ্ঞাতম্ অবিজানতাম্’। মার্ক্সীয় অনুষঙ্গের মধ্যে যাঁরা অতিসরলীকরণ, বিকৃতায়ন বা একবাচনিকতার লক্ষণ খুঁজে পান—তাঁদের পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের আড়ালে চলে গেছে বাখতিনের জীবনব্যাপী মননের নির্যাস। অস্তিত্ব যাঁর কাছে অংশীদার হওয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া এবং তাৎপর্য যাঁর কাছে সামাজিক ভাবে নির্ধারিত অনেকার্থদ্যোতনার গ্রন্থনা—তাঁকে ইতিহাসের পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার প্রয়াস আসলে প্রতিভাবাদর্শের অভিব্যক্তি। বিপ্লবোত্তর বাস্তবকে যাঁরা কৃষ্ণবিবর বলে প্রমাণ করতে মরিয়া, তাঁরা একদিকে বলেন, সমকালীন রুশ সমাজেও প্রধান উচ্চারণ মার্ক্সীয় চেতনা নয়, আবার অন্যদিকে তাদের অক্লান্ত পুনরাবৃত্তি হলো, মার্ক্সবাদ বৌদ্ধিক বর্গের ওপর আরোপিত হয়েছিল ‘as the deadening intellectual orthodoxy!’ (ডেণ্টিথ: ১৯৯৫: ১১)।

 তার মানে, মার্ক্সীয় চেতনা কোনো উত্তরণমনস্ক বিশ্বাসের আয়ুধ—প্রতীচ্যের বিশেষজ্ঞরা কিছুতেই তা মানতে রাজি নন। তাঁদের অবস্থানের পক্ষে মানানসই রাজনীতির প্রয়োজনে এঁরা যেমন সত্যকে উৎপাদন করে থাকেন এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে নিজস্ব বর্গের তাগিদ অনুযায়ী সাজিয়ে নেন তেমনি বাখতিনকেও তাঁরা নিজেদের ছাঁচে গড়ে নিতে চেয়েছেন। তাঁরা এও বলতে চেয়েছেন যে বাখতিনের ওপর মার্ক্সবাদের প্রভাব ততটা ছিল না যতটা ছিল সমসাময়িক টালমাটাল সমাজের অভিঘাত। একক বাচনকে তিনি যে চিরকাল সামূহিক বাচনের অন্তর্বয়ন হিসেবে জেনেছেন, তার পেছনে এঁরা কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঞ্জীবনী উত্তাপ খুঁজে পাননি। বরং বিমূর্তায়িত সামাজিক আলোড়নের ঘাত-প্রতিঘাতে তাঁর ‘overwhelming sense of the transfigurative power of collective life’ (তদেব: ১৪) উদ্ভূত হওয়ার কথাই বলেছেন। সূর্য উঠলেও যারা সেই সত্য অস্বীকার করে ‘কে বা আঁখি মেলে রে’ জাতীয় অবস্থান নেয়—এখানে যেন তেমনি জ্বলন্ত বাস্তবকে ইচ্ছা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পরিচিত প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। যার অস্তিত্ব সইতে পারি না, তাকে প্রাণপণে অস্বীকার করে মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা মেটাই: এখানে সেই অভ্যস্ত পুরোনো রীতির প্রতিফলন দেখছি। সেসময়কার দার্শনিক প্রবণতা অনুযায়ী নব্যকাণ্টীয় চিন্তাধারা বাখতিনকেও আকৃষ্ট করেছিল যদিও বিশুদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা তাঁর ছিল না। চেতনাকে বহিরঙ্গ জগতের নিছক প্রতিফলন বলে ব্যাখ্যা তিনি করেননি কারণ মন তাঁর কাছে এমন কোনো সাদা পাতা নয় যাতে জগতের সানুপুঙ্খ অভিজ্ঞতা মুদ্রিত হবে। নিজের বাইরে বড়োসড়ো যে-জগৎটি রয়েছে, তার স্বরূপ উপলব্ধি ও ব্যাখ্যার জন্যে চেতনা নিজস্ব স্বতন্ত্র প্রকরণ তৈরি করে নেয়। বিশেষত সময় ও পরিসরের ধারণা যথাপ্রাপ্ত জগৎ থেকে নিষ্পন্ন হয় না কখনো। চেতনা মানে অপরতার প্রত্যয়, একথা বলেছেন বাখতিন। চিন্তার নব্য-কাণ্টীয় প্রকরণ দিয়ে তিনি সত্তা ও অপরের দ্বিবাচনিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। নিঃসন্দেহে তাঁর ভাবনার নির্যাস মার্ক্সীয় দ্বন্দ্ববাদের মৌল স্বরূপে নিষ্ণাত।

 সত্তা সম্পর্কে আমাদের অনুভব কিংবা অপর ব্যক্তিদের অপরতা সম্পর্কে আমাদের অনুভব পারস্পরিক অন্বয় ও অনন্বয়ের যে-বয়ন তৈরি করে—সেখানেই বাখতিনের জ্ঞানতত্ত্ব ও নন্দনতত্ত্ব আধারিত। জীবনে ও শিল্পে তাৎপর্যের অন্তর্বস্তু ও প্রকরণ স্বভাবত গড়ে ওঠে একই প্রক্রিয়ায়। যেহেতু সম্পর্কে সংলগ্নতা না কেবল—ব্যবধানও থাকে, সেতু নানাভাবে গড়ে ওঠে। অন্তত সেতুর সম্ভাবনাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না কখনো। সূক্ষ্মভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিক, নৈতিক ও নান্দনিক সমস্যাগুলি পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষায় যেমন সমস্ত একটি অভিন্ন বস্তুতান্ত্রিক ঐক্যে বিধৃত, তেমনি বাখতিনের বহুস্বরিক যুক্তি-শৃঙ্খলায় আপাত-ভিন্ন অস্তিত্ব সমান্তরাল অবস্থানের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক ঐক্যপ্রতীতির সম্ভাবনাকে কর্ষণ করেছে। দীর্ঘ চিন্তাজীবন জুড়ে তিনি এই মৌল আকল্পকে অনুসরণ করে গেছেন: ‘artistic form and meaning emerge betwen people’ (তদেব: ১৩)। শৈল্পিক প্রকরণ ও তাৎপর্য যদি জনসাধারণের পারস্পরিক বিনিময়ের প্রভাব থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে আধার ও আধেয়ের বহুমুখী দ্বিবাচনিকতা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষিত আগাগোড়া তাঁর ভাববিশ্বে অনুসৃত হয়েছে। দার্শনিক ও নৈতিক উপাদানের সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সর্বদা তাঁর নজরে পড়ে বলে বিমূর্তায়নের প্রতি তত্ত্ববিদদের স্বাভাবিক ঝোঁককে তিনি অনেকখানি এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। সাহিত্যতাত্ত্বিক আলোচনায় চেতনার ঐতিহাসিক ভিত্তিকে তিনি কখনো ভুলে যাননি। বস্তুত বাখতিনের দ্বিবাচনিকতা সর্বতোভাবে সামাজিক চরিত্রসম্পন্ন এবং লোকায়ত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। যাঁরা শ্লেষের ভঙ্গিতে ও আত্মপ্রতারণার তাগিদে বলেন, ১৯১৭ সালের পরে ‘সরকারি বৌদ্ধিক অবস্থান’ (অর্থাৎ মার্ক্সীয় চেতনা) এড়িয়ে চলা বাখতিনের পক্ষে অসম্ভব ছিল—তাঁরা আসলে তাঁর জীবনব্যাপ্ত সত্যনিষ্ঠাকে অবমাননা করেন। এঁদের এইসব কথাবার্তা প্রতিভাবাদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এঁরা প্রমাণ করেন যে চোখ থাকলেও সবাই দৃষ্টিমান হয় না। তাঁরা যা দেখতে চেয়েছেন তা-ই দেখেছেন। মার্ক্সবাদের মধ্যে তাই এঁরা কেবলই খুঁজে পান ‘monolithic orthodoxy’ এবং পরস্পর-বিরোধী প্রবণতার সমন্বয়। এমনকি, তাঁদের ধৃষ্টতা এই বলে সীমা ছাড়িয়ে যায় যে মার্ক্সবাদ নাকি আদৌ রুশ সমাজতন্ত্রের বৈপ্লবিক চালিকাশক্তি নয় (তদেব: ৩৯৪)। ইতিহাসের অপব্যাখ্যা করার এই নবার্জিত ঔদ্ধত্য এঁরা পেয়েছেন বিশ্বপুঁজিবাদের রুশ ‘মিত্র’দের মধ্যে যারা আশির দশকের শেষে অকল্পনীয় অন্তর্ঘাত করে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। অতএব বাখতিনের ভাববিশ্বেও তাঁরা একই ধরনের প্রতিবৈপ্লবিক অন্তর্ঘাত করার জন্যে তাঁর তত্ত্ব থেকে মার্ক্সীয় অনুষঙ্গের সমস্ত সম্ভাবনাকে মুছে ফেলতে তৎপর।


পাঁচ

নব্বইয়ের দশকের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখছি, গত কয়েক বছর থেকে পৃথিবী জুড়ে চলছে তত্ত্ব-সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া ঔপনিবেশিক কৃৎকৌশলের তাণ্ডব। ইতিহাসের প্রতিবেদনকে নস্যাৎ করার জন্যে নানা আয়োজন চলেছে প্রতীচ্যের প্রতাপসংলগ্ন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। কখনো শুনছি উত্তর-মার্ক্সবাদের প্রস্তাবনা, কখনো দেখছি নব্য-ঐতিহাসিকতাবাদের ঝলকানি। একই সুতোয় গাঁথা বাখতিনের ভাববিশ্বে মার্ক্সীয় চেতনার গৌণ ভূমিকা প্রমাণের চেষ্টা। আবার একই নিঃশ্বাসে প্রতীচ্যের তাত্ত্বিক একথাও বলেছেন যে মার্ক্সবাদী প্রেক্ষণের কিছু কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বাখতিনকে আকর্ষণ করেছিল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দর্শনে সমস্ত ক্রিয়ার সামাজিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি যেভাবে স্বীকৃত হয়ে থাকে, বাখতিনের বিশ্ববীক্ষায় তার প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট—এটাও তাঁরা অস্বীকার করতে পারেননি। ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উচ্চারণের সামাজিক নির্দিষ্টতা মেডভেডেভ ও ভোলোশিনোভের নামে প্রচলিত রচনাগুলিতে মুখ্য আকল্প হিসেবে উপস্থিত। তাছাড়া এই দুটি নামে এবং স্বনামে লিখিত প্রতিবেদনে ব্যক্ত অনেকার্থদ্যোতনার ভাবনায় ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক শ্রেণীর গুরুত্বের কথা বাখতিন বিশেষভাবে বলেছেন। এই ব্যাপারকে পাশ কাটাতে না-পেরে ঐ তাত্ত্বিকেরা বলেছেন, এতে মার্ক্সীয় চেতনার বিশেষত্ব নেই কেননা আরো অনেক সামাজিক তত্ত্ব ও দর্শন এরকম কথা বলে থাকে। রাবেলে ও তাঁর জগৎ বইতে বহুচর্চিত কার্নিভালের ধারণায় যদিও শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অনুষঙ্গ দিবালোকের মতো স্পষ্ট, সামাজিক তাৎপর্যবহ উচ্চারণে একক বাচনের অনন্যতা ও বিশেষত্ব বেশি প্রকাশিত হয়েছে—এই হলো তাঁদের অভিমত। এতে তাঁরা অবসংগঠন ও অধিসংগঠনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের অভিব্যক্তি দেখতে চাননি। একদিকে তাঁরা বলছেন, মার্ক্সীয় চেতনার অনুষঙ্গ বাখতিনের মধ্যে খোঁজা নিরর্থক, অন্যদিকে বলছেন, রুশ ইতিহাসের বিশিষ্ট বিকাশের পথ ধরে তিনি মার্ক্সবাদীদের পুঁজিবাদ-বিরোধী আবেগের অংশীদার হয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে চমৎকার সিদ্ধান্ত সম্ভবত এই যে: ‘Bakhtin's explicit hostility to the isolating and alienating nature of capitalist social relations is cognate with one version of Marxism though it clearly does not imply any commitment to a belief in the socialist transformation of society.’ (তদেব: ১৫)। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

 বাখতিন/মেডভেডেভ বা বাখতিন/ভোলোশিনোভ যেভাবে নিজেদের যুক্তি সাজিয়েছেন, তা অনুসরণ করে আমরা বিভিন্ন বর্গের উচ্চারণকে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বহুস্বরিক ফসল বলে বুঝতে পারি। সেই সঙ্গে আমাদের ধারণা হয়, কীভাবে দ্বিবাচনিকতার তাত্ত্বিক আকল্প ক্রমশ দৃঢ়মূল হয়েছে। দেখি, জটিল ও বিচিত্র প্রকরণের মধ্য দিয়ে বাচন, উচ্চারণ, প্রতিবেদন, জনসাধারণ, সামাজিক বর্গ অনবরত মিথষ্ক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে এবং রূপ থেকে রূপান্তরে পরস্পরকে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে মার্ক্সীয় চেতনার নির্যাস গভীর সংবেদনা নিয়ে উপস্থিত। যাঁরা নিতান্ত কুযুক্তির বশে তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে বাখতিনের অবস্থান মূলত মার্ক্সবাদের অনেক বাইরে এবং তিনি পীড়নপ্রবণ সরকারি ভাবাদর্শের কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলেন—তাঁরা জেনে-শুনে সত্যের অপলাপ করেন। তাঁরা বাখতিনের জীবন-সত্য এবং সত্য-সন্ধানকে জানতে চান না এবং নিজেরা আসলে শ্রেণী-বিভাজক বিশ্বপুঁজিবাদের তলপিবাহক হিসেবে প্রগতিবিরোধী সরকারি প্রতিভাবাদর্শের ধ্বজ বহন করেন। তাঁরা বাখতিনকে নিজেদের প্রয়োজনমাফিক পিঞ্জরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে ছেঁটে নিতে চান এবং পছন্দসই সেই প্রতিবাখতিনকে সমাজতান্ত্রিক চেতনায় সফল অন্তর্ঘাতক বলে প্রমাণ করতে চান। মার্ক্সীয় ভাবনার পরিমণ্ডলকে যাঁরা রুদ্ধ পরিসরের অচলায়তন বলে নিন্দা ও প্রত্যাখ্যান করেন—কার্যত তাঁরাই মতান্ধ ও নিরন্ধ্র স্থবিরতার উপাসক। অথচ বাখতিন সৃজনশীল ভাবে মার্ক্সীয় চেতনার পরিধিকে বিকশিত করে গেছেন; তাঁর এই পরিশীলিত বৈদগ্ধ্য ও অনুভূতির নিবিড়তা ঐসব তথাকথিত তাত্ত্বিকদের মনের অন্ধকার কাটাতে পারেনি।

 মেডভেডেভ/বাখতিনের The Formal Method in Literary Scholarship: A Critical Introduction of Sociological Poetics বইটি প্রকরণবাদের সঙ্গে মার্ক্সীয় বীক্ষণের দ্বিবাচনিক মিথষ্ক্রিয়ার ফসল। সাহিত্যের সঙ্গে ব্যবহারিক ভাষার বিচ্ছেদ মেনে নিলে শেষ পর্যন্ত অন্তর্বস্তু, মূল্যবোধ, ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে লিখন-প্রক্রিয়া, সমালোচনা ও তাৎপর্য-সন্ধানের বৈদগ্ধ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য। মেডভেডেভ/বাখতিন দেখিয়েছেন, নির্দিষ্ট ভাবাদর্শের আবহে সমস্ত লেখা জন্ম নেয় এবং বিকশিত হয়; সাহিত্যের পরিধির ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত মূল্যবোধকে কখনো মেনে নেয় প্রতিটি মানবিক উচ্চারণ কখনো বা বিরোধিতা করে। পার্থক্য ও সমান্তরালতার দ্বিবাচনিকতাকে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার আবহে প্রয়োগ করে লেখক দেখিয়েছেন, অন্তর্বস্তু ও প্রকরণের তুলনামূলক গুরুত্বকে বুঝতে হবে ভাবাদর্শের সামগ্রিকতায়—‘within the bounds of the unified sociological laws of development’ (তদেব: ২৯)। অর্থাৎ দ্বন্দ্ববাদের নিষ্কর্ষকে সাহিত্য ও ভাবাদর্শপ্রসূত প্রকরণের সম্পর্ক বোঝাতে কাজে লাগিয়েছেন। মেডভেডেভ/বাখতিনের মূল আকল্প হলো: ‘The language of art is only a dialect of a single social language’ (তদেব: ৩৬)।

 ভোলোশিনোভ/বাখতিনের Freudianism: A Marxist Critique বইতে এই যুক্তিবিন্যাস আরো একটু প্রসারিত হয়েছে। অবচেতনা সম্পর্কে ফ্রয়েডীয় ধারণাকে অন্তর্বৃত সামাজিক ভাষার নানা পরস্পরবিরোধী ও বহুস্বরিক বিভঙ্গের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এখানে। মনস্তাত্ত্বিক জীবনকে সামাজিক বর্গায়তনের দ্বিবাচনিকতায় প্রতিস্থাপন করে লেখক মানবিক বাচনের নতুন দ্যোতনা আবিষ্কার করেছেন যেন। তাঁর প্রণিধানযোগ্য সিদ্ধান্ত হলো: ‘Only as a part of social whole, only in and through a social class, does the human person become historically real and culturally productive.’ (তদেব: ১৫) স্পষ্টতই এই বক্তব্য মার্ক্সীয় চেতনার ফসল। তেমনি Marxism and the Philosophy of Language বইতে ভোলোশিনোভ/বাখতিন নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন, সামাজিক জীবনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অর্জিত জীবনের অভিজ্ঞতা চিহ্নায়কের নিয়ন্তা এবং সেইজন্যে যাবতীয় মানবিক তাৎপর্যের সূত্রধার। শুধু যে বাস্তবতার যথাপ্রাপ্ত অংশ হিসেবে চিহ্নায়ক সক্রিয় থাকে, তা-ই নয়; সমান্তরাল ভাবে বিদ্যমান অপর বাস্তবতার বিচ্ছুরণও ঘটে ঐ চিহ্নায়ক থেকে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাবাদর্শপ্রাণিত দৃষ্টিকোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোলোশিনোভ/বাখতিন লিখেছেন: “Every sign is subject to the criteria of ideological evaluation (i.e., whether it is true, false, correct, fair, good etc.). The domain of ideology coincides with the domain of signs. They equate with one another. Whenever a sign is present, ideology is present, too. Everything ideological possesses semiotic value.’ (তদেব: ১০)। এই মন্তব্যের শেষ দুটি বাক্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ভাবাদর্শহীন কোনো চিহ্নায়ক হয় না বলে সময় ও পরিসরের অনুষঙ্গ ছাড়া তার তাৎপর্যের প্রতীতিও কখনো হতে পারে না। ভাষার অন্তর্বর্তী বহুস্বরিক সম্ভাবনাকে লেখক সর্বদা প্রত্যক্ষ করেছেন বর্গবিভাজিত সমাজের দর্পণে, ভাবাদর্শের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী প্রেক্ষিতে এবং সর্বোপরি সত্তা ও অপরতার দ্বিবাচনিক আয়তনে। ভাষার সামাজিক চরিত্রই চিহ্নায়কের নান্দনিক মাত্রা নির্ধারণ করে এবং সেই সূত্রে গ্রথিত হয়ে পড়ে প্রতিবেদনের পরিসরও। কোনো উচ্চারণ যখন অপর উচ্চারণের সীমানাকে ছোঁয়, তখনই বাচনিক মিথষ্ক্রিয়ার সূচনা হয়। সেই বিন্দুতে জীবনও সচল হয়ে ওঠে। জন্ম নেয় উপন্যাসের নীহারিকাপুঞ্জ। সুতরাং গভীর অন্তর্বৃত যুক্তিশৃঙ্খলায় মেডভেডেভ/বাখতিন ও ভোলোশিনোভ/বাখতিন পরিণততর বাখতিনের মননক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং মার্ক্সীয় চেতনার পরিসর ধারাবাহিক ভাবে পরিশীলিত হয়ে তাঁর অণুবিশ্বকে গড়ে তুলেছে—এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয় নিতে পারি আমরা। এই পরিপ্রেক্ষায় একক ও সামূহিক বাচনের দ্বিবাচনিকতায় সংগঠিত প্রতিবেদনের নান্দনিক ও সামাজিক তাৎপর্য আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আরো। কিন্তু এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।


ছয়

রাবেলে ও তাঁর জগৎ, ডস্টয়েভস্কির নন্দন-বিষয়ক সমস্যাবলী, দ্বিবাচনিক কল্পনা, বাচন-মাধ্যম ও অন্যান্য পরবর্তী রচনা ইত্যাদি বইতে মার্ক্সীয় সাংস্কৃতিক তত্ত্বপ্রস্থানকে যেন বাখতিন নতুন-নতুন আয়তনে নিয়ে গেছেন। কোনো প্রচলিত পথে তা হয়নি; নিজের পথ ও পাথেয় তিনি নিজেই পুনর্নির্মাণ করেছেন বারবার। সাধারণ বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনি লোকসমাজের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে উপেক্ষা করেননি; বরং তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন সঞ্জীবনী সুধা। উপন্যাসের প্রতিবেদনে তিনি যে শিল্পসংবিদের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ লক্ষ করেছেন, এর কারণ, লোকায়ত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি বয়নের শরীর ও আত্মাকে নির্মাণ করে। এসময় বাখতিন যেসব পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাদের মধ্যেও লোকজীবনের অনুষঙ্গ খুব স্পষ্ট; যেমন: ‘কার্নিভাল’। রাবেলে-বিষয়ক বইতে তিনি লিখেছেন, জনসাধারণ কার্নিভালকে দেখে না কেবল—তারা এর মধ্যে বাসও করে। বলা ভালো, প্রত্যেকে থাকে এতে। শব্দটির অভিধাগত অর্থ যদি বিচার করি, দেখব, জনগণের সমগ্র অংশ এর সঙ্গে যুক্ত। যখন কার্নিভাল চলতে থাকে, তার বাইরে জীবনের কোনো স্পন্দন থাকে না। যেহেতু এর পরিসরের কোনো সীমান্ত নেই, একে কেউ এড়াতে পারে না। কার্নিভাল যখন চলে, কেবলমাত্র তারই নিয়ম অনুযায়ী জীবন-যাপন করা সম্ভব; তবু এর মধ্যে সবাই পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। সর্বজনীন চরিত্র এর সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য; সমগ্র জগতের পুনরুদয় ও পুনর্নবায়নকে কেবলমাত্র তারাই অনুভব করতে পারে যারা কার্নিভালে অংশ নেয়। বাখতিনের বক্তব্য নিবিড় ভাবে বিশ্লেষণ করলে আমাদের মনে হয়, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনাই কার্নিভালের আকল্পকে গড়ে তুলেছে। ১৯১৭ সালের যুগান্তকারী ঘটনায় ব্যক্ত হয়েছে যৌথ বিশ্বাসের স্বপ্নময় সামগীতি; একে বলা যেতে পারে শোষিত-নিপীড়িত-প্রান্তিকায়িত মানুষের উজ্জীবনের উৎসব। এ কেবল বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর যান্ত্রিক প্রবর্তনা নয়; রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের আরোপিত দীর্ঘতম অমারাত্রির পরে এ যেন উজ্জ্বল ভোরের কুসুমিত হয়ে ওঠা। প্রতিটি মানুষ সেখানে নবনির্মাণের হোতা এবং লক্ষ্যস্থল; বিপ্লব যেন মানুষের সমস্ত রুদ্ধ সম্ভাবনাকে মুক্ত করার উৎসব। বৈপ্লবিক পরিসরেরও সীমারেখা নেই কোনো এবং প্রতিটি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে তা যেহেতু অনবরত পূর্ণ হয়ে ওঠে—প্রত্যেকের স্বাধীনতা সেখানে চূড়ান্ত। অতএব কার্নিভাল রাজনৈতিক অবচেতনায় সম্পৃক্ত, এতে সংশয়ের অবকাশ নেই।

 ত্রিশের দশকে সমগ্রের এই উৎসবে অন্তর্ঘাত করছিল যান্ত্রিক ও মতান্ধ রাষ্ট্রিক আমলাতন্ত্র। বাখতিন নিজেও নির্বাসিত হয়ে লক্ষ করেছিলেন কীভাবে জনসাধারণের উজ্জীবনের স্বপ্ন ও উৎসবের আবহ থেকে সর্বজনীন চেতনা সংকুচিত হয়ে ক্রমশ বিষাদে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু এইজন্যে লোকায়ত সংস্কৃতির শৌর্য ও লাবণ্য সম্পর্কে তাঁর মৌল প্রত্যয় হারিয়ে যায়নি। কার্নিভালের আকল্পে তিনি লোকজীবনের অন্তর্বৃত ভাবাদর্শগত শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে এও দেখিয়েছেন, নান্দনিক আকরণ-অন্তর্বস্তু-কৃৎকৌশল-প্রতিবেদনের গ্রন্থনায় ঐ শক্তি কত বিচিত্র ভাবে ব্যক্ত হয়ে থাকে। ফলে শুধু যে সাহিত্য ও শিল্প বদলে যায়, তা-ই নয়; জীবন ও সমাজ আমূল রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেমন হির্শকোপ বলেছেন, মার্ক্সীয় সাংস্কৃতিক তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে বাখতিনের মৌলিক অবদান রয়েছে। তাঁর মতে, বাখতিন একমাত্র তাত্ত্বিক—‘for whom popular culture is the privileged bearer of democratic and progressive values’ (১৯৮৬: ৯২)। জনসমাজের মধ্যে প্রচলিত ও মান্যতাপ্রাপ্ত সংস্কৃতিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন বাখতিন; তাঁর তাত্ত্বিক সন্দর্ভের মৌল ভিত্তিও ওখানে। অন্তর্নাট্য ও বহির্নাট্যের দ্বিবাচনিকতায় উন্মোচিত হলো এই সত্য, কার্নিভালের আশ্রয়ভূমিতে—‘Power was forced out of the wings and onto the stage where it could be displayed, mocked, contested and transformed.’ (তদেব)। ব্যক্তিগত জীবনে যত দুর্যোগই নেমে আসুক, বাখতিন কিন্তু সদ্য অতীত ও সমকালীন ইতিহাসের দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর আস্থা হারাননি। সামাজিক ও বৌদ্ধিক অস্থিরতা ও রূপান্তর, বিভ্রান্তি ও নিরীক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে ‘দ্রষ্টা চক্ষু’র প্রয়োজনকে অনিবার্য করে তুলছিল। সত্যভ্রম ও সত্যকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বীক্ষণের দর্পণে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করার উপায় খুঁজছিলেন বাখতিন। কার্নিভালের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন বহুস্তরান্বিত ইতিহাসের প্রতিবেদনে ইতিবাচক ও গঠনমূলক অন্তর্ঘাত ঘটানোর উপযোগী আয়ুধ। একদিকে প্রকরণবাদী নন্দনের প্রচ্ছায়া এবং অন্যদিকে আধুনিকতাবাদের জায়মান চিহ্নায়কগুলির ইশারা—এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের পথ তাঁকে তৈরি করে নিতে হলো। এই পথ কার্যত লোকায়ত অনুষঙ্গের পুনর্নির্মাণে গড়ে উঠেছে।

 প্যারডি, শ্রুতিসাহিত্যের শৈলী, প্রকল্পনা, প্রহসন, তির্যক বাচন এবং দ্যুতিময় হাসি প্রকৃতপক্ষে লোকায়ত বিনির্মাণের বিশিষ্ট ধরন হিসেবে কার্নিভালকে প্রতিবাদী ভাবাদর্শের আকর করে তুলেছে। এই বিনির্মাণ হলো দ্বিবাচনিকতার প্রায়োগিক দর্শন যার উপযোগিতা ও তাৎপর্য ইতিহাসের প্রেক্ষিতে রচিত হয়। প্রাগুক্ত ধরনগুলির মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘active discursive intervention conditioned by precise social and historical circumstances.’ (তদেব: ৯৩)। এভাবে নতুন প্রতিবেদনের যে যুক্তিবিন্যাস ফুটে উঠেছে, তাতে ব্যাকরণের বিধি কিংবা বাস্তবতার প্রত্যক্ষ অনুশাসন বড়ো নয়। সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যে দ্বিবাচনিকতার আধার ও আধেয় খুঁজেছেন বাখতিন, তাতে বাস্তবতা ও ব্যাকরণ পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। আসলে আধিপত্যবাদীদের প্রতাপাত্মক সন্দর্ভে কার্নিভালের তির্যক হাসি দিয়ে অন্তর্ঘাত করতে চেয়েছেন তিনি। নিম্নবর্গীয়দের নিরুচ্চার অবস্থান থেকে লক্ষ করেছেন সংঘর্ষ ও ঘাত-প্রতিঘাতে বিক্ষত রুশ সমাজকে। দ্বিবাচনিকতা যেন মুখোশের আড়াল থেকে মুখের আদল আবিষ্কার করার নিরন্তর প্রক্রিয়া, অপ্রতিহত এক প্রতিজ্ঞা। বাখতিনের প্রবাদপ্রতিম উচ্চারণ আমাদের মনে পড়ে আরো একবার: ‘প্রতিটি তাৎপর্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়’ এবং ‘প্রতিটি তাৎপর্য সামাজিক’। কার্নিভালের আকল্প যেন আরো একটু এগিয়ে আমাদের জানাতে চাইছে, যে-দিকে আলো পড়ে না সাধারণত—সেদিকেই খুঁজতে হয় আলোর আর্তি। তখন নতুন ঠিকানায় পৌঁছাতে পারি, অতিব্যক্ত স্বরের বদলে অনাবিষ্কৃত স্বরের শৌর্য ও সৌন্দর্য গড়ে নিতে পারি। ফলে সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিচারে এই প্রক্রিয়া কখনো নিরপেক্ষ হতে পারে না। প্রতিটি উচ্চারণকে তাৎপর্যবহ হতে হলে ভাবাদর্শগত প্রেক্ষিত, শ্রেণীবিভাজিত সমাজের অতীত ও বর্তমানকে স্বীকার করতে হয়। প্রান্তিকায়িত লোকসমাজ নিজস্ব তাগিদে যথাপ্রাপ্ত জগৎকে বিনির্মাণ করে; কেননা তা-ই সার্বিক পুনর্নির্মাণের আবশ্যিক ও ন্যূনতম প্রাক্‌শর্ত।

 বাখতিন জানিয়েছেন, প্রতিবেদনের সামাজিকতা সমস্ত নান্দনিক উদ্যোগকে অর্থবহ করে তোলে এবং নিজস্ব নিয়তির দিকে নিয়ে যায়। ‘Discourse in the Novel’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন ‘the life destiny of given discourse’ (১৯৮১: ২৯২) এর কথা যাকে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অনুভব করতে হয়। পার্থক্য ও সমান্তরালতার উপলব্ধিতে স্পন্দিত বিভিন্ন বিষয়ের চেতনা একে অপরকে সৃষ্টি ও রূপান্তরিত করে চলেছে। বাখতিন যে সামাজিক প্রেক্ষিতকে উপস্থাপিত করেছেন, চেতনার বহুত্ব তার গোত্রলক্ষণ। আবার এর মধ্যে সন্নিবেশিত হচ্ছে বিবিধ অপরতার ধারাবাহিক অভিব্যক্তি। দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ার শেষ নেই এবং তাতে বিচ্ছেদও নেই। বিভিন্ন দৃষ্টিকোনের আভাস দিয়ে জটিল-এক সমগ্রতার আকরণ এরা গড়ে তোলে। সংশয়পীড়িত সময়-পর্বেও বাখতিন যে অনেকার্থদ্যোতনার তাত্ত্বিক আকল্প তুলে ধরতে পেরেছেন, এতে তাঁর একক বাচনের প্রতিরোধ-আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে। আবার, দ্বিবাচনিকতার নিরন্তর প্রবাহ যেহেতু লক্ষ করছেন তিনি—সমাজতান্ত্রিক নবনির্মাণের প্রতিজ্ঞাও সৃজনশীল ভাবে পুনর্বিন্যস্ত হলো। সামাজিক কৃত্যের বহুত্ব দ্বন্দ্ববাদে অস্বীকৃত হয়, তা কিন্তু নয়। বাখতিন যেমন প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি পরিসরের কথা ভেবেছেন, তেমনি সামূহিক বাচনের আশ্রয় হিসেবে সমগ্র কাল ও সমগ্র পরিসরের কথাও ভেবেছেন। তবে তাঁর বিশেষত্ব হলো, সত্যের উদ্ভাসনে ‘dialogically interrelated set’ (তদেব: ২৯৩) এর গুরুত্বকে তিনি সর্বাত্মক করে তুলেছেন। এভাবে দ্বিবাচনিকতা ভাবাদর্শগত সংগ্রামেরও বিশিষ্টতম আয়ুধ হয়ে উঠেছে যা ব্যক্তিকে সামাজিক প্রেরণায় গ্রথিত করে বারবার। সুতরাং বাখতিন মার্ক্সীয় চেতনার নির্যাসকে সৃষ্টিশীল ভাবে প্রয়োগ করে সমকালের সংশয়কুহেলি ছিন্নভিন্ন করেছেন এবং চিরদিবসের সূর্যকে সমকাল থেকেও আরো বেশি সংশয়কণ্টকিত ভবিষ্যতে ঈপ্সিত দিগন্তের দিশারি করে রেখেছেন—একথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।

 বাখতিন কি তাহলে তাঁর তত্ত্ববিশ্বকে কল্পিত স্বর্গের আদলে গড়তে চেয়েছেন? তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসী হিসেবে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের বহুবাচনিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে, আমাদের কিন্তু তা মনে হয় না। বহুদিন মার্ক্সবাদীদের নতুন মানবসমাজের স্বপ্ন দেখার জন্যে কল্পিত স্বর্গের নির্মাতা বলে ঠাট্টা করা হয়েছে। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। বাখতিনের আকল্প অনুযায়ী প্রতাপের কথা না-বলে ভাষা-বাচন-প্রতিবেদনের কথা বললে তার কোনো তাৎপর্য থাকবে না। পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক শোষণের আবহে কোনো আন্তরিক উচ্চারণ সম্ভব নয়। তাছাড়া ‘নিরপেক্ষ’ উচ্চারণ বলে কিছু হতে পারে না; কখনো বা প্রতাপের বশীভূত কখনো প্রতাপের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিব্যক্তি। এই হলো প্রতিবেদনের অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক চেতনার দ্বিবাচনিক প্রেক্ষিত। বাখতিনকে যাঁরা রাজনীতির সংক্রমণ থেকে মুক্ত করার জন্যে মার্ক্সবাদের সঙ্গে তাঁর সমস্ত সম্পর্ক মুছে ফেলতে চান—তাঁরা আসলে বাখতিনীয় অণুবিশ্বকে প্রত্যাখ্যান করেন। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের চূড়ান্ত প্রযুক্তিনির্ভর আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়ে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিকায়িত জনসাধারণ যখন বিশ্বপুঁজিবাদের একবাচনিক সন্দর্ভে কেবল সন্ত্রাসের অনেকান্তিক বয়ন দেখতে পাচ্ছে—সেসময় বাখতিনের দ্বিবাচনিকতা ও অনেকার্থদ্যোতনা, কার্নিভাল ও বহুস্বরিকতা যেন প্রতিবাদের আয়ুধ যোগান দিচ্ছে। যাকে ব্যারি রুটল্যাণ্ড ‘dialogic flux of collective desire’ বলেন, তারই প্রেরণায় তৃতীয় বিশ্বের দেশে-দেশে জেগে উঠছে জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা। অতিকেন্দ্রায়িত একবাচনিক সন্দর্ভের বিস্তার প্রতিরোধহীন তৃতীয় বিশ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে-রুদ্ধতার আশঙ্কা তৈরি করছে, তার বিপ্রতীপে বাখতিনের প্রস্তাবিত কার্নিভাল ও দ্বিবাচনিকতা তুলে ধরছে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের পতাকা। সাম্প্রতিক ইতিহাস ও রাজনীতি বিশ্বায়নের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষিতে যখন ক্রমশ জটিলতর হয়ে উঠছে, একদিকে আধুনিকোত্তর ও অন্যদিকে উপনিবেশোত্তর জীবনের পার্থক্য ও সমান্তরালতা অনৈক্য এবং ঐক্যের অভূতপূর্ব ও অন্যোন্য-উদ্ভাসন সম্ভব করে তুলেছে—সেসময় দুটি প্রাগুক্ত আকল্প বিচিত্র বহুস্বরিকতার আধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের উপর আন্তর্জাতিক পণ্যায়নের অভিঘাত যখন প্রবলতম, বাখতিনের ভাববীজগুলি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। কেননা সেইসব আকল্প ‘display...a built-in affinity for the oppressed and the marginal.’ (রবার্ট স্ট্যাম: ১৯৮৯: ২১)। কার্নিভালের মধ্য দিয়ে প্রকাশমান দ্বিবাচনিকতা তাই এই মুহূর্তে নিপীড়িতের রণকৌশল হিসেবে গৃহীত হতে পারে। মার্ক্সীয় চেতনার যা মৌল লক্ষ্য, বাখতিনের মধ্য দিয়ে আমরা আজ পৌঁছে যেতে পারছি সেই প্রতিবাদী প্রক্রিয়ায় যার সাহায্যে প্রান্তিকায়িত বর্গ বিকেন্দ্রায়নের আধেয় হয়ে উঠতে পারে। অবজ্ঞাত তৃতীয় বিশ্বে এইজন্যে এখন বাখতিন যেন পুনরাবিষ্কৃত চেতনার অক্ষয় তূণীর, মানবিক উদ্ভাসনের ভরসাস্থল, অন্তেবাসীদের পুনরুজ্জীবনের উৎস।