বিষয়বস্তুতে চলুন

বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী/শিল্পীর ক্রিয়াকাণ্ড

উইকিসংকলন থেকে

শিল্পীর ক্রিয়াকাণ্ড

“পৃথক্‌ পৃথক্ ক্রিয়াভিহি কলাভেদস্তু জায়তে”

    —শুক্রাচার্য্য।

 ক্রিয়ার ভেদে হ’ল নানারূপ কলা। কুমোর কাঠামোটায় যখন মাটি চাপিয়ে ক্রিয়া করে' গেল, তখন হ’ল ঠাকুর গড়া, আবার সে যখন ঢাকের উপরে মাটি চাপিয়ে গড়তে চল্লো তখন সে ক্রিয়ার ফলে হ’ল হাঁড়িকুঁড়ি। ধুনুরী তাঁতের যন্ত্রে ঘা দিয়ে তুলো ধুনে' চল্লো, সেই লোকই আবার আর একটা তারের যন্ত্রে অন্ত ক্রিয়া করে সুরের স্মৃষ্টি করলে। কামারের হাতুড়ি লোহাকে পিটে' ঠিক করে দিলে। ভাস্করের হাতুড়ি পেটার ক্রিয়া থেকে বার হ'য়ে এল অষ্টধাতুর এবং পাথরের দেবতা মানুষ হাতী ঘোড়া মন্দির মঠ ইত্যাদির নানা সাজ-সরঞ্জাম। ছবি লেখা হাতুড়ি চালানোর ফলে হয় না; কলম চালানো তুলি চালানোর ক্রিয়া জানা হ’ল তো ছবি হ’ল। আবার তুলি বুলিয়ে পাথর কাটা চল্লো না, সারং বাজিয়ে তূলো ধোনাও গেল না—যদিও কেউ কেউ সুর ধোনে বটে! ছবিটা লেখা, তাই অন্য লেখার সঙ্গে তার মিল লেখনীর দিকে। ছবি আঁকা দেখ তুলি দিয়েও চল্লো কলম দিয়েও হ’ল। জাপানে তারা কবিতা লিখলে, রসিদ লিখলে এবং ছবিও লিখলে একই তুলিতে। এটা দেখছি যে কতক শিল্পকর্ম বড় একটা যন্ত্রের খুঁটিনাটি অপেক্ষা না করেই সহজে সুনিষ্পন্ন হয়ে যায় আর কতক শিল্পকর্ম যান্ত্রিকভাবে নিম্পন্নই হ’তে চায়। শিল্পে যে উচ্চ নীচ ভেদ হয়েছে তা’ যান্ত্রিক ক্রিয়ার বাহুল্য ও তার অভাব নিয়ে। কুমোর তাঁতি এরা অনেকখানি যন্ত্রের ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে' কায করে' যায়—না করে তার উপায় নেই—কিন্তু পুতুল গড়বার বেলায় কুমোরের বৌ শুধু হাতেই নানান খেলনা গড়ে' চলে। ক্রিয়া যেখানে যন্ত্রের দ্বারা না হ’লে হয়ই না সেখানে কর্মটা কলে যেন জলের মতে নিম্পন্ন হ’য়ে গেলেও তার যান্ত্রিকতা একেবারে সুস্পষ্ট বিদ্যমান থাকে। এর ঠিক উল্টো হয় উচ্চ অঙ্গের শিল্পে, ক্রিয়ার যান্ত্রিকতা সেখানে যেটুকু বা থাকে সেটা আন্তরিকতায় ঢাকা পড়ে' যায়।  ক্রিয়ার বা techniqueএর কৃত্রিমতা ও অকৃত্রিমতা ভেদ নিয়ে কতক শিল্প পড়লো fine artএর কোঠায়, কতক শিল্প রইলো craftsএর কোঠায়। মনের আনন্দে গলা ছেড়ে' যখন গান গাওয়া, তখন সেটা Granophoneএ কালোয়াতি গাওনার থেকে অনেকখানি বড় জিনিষ। আবার যখন গাইয়ে এক এক সময় নিজের গলাটাকে যন্ত্রের সঙ্গে এমন বেঁধে ফেল্লে যে নিজেই একটা Granophone হ’য়ে উঠলো সে তখন artist রইলো না—technician হ'ল মাত্র। ক্রিয়া বা techniqueকে ছাপিয়ে চলা হ’ল সুন্দর চলা। অকৃত্রিমভাবের চলার art বড় কম art নয়। নর্তন ক্রিয়ার মধ্যে, অভিনয়ের মধ্যে, সচরাচর চলা বলার থেকে অনেক বিষয়ে তফাৎ না করলে ভাল নাচ ভাল অভিনয় হয় না। কিন্তু এই দুই কলারই মূলমন্ত্র হ’ল অকৃত্রিমতা অর্থাৎ ক্রিয়ার যান্ত্রিকতা লুকিয়ে চলা বলা। সব কর্মের সঙ্গেই তার নিষ্পাদনের প্রক্রিয়া রয়েছে। মনের মধ্যে যা রয়েছে নানা ক্রিয়া ধরে সেটা যতক্ষণ প্রকাশ না হচ্ছে ততক্ষণ সে মনেই আছে বাইরে নেই। ব্যাকরণের অভিধানের নান। ক্রিয়া কর্ম বিশেষ্য বিশেষণ ধরে' মাসিক পত্রে মস্ত একটা সমালোচনা বা প্রবন্ধ বার হ’ল, তবেই জানলেম অমুক লোকটা অমুকের উপর চটেছে বা খুসি আছে, কি এ লোকটা এই ভাবছে ও লোকটা তাই ভাবছে।

 ছবিতেও রং রেখার কতকগুলো ক্রিয়া ধরে' তবে চিত্রকরের মনের কথা বার হয়ে এল। রং রেখার এক রকম ক্রিয়া করা গেল—ছবিটা হ’ল landscape, অন্য প্রক্রিয়ায় হ’ল portrait; আর এক রকমে রং রেখার ক্রিয়া করলেম, সেটা হ’ল caricature,—এক ক্রিয়ার ছবি দেগে লোককে কাঁদানো গেল, অন্য রকমে লোককে হাসানো গেল। তবে এও দেখছি artist যা করলে দর্শকের উপর তার প্রতিক্রিয়া হ’লই না, কিম্বা উল্টো হ’ল; যেখানে হাসা উচিত সেখানে হয়তো দর্শক কাঁদলে। প্রদর্শকের ক্রিয়ার অপকর্ষ কিম্বা দর্শকের বুদ্ধির অভাবও এর কারণ হতে পারে। বিদ্যুৎ চালনা করলে একটা মরা মাছও দেখেছি চমকে উঠলো, কিন্তু এক টুকরো পাথর সে সাড়াই দিলে না! সুতরাং পাত্রভেদে দর্শক শ্রোতা ও ভোক্তার ওপরে কলাসমূহের প্রতিক্রিয়া এক এক রকম হ’য়ে থাকে। এখানে যে ক্রিয়া করছে তার কোন হাত নাই। তার দেখবার বিষয় হচ্ছে যে কর্ম সে করলে তার উপযুক্ত ক্রিয়া সে আচরণ করলে কি না। কর্মের সুসম্পন্নতার দিকে চেয়েই শিল্পীর ক্রিয়া ক’রে চলা। কর্মটা কার ভাল লাগবে কি মন্দ লাগবে এ লক্ষ্য রেখে চলা যারা হুকুমে কিছু করছে তাদেরই পক্ষে অত্যাবশ্যক। কিন্তু ভিতরের তাগিদে যে মানুষ কর্ম করছে তার লক্ষ্য মনিব নয়—কর্মের সুচারুতার দিকেই তার দৃষ্টি। অন্য কর্ম্মের কথা থাক, শিল্পকর্মের যে নানা ক্রিয়া ত। কর্মভেদে শিল্পীকে অভ্যাসের দ্বারা এবং পরীক্ষার পর পরীক্ষার দ্বারা দিনের পর দিন ধরে' দখল করতে হ’ল। এসব জিনিষ হাতে কলমে করে’ শিখতে হ’ল। শিল্পশাস্ত্র ছন্দশাস্ত্র এমনি সব নানা পুঁথি পড়ে' গেলেই কেউ কারিগরিতে পাকা হ’ল না। করার অভ্যাসই কারিগরকে নিপুণ করে' তুল্লে। পড়ার অভ্যাস শাস্ত্রপাঠে নিপুণ করে, করার অভ্যাস কর্মে দক্ষতা দেয়, এটা ভারি সত্য কথা। যে কাজে যে যখন মজবুদ হ’তে চেয়েছে সে সেই কাযের নানা ক্রিয়া নিয়ে নাড়াচাড়া এমন কি খেলা করতে করতেও কর্ম সম্পাদনে পাকা হয়েছে। শিল্পশাস্ত্র পড়ে' শাস্ত্রী এবং একখানা শাস্ত্র না পড়েও লোকে শিল্পী হয়ে উঠলো এমন ঘটনা মানুষের ইতিহাসে বিরল নয়। ভাষা ও পুঁথির অক্ষর সৃষ্টি হবার পূর্বে গুহাবাসী মানুষ যে সব ছবি লিখলে এখানকার অনেকেই তেমন ক’রে হরিণ মহিষ বাঘ এ সব আঁকতে একেবারেই পারে না বলতে চাইনে, শুধু এইটুকু আশ্চর্য্যের বিষয় হয় যে প্রাচীনতম যুগের মানুষের হাতে শিল্পশাস্ত্র ছিল না অথচ তারা ভারে ভারে আশ্চর্য শিল্পসামগ্রী রেখে গেল পরবর্তিকালের পণ্ডিতদের শিল্পশাস্ত্র লেখার কার্যের সুবিধার জন্য। আফ্রিকার নিরক্ষর বর্বরদের মূর্তিশিল্প অতি আশ্চর্য ও মনোহর বলে' এখন ইউরোপে আদর পাচ্ছে বড় বড় শিল্পীর কাছে। কিন্তু সেই সব বর্বর জাতির মধ্য থেকে লিখিত শিল্পশাস্ত্র একখানিও পাওয়া যায়নি। তারা শিল্পক্রিয়া করে' চলেছে মাত্র। মানুষের এই ক্রিয়াশীল নিরক্ষর অবস্থায় গড়া জিনিষের থেকে পরবর্তীকালের ভাষাবিদ্‌ কলাবিদ্‌ বসে বসে আদিম শিল্পের একটা শাস্ত্র রচনা করলে, অলিখিতকে লিখিতের মধ্যে ধরলে। এই ভাবেই সব কালে সব দেশে শিল্পশাস্ত্র দেখা দিয়েছে। এখন আমাদের হাতে মূর্তি-লক্ষণ, চিত্র-লক্ষণ, বাস্তুশাস্ত্র এমনি নানা পুঁথি যা পড়ছে সে সব শাস্ত্রের অনেকখানি অংশ যা গড়া হ'য়ে গেছে, যা আঁকা হ’য়ে গেছে যা লেখা হ’য়ে গেছে, গাওয়া হ’য়ে গেছে শাস্ত্র-ছাড়া অবস্থায় মানুষের দ্বারা— তারই লিখিত হিসেব। শিল্পকর্ম এল নানা ক্রিয়া ধরে’, শাস্ত্র লেখা হ’ল সেই ক্রিয়ার লক্ষণাদি ধরে'। ধর্মপ্রচার পূজা ইত্যাদি সুবিধার জন্য শাস্ত্রের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা মতো ক্রিয়া করে' মানুষ যে যুগে প্রতিমা তাদের বাহন তাদের স্থাপন করতে মন্দিরাদি গড়ছে—সেটা অনেক পরের কথা। তার অনেক আগে মানুষ হাত তৈরি করেছে পাথর কেটে' গড়া লাইন টেনে' আঁকার প্রক্রিয়ায়। শিল্পব্রত আচরণ করতে অনেক পাকা হ’য়ে উঠেছে মানুষ যখন, তখন দেখি তার হাতের কৌশল পায়ের কৌশল এমন কি তার শিল্পবুদ্ধিও স্ব-ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সে লাগিয়েছে শাস্ত্র মতো ধর্মবিশেষের নয় তো রাজা বাদশার তাঁবেদারিতে। ধর্মপ্রচারের ইতিহাস দেখায়, আমাদের মূর্তিশিল্প কেমন করে এক ধর্ম থেকে আর এক ধর্মের সম্পর্কে এসে রূপ বদলে নিচ্ছে এবং আস্তে আস্তে ধর্ম প্রচারের পথ ধরে' বিদেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং সেখানকার মূর্তিশিল্পের সঙ্গে বোঝাপড়া অদল-বদল ক্রিয়া ধরে' নতুন নতুন সমস্ত রূপের সৃজন করছে। বৌদ্ধদের ত্রয়স্ত্রিংশ লোকের অধিবাসীরা হিন্দুদের তেত্রিশকোটীতে এসে পরিণত হ’ল, কি ভাবে নানা লৌকিক দেবদেবী এসে ঢুকে পড়লো দেশবিদেশ থেকে ভারতীয় দেবসভায়—সে এক বিচিত্র মহাভারতের বিচিত্র ইতিহাস। আবার দিক্ বিজয়ের দিক দিয়ে নানা দেশে লোকশিল্প সমস্তের যাতায়াত ও শিল্পক্রিয়া-প্রক্রিয়ার আদান-প্রদান—তারও ইতিহাস বড় ছোটখাটো নয়। আমাদের শিল্প ব্যাপারে এই আমদানি রপ্তানির খাতা পূরো লেখা হয়নি এখনো। শিল্পশাস্ত্র বলে' যে পুঁথি রয়েছে আমাদের তার মধ্য থেকে একটু একটু আভাষ পাই মূর্তিশিল্পকে কেমন করে' এক ধর্ম্ম থেকে জোর করে আর এক ধর্মের দাসত্বের কাযে লাগানো হচ্ছে—“সলক্ষণং মর্ত্ত্যবিম্বম্ ন হি শ্রেয়স্করং সদা”। শিল্পশাস্ত্রের একথা থেকে বেশ বোঝা যায়—সুলক্ষণযুক্ত বুদ্ধমূর্তিকে চিরকালের মতো চেপে দিতে চেষ্টা হচ্ছে এবং বুদ্ধের ধ্যান উড়িয়ে অন্য দেবতার ধ্যান লেখা হচ্ছে। এই ভাবে ধর্মের ঘাত-প্রতিঘাত বিজিত ও বিজেতার ঘাত-প্রতিঘাত ও দেশ বিদেশের সংমিশ্রণে ভারত-শিল্পের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া যেভাবে হ’য়ে চলেছে তার ইতিহাস শিল্পের উপরে ছাপ রেখে গেছে আপনার।

 ক্রিয়া ধরেই মানুষ বড় হয়েছে, নতুন নতুন সত্য আবিষ্কার করেছে এবং করে' চলেছে এখনো। সেই সব পরীক্ষার হিসেব পুঁথির আকারে সময়ে সময়ে ধরে' রাখতে চেয়ে লিখিয়ে তাঁরা লিখলেন পুঁথি— যেগুলো সংগ্রহ মাত্র, Encyclopedia বা Catalogue। সুতরাং পুঁথি যে লেখা হ’য়ে ঢুকেছে এমন কথা বলা যায় না। অনেক কিছু কথা যা এখনকার তা আজ থেকে শত শত বৎসরের পুরোনো পুঁথিতে থাকতে পারে না। এই ধরণের লেখাকে শিল্পশাস্ত্র কি আর কোন শাস্ত্র বলে' নাম দেওয়াই ভুল–Encyclopediaকে Gospel বলে' ধরার মতো কায। সব জাতেরই মধ্যে ধর্মশাস্ত্র এবং সেই সব ধর্ম পালনের নিত্য-ক্রিয়াপদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু সেই সব ক্রিয়া যথালিখিত পালন করে’ কেউ ইন্দ্রত্ব কেউ বুদ্ধত্ব পেলে কিনা, কি কারু জন্য সেণ্ট-পিটার স্বর্গের চাবি সহজে খুলে' দিলে কি না বা হুরীরা বেহেস্তের দ্বারে অপেক্ষা করলে কি না তা পরীক্ষা করে' প্রমাণ করার উপায় নেই। কিন্তু শিল্প সঙ্গীত ইত্যাদি নানা শাস্ত্রের ক্রিয়াপদ্ধতি হাতে কলমে পরীক্ষা করে' ফলাফল জানবার উপায় আছে। তাতে করে দেখা যায় যে মানুষের অনেক অসম্পূর্ণ পরীক্ষার হিসেব এই সব তথাকথিত শিল্পশাস্ত্রের অনেক অংশ ভর্তি এবং যেভাবে ক্রিয়া করে' চলে' যে ফল পাওয়া উচিত মানুষ তা পায় না। আবার দেখি যে সব পরীক্ষা রং রেখা সুরসার ছন্দোবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে মানুষ অনেক কাল আগে সম্পূর্ণ করে' গেছে তারও সমস্ত প্রক্রিয়ার হিসেব নানা শাস্ত্রে ধরা রয়েছে। যথাযথভাবে সেই সব ক্রিয়া পালন করে' চলে' পুরোপুরি ফলও পাচ্ছে তখনকার মতো এখনকার কর্মীরাও।

 যে সব ক্রিয়া সুপরীক্ষিত না হ’য়েই শাস্ত্রের পুঁথিগুলোতে ধরা গেছে, তার বিষয়ে দীপক মেঘমল্লার গেয়ে জল আগুনের ক্রিয়া দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যেতে পারে। কতকগুলো ক্রিয়া করে' বৃষ্টি আনা যেতে পারে এই বিশ্বাসে খুব আদিম যুগে মানুষ পরীক্ষা সুরু করলে। ধারা ব্রত হ'তে থাকলো, সাত তারা আঁকা জলের কলসী ফুটো করে' করে' আকাশ ফুটো করার রূপক ধরে' একটা ক্রিয়া—এই ভাবে পরীক্ষা চল্লো কত কাল এবং মেয়েদের মধ্যে এখনো চলছে। তারপর সুরু হ'ল নতুন পরীক্ষা, যজ্ঞ-ক্রিয়ার দ্বারা ইন্দ্রকে খুসি করে' জল আদায় এবং মেঘমল্লার গেয়ে বাদল আনা। এই সব পরীক্ষার ক্রিয়া-কাণ্ডের হিসেব ভালমন্দ নির্বিশেষে শাস্ত্রের মধ্যে একটা একটা সময়ে ধরা হ'য়ে গেল এবং সেই শাস্ত্রনির্দেশমত মানুষ ক্রিয়া করে' চল্লো। পরীক্ষা কিন্তু সফলতার দিকেও গেল না, অথচ শাস্ত্রেও এই এই ক্রিয়াতে জল হ’ল না বা মেঘ এল না একথা লেখা রইলো না। কতক মানুষ অসম্পূর্ণ প্রাচীন প্রথা ধরে' ক্রিয়া করে' চল্লো। কিন্তু সত্যি কারিগর কাযের মানুষ যারা তারা ক্রিয়া করেই চল্লো জল মেঘ আনার জন্য সঙ্গীতশাস্ত্র যজনক্রিয়া এবং মেয়েলী শাস্ত্রের অলিখিত ও লিখিত ক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিভিন্ন রাস্তা ধরে'। অম্লজান জলজান নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা থেকে ক্রিয়া সুরু হ’য়ে এই অল্পদিন হ’ল সেই আদিম যুগের আকাশ ফুটো ক’রে জল বর্ষাণোর যে চিন্তা তার সঙ্গে গিয়ে মিল্লো। ক্রিয়াবান মানুষ নতুন ক্রিয়ার দ্বারা বালুকণাকে তড়িৎ সঞ্চারে শক্তিমান করে' সত্যই আকাশ ফুটো করে' বৃষ্টি বর্ষালে। সেই পুরোনো যুগের পরীক্ষা আর আজকের যুগের পরীক্ষার মধ্যে মানুষের ভাবনা ও কামনাগত সাদৃশ্য সুস্পষ্ট হ’লেও দেখছি পুরোনো প্রক্রিয়াটা ব্যর্থ হয়েছে এবং নতুন ক্রিয়া তার নতুনত্ব নিয়ে তবেই সার্থকতা পেতে চলেছে। অতি প্রাচীন ক্রিয়াবান এবং অত্যন্ত নবীন ক্রিয়াবান এই দুয়ের ক্রিয়ার উপকরণ প্রকরণ, এমন কি ধ্যানটাও, একদিকে মিল্লো একদিকে মিল্লো না। আবার দীপক গেয়ে গেয়ে বহুকাল ধরা-গলা চিরেও কালোয়াৎ তার শাস্ত্রের বচনের সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু গান বাজনার দিক দিয়েও গেল না অথচ কারিগর মানুষ তারা নতুন ক্রিয়া নতুন পন্থা ধরে' তারে ও বিনা তারে আগুন জ্বালিয়ে চলেছে আমাদের চোখের সামনে। শাস্ত্রমতো যজ্ঞ-ক্রিয়া সঙ্গীত প্রকরণ ইত্যাদির দরকারই বোধ করছে না তারা এবং ওই সব শাস্ত্রমতো ক্রিয়া হ’ল না বলে তাদের ক্রিয়া যে ব্যর্থ হচ্ছে তাও নয়। ক্রিয়াবান মানুষের শিল্প নানা ক্রিয়া ধরে' যেমন যেমন এগিয়ে চলেছে, তারি অনুসরণ করে’ শিল্পশাস্ত্রকার তেমনি তেমনি হিসেবের খাতা লিখে চলেছে। পণ্ডিত শিল্পশাস্ত্র লিখে পড়িয়ে চল্লেন। শিল্পী তারি উপদেশ অনুসারে যখন পড়তে ও লিখতে আরম্ভ করেছে সে কালটা আজ থেকে খুব দূরে নয়। কিন্তু এই টোলের পড়া বিদ্যে থেকে অনেক দূরে সেই কালটা যে কালে নানা অনুপদিষ্ট উপায় ও ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রিয়াবান সম্পূর্ণ করে তুলছেন কাজ, কিম্বা অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রেখে নতুন পরীক্ষায় অগ্রসর হয়েছেন। ক্রিয়া থেকে নানা কলার উৎপত্তি হ’য়ে চলেছে যখন সেই সময়ে ক্রিয়ার সার্থকতার উপরে মানুষের জীবন যাত্রার অনেকখানি নির্ভর করতো। কর্ষণ-ক্রিয়া হনন-ক্রিয়া থেকে হাঁড়িকুড়ি অস্ত্রশস্ত্র কাপড়-চোপড় সমস্তই করে' তুলতে হ’ত কাযে হাত পাকিয়ে; করে' শিখতো, পড়ে শিখতো, না দেখে শিখতো, ঠেকে শিখতো নিজেরা। পরের দেখা পরের শোনা নিয়ে কাযের মানুষ হ'য়ে ওঠা, কিম্বা পড়ে পাশ করা এখন হয়েছে। তখন ক্রিয়া করে' কাযের মানুষ হ’ত, বই মুখস্থ করে' নয়। কাযেই তখন শাস্ত্র ছিল না। এখন পড়ার যুগে পুঁথির দরকার হয়ে পড়লো; নানা কাজের নানা manual বা ক্রিয়াপদ্ধতির পর পর রচনা হ’তে থাকলো।

 শিল্পের ইতিহাসের আদি কথা শিল্পক্রিয়ার দ্বারা মানুষ শিল্পের নানা দিকের নানা সন্ধান নিয়ে চলেছে ভাঙ্তে‌ গড়তে, মধ্য যুগের কথা নানা শাস্ত্রে নানা কথার সঙ্গে শিল্পের কথাও মানুষ যতটা পারছে লিখে লিখে সংগ্রহ করছে, এবং খুব আধুনিক কথা হচ্ছে যখন রাজাদের সভায় পণ্ডিত এবং কবি ও শিল্পী দুজনেই এসে পড়েছে এবং বিশেষ বিশেষ কলার উন্নতির বা অবনতির সূত্রপাত হচ্ছে লোকমতের গতি বশে। শিল্পীর অভিমতের উপরে এই সময় শাস্ত্রমত লোকমত প্রাধান্য লাভ করে' এই ভাল এই মন্দ এমনি একটা করে’ গণ্ডি টেনে দিলে এবং শিল্পের ক্রমবিকাশ বিচিত্র গতি বন্ধ হ’য়ে জড়তা উপস্থিত হ’ল শিল্পের ধারায়। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ সব দেশের সব শিল্পের মধ্যে কিছু কিছু বর্তমান আছে। যে মূর্তি গড়বে সে একই ছাঁদে একই প্রক্রিয়ায় মূর্তি গড়ে চল্লো। পুরুষানুক্রমে একই জিনিষে বুদ্ধিবৃত্তি চালিত হ’তে হ'তে শিল্পীরা এ সময়ে একটা অত্যাশ্চর্য দক্ষতা পেলে এক এক কলায়। কিন্তু এ ভাবে তো জগৎ চলে না। স্থিরতা যেখানে নেই, যাদের জন্য বহুকাল ধরে' শিল্পী হাত পাকালে কাযে তারা কোথায় চলে' গেল, তার জায়গায় হঠাৎ-নবাব শাস্ত্রঘাঁটা রসিক এবং পুঁথি ধরে' ব্যবস্থা এল দেশে। তখন কবিতা গণেশবন্দনা এবং রাজ-প্রশস্তি এই দুই জাঁতিকলের মধ্যে পেষা হয়ে শুকনো ছাতু হয়ে গেল এমন যে মানুষের কাজে এল না—সরস্বতী পোকার পেট ভরাবার কাজেই লাগলো। ছবি মূর্তি এরাও রইলো নোড়ানুড়ি চুন সুরকীর কায করে' দেবায়তন রাজপ্রাসাদ এমনি সব বড় বড় কারাগারের প্রকাণ্ড প্রাকার খাড়া করে' তুলতে এবং রসের শতমুখী ধারার ক্রিয়া ও ক্রীড়ার মুখে ভীষণ শক্ত বাঁধ বাঁধতে। এই নিরেট বাঁধ যদি কোনদিন ভাঙলো তো রস আবার ছুটলো, নয়ত নিষ্ক্রিয় শিল্পকুণ্ডের জলের মতো কিছুদিন থাকলো এবং অবশেষে একদিন শুকিয়ে গেল, —কেবল বাঁধগুলো পড়ে' রইলো এক ফোঁটা রসের শোচনীয় অবসানের সাক্ষী দিয়ে।

 দেশের বিদেশের কলাবিদ্যাসমূহের এমন এক একটা সঙ্কটাপন্ন অবস্থার দেখা পাওয়া যাচ্ছে যখন কারিগর বেঁচে আছে, কিন্তু art কোথাও নেই দেশে। Artএর দিক দিয়ে অনুর্বর ক্ষেত্রে খরার দিনের মধ্য দিয়ে চলা কোন জাতিই এড়াতে পারেনি। এই রসহীনতার মধ্যে ক্রিয়া করে চলার শ্রান্তি সব জাতির সব আর্টিষ্টদের কাযের উপরে সুস্পষ্ট ছাপ রেখে গেছে দেখতে পাই, আরো দেখি যখন আট বর্তমান নেই জাতির মধ্যে তখনই জাগছে তার প্রাণে যা ছিল তার জন্য বেদনা এবং যা আসার সম্ভব ভবিষ্যতে তার জন্যে বিষম তৃষ্ণা! যারা ক্রিয়াবান তারা ভূত ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান তিনের মধ্য দিয়ে ক্রিয়া করে চলে, যারা তা নয় কিন্তু কিছু করতেও চায় তারা হয় ভূত নয় ভবিষ্যৎ এমনি একটা কিছুতে গ্রস্ত হয়ে থাকে। নতুন এল, পুরোনো কেউ জায়গা আটকে বসলো না, নতুনকে বড় হবার দিকে অগ্রসর করে' দিলে— এইটেই হ’ল স্বভাবের নিয়ম, এ যেন কত কালের আসবাব আবর্জনায় ঠাসা পুরোনো বাড়িতে নতুন ছেলেরা জন্ম নিয়ে ক্রীড়া সুরু করে' দিলে। সেকালের খেলনা একালের ছেলের খেলবার কাজে এল,—ছেলে ভাঙলে অনেক জিনিষ কিন্তু এই ভাঙা-চোরার মধ্য দিয়ে ক্রিয়া ও ক্রীড়া সুরু হয়ে গেল। পুরোনোর কোলে নতুনের লীলা এটা প্রাচীন গম্ভীর লোকদের না-পছন্দের ব্যাপার, কেননা একালটাকেও সেকাল হিসেবে না দেখতে পেলে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ব্যাঘাত ঘটে, চারিদিকের বাঁধা দস্তুরের মধ্যে ওলট পালট অশান্তি এলে তাদের অসোয়াস্তির সীমা থাকে না, এইজন্য নতুনের ক্রিয়ার সঙ্গে, পুরাতনের ক্রিয়ার কোন কোন স্থলে একটা সংঘাত বাধে এবং হঠাৎ যদি সেকালে মূল্যবান অথচ একালে একেবারেই অকেজো এমন কিছু জিনিষ নতুন মানুষ খেলার মুখে ভেঙ্গে চুরমার করে' দেয় তবে পুরাতনের কাছে সে কাণমলা গালাগালি খেয়ে মরে। কিন্তু ক্রিয়া এবং ক্রীড়া দুয়েরই একটা লক্ষণ হ’ল নড়াচড়া ও সজীবতা, সে ভেঙে গড়ে—ঠিক যে ভাবে গতিহীন সোজা দাঁড়িকে গতি দেয় artist ভঙ্গি বা ভঙ্গ দিয়ে; নতুন জাতির জীবন তার সমস্ত ক্রিয়াপ্রবণতা ও ক্রীড়াশীলতা এই ভাবে নিয়োগ করে নিষ্ক্রিয়তাকে ভেঙে ক্রিয়াশীল ক্রীড়াশীল করে' তুলতে। যারা এত বড় যে শাস্ত্রের নিষেধ-বিধির উপরে চলে' গেছে এবং যারা এত ছোট যে শাস্ত্রের বাইরে পড়ে' গেছে—এদের দুজনের জন্যই শাস্ত্র নয়, যারা মাঝারি রকম মানুষ কেবল তাদেরই জন্য শাস্ত্র। এই শাস্ত্র ধরে' গড়ে’ চল্লে তারা ভাল জিনিষের অনুকরণ করে' ক্রমে হয় তো পাকা হয়ে উঠবে—এই জন্যই শিল্পের আইনবাঁধা ক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে মানুষ, ভবিষ্যতের ক্রমবিকাশের পথে কাঁটার বেড়া হিসেবে শাস্ত্র গড়া হয় নি। ধর্মশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র, সঙ্গীত, অলঙ্কার প্রভৃতি শাস্ত্র কারো কাঁটারোপণ কাজ নয়, চলার পথ নিষ্কণ্টক ও সহজ করে' দিতেই শিল্পশাস্ত্রের সৃষ্টি। যে কিছু জানে না তাকে জানার পথে অগ্রসর করে' দেওয়াই শাস্ত্রের লক্ষ্য। শাস্ত্রের একটা মানে যদিও শাসনে রাখা বোঝায়, তবু শাসনের প্রয়োগ স্থান-কাল-পাত্র-ভেদে রকম রকম না হ’লে মানুষ শাসনের বিরুদ্ধ আচরণ করবেই। শাস্ত্রকারেরা একথা যে ভাবেননি তা নয়, অন্য শাস্ত্রের ফাঁকি কোথায় কি তা আমি জানিনে, শিল্পশাস্ত্রের শাসনে অনেকখানি ফাঁক আছে—“লেখ্যা লেপ্যা সৈকতী চ মৃন্ময়ী পৈষ্টিকী তথা। এতাসাং লক্ষণাভাবে ন কশ্চিৎ দোষ ঈরিতঃ॥”

 প্রাচীন শিল্পশাস্ত্রের শাসন এখন যদি মানতে হয় তো যেমনটি লেখা আছে তেমনি ভাবেই। এখনকার গাইয়ে বাজিয়ে কাব্যকার চিত্রকার সবাইকে ক্রিয়া করে' চলে' যেতে হয় প্রাচীন পথে, নতুন কিছু করার উপায় নেই। বর্তমানকে উজান বইয়ে অতীতের দিকে নিয়ে অতীতের মধ্যে কি ছিল তা জেনে চলা হ'ল শিল্পীর শিক্ষার একটা দিক, তার পরে হ’ল বর্তমানে চারিদিকে দেশ-বিদেশে কোথায় কি রয়েছে জেনে নেওয়া বা যাকে বলি পরখ করে’ গ্রহণ করে' চলা, তারপরে হ’ল ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে ক্রিয়া করে' চলা নিজের প্রথা মতো,—আসল কথা চলা চাই চালানো চাই, না হলেই মুস্কিল। ঠিক যে ভাবে প্রপৌত্র তার প্রপিতামহের কতক এবং তার ভবিষ্যৎ বংশাবলীর খানিক জড়িয়ে নিয়ে চলে, এইভাবে চলা হ’ল শিল্পই বল আর যে কাজই বল তার স্বাভাবিক গতি। এক কালের নতুন সে খানিকটা ক্রিয়া-চক্র চালিয়ে থামলো, আর এক নতুন সেখান থেকে ক্রিয়া সুরু করলে এবং অন্য নতুনের হাতে কায দিয়ে ক্ষান্ত হ’ল,—এইভাবে ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমানের মধ্যে ক্রিয়া-প্রবাহ চল্লো অবিচ্ছিন্নভাবে। গঙ্গার ধারায় কোথাও চড়া পড়লো না তবেই ধারা সরতে পেলে, কোথাও দুর্গম হ’ল না আবিল হ’ল না আবর্জনায়। এক সময়ে দেবমূর্তির একটা বাজার সৃষ্টি হয়েছিল এদেশে, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার, শিল্পকর্মের প্রসার ছিল গৌণ; সুতরাং সেই কাজের উপযোগী মূর্তির মান-প্রমাণ-লক্ষণাদি দিয়ে শাস্ত্র বাঁধা হয়েছিল এবং ভারতবর্ষের মূর্তি-শিল্প ধ্যান-যোগের সম্পূর্ণ সিদ্ধির উপায় ধরে' একটা যে ছাপ পেলে সেটা সাময়িক ছাপ এবং বাঁধ। দস্তুরের ক্রিয়ার ছাপ। চীন দেশে এক সময়ে মানুষের পা এই ভাবে কড়া হুকুমে খুব ছোট করে’ তার স্বাভাবিক বাড় নষ্ট করে' দেওয়া হয়েছিল। চীনের সৌন্দর্যশাস্ত্রে এবং আমাদের এখনকার তথাকথিত বিপশ্চিতাম্ মতম্‌-এর মধ্যে ভয়ঙ্কর রকমের একটা মিল রয়েছে,—জীবন্ত জিনিষকে স্বাভাবিক বাড় থেকে বঞ্চিত করে' শাসনের বলে একটা কৃত্রিম রূপ দেওয়ায়। কিন্তু চীনের শাসন ও সেকালে শিল্পশাস্ত্রের শাসন এই দুয়ের মধ্যে নিয়মের চাপের কষনের ইতর-বিশেষ হওয়ার দরুণ আমাদের মূর্তি-শিল্প একটা সুন্দর ছাঁদ পেলে, চীনের পদপল্লব বেঁকে চুরে একটা বীভৎস রূপ ধরলে। শাস্ত্রের নিয়ম যেখানে স্বভাবের নিয়ম ধরে’ বাঁধা সেখানে সে অনেকখানি বিস্তার দিলে শিল্পের গতিবিধিকে অব্যাহতভাবে চলতে, কিন্তু স্বভাবকে অতিক্রম করে’ যেখানে কঠোর নিয়ম গড়া হ’ল সেখানে কৃত্রিমতা কদর্যতাই গড়ে' উঠলো। দেবমূর্তির ব্যবসা খুলতে যখন নানা আইনে শিল্পীদের কঠিন বাঁধন পরানো হয়েছিল, ভারতবর্ষের মূর্তি-শিল্প তখন একদিকে যেমন এক বিষয়ে প্রাচুর্যলাভ করলে অন্য দিকে তেমনিই খোঁড়া হ’য়ে রইলো; কেবল ঠাকুর গড়তেই পাকা হ’ল মানুষ এবং তাও ক্রমে দাঁড়ালো গিয়ে পুঁথির লেখা মাপজোখে ঠিকঠাক করে' কোঁদা ঠাকুরে যার মধ্যে দেবচক্ষু ইত্যাদি সবই থাকলো—অমরত্বটুকু ছাড়া। পাথরের কাযে পরলোকের অবিচিত্র ছায়াই পড়লো, ইহলোকের বিচিত্রতা নয়, এবং আমাদের দেশে সব পাথরগুলো অবস্তু হয়ে উঠলে। একটাও বস্তু রইলো না। শিল্পের হিসেবে এটা একেবারেই ভাল নয়। এই দুৰ্দৈব শিল্পে আসবেই কড়া আইন হ’লে এটা যেন শাস্ত্রকারেরা দেখেছিলেন, তাই তাঁরা শিল্প সম্বন্ধে আইনের বজ্র আঁটুনির মাঝে নানান ফস্কা গেরো রেখে গেলেন যার গুণে শিল্পের বাঁধা গতি বাঁধা জিনিষের দুৰ্গতি থেকে বেঁচে গেল। ভারতবর্ষের বাইরে নানা ধৰ্ম নানা কালে শাস্ত্রীয় মূর্তি সমস্তের রচনা পদ্ধতি দিয়ে শিল্পী ও শিল্পকে বেঁধেছে অনেক স্থানে। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে সেখানে যেখানে শিল্প একটা দেবমূর্তির বৈরূপ্যমাত্র হয়ে উঠেছে। আমাদের মূর্তিশিল্প যে এ দুর্গতি থেকে বেঁচে গেছে তার একটা কারণ শিল্প রচনারও ভার একদল নিরক্ষর artistএর হাতে ছিল যারা ক্রিয়াবান, এবং জোর করে' তাদের শাস্ত্র গেলানো হয় নি। এদেশে এখনো পাকা কারিগর পাবে কিন্তু তাদের মধ্যে শিল্পশাস্ত্রজ্ঞানে একেবারে পাকা এমন লোক একজনও আছে কি না সন্দেহ। শিল্পশাস্ত্রের শাসন কি তারা অনেকেই জানে না অথচ দিব্য গড়ে চলেছে পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত এবং অর্জিত শিল্পজ্ঞান নিয়ে নানা বস্তু! এদেশে শিল্পশাস্ত্র যা পাওয়া যাচ্ছে তা রাজ-রাজড়ার পুস্তকাগারে, নয় তো পণ্ডিতদের ঘরে,—শাস্ত্রে অপণ্ডিত কিন্তু শিল্পক্রিয়াতে সম্পূর্ণ পারগ শিল্পীদের পুঁথি ক্বচিৎ পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং শাস্ত্র যে খুব একটা বড় জায়গা পেয়েছিল শিল্পীদের ঘরে তা বোধ হয় না, শুধু সিন্দূর-চন্দনে পূজা পেয়েছিল। শোনা শাস্ত্র কতক এবং বংশানুক্রমে ক্রিয়া করে' দখল করা কলাবিদ্যা অনেকখানি, এই নিয়ে ভারত শিল্প গড়ে' উঠেছে, এটা দুঃখের কারণ নয় সুখের বিষয় বলতে হয়। শাস্ত্রের চাপ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি, তা থেকে বেঁচে গেছে এদেশের শিল্পীরা কাজের দিক দিয়ে শুধু তারা নিরক্ষর ছিল বলে। এখন আমরা, যারা পড়ে' শুনে' পাকা হয়ে শিল্পক্রিয়া করতে চলেছি, সেকাল যদি হঠাৎ একালে ফিরে আসে তবে শাস্ত্রের চাপন আমাদের উপর অনিবার্য। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা নির্ভয় যে স্বভাবের নিয়মে সেকাল একালের ত্রিসীমানায় আসতে পারে না, এলেও সজীব একালের পৃথিবীতে গতজীবন সেকালটা যদি ভূতের উপদ্রব বাধায় তো একাল সেটা সইতে নারাজ হবেই একদিন। সেকালের সঙ্গে একালের শিল্পের যোগ শিল্পশাস্ত্র পড়াশুনার দিক দিয়ে যেরূপটা হওয়া স্বাভাবিক তাই হবে এইটেই আমার ধারণা। বৌদ্ধ যুগে এবং তারপরেও দেখা যায় ধর্মে শ্রদ্ধাবান্‌ শিল্পশাস্ত্রে পণ্ডিত এবং শিল্প-ক্রিয়াতেও নিপুণ ধৰ্মযাজকগণ ভারতবর্ষের বাইরে নানা ম্লেচ্ছ জাতির মধ্যে ধর্ম-প্রচার ও সেই সঙ্গে শিল্প-প্রচারও করেছেন। ধর্মের অনুশাসন তাঁরা স্থানে স্থানে কঠিন ভাবে প্রয়োগ করেছেন সেই সব অন্যব্রতগণের উপরে কিন্তু শিল্পশাস্ত্রের নিয়মগুলো ঢিলে করে দিয়েছেন দেশে দেশে, শিল্পের দেশীয়তার সঙ্গে শাস্ত্রমতো বিশুদ্ধ শিল্পের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন —কোন বাধা দেননি সে পথে। সেকালের তাঁরা পণ্ডিত ছিলেন শাস্ত্র ও শিল্পে, কাযেই কালে কালে দেশে দেশে একই শিল্পের পুনরাবৃত্তি যে একেবারেই দোষ, বিচিত্রতাই যে শিল্পের মূল কথা, সেটা তাঁরা ভাল রকমই জানতেন। একালের ইউরোপীয় শিল্পের নিয়ম ও লক্ষণাদির সঙ্গে আমাদের art studentদের যখন মিলন হ’ল তখন নিজেদের শিল্পের জ্ঞান ছিলই না তাদের মধ্যে, সুতরাং ইউরোপের শিল্প imposed হ’তে চল্লো এদেশে, মিলন সার্থক হ’ল না শোভন হ’ল না। তেমনি সেকালের শিল্প-শাস্ত্রের বিধি-ব্যবস্থা যদি একালে imposed হয় তবে সে কার্যটা অশোভনতা এবং অকৃত্রিমতারই সৃষ্টি করবে। এরূপ impositionএর বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিকটায় অনেক যুদ্ধ চলেছে। চলছে, সুতরাং শিল্পেও সেকালে একালে যে স্বাভাবিক যোগ না ঘটিয়ে imposition ঘটালে বিপত্তির সম্ভাবনা তা সব দিক দিয়েই দেখতে পাচ্ছি। প্রাচীন ভারত-শিল্প শিল্পশাস্ত্র সমস্তই আমাদের এবং সেটা খুব বড় বলে’ যতই মনে করি না, সিন্দবাদের বুড়োর মতো কেবল তাকেই ঘাড়ে করে বইতে নতুন ভারতে আমরা সবাই এলেম-কবি শিল্পী গায়ক বাদক এমন কি পণ্ডিতেরাও—এটা ভাবাই স্বাভাবিক অবস্থার কাজ নয়! সেকাল একালের মধ্যে মিলে নবীনতার সৃজন করবে, গাছের পুরোনো বীজটা নতুন জীবন-রসে মিলে নতুন বীজের মধ্যে আপনাকে প্রকাশ করে যে ভাবে সেইভাবে সেকাল এগিয়ে চলবে একালের ক্রিয়ার ছন্দ ধরে' ভবিষ্যৎ কালের সফলতার দিকে,—এ না হলেই বিপদ। গাছটা তার পুরোনো বীজের খোলার মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়লো কিম্বা পুরোনো বীজ আপনাকে গাছের ছাঁদে মেলাতে না চেয়ে গাছের ঘাড় মটকে মাটির মধ্যে টেনে নিয়ে চল্লো, দুজনেই আপনার মৃত্যু ডেকে আনলে। শিল্পের গতি কালে কালে নতুন নতুন শিল্পীর মতি ধরে চলেছে, কোনো এক কালের বা এক শাস্ত্রের মত ধরে' চলেনি, চলতে পারেও না। শিল্পশাস্ত্র মতো গড়ে’ সেকালে তারা ভাল গড়েছে সুতরাং আমরা একালেও সেই প্রাচীন মত ধরে গড়লে ভালই গড়বো এই কথাই স্থির জেনে যদিই বা ক্রিয়া করে’ চলি তবে সে কালের অনুকরণের কায ছাড়া কিছু বেশী গড়বে বলে মনে তো হয় না। আমাদের একালের তথাকথিত কালোয়াৎ তারা এটা প্রমাণ করছে। একালের শিক্ষা-সমস্যায় সেকালের টোলের পণ্ডিতের ব্যবস্থার কতকটা স্থান আছে সত্যি কিন্তু টোলের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও কায চালানোর ধারাকে একালের শিক্ষা-সমস্যার সবখানি মেটাতে দিলে টোলও বিপদে পড়বে, বিশ্ববিদ্যালয়ও বিপদে পড়বে। আজ আমরা ঠিক শাস্ত্রমতো যদি কেউ মূর্তি গড়া শিখতে চাই তবে কিছুকাল আমাদের মূর্তি গড়া থেকে হাত গুটিয়ে বসে' থাকতে হবে; কেননা শাস্ত্রে লিখেছে— রাজা গেছে পণ্ডিতের কাছে মূর্তি গড়বার উপদেশ নিতে। রাজা বল্লেন— মূর্তি গড়ার উপদেশ করুন। পণ্ডিত বল্লেন—চিত্র-সূত্র থেকে ছবি আঁকার সম্বন্ধে আগে জান তো বুঝবে চিত্রকল্পে মূর্তি গড়ার উপদেশ যা আছে। রাজা চিত্র-সূত্রই আগে জানতে চাইলেন। পণ্ডিত তখন গম্ভীর হয়ে বল্লেন নৃত্য-সূত্র না জানলে চিত্র-সূত্র জানাই হবে না। রাজা নিরুপায়, নৃত্য-সূত্রই মঞ্জুর করলেন। পণ্ডিত আরো গম্ভীর হয়ে বল্লেন বাদন-সূত্র না জানলে নৃত্য-সূত্রের খেইটা ধরাই যাবে না। রাজা বল্লেন, তবে বাদনই চলুক। তখন পণ্ডিত গায়নের কথা তুল্লেন। ঠিকঠাক শাস্ত্রমতো মূর্তিগড়া শিখতে হ’লে গান থেকে আরম্ভ করে’ বাজনা নাচ ছবি আঁকা ও শেষ মূতি গড়াতে গিয়ে তারপর পাকা হতে হবে কাযে! আমাদের দেশে যেমন শিল্পশাস্ত্রকার তেমনি ইয়োরোপেও Silruvius একখানা বস্তুশাস্ত্র লিখেছেন বহুদিন আগে, দেউলী হতে হ’লে মানুষটাকে কি কি বিষয়ে পাকা হওয়া চাই তার তালিকা দিলেন–a knowledge of letters, of Drawing, of Geometry, of Arithmetic, of Optic, বেশ কথা, of History, of Natural and Moral Philosophy, of Jurisprudence, of Medicine, of Astrology, of Music and so on;– এর পরে যে সত্যই কিছু গড়তে আঁকতে এক কথায় কিছু করতে চায় সে কি বলবে না, ‘Every thing is worth knowing: learn the art and lay it aside?”

 রসায়নশাস্ত্রে জল গ্যাস এসব তৈরীর প্রক্রিয়া বিষয়ে পরীক্ষার দায়ে সুনিশ্চিত হয়ে তবে পুঁথির মধ্যে মানুষ প্রক্রিয়ার হিসেবটা ধরলে। বই পড়ে' সেই ক্রিয়া কর ঠিকঠাক ফল নিশ্চয় পাবে। কিন্তু শিল্পশাস্ত্রের নির্দেশ ও মান-পরিমাণ মতো মূর্তি গড়লে পাথর দেবতাই হবে যে তা নয়, আট দশ হাত মনুষ্যেতর ব্যাপারও হ'তে পারে। ছন্দশাস্ত্র মতো ঠিকঠাক ছন্দ-বাঁধা জিনিষ সব সময়ে কবিতা হয় না, ঠিকঠাক লা-র-গ-ম দোরস্ত জিনিষ সব সময়ে সঙ্গীতও হয় না,—এর প্রমাণ হাতে হাতে পাই। ইতিহাস পুরাণ রূপক ইত্যাদির দিক দিয়ে লাট কর্জনের মতে আমাদের দেবমূর্তির সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই আমাদের দেবতার অথচ তার কাছে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর সবাই মনুষ্যেতর বীভৎস কিছু। শিল্পশাস্ত্রের নিছক আইনে বলে মূর্তিগুলোর মধ্যে দেবত্ব যে আসেনি তা আইনের পিছনে থাকে বলে'। Mythology, Symbolism, মুদ্রা, রূপক ইত্যাদি এমনি সব জিনিষের শক্তি অনেকখানি কাজ করে, তবে শাস্ত্রবিধি মতে কাটা পাথরকে এ-দেবতা সে-দেবতা বলে প্রতিপন্ন করছে এটা ঠিক! মর্ত্যভূমির অনেকখানি জড়িয়ে আছে বলেই এই সব মূর্তি আমাদের কাছে সুন্দর ঠেকে। আর্টে নিছক দেবতা হ’তে পারে না—নরদেব পর্যন্ত আর্টের গতি,—এইটে আমার ধারণা। অবশ্য লাট কর্জনের মতো রূপক ইত্যাদির জ্ঞান ও সেই সঙ্গে রস-জ্ঞানেরও যার অভাব তার কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু ইজিপ্তের রাজাদের মূর্তি, রাজার নাম রাজার ইতিহাস এ সবের অপেক্ষা না রেখে স্বাধীন ভাবেই রসিকের কাছে আপনার নরদেবত্ব প্রমাণ করছে; এবং বুদ্ধ-মূর্তি নটরাজ-মূর্তি কপিল-মূর্তি এমনি অসংখ্য মূর্তি এদেশে রয়েছে যা পুরাণের রূপক ছেড়েও নিজের মহিমা নিজের রূপ দিয়ে প্রচার করছে; সেই সব মূর্তি হচ্ছে শিল্পীর কাছে অলিখিত যে শিল্পশাস্ত্র তার বিধিনিয়ম ও প্রক্রিয়ার ফল, হাজার বছর ধরে' শিল্পশাস্ত্র মতো গড়ে' চল্লেও এ জিনিষ পাওয়া শক্ত, কেবল তারাই পেয়েছে যারা মনের মধ্যে মনের আকাশে নিজের মনের মধ্যের মানসদেবতাকে ক্রিয়ার দ্বারায় বশ করতে শিখেছে অনেক সাধনা অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। বাঁধা-ধরা যোগশাস্ত্র পড়িয়ে যোগী সৃষ্টি করা যায় না, বাঁধা-ধরা ছন্দ নিয়ে সুর নিয়ে কবিতা বা সুরকে ধরে' আনা যায় না—তা যদি হ’ত তো ভাবনা ছিল না। যে কবিতা ছিল কালিদাসের আমলে, ছন্দশাস্ত্র মতে তারি পুরাবৃত্তি চলতো, তাহলে সাহিত্য-সেবার দরকারই হত না আজকের মানুষের; শাস্ত্রের তথাকথিত রাসায়নিক প্রক্রিয়া ধরে' ছবি হ’ত কবিতা হ’ত গান হ’ত প্রস্তুত ঠিক কালিদাসের মতো তানসেনের মতো দেবী চিত্রলেখার মতো। কিন্তু সৌভাগ্য যে এটা ঘটা সম্ভব হ’ল না, শিল্পীর intention বা ধ্যান তারি অনুপাতে ক্রিয়া চল্লো, কর্মের ভাবভঙ্গি মান-পরিমাণ সব সেই intention ও তার ক্রিয়া বশে হ’ল,—জিনিষটা দেবতার ছাঁদ পেলে কি মানুষের ছাঁদ পেলে, নবতাল হ’ল কি দশতাল হ’ল। দেবতা হ’লেই নবতাল, নর হ’লেই অষ্টতাল ইত্যাদি শাস্ত্রের বাঁধা যে নিয়ম intention ও তার ক্রিয়ার বশে কায করে, সে নিয়ম শিল্পী মাত্রেই ভাঙলে বদলালে, প্রাচীন ভারত-শিল্পের ইতিহাস থেকেও এটা সপ্রমাণ করা শক্ত নয়, একালে তো এটা নিত্য ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। নিছক শিল্প-ক্রিয়া থেকেই ঠিকঠাক ছন্দ সুর ছাঁদ বাঁধ সমস্তই বেরিয়েছে একদিন একথা যদি অস্বীকার করি তবে শাস্ত্রকেও অস্বীকার করা হয়, কেননা শাস্ত্রই বলেছেন— ব্রহ্মা অদ্ভূত সমস্ত যা তার দেবতা, তাঁর থেকে সুর এসেছে, ছন্দ এসেছে, সৃষ্টি এসেছে—তিনি কোন বাঁধা শাস্ত্র দেখে সৃষ্টি-ক্রিয়া করে চলেন নি। যে নিয়মে শিল্পী সুরূপ কুরূপ গড়ে—কিম্বা সুভাব কুভাব দেবভাব মানুষভাব রাক্ষসভাব আসে কাযে, তার প্রক্রিয়া ও হিসেব সম্পূর্ণভাবে শিল্পীর নিজস্ব জিনিষ—শাস্ত্রের মধ্যে তার হিসেব ধরা নেই। মূর্তির আধ্যাত্মিকতা শাস্ত্রে লেখা মাপজোখ নিয়ে ধরা যায় না, শিল্পীর আত্মায় তার ব্যক্ত করার হিসেবের পুঁথিটা লুকানো আছে—সেই পুঁথি অনুসারে ক্রিয়া করে' চলে’ শিল্পী নানা কাণ্ড বাধিয়ে যায় যার হিসেব শুধু ক্রিয়াবানদের কাছেই ধরা পড়ে।