বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ৭

প্রাচীন মুদ্রা

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

মগধের গুপ্তরাজবংশ।

 কোন্ সময়ে প্রথম কুমারগুপ্তের বংশলোপ হইয়াছিল এবং গোবিন্দগুপ্তের বংশধরগণ সিংহাসনলাভ করিয়াছিলেন তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। বিষ্ণুগুপ্ত, তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত, জয়গুপ্ত, হরিগুপ্ত প্রভৃতি রাজগণের শাসনকালে মগধ ও বঙ্গের শাসনকর্ত্তৃগণ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন রাজা হইয়াছিলেন। আওরঙ্গজেবের পুত্র প্রথম শাহ্-আলমের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র ও পৌত্রগণ যখন গৃহবিবাদে উন্মত্ত, তখন বিস্তৃত মোগলসাম্রাজ্যের শাসনকর্ত্তা ও সেনাপতিগণ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা লাভ করিয়াও যেমন সুলতান বা বাদ্‌শাহ উপাধি গ্রহণ করেন নাই, সেইরূপ প্রাচীন গুপ্তসাম্রাজ্যের শেষদশায় ভারতবর্ষের বহু প্রদেশের শাসনকর্ত্তা ও তাঁহাদিগের বংশধরগণ প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করিয়াও গুপ্তবংশীয় সম্রাট্‌দত্ত উপাধি লইয়াই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং রাজোপাধি গ্রহণ করেন নাই। স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পঞ্চশতবর্ষ পরেও বাঙ্গালাদেশের স্থানে স্থানে “কুমারামাত্যাধিকরণ” অথবা “মণ্ডলাধিকরণ” উপাধিধারী গুপ্তসাম্রাজ্যের রাজকর্ম্মচারিগণের বংশধরগণ দেশ শাসন করিতেন। প্রাচীন গুপ্তবংশীয় সম্রাট্‌গণের রাজত্বকালে “কুমারামাত্যাধিকরণ” বা “মণ্ডলাধিকরণ” উপাধিধারী তাঁহাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ যে রাজমুদ্রা লইয়া সাম্রাজ্যের কার্য্য সম্পন্ন করিতেন, সাম্রাজ্যধ্বংসের শত শত বর্ষ পরেও তাঁহারা সেই মুদ্রা রাজকীয়মুদ্রারূপে ব্যবহার করিতেন।

 অনুমান হয় যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠপুত্র প্রথম কুমারগুপ্তের বংশলোপ হইলে, তাঁহার দ্বিতীয়পুত্র গোবিন্দগুপ্ত বা কৃষ্ণগুপ্তের বংশধরগণ পাটলিপুত্রের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। ইঁহারা এই সময়ে গৌড়দেশের অধিকারী ছিলেন কি না তাহা বলিতে পারা যায় না। গোবিন্দগুপ্ত বা কৃষ্ণগুপ্তের পৌত্র তৃতীয় কুমারগুপ্ত বোধ হয় এই বংশের প্রথম রাজা। তাঁহার কোন শিলালিপি বা তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু তাঁহার বৃদ্ধপ্রপৌত্র আদিত্যসেনের শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, তিনি ঈশানবর্ম্মা নামক জনৈক নরপতিকে পরাজিত করিয়াছিলেন এবং প্রয়াগে চিতারোহণ করিয়াছিলেন[১]। এই ঈশানবর্ম্মা সম্ভবতঃ মৌখরীবংশীয় রাজা ঈশানবর্ম্মা। ঈশানবর্ম্মার একখানি শিলালিপি বড়বাঁকি জেলায় হড়াহা গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই শিলালিপি হইতে জানা যায় যে, ঈশানবর্ম্মা সমুদ্রতীরবাসী গৌড়গণকে স্বাধিকার মধ্যে থাকিতে বাধ্য করিয়াছিলেন[২]। হড়াহা গ্রামের শিলালিপি ৬১১ বিক্রম সম্বৎসরে (৫৫৪ খৃঃ অব্দ) উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৩] সুতরাং ঈশানবর্ম্মার গৌড়বিজয় এবং তৃতীয় কুমারগুপ্তের সহিত তাঁহার যুদ্ধ খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় পাদে ঘটিয়াছিল। ভানুগুপ্ত যখন ২১৪ গৌপ্তাব্দে (৫৩৩ খৃঃ অব্দ) জীবিত ছিলেন, তখন ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, তৃতীয় কুমারগুপ্ত খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়পাদের মধ্যভাগে সিংহাসনলাভ করিয়াছিলেন। অতএব ইহা অনুমান করা যাইতে পারে যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে ঈশানবর্ম্মা পূর্ব্বদেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং তৃতীয় কুমারগুপ্তের সহিত তাঁহার যুদ্ধ হইয়াছিল। কৃষ্ণগুপ্ত বা গোবিন্দগুপ্তের বংশের যে সমস্ত শিলালিপি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তৎসমুদয় অঙ্গে বা মগধে আবিষ্কৃত হইয়াছে সুতরাং গৌড়দেশ তাঁহাদের অধিকারভুক্ত ছিল কি না তাহা বলিতে পারা যায় না।

 হড়াহা গ্রামে আবিষ্কৃত শিলালিপিতে তৃতীয় কুমারগুপ্তের উল্লেখ নাই কিন্তু সমুদ্রতীরবাসী গৌড়গণের নাম উক্ত শিলালিপিতে যে ভাবে উল্লিখিত হইয়াছে তাহা হইতে বোধ হয় যে, সে সময়ে গৌড়দেশ স্বাধীন হইয়াছিল। উক্ত শিলালিপিতে গৌড়গণকে “সমুদ্রাশ্রয়ান্‌” আখ্যা প্রদান করা হইয়াছে। ইহা হইতে বোধ হয় সূচিত হইতেছে যে, গৌড়গণ নৌ-বলে বলীয়ান ছিলেন। খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাঙ্গালাদেশে ফরিদপুর জেলায় চারিখানি তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, নানাকারণে ১৯১০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত ইহাদিগের পাঠোদ্ধার হয় নাই। ১৯১০ খৃষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত পার্জিটার (F. E. Pargiter) এই চারিখানি তাম্রলিপির মধ্যে তিনখানির পাঠোদ্ধার[৪] করিলেও সেগুলি কৃত্রিম বলিয়া অনুমিত হইয়াছিল[৫], কারণ উক্তবর্ষ পর্য্যন্ত যে সমস্ত তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে, ফরিদপুরের তাম্রলিপিগুলি তাহা হইতে বিভিন্ন। ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলার দামোদরপুর গ্রামে আবিষ্কৃত পাঁচ খানি তাম্রলিপির পাঠোদ্ধার হইলে প্রমাণ হইয়াছে যে ফরিদপুরের তাম্রলিপিগুলি কৃত্রিম তাম্রশাসন নহে। দামোদরপুরের তাম্রলিপিগুলির ন্যায় এগুলিও ভূমি বিক্রয়ের দলিল। ফরিদপুরের চারিখানি তাম্রলিপিতে তিনজন নূতন রাজার নাম পাওয়া গিয়াছে। ইঁহাদিগের নাম ধর্ম্মাদিত্য, গোপচন্দ্র এবং সমাচার দেব। ইহার পূর্ব্বে কোন শিলালিপি, তাম্রশাসন বা মুদ্রায় এই তিনজন রাজার নাম বা বংশপরিচয় পাওয়া যায় নাই। সম্প্রতি ঢাকা চিত্রশালার অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী স্থির করিয়াছেন যে, কলিকাতার চিত্রশালায় রক্ষিত, বহুপূর্ব্বে কোন অজ্ঞাত স্থানে আবিষ্কৃত, দুইটি অবিশুদ্ধ সুবর্ণের মুদ্রায় সমাচারদেবের নাম আছে। ধর্ম্মাদিত্য ও গোপচন্দ্রের নাম অদ্যাবধি কোন মুদ্রায় পাওয়া যায় নাই। ধর্ম্মাদিত্যের দুইখানি তাম্রলিপি ফরিদপুর জেলায় আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইহার মধ্যে প্রথম খানি তাঁহার তৃতীয় রাজ্যাঙ্কের বৈশাখমাসের পঞ্চম দিবসে প্রদত্ত হইয়াছিল[৬]। এই লিপিতে তাঁহার “মহারাজাধিরাজ, পরমেশ্বর বা পরমভট্টারক” উপাধি ব্যবহৃত হয় নাই। এই তাম্রলিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, ধর্ম্মাদিত্যের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে মহারাজ স্থাণুদত্ত গৌড়দেশের এক অংশের শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং তিনি বারকমণ্ডলে জজাব নামক বিষয়পতিকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। এই সময়ে বাতভোগ নামক একজন সাধনিক, এটিত, কুলচন্দ্র, গরুড়, বৃহচ্চট্ট, আলুক, অনাচার, ভাশৈত্য, শুভদেব, ঘোষচন্দ্র, অনিমিত্র, গুণচন্দ্র, কালসখ, কুলস্বামী, দুর্ল্লভ, সত্যচন্দ্র, অর্জ্জুন, বপ্প, কুণ্ডলিপ্ত প্রভৃতি বিষয় মহত্তরগণকে একব্রাহ্মণকে দান করিবার জন্য একখণ্ড ভূমি ক্রয়ার্থ আবেদন করিয়াছিল। তাহার আবেদনানুসারে পুস্তপাল বিনয়সেনের অবধারণে প্রতিকুল্যবাপের চারদীনার মূল্যানুসারে দ্বাদশ দীনার মূল্য গ্রহণ করিয়া, তিনকুল্যবাপ পরিমাণ ভূমি, বাতভোগকে প্রদান করা হইয়াছিল। এই ভূমি ধ্রুবিলাটীগ্রামে অবস্থিত ছিল। এই ধ্ৰুবিলাটীর বর্ত্তমান নাম ধুলট, ইহা ফরিদপুর জেলায় ফরিদপুর নগরের চৌদ্দক্রোশ উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত।

 ধর্ম্মাদিত্যের দ্বিতীয় তাম্রলিপিতে তারিখ নাই। ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, ধর্ম্মাদিত্যের রাজ্যকালে নব্যবকাশিকা নামক স্থানে মহাপ্রতীহার উপরিক নাগদত্ত শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং বারকমণ্ডলে গোপালস্বামী বিষয়ের শাসনকর্ত্তা ছিলেন। এই সময়ে বাসুদেবস্বামী নামক একব্যক্তি, সোমস্বামী নামক এক ব্রাহ্মণকে প্রদান করিবার জন্য, কিঞ্চিৎ ভূমি ক্রয়ের আবেদন করিয়াছিলেন। তাঁহার আবেদন গ্রাহ্য হইয়াছিল এবং এই তাম্রলিপিতে লিপিবদ্ধ হইয়াছিল[৭]। গোপচন্দ্রের রাজ্যকালের একখানিমাত্র তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা তাঁহার রাজ্যের ঊনবিংশবর্ষে প্রদত্ত হইয়াছিল এবং ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, উক্তবর্ষে নব্যবকশিকায় মহাপ্রতীহার কুমারামাত্য উপরিক নাগদেব শাসনকর্ত্তা ছিলেন। এই সময়ে বারুকমণ্ডলে বিনিযুক্ত বৎসপালস্বামী শাসনকর্ত্তা ছিলেন। বৎসপালস্বামী স্বয়ং, ভট্টগোমিদত্তস্বামী নামক এক ব্রাহ্মণকে দান করিবার জন্য, কিঞ্চিৎ ভূমিক্রয়ের আবেদন করিয়াছিলেন। সেই আবেদনানুসারে প্রতিকুল্যবাপের চার দীনার মূল্য অবধৃত হওয়ায়, এককুল্যবাপ ভূমি বৎসপালস্বামীকে বিক্রীত হইয়াছিল এবং তিনি উহা পুত্র পৌত্রাদিক্রমে ভোগ করিবার জন্য গোমিদত্তস্বামীকে দান করিয়াছিলেন। এই ভূমির পূর্ব্বদিকে ধ্রুবিলাটীগ্রামের অগ্রহার অবস্থিত ছিল[৮]

 চতুর্থ তাম্রশাসনখানি ফরিদপুর জেলায় বাগরাহাটীগ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল এবং উহা এখন ঢাকার চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, মহারাজাধিরাজ শ্রীসমাচারদেবের রাজ্যকালে নব্যবকাশিকায় অন্তরঙ্গ উপরিক শ্রীজীবদত্ত শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং তৎকর্ত্তৃক নিযুক্ত বিষয়পতি পবিত্রুক বারকমণ্ডলের শাসনকর্ত্তা ছিলেন। এই সময়ে সুপ্রতীকস্বামী নামক একব্যক্তি জ্যেষ্ঠাধিকরণিক দামুক প্রমুখ বিষয়মহত্তরগণের নিকট একখণ্ড ভূমি ক্রয় করিবার জন্য আবেদন করিয়াছিল এবং তদনুসারে তিনকুল্যবাপ পরিমাণ ভূমি তাহাকে বিক্রীত হইয়াছিল[৯]। এই তাম্রলিপির উদ্ধৃত পাঠ বহুবার প্রকাশিত হইয়াছে[১০] তন্মধ্যে শ্রীযুক্ত পার্জিটার (Pargiter) ও শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালীর পাঠ অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য। সম্প্রতি শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী পূর্ব্বপ্রকাশিত দুইটি সুবর্ণমুদ্রার লিপির নূতন পাঠ প্রকাশ করিয়াছেন। এই দুইটি সুবর্ণমুদ্রা কলিকাতার সরকারী চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। উক্ত চিত্রশালার তালিকায় মৃত ডাক্তার স্মিথ (Dr. V. A. Smith) এই দুইটি মুদ্রার পাঠোদ্ধার করিতে পারেন নাই[১১]। লেখক স্বয়ং দ্বিতীয়বার উহার পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছিলেন[১২]। কিন্তু ভট্টশালী মহাশয়ের পাঠই অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য[১৩]। তাঁহার মতানুসারে এই দুইটি মুদ্রাই সমাচারদেবের মুদ্রা। মুদ্রা দ্বারা সমাচারদেবের অস্তিত্ব প্রমাণ হইতেছে বটে কিন্তু বাগরাহাটী গ্রামে আবিষ্কৃত তাম্রলিপিটি কৃত্রিম। ইহা দামোদরপুরে আবিষ্কৃত প্রথম কুমারগুপ্ত, বুধগুপ্ত ও ভানুগুপ্ত এবং ফরিদপুরে আবিষ্কৃত ধর্ম্মাদিত্য ও গোপচন্দ্রের রাজ্যকালের তাম্রলিপির অনুরূপ কিন্তু ইহার লিখনকালে লেখক দুই তিন ভিন্ন ভিন্ন শতাব্দীর অক্ষর ব্যবহার করিয়াছেন। এতদ্দ্বারা প্রমাণ হইতেছে যে, সমাচারদেবের মৃত্যুর অথবা রাজ্যাবসানের পরে কোন ব্যক্তি প্রাচীন তাম্রলিপি ও তাম্রশাসনের অক্ষর অবলম্বন করিয়া এই তাম্রলিপিখানি জাল করিয়াছিল। সমাচারদেব নামক একজন রাজা ছিলেন বটে কিন্তু তিনি ধর্ম্মাদিত্য বা গোপচন্দ্রের পূর্ব্বে কি পরে রাজত্ব করিয়াছিলেন তাহা বলিতে পারা যায় না। ধর্ম্মাদিত্য, গোপচন্দ্র এবং সমাচারদেবের পরে শশাঙ্কের অভ্যুদয় পর্য্যন্ত গৌড়দেশ সম্বন্ধে আর কোন সংবাদ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।

 মগধে তৃতীয় কুমারগুপ্তের পরে তাঁহার পুত্র দামোদরগুপ্ত সিংহাসনলাভ করিয়াছিলেন। তিনি যুদ্ধে হূণবিজয়ী মৌখরীগণকে পরাজিত করিয়া তাঁহাদিগের সুশিক্ষিত রণতরীশ্রেণী বিপর্য্যস্ত করিয়াছিলেন[১৪]। প্রাচীন গুপ্তসাম্রাজ্যের অধঃপতনের সময়ে মুখরবংশীয় রাজগণ মধ্যদেশে (যুক্তপ্রদেশে) একটি নূতন রাজ্যস্থাপন করিয়াছিলেন। ইঁহারা অথবা মুখরবংশের অন্য কোনও শাখা মগধদেশের দক্ষিণাংশ বিজয় করিয়াছিলেন। বর্ত্তমান গয়াজেলার বরাবর পর্ব্বতে মৌর্য্যবংশীয় নরপতি অশোক প্রিয়দর্শী ও তাঁহার পুত্র দশরথ কর্ত্তৃক খনিত গুহায়, যজ্ঞবর্ম্মার পৌত্র, শার্দ্দূল বর্ম্মার পুত্র, অনন্তবর্ম্মা কতকগুলি দেবকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। প্রথম শিলালিপি লোমশঋষি-গুহায় উৎকীর্ণ আছে। ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, অনন্তবর্ম্মা এই গুহায় এক কৃষ্ণমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[১৫]। দ্বিতীয় শিলালিপি নাগার্জ্জুনী পর্ব্বতে বডথি গুহায় উৎকর্ণ আছে এবং ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, এই গুহায় অনন্তবর্ম্মা হরপার্ব্বতীর মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন[১৬]। তৃতীয় শিলালিপিটি গোপীকাগুহায় উৎকীর্ণ আছে এবং ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, অনন্তবর্ম্মা এই গুহায় কাত্যায়নীদেবীর মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহার সেবার জন্য একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[১৭]। হর্ষবর্দ্ধন যখন উত্তরাপথ অধিকার করিয়াছিলেন, মৌখরীরাজ্য সেই সময়ে লোপ হইয়াছিল। শেষ মৌখরীরাজ গ্রহবর্ম্মা হৰ্ষবর্দ্ধনের ভগ্নী রাজ্যশ্রীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন[১৮] এবং মালবের গুপ্তবংশীয় রাজা দেবগুপ্ত কর্ত্তৃক পরাজিত ও নিহত হইয়াছিলেন[১৯]। দামোদরগুপ্তের কন্যা মহাসেনগুপ্তার সহিত স্থাণ্বীশ্বর (বর্ত্তমান থানেশ্বর) রাজ আদিত্যবর্ম্মার বিবাহ হইয়াছিল[২০]। মহাসেনগুপ্তার পুত্র প্রভাকরবর্দ্ধন সর্ব্বপ্রথমে স্থাণ্বীশ্বর-রাজবংশে সম্রাট্ (মহারাজাধিরাজ) উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন[২১]। দামোদরগুপ্তের পুত্র মহাসেনগুপ্ত লৌহিত্য-তীরে (ব্রহ্মপুত্রতীরে) কামরূপরাজ সুস্থিতবর্ম্মাকে পরাজিত করিয়াছিলেন[২২]

 এই সময়ে উত্তরাপথের পূর্ব্বাঞ্চলে নবশক্তির উন্মেষ হইয়াছিল এবং মগধ ও গৌড়বাসিগণ অষ্টশতাব্দী পরে পুনরায় উত্তরাপথে একাধিপত্য বিস্তারে প্রয়াসী হইয়াছিলেন। এই সময়ে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক পূর্ব্বাঞ্চলের অধিপতি। শশাঙ্ক কে? তিনি কোন্ বংশজাত,তাহা নির্ণয় করিবার উপায় অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই। বাণভট্ট-প্রণীত হর্ষচরিত, চৈনিক-পরিব্রাজক ইউয়ান্-চোয়াঙের ভ্রমণবৃত্তান্ত ও দুইখানি খোদিতলিপি হইতে আমরা শশাঙ্ক নামক গৌড়েশ্বরের অস্তিত্ব ও স্থাণ্বীশ্বররাজের সহিত তাঁহার বিবাদের বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছি। এতদ্ব্যতীত বঙ্গ ও মগধের নানা স্থানে শশাঙ্ক ও নরেন্দ্রাদিত্য নামাঙ্কিত সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। পূর্ব্বোক্ত খোদিতলিপিদ্বয়ের মধ্যে প্রথমখানি তাম্রশাসন ও দ্বিতীয়খানি শিলালিপি। তাম্রশাসনথানি মাদ্রাজ প্রদেশের গঞ্জাম জেলায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল এবং এই তাম্রশাসনদ্বারা ৩০০ গৌপ্তাব্দে শশাঙ্কের রাজ্যকালে, সৈন্যভীত-মাধববর্ম্মা নামক জনৈক সামন্ত নরপতি এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দান করিয়াছিলেন[২৩]। শিলালিপিখানি দক্ষিণ-মগধে রোহিতাশ্ব দুর্গাভ্যন্তরে (বর্ত্তমান রোহতস্ গড়) পর্ব্বতগাত্রে আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহা শশাঙ্কের মুদ্রার ছাঁচ। যখন ইহা খোদিত হইয়াছিল, তখন শশাঙ্ক স্বাধীন রাজা নহেন। এই মুদ্রার ঊর্দ্ধদেশে একটি উপবিষ্ট বৃষের মূর্ত্তি খোদিত আছে এবং তন্নিম্নে “শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্কদেবস্য” উৎকীর্ণ আছে[২৪]। শশাঙ্কের বহু সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই মুদ্রাগুলি মূল্যানুসারে দুই ভাগে বিভক্ত হইতে পারে। প্রথমভাগের মুদ্রা অবিমিশ্রসুবর্ণে মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল ও দ্বিতীয় ভাগের মুদ্রা কিঞ্চিৎ সুবর্ণমিশ্রিত রজতে মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল[২৫]। চীনদেশীয় শ্রমণ হিউয়েন-থ্‌সং বা ইউয়ান্‌-চোয়াং তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্তে শশাঙ্ক সম্বন্ধে নিম্নলিখিত কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন:—"কর্ণসুবর্ণের অধিপতি বৌদ্ধধর্ম্মের প্রবল শত্রু দুষ্টাত্মা শশাঙ্ক কর্ত্তৃক হর্ষবর্দ্ধনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্দ্ধন নিহত হইয়াছিলেন। শশাঙ্ক গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্নাঙ্কিত পাষাণখণ্ড বিনাশে অসমর্থ হইয়া উহা গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন; কিন্তু উহা যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়াছিল। শশাঙ্ক বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করিয়া উহা নষ্ট করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু উহা অশোকের বংশধর মগধরাজ পূর্ণবর্ম্মার যত্নে পুনর্জ্জীবিত হইয়াছিল।” এতদ্ব্যতীত চীনদেশীয় শ্রমণের ভ্রমণবৃত্তান্তের নানা স্থানে শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ ও বৌদ্ধ নির্য্যাতনের কথা লিপিবদ্ধ আছে[২৬]

বাণভট্ট প্রণীত হর্ষচরিতে উল্লিখিত আছে যে, স্থাণ্বীশ্বররাজ রাজ্যবর্দ্ধন গ্রহ-বর্ম্মানিহন্তা মালবরাজকে অনায়াসে পরাজিত করিলেও গৌড়াধিপ মিথ্যা প্রলোভন দেখাইয়া, বিশ্বাস উৎপাদন করাইয়া, তাঁহাকে স্বভবনে অস্ত্রহীন অবস্থায় একাকী পাইয়া, গোপনে নিহত করিয়াছেন[২৭]। কথিত আছে, হৰ্ষবর্দ্ধন বলিয়াছিলেন যে, গৌড়রাজ ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি তাদৃশ মহাপুরুষকে এইরূপ ভাবে হত্যা করিবে না[২৮]। “সেই গৌড়াধম এই কার্য্যদ্বারা … … … কেবল অখ্যাতি সঞ্চয় করিয়াছে”[২৯]। হর্ষচরিতের আর এক স্থানে সিংহনাদ নামক সেনাপতি হৰ্ষবর্দ্ধনকে কহিতেছেন,—“দেব, রাজ্যবর্দ্ধন দুষ্ট গৌড়ভুজঙ্গের দংশনে স্বর্গে গমন করিয়াছেন”[৩০]

 রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যাকারী এই গৌড়াধিপ কে? হিউয়েন-থ্‌সং বা ইউয়ান্‌-চোয়াং রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যা সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন,—“প্রভাকরবর্দ্ধনের মৃত্যুর পরে (হৰ্ষবর্দ্ধনের) জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্দ্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিয়া সদ্ভাবে রাজ্য শাসন করিতেছিলেন। এই সময় ভারতের পূর্ব্বাংশস্থিত কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক অনেক সময় তাঁহার মন্ত্রিগণকে বলিতেন,—‘যদি সীমান্ত প্রদেশের রাজা ধার্ম্মিক হয়, তবে স্বরাজ্যের অকল্যাণ হয়।’ এই কথা শুনিয়া, তাঁহারা রাজা রাজ্যবর্দ্ধনকে সাক্ষাৎ করিতে আহ্বান করিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নিহত করিয়াছিলেন[৩১]।” চীনদেশীয় শ্রমণের মতে রাজ্যবর্দ্ধনের নিহন্তা কর্ণসুবর্ণের রাজা—কিন্তু বাণভট্টের মতে তিনি গৌড়েশ্বর। ইউয়ান্‌-চোয়াং বলেন যে, তাঁহার নাম শশাঙ্ক, কিন্তু স্বর্গগত ডাঃ বুলার (Hofrath Dr. Buhler) বলেন যে, হর্ষচরিতের একখানি পুথিতে রাজ্যবর্দ্ধন নিহন্তার নাম নরেন্দ্রগুপ্ত লিখিত আছে[৩২]। হর্ষচরিতের ষষ্ঠ উচ্ছ্বাসের টীকাকার বলিয়া গিয়াছেন যে, যিনি রাজ্যবর্দ্ধনকে হত্যা করিয়াছেন, তিনি শশাঙ্কনামা গৌড়াধিপতি[৩৩]। হর্ষচরিতের আর এক স্থানে ভণ্ডী বলিতেছেন যে, রাজ্যবর্দ্ধন স্বর্গারোহণ করিলে গুপ্তনামা জনৈক কুলপুত্র কুশস্থল (কান্যকুব্জ) অধিকার করিয়াছিলেন[৩৪]। এই স্থানে কুলপুত্র অর্থাৎ অভিজাতসম্প্রদায়ভুক্ত গুপ্তনামা কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ অধিকারের উল্লেখ দেখিয়া পণ্ডিতপ্রবর হল অনুমান করিয়াছিলেন যে, রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যাকারী গুপ্তবংশসম্ভূত[৩৫]। ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে যশোহর জেলার মহম্মদপুরে অরুণখালি নদীর নিকটে একটি মৃৎভাণ্ডে কতকগুলি প্রাচীন মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এই স্থানে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, প্রথম কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের কতকগুলি রজতমুদ্রার সহিত তিনটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহার মধ্যে একটি মুদ্রা শশাঙ্কের নামাঙ্কিত[৩৬]। দ্বিতীয় মুদ্রাটি মহাসেনগুপ্তের বংশধরগণের, অথবা বঙ্গবাসী প্রাচীন গুপ্তসাম্রাজ্যের সামন্তরাজগণের মুদ্রা[৩৭]। তৃতীয় মুদ্রাটিতে “শ্রীনরেন্দ্র বিনত” লিখিত আছে[৩৮]। কলিকাতার চিত্রশালায় মিশ্র সুবর্ণের আর একটি মুদ্রা আছে, তাহা এই মুদ্রা হইতে আকারে বিভিন্ন; কিন্তু ইহা কোন্ স্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য[৩৯]। মুদ্রাতত্ত্ববিদ্ জন্ আলান অনুমান করেন যে, এই মুদ্রাদ্বয়ও শশাঙ্কের মুদ্রা[৪০]

 রোহিতাশ্ব দুর্গে আবিষ্কৃত শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, শশাঙ্ক প্রথমে সম্পূর্ণ রাজোপাধি গ্রহণ করেন নাই এবং দক্ষিণ-মগধ তাঁহার অধিকারভুক্ত ছিল। ইউয়ান্‌-চোয়াঙের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত হইতে জানিতে পারা যায় যে, তিনি কর্ণসুবর্ণের অধিপতি ছিলেন। কর্ণসুবর্ণের বর্ত্তমান নাম রাঙ্গামাটী ইহা মুর্শিদাবাদ জেলার প্রধান নগর বহরমপুরের দক্ষিণে অবস্থিত[৪১]। হর্ষচরিত অনুসারে শশাঙ্ক গৌড়াধিপতি, গৌড় বলিতে উত্তর-বঙ্গ বুঝায়; সুতরাং মগধ, গৌড় ও রাঢ়দেশ শশাঙ্কের অধিকারভুক্ত ছিল, ইহা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে। শশাঙ্কের অপর নাম নরেন্দ্রগুপ্ত[৪২]। হর্ষচরিতের একখানি পুথিতে নরেন্দ্রগুপ্ত নামের উল্লেখ আছে। এতদ্ব্যতীত হর্ষচরিতের টীকাকার ষষ্ঠ উচ্ছ্বাসের টীকায় এই কথা স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। নরেন্দ্রগুপ্ত নাম দেখিলে বোধ হয় যে, তিনি গুপ্তবংশীয় নরপতি ছিলেন। গুপ্তনামধারী অভিজাতকুলজ কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যুর পরে কান্যকুব্জ অধিকারের উল্লেখ দেখিয়া পূর্ব্বোক্ত অনুমান যথার্থ বলিয়া বোধ হয়। তাঁহার যে সমস্ত মুদ্রা শশাঙ্ক নামে মুদ্রাঙ্কিত, তৎসমুদয়ের এক পার্শ্বে নন্দীর পৃষ্ঠে উপবিষ্ট মহাদেবের মূর্ত্তি ও অপর পৃষ্ঠে পদ্মাসনে সমাসীনা লক্ষ্মীর মূর্ত্তি আছে[৪৩]। প্রাচীন গুপ্তরাজবংশের সুবর্ণমুদ্রাসমূহের সহিত তুলনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, দুই একটি বিষয়ে পার্থক্য থাকিলেও শশাঙ্কের মুদ্রার সহিত প্রাচীন গুপ্তরাজবংশের সুবর্ণমুদ্রার বিশেষ সাদৃশ্য আছে। প্রথমতঃ মুদ্রার দ্বিতীয় পৃষ্ঠে কমলাত্মিকা-মূর্ত্তি, দ্বিতীয়তঃ মুদ্রার প্রথম পৃষ্ঠে রাজার নাম লিখনের পদ্ধতি, গুপ্তমুদ্রার সহিত শশাঙ্কের মুদ্রার তুলনা করিলে এই দুইটি সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। প্রাচীন গুপ্তসম্রাট্‌গণ ভাগবতমতাবলম্বী অর্থাৎ বৈষ্ণব ছিলেন; কিন্তু শশাঙ্ক শৈব ছিলেন, সেই জন্যই বোধ হয়, তাঁহার মুদ্রায় বৃষভবাহন মহাদেবের মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণের মুদ্রায় রাজার নাম লিখনকালে একটি অক্ষরের নিম্নে আর একটি অক্ষর অঙ্কিত হইত, শশাঙ্কের মুদ্রাতেও এই লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়। যশোহর জেলায় মহম্মদপুর গ্রামে ও অজ্ঞাত স্থানে প্রাপ্ত যে দুইটি মুদ্রা কলিকাতার চিত্রশালায় আছে, তাহাদিগের দ্বিতীয় পৃষ্ঠে যে খোদিতলিপি আছে, কোন পণ্ডিতের মতে তাহার প্রকৃত পাঠ নরেন্দ্রাদিত্য। ইহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে নরেন্দ্রাদিত্য শশাঙ্কের “আদিত্য” নাম ছিল। সমুদ্রগুপ্ত ব্যতীত অন্যান্য গুপ্তরাজগণের এইরূপ আদিত্য নাম ছিল দেখিতে পাওয়া যায়[৪৪]। যথা:—চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত মহেন্দ্রাদিত্য, স্কন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য, চন্দ্রগুপ্ত দ্বাদশাদিত্য ইত্যাদি।

 শশাঙ্কের রাজ্য ও তাঁহার বংশপরিচয় সম্বন্ধে যে সমস্ত প্রমাণ লিপিবদ্ধ হইল, তাহা হইতে অনুমান হয় যে, তিনি মগধের গুপ্তবংশজাত ছিলেন এবং মহাসেনগুপ্তের পুত্র অথবা ভ্রাতুষ্পপুত্র ছিলেন। মগধের গুপ্তরাজবংশ সম্ভবতঃ সম্রাট্ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কনিষ্ঠ পুত্র গোবিন্দগুপ্ত হইতে উৎপন্ন। গুপ্ত-সাম্রাজ্যের শেষ দশায় গুপ্তবংশের কোনও ব্যক্তি মালব অধিকার করিয়া একটি নূতনরাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। মালবের গুপ্তরাজগণ খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্য্যন্ত মালবে স্বীয় অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তবে তাঁহারা যশোধর্ম্মদেব অথবা প্রভাকরবর্দ্ধন ও হর্ষবর্দ্ধন প্রভৃতি প্রবল রাজগণের অধীনতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। প্রভাকরবর্দ্ধন মালবরাজের কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্ত নামক পুত্রদ্বয়কে মালব হইতে স্থাণ্বীশ্বরে আনয়ন করিয়া তাঁহাদিগকে রাজ্যবর্দ্ধন ও হর্ষবর্দ্ধনের সঙ্গী নিযুক্ত করিয়াছিলেন[৪৫]। গ্রহবর্ম্মানিহন্তা মালবরাজ দেবগুপ্তের নাম ইতিপূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। এক বংশসম্ভূত বলিয়াই, বোধ হয়, শশাঙ্ক দেবগুপ্তের সাহায্যার্থ বঙ্গ হইতে সুদূর কান্যকুব্জে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন। প্রভাকরবর্দ্ধন মালবরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াও মালবদেশ অধিকার করেন নাই, কিন্তু মালবরাজপুত্রদ্বয়কে স্থাণ্বীশ্বরে লইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পরে, উপযুক্ত অবসর বিবেচনা করিয়া, দক্ষিণে দেবগুপ্ত ও পূর্ব্বে শশাঙ্ক প্রাচীন গুপ্তরাজবংশের অতীত গৌরব উদ্ধার করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্তের, স্থাণ্বীশ্বর রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার অপর কোন কারণ দেখিতে পাওয়া যায় না। শশাঙ্ক সসৈন্যে দেবগুপ্তের সহিত মিলিত হইবার পূর্ব্বেই মালবরাজ বোধ হয়, রাজ্যবর্দ্ধনের সহিত যুদ্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন এবং তৎকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া পলায়ন করিয়াছিলেন, অথবা নিহত হইয়াছিলেন[৪৬]। ইতিপূর্ব্বে দেবগুপ্ত কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন এবং রাজ্যবর্দ্ধনের ভগিনীপতি গ্রহবর্ম্মাকে পরাজিত ও নিহত করিয়া রাজ্যশ্রীকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। রাজ্যশ্রীকে কারারুদ্ধ করিবার বিশেষ কোন কারণ দেখিতে পাওয়া যায় না; কিন্তু বিনা কারণে একজন গুপ্তবংশীয় নরপতি রমণীর প্রতি অত্যাচার করিয়াছিলেন, ইহা বিশ্বাস করিতেও প্রবৃত্তি হয় না। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন যে, শশাঙ্কের আদেশানুসারে রাজ্যশ্রী কারামুক্ত হইয়াছিলেন[৪৭]দেবগুপ্তের পরাজয়ের পরে রাজ্যবর্দ্ধনের সহিত শশাঙ্কের সাক্ষাৎ হইয়াছিল। হর্ষবর্দ্ধনের তাম্রশাসনদ্বয়ে দেখিতে পাওয়া যায় যে, রাজ্যবর্দ্ধন সত্যানুরোধে অরাতি-ভবনে গমন করিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন[৪৮]। হর্ষচরিতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, গৌড়াধিপ তাঁহাকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করিয়াছিলেন। বাণভট্ট স্থাণ্বীশ্বরের রাজবংশের অনুগ্রহপ্রার্থী ছিলেন এবং ইউয়ান্-চোয়াং হৰ্ষবর্দ্ধনের নিকট হইতে নানাবিধ সাহায্য ও উপহার পাইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত চীনদেশীয় শ্রমণ ঘোরতর ব্রাহ্মণবিদ্বেষী ছিলেন, এই জন্যই রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যু সম্বন্ধে তাঁহার উক্তি বিশ্বাসযোগ্য নহে। যিনি অনায়াসে মালবাধিপকে পরাজিত করিয়াছিলেন ও একাকী দুর্গম পার্ব্বত্য-প্রদেশে দুর্দ্ধৰ্ষ হূণজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, তিনি যে একাকী নিরস্ত্র অবস্থায় শক্র-ভবনে গমন করিবেন, ইহা বিশ্বাসযোগ্য উক্তি নহে। রাজ্যবর্দ্ধন মালবরাজকে পরাজিত করিয়া লুণ্ঠনলব্ধ দ্রব্যাদি ভণ্ডীর সহিত স্থাণ্বীশ্বরে প্রেরণ করিয়াছিলেন। ইহার পরই শশাঙ্ক বোধ হয়, তাঁহাকে বহু সৈন্য লইয়া আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং অনুমান হয় যে, যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হইয়া রাজ্যবর্দ্ধন অবশেষে নিহত হইয়াছিলেন। রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যুর পরে শশাঙ্ক কি জন্য স্থাণ্বীশ্বর আক্রমণ করেন নাই, তাহা বলিতে পারা যায় না। রাজ্যবর্দ্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্দ্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, তিনি যত দিন তাঁহার ভ্রাতার শত্রুগণকে শাস্তি দিতে না পরিবেন, তত দিন তিনি দক্ষিণ হস্ত দ্বারা আহার্য্য সামগ্রী তুলিয়া মুখে দিবেন না[৪৯]। হৰ্ষবর্দ্ধনের রাজ্যাভিষেকের সঙ্গে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বিগণের ষড়্‌যন্ত্র আরম্ভ হইয়াছিল। হর্ষবর্দ্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রাকালে কামরূপরাজপুত্র ভাস্করবর্ম্মা কর্ত্তৃক প্রেরিত হংসবেগ নামক জনৈক দূতের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। ভাস্করবর্ম্মা হর্ষের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইবার জন্য বহুমূল্য উপঢৌকনের সহিত হংসবেগকে প্রেরণ করিয়াছিলেন[৫০]। হর্ষের রাজ্যের প্রারম্ভে স্থাণ্বীশ্বর-রাজগণের এমন কোন আকর্ষণী শক্তি ছিল না যদ্দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া কামরূপরাজগণ ভারতের অন্য প্রান্তে অবস্থিত স্থাণ্বীশ্বররাজ্যের সহিত সন্ধি-বন্ধনের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই ভাস্করবর্ম্মা পরবর্ত্তিকালে অন্ততঃ কিয়ৎকালের জন্য কর্ণসুবর্ণ নগর অধিকার করিয়াছিলেন, কারণ, নিধানপুরে ভাস্করবর্ম্মার যে তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা কর্ণসুবর্ণ হইতে প্রদত্ত হইয়াছিল। অনুমান হয় যে, কামরূপ-রাজ শশাঙ্ক কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া অবশেষে স্থাণ্বীশ্বররাজের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন এবং হর্ষ ও ভাস্করবর্ম্মার সহিত যুদ্ধে শশাঙ্ক অবশেষে পরাজিত হইয়াছিলেন। শশাঙ্কের যে সমস্ত সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে অপকৃষ্ট ও উৎকৃষ্ট উভয় জাতীয় ধাতুতে অঙ্কিত মুদ্রা দেখিতে পাওয়া যায়। গৌড়েশ্বর বোধ হয়, দীর্ঘকাল যুদ্ধ করিয়া অবশেষে অর্থাভাবে বহুল পরিমাণে রজতমিশ্রিত সুবর্ণে মুদ্রাঙ্কণ আরম্ভ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ৬০৬ খৃষ্টাব্দে রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যু হইয়াছিল। এই সময়ে শশাঙ্ক কামরূপ ব্যতীত সমগ্র উত্তর-পূর্ব্ব ভারতের অধীশ্বর ছিলেন। ৬১৯ খৃষ্টাব্দে উড়িষ্যার দক্ষিণস্থিত কোঙ্গোদমণ্ডলে সৈন্যভীত মাধববর্ম্মা নামক শশাঙ্কের জনৈক সামন্তরাজার অধিকার ছিল। ৬৩৬ হইতে ৬৩৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে ইউয়ান-চোয়াং কর্ণসুবর্ণে আসিয়াছিলেন[৫১], তাহার পূর্ব্বেই শশাঙ্কের মৃত্যু হইয়াছে এবং কর্ণসুবর্ণ তখন হর্ষের সাম্রাজ্যভুক্ত, কারণ, ইউয়ান-চোয়াং কর্ণসুবর্ণের কোন নূতন রাজার নাম উল্লেখ করেন নাই[৫২]। ৬১৯ হইতে ৬৩৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে শশাঙ্কের মৃত্যু হইয়াছিল। হর্ষের সহিত যুদ্ধের শেষভাগে শশাঙ্ক বোধ হয়, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর নিকট সাহায্য পাইয়াছিলেন। হর্ষবর্দ্ধন দ্বিতীয় পুলকেশী কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন[৫৩]। ঐতিহাসিক ভিন্সেণ্ট্ স্মিথ অনুমান করেন যে, ৬২০ খৃষ্টাব্দে হৰ্ষবর্দ্ধন চালুক্যরাজ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন[৫৪]। অনুমান হয় যে, উড়িষ্যায়, দক্ষিণ-কোশলে ও কলিঙ্গে হর্ষের সহিত পুলকেশীর সংঘর্ষ হইয়াছিল, কারণ, পুলকেশীর ঐহোলে প্রাপ্ত খোদিতলিপিতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, হর্ষবর্দ্ধনকে পরাজিত করিবার সময়ে অথবা তাহার পরে পুলকেশীকে কলিঙ্গ ও কোশল জয় করিতে হইয়াছিল[৫৫]। কলিঙ্গ ও কোশল, কোঙ্গোদ দেশের পূর্ব্বে অবস্থিত[৫৬]। ৫৫৬ শকাব্দ অর্থাৎ ৬৩৪ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে দ্বিতীয় পুলকেশী কর্ত্তৃক হর্ষবর্দ্ধনের পরাজয় এবং কলিঙ্গ ও কোশল বিজয় ঘটিয়াছিল[৫৭], কিন্তু ইউয়ান্‌-চোয়াং লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার চীনদেশের প্রত্যাগমনের অব্যবহিত পূর্ব্বে অর্থাৎ ৬৪২ বা ৬৪৩ খৃষ্টাব্দে কুমার ভাস্করবর্ম্মা তাঁহাকে কামরূপে আহ্বান করিয়াছিলেন। এই সময়ে হর্ষবর্দ্ধন কোঙ্গোদমণ্ডলে যুদ্ধাভিযান শেষ করিয়া আর্য্যাবর্ত্তে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিলেন[৫৮], সুতরাং শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে শৈলোদ্ভববংশীয় সৈন্যভীত মাধববর্ম্মা অথবা তাঁহার পুত্র চালুক্যরাজের সাহায্যে হর্ষের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলেন।

 পরিব্রাজক ইউয়ান্‌-চোয়াং নানাস্থানে শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষের কথা উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু বৌদ্ধতীর্থ বা বৌদ্ধাচার্য্যগণের প্রতি শশাঙ্কের অত্যাচারের কাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযোগ্য নহে। ইহার প্রথম কারণ এই যে, চৈনিক শ্রমণের ধর্ম্মমত অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ছিল এবং তিনি স্বধর্ম্মিগণের প্রতি সর্ব্বত্র অযথা পক্ষপাত প্রদর্শন করিয়াছেন। দ্বিতীয় কারণ এই যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও বঙ্গে ও মগধে বহু মন্দির, বিহার, সঙ্ঘারামাদি বিদ্যমান ছিল। ইউয়ান্-চেয়াং যাহা লিখিয়াছেন, তাহা যদি সত্য হইত, বৌদ্ধধর্ম্মের বিলোপসাধনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া শশাঙ্ক যদি বৌদ্ধতীর্থসকলের ধ্বংসসাধনে প্রবৃত্ত হইতেন, তাহা হইলে পরিব্রাজক স্বয়ং শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে গৌড়ে, রাঢ়ে ও মগধে সমৃদ্ধ ও জনপূর্ণ সঙ্ঘারাম ও বিহারাদি দেখিতে পাইতেন না। শশাঙ্ক কর্ত্তৃক বোধিদ্রুম বিনাশ, কুশীনগরে ও পাটলিপুত্রে বৌদ্ধকীর্ত্তি ধ্বংস প্রভৃতি কার্য্যের বোধ হয়, অন্য কোন কারণ ছিল। বৌদ্ধধর্ম্মানুরক্ত স্থাণ্বীশ্বররাজের অনুকূলাচরণের জন্যই বোধ হয় শশাঙ্ক বুদ্ধগয়া, পাটলিপুত্র ও কুশীনগরের বৌদ্ধযাজকগণকে শাসন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দও পূর্ব্বে এই মত প্রকাশ করিয়াছেন[৫৯]

 শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা অথবা পিতৃব্যপুত্র মাধবগুপ্ত মগধের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। শশাঙ্ক যে গুপ্তবংশীয় ছিলেন, ইহার বহু প্রমাণাভাস পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে। শশাঙ্ক সম্ভবতঃ মগধের গুপ্তবংশজাত ছিলেন, এই অনুমান সত্য হইলে তাঁহার সম্বন্ধনির্ণয়ে বিশেষ কোন বাধা থাকে না। মহাসেনগুপ্ত কামরূপরাজ সুস্থিতবর্ম্মার সমসাময়িক ব্যক্তি। সুস্থিতবর্ম্মার কনিষ্ঠপুত্র ভাস্করবর্ম্মা শশাঙ্কের সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন; অতএব শশাঙ্ক মহাসেনগুপ্তের জ্যেষ্ঠপুত্র অথবা পুত্রস্থানীয়। মহাসেনগুপ্তের পুত্র মাধবগুপ্ত, প্রভাকরবর্দ্ধনের কনিষ্ঠ পুত্র হর্ষবর্দ্ধনের সমসাময়িক ব্যক্তি; শশাঙ্ক, প্রভাকরবর্দ্ধন ও রাজ্যবর্দ্ধনের সমসাময়িক ব্যক্তি; অতএব শশাঙ্ক মাধবগুপ্তের জ্যেষ্ঠস্থানীয়। এই সকল প্রমাণের ফল অনুমান মাত্র, নূতন আবিষ্কার না হইলে শশাঙ্কের সহিত মগধের গুপ্তরাজবংশের সম্বন্ধ নির্দ্দিষ্ট হইবে না। মাধবগুপ্তের রাজ্যকালে মগধের গুপ্তবংশীয় রাজগণ হর্ষবর্দ্ধনের সামন্তরূপে পরিগণিত হইতেন। নিধানপুরে আবিষ্কৃত ভাস্করবর্ম্মার তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, উক্ত তাম্রশাসন কর্ণসুবর্ণবাসক হইতে প্রদত্ত হইয়াছিল[৬০]। ইহা হইতে শ্রীযুক্ত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য অনুমান করেন যে, কর্ণসুবর্ণ তৎকালে কামরূপরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল[৬১]। ঐতিহাসিক ভিন্সেণ্ট্ স্মিথ এই উক্তির সমর্থন করিয়াছেন[৬২], কিন্তু এই অনুমান যথার্থ বলিয়া বোধ হয় না, কারণ, স্কন্ধাবার বা বাসক শব্দে রাজধানী বুঝায় না। সম্ভবতঃ ভাস্করবর্ম্মা শশাঙ্কের সহিত দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধের সময়ে কিয়ৎকাল কর্ণসুবর্ণ অধিকার করিয়াছিলেন এবং সেই সময়ে নিধানপুরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন প্রদত্ত হইয়াছিল। যুদ্ধযাত্রার সময়ে তাম্রশাসন প্রদানের আরও দুই একটি উদাহরণ ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়। গাহডবালবংশীয় কান্যকুব্জরাজ গোবিন্দচন্দ্র ১২০২ বিক্রমাব্দে মুদ্গগিরিতে গঙ্গাস্নান করিয়া শ্রীধর ঠক্কুর নামক জনৈক ব্রাহ্মণকে একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[৬৩]। গোবিন্দচন্দ্র এই সময়ে নিশ্চয়ই যুদ্ধাভিযান উপলক্ষে মুদ্গগিরিতে বা মুঙ্গেরে আসিয়াছিলেন; কারণ, অঙ্গদেশ কখনও গাহডবাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় নাই।

 মাধবগুপ্তের পুত্র আদিত্যসেনের অফসড় গ্রামে আবিষ্কৃত খোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, মাধবগুপ্ত হর্ষবর্দ্ধনের বন্ধু ছিলেন[৬৪]। এই খোদিতলিপিতে মহাসেনগুপ্তের নামের পরেই মাধবগুপ্তের নাম আছে, ইহাতে শশাঙ্কের নাম নাই। ভিটরী গ্রামে আবিষ্কৃত সম্রাট দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের মুদ্রায় শ্রীগুপ্ত হইতে দ্বিতীয়কুমারগুপ্ত পর্য্যন্ত সমস্ত গুপ্তবংশীয় সম্রাট্‌গণের নাম আছে, কেবল স্কন্দগুপ্তের নাম নাই[৬৫]। ইহাতে প্রথম কুমারগুপ্তের জ্যেষ্ঠপুত্র স্কন্দগুপ্তের নামের পরিবর্ত্তে তাঁহার কনিষ্ঠভ্রাতা পুরগুপ্তের নাম দেখিতে পাওয়া যায়। স্কন্দগুপ্তের নাম লোপের দুইটি কারণ দেখিতে পাওয়া যায়। প্রথম কারণ অপত্যাভাব, দ্বিতীয় কারণ ভ্রাতৃবিরোধ। প্রথম কারণটি সমীচীন বলিয়া বোধ হয় না, কারণ, কেহ কেহ অনুমান করেন যে, তৃতীয় চন্দ্রগুপ্ত দ্বাদশাদিত্য, বিষ্ণুগুপ্ত চন্দ্রাদিত্য প্রভৃতি রাজগণ স্কন্দগুপ্তের বংশধর[৬৬]। পক্ষান্তরে অন্যান্য তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, ভ্রাতৃবিরোধ না থাকিলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, এমন কি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পুত্রের নাম পর্য্যন্তও কনিষ্ঠ ভ্রাতার তাম্রশাসনে উল্লিখিত আছে। নিধানপুরের আবিষ্কৃত ভাস্করবর্ম্মার তাম্রশাসনে তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সুপ্রতিষ্ঠিতবর্ম্মার,[৬৭] মধুবন ও বাঁশখেরা গ্রামদ্বয়ে আবিষ্কৃত হর্ষবর্দ্ধনের তাম্রশাসনদ্বয়ে রাজ্যবর্দ্ধনের নামোল্লেখ[৬৮] এবং মনহলি গ্রামে আবিষ্কৃত মদনপালদেবের তাম্রশাসনে তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কুমারপাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র তৃতীয় গোপালের[৬৯] নামোল্লেখ এই[৭০] অনুমানের প্রমাণস্বরূপ উল্লিখিত হইতে পারে।

 ইউয়ান্-চোয়াং বারাণসী হইতে মহাসারনগর (বর্ত্তমান আরার নিকটস্থিত মাসার গ্রাম) এবং মহাসার হইতে বৈশালী নগরে গমন করিয়াছিলেন। বর্ত্তমান মজঃফরপুর জেলার দশক্রোশ দূরবর্ত্তী বসাঢ় গ্রামে প্রাচীন বৈশালী নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়[৭১]। ইউয়ান্‌-চোয়াং যে সময়ে বৈশালী দর্শন করিয়াছিলেন, সে সময়ে নগর-ধ্বংসোন্মুখ। বৈশালী নগরে যে হ্রদের তীরে একটি বানর বুদ্ধদেবকে একপাত্র মধু অর্পণ করিয়াছিল, সেই হ্রদের তীরে, চৈনিক শ্রমণ সম্রাট্ অশোক কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি বৃহৎ শিলাস্তম্ভ দর্শন করিয়াছিলেন। সে সময়ে বৈশালী নগরে ব্রাহ্মণ, জৈন ও বৌদ্ধ তিন সম্প্রদায়েরই মন্দির ও মঠ ছিল; কিন্তু দিগম্বর জৈন-সম্প্রদায়ের প্রভাব সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ছিল। ইউয়ান্-চোয়াং লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, বৈশালী হইতে দুই ক্রোশ দূরে একটি স্তূপ আছে, এই স্থানে সপ্তশত অর্হৎ বিনয় ও অভিধর্ম্মপিটক সংগ্রহ করিয়াছেন। পরিব্রাজক, বৈশালী হইতে বজ্জিদেশ ও নেপাল ভ্রমণ করিয়া মগধে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিলেন। তখন মগধদেশের অবস্থা অতি শোচনীয়, নগরসমূহ জনশূন্য এবং রাজধানী পাটলিপুত্রনগরী শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য। তখন মগধে বৌদ্ধধর্ম্মের অপ্রতিহত প্রভাব; ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের একশত দেবমন্দিরও ছিল না। পাটলিপুত্র নগর গঙ্গাতীরে অবস্থিত ছিল এবং ইহার ধ্বংসাবশেষের পরিধি সপ্তক্রোশের অধিক। পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে চীনদেশীয় শ্রমণ মৌর্য্যসম্রাট্‌গণের পুরাতন প্রাসাদ, অশোক-নির্ম্মিত দুই তিনটি শিলাস্তম্ভ এবং বহু মন্দির, বিহার, সঙ্ঘারামাদির ধ্বংসাবশেষ দর্শন করিয়াছিলেন। এই স্থানে তখন একটি খোদিতলিপিযুক্ত শিলাস্তম্ভ ও পাষাণখণ্ডে অঙ্কিত গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ন দেখিতে পাওয়া যাইত এবং এই স্থানে ইউয়ান্-চোয়াং কুক্কুটারাম বা কুক্কুটপাদবিহারের ধ্বংসাবশেষ দর্শন করিয়াছিলেন। ইউয়ান্-চোয়াং পাটলিপুত্র হইতে গয়া এবং গয়া হইতে বুদ্ধগয়ায় গমন করিয়াছিলেন, গয়া নগর তখনও ব্রাহ্মণপ্রধান ছিল। তখন বুদ্ধগয়ায় মহাবোধিবিহারের বহির্দ্দেশে সিংহলের জনৈক ভূতপূর্ব্ব অধিপতি-নির্ম্মিত একটি বৃহৎ সঙ্ঘারাম ছিল; ইহাতে সহস্রাধিক মহাযানমতাবলম্বী ভিক্ষু বাস করিতেন। তখন প্রতি বৎসর বর্ষাবাসের শেষে চতুর্দ্দিকের ভিক্ষু ও শ্রমণগণ এই স্থানে আসিয়া সপ্তাহকাল উৎসবে নিমগ্ন থাকিতেন। মহাবোধি হইতে ইউয়ান্‌-চোয়াং গুরুপাদ পর্ব্বতশীর্ষে (বর্ত্তমান গুর্‌পা) মহাকাশ্যপের সমাধি-স্থান দর্শন[৭২] করিয়া প্রাচীন মগধের ভূতপূর্ব্ব রাজধানী রাজগৃহে গমন করিয়াছিলেন; তখন রাজগৃহ জনশূন্য মরুভূমি। রাজগৃহ হইতে ইউয়ান্-চোয়াং নালন্দায় গমন করিয়াছিলেন এবং সর্ব্বসমেত সেই স্থানে দুই বৎসর কাল বাস করিয়া বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। তখন নালন্দার সঙ্ঘারামসমূহে সহস্র সহস্র ভিক্ষু বাস করিতেন। নানা দেশ হইতে বিদেশীয় ছাত্রগণ অধ্যয়নার্থ নালন্দায় আসিত। ইউয়ান্-চোয়াংএর অবস্থানকালে সমতট দেশের রাজপুত্র মহামতি শীলভদ্র নালন্দা মহাবিহারের মহাস্থবির ছিলেন। চীনদেশীয় শ্রমণ শীলভদ্র ব্যতীত ধর্ম্মপাল, চন্দ্রপাল, গুণমতি, স্থিরমতি, প্রভামিত্র, জিনমিত্র ও জ্ঞানচন্দ্র নামধেয় নালন্দাবাসী মহাপণ্ডিতগণের নামোল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। স্থিরমতি-প্রণীত ‘মহাযানাবতারকশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থ খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর শেষভাগে চীনভাষায় অনুদিত হইয়াছিল এবং তাঁহার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘মহাযানধর্ম্মধাত্ববিশেষতাশাস্ত্র’ ৬৯১ খৃষ্টাব্দে চীনভাষায় অনুবাদিত হইয়াছিল[৭৩]। জিনমিত্র বোধিসত্ত্ব, সর্ব্বাস্তিবাদীয় সম্প্রদায়ের বিনয়পিটক সম্বন্ধে একখানি বহুমূল্য গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। ইহার নাম ‘মূলসর্ব্বাস্তিবাদ-নিকায়-বিনয়-সংগ্রহ’ এবং পরিব্রাজক ই-চিঙ্গ্ ইহা চীনভাষায় অনুবাদ করিয়াছিলেন[৭৪]। অঙ্গদেশে চম্পা নগরে ইউয়ান্‌-চোয়াং বহু সঙ্ঘারামের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়াছিলেন। তিনি গৌড়ে পৌণ্ড্রবর্দ্ধন, পূর্ব্বদেশে সমতট, রাঢ়ে কর্ণসুবর্ণ ও সুহ্মে তাম্রলিপ্তি দর্শন করিয়াছিলেন। তাঁহার সময়ে পৌণ্ড্রবর্দ্ধনে বিংশতি বৌদ্ধসঙ্ঘারাম ও শতাধিক দেবমন্দির ছিল। এই স্থানেও তিনি বহু দিগম্বর সম্প্রদায়ভূক্ত জৈন দেখিতে পাইয়াছিলেন। সমতটে কিঞ্চিদধিক ত্রিংশতিটি সঙ্ঘারাম ও শতাধিক দেবমন্দির ছিল। সমতটদেশ সমুদ্রতীরে অবস্থিত এবং এই স্থানেও বহু দিগম্বর জৈন পরিদৃষ্ট হইয়াছিল। সমতটের পূর্ব্বে শ্রীক্ষেত্র (বর্ত্তমান প্রোম), কমলাঙ্ক বা কামলঙ্কা (বর্ত্তমান পেগু), দ্বারাবতী (শ্যামদেশের প্রাচীন রাজধানী আয়ুথা বা অযোধ্যার প্রাচীন নাম), যবপতি ও ঈশানপুর (পূর্ব্বে কাম্বোজ বা কাম্বোডিয়া নামক পাঁচটি প্রদেশ ছিল। এই প্রদেশগুলির পূর্ব্বে মহাচম্পা (বর্ত্তমান কোচিন চীন ও আনাম), দক্ষিণপূর্ব্বে যমনদ্বীপ বা যবদ্বীপ (?) অবস্থিত ছিল। তাম্রলিপ্তি সমুদ্রতটে অবস্থিত ছিল। এই স্থানে বহু দেবমন্দির ও দশটিমাত্র বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম ছিল। কর্ণসুবর্ণে দশটি সঙ্ঘারামে সম্মতীয় সম্প্রদায়ের প্রায় দ্বিসহস্র ভিক্ষু বাস করিতেন। কর্ণসুবর্ণ নগরে পঞ্চাশটি দেবমন্দির ছিল এবং এই স্থানে নানাধর্ম্মাবলম্বী লোক বাস করিত। ইহার নিকটে রক্তমৃত্তিক সঙ্ঘারাম অবস্থিত ছিল ও নগরমধ্যে অশোক-নির্ম্মিত কয়েকটি স্তূপ বা চৈত্য ছিল[৭৫]

 শ্রীমতীদেবী নাম্নী পত্নীর গর্ভজাত মাধবগুপ্তের আদিত্যসেন নামক পুত্র তাঁহার মৃত্যুর পরে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন[৭৬]| প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌গণ অনুমান করেন যে, ৬৪৬ অথবা ৬৪৭ খৃষ্টাব্দে হর্ষবর্দ্ধনের মৃত্যু হইয়াছিল[৭৭]। হর্ষবর্দ্ধনকে হত্যা করিয়া অর্জ্জুন বা অর্জ্জুনাশ্ব নামক তাঁহার জনৈক অমাত্য কান্যকুব্জের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। এই সময়ে মাধবগুপ্ত অথবা আদিত্যসেন স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিলেন। অফ্‌সড্ গ্রামে আদিত্যসেনের একখালি খোদিতলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, আদিত্যসেন একটি বিষ্ণুমন্দির নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তাঁহার মাতা শ্রীমতীদেবী একটি মঠ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পত্নী কোণদেবী একটি পুষ্করিণী খনন করাইয়াছিলেন। এই খোদিতলিপি গৌড়বাসী সূক্ষ্মশিব কর্ত্তৃক রচিত বা উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৭৮]। হর্ষবর্দ্ধন কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত অব্দের ৬৬ সম্বৎসরে ৬৭১-৭২ খৃষ্টাব্দে সালপক্ষ নামক জনৈক বলাধিকৃত (সেনাপতি) কর্ত্তৃক একটি সূর্য্যমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[৭৯]। আদিত্যসেনের রাজ্যকালের এই খোদিতলিপিদ্বয় বর্ত্তমান সময়ে অদৃশ্য হইয়াছে। মন্দার পর্ব্বতে আদিত্যসেনের পত্নী পরমভট্টারিকা রাজ্ঞী মহাদেবী কোণদেবী দুইটি পুষ্করিণী খনন করাইয়াছিলেন[৮০]। এতদ্ব্যতীত ঝাড়খণ্ডে (দেওঘর) বৈদ্যনাথদেবের মূল মন্দিরের প্রাচীরে সংলগ্ন দ্বাদশ শতাব্দীর একখানি খোদিতলিপিতে আদিত্যসেন ও তৎপত্নী কোষদেবীর (কোণদেবীর) নাম আছে[৮১]। আদিত্যসেনের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র দেবগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দেবগুপ্ত ব্যতীত আদিত্যসেনের আর এক কন্যা ছিলেন, তাঁহার সহিত মৌখরিবংশীয় নরপতি ভোগবর্ম্মার বিবাহ হইয়াছিল[৮২]। দেবগুপ্তের পত্নীর নাম কমলাদেবী এবং তাঁহার পুত্রের নাম বিষ্ণুগুপ্ত। বিষ্ণুগুপ্তের পত্নীর নাম ইজ্জাদেবী এবং তাঁহার পুত্রের নাম জীবিতগুপ্ত। এই দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের রাজ্যকালে বরুণিকা (বর্ত্তমান নাম দেওবনারক) গ্রাম বরুণবাসী মন্দিরদেবতার পূজার নিমিত্ত প্রদত্ত হইয়াছিল। এই গ্রাম পূর্ব্বে বালাদিত্যদেব অর্থাৎ সম্রাট্ নরসিংহগুপ্ত কর্ত্তৃক প্রদত্ত হইয়াছিল, তৎপরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইহা শর্ব্ববর্ম্মা ও অবন্তীবর্ম্মা কর্ত্তৃক বরুণবাসী দেবতার পূজার্থ প্রদত্ত হইয়াছিল[৮৩]। শর্ব্ববর্ম্মা ও অবন্তীবর্ম্মা উভয়েই মৌখরী-বংশজাত। শর্ব্ববর্ম্মা মৌখরিরাজ ঈশানবর্ম্মার পুত্র[৮৪] এবং দামোদরগুপ্তের সমসাময়িক ব্যক্তি। দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের পরবর্ত্তী গুপ্তবংশজাত অন্য কোন নরপতির নাম অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। কোন্ সময়ে দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের মৃত্যু হইয়াছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। অনুমান হয় খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষপাদে অথবা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম পাদে মগধের গুপ্তরাজবংশের অধিকার লোপ হইয়াছিল। বাঙ্গালাদেশের নানাস্থানে স্কন্দগুপ্তের মুদ্রার অনুরূপ সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। যশোহর জেলায় মহম্মদপুর গ্রামে এই জাতীয় একটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৮৫]। ঢাকার নিকটে আর একটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৮৬]। ফরিদপুরে কোটালিপাড় গ্রামে জনৈক কৃষকের নিকটে এই জাতীয় আর একটি মুদ্রা আছে[৮৭]। ১৯১০ খৃষ্টাব্দে কোটালিপাড় গ্রামে এই জাতীয় আর তিনটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছিল। বগুড়া জেলায় আবিষ্কৃত এই জাতীয় একটি মুদ্রা রঙ্গপুর সদ্যপুষ্করিণীর অন্যতম ভূম্যধিকারী রায় শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় রায় চৌধুরী বাহাদুরের নিকটে আছে[৮৮]। লণ্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়মে এই জাতীয় তিনটী মুদ্রা আছে[৮৯]; কিন্তু তাহা কোন্ কোন্ স্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। স্বর্গীয় পণ্ডিত উইলসন্ (H. H. Wilson) এই জাতীয় আর একটী মুদ্রার চিত্র প্রকাশ করিয়াছিলেন[৯০]। শিক্ষাবিভাগের ইনস্পেক্টর শ্রীযুক্ত ষ্টেপল্‌টন্‌ প্রথমে অনুমান করিয়াছিলেন যে, এই মুদ্রাগুলি স্কন্দগুপ্তের মুদ্রা[৯১]। কিন্তু তিনি পরে স্বীকার করিয়াছেন যে মুদ্রাগুলি পরবর্ত্তীকালের মুদ্রা[৯২]। মুদ্রাতত্ত্ববিদ্ শ্রীযুক্ত জন আলানের মতানুসারে এই মুদ্রাগুলি বঙ্গদেশের প্রচলিত খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মুদ্রা[৯৩]। সম্ভবতঃ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর মাধবগুপ্ত ও তাঁহার বংশধরগণ এই জাতীয় মুদ্রা প্রচলন করিয়াছিলেন।

 এই জাতীয় অনেকগুলি মুদ্রার সন্ধান সম্প্রতি ঢাকা চিত্রশালার অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী সংগ্রহ করিয়া ঢাকা রিভিউ-পত্রে প্রকাশ করিয়াছেন।

 ১। কোটালিপাড় থানার অর্দ্ধক্রোশ পূর্ব্বে অবস্থিত কয়েখা নামক স্থানে আবিষ্কৃত একটি সুবর্ণমুদ্রা, ইহা তারাসী নিবাসী শ্রীযুক্ত মদনমোহন সাহা কর্ত্তৃক ঢাকা চিত্রশালায় উপহার প্রদত্ত হইয়াছে।

 ২। ঢাকা জেলায় সাভার গ্রামে আবিষ্কৃত আর একটি মুদ্রা, ইহা সাভারের নিকটবর্ত্তী পুরান ভাটপাড়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছিল।

 ৩। পুরান ভাটপাড়ায় আবিষ্কৃত এই জাতীয় আর একটি সুবর্ণ মুদ্রা।

 ৪। সাভারের নিকট কাটাগঙ্গার দক্ষিণ পূর্ব্বে রাজাসনে আবিষ্কৃত এই জাতীয় আর একটি সুবর্ণ মুদ্রা।

 ৫। সাভারে আবিষ্কৃত এই জাতীয় আর একটি সুবর্ণ মুদ্রা, ইহা শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্র নাথ বসুর নিকটে আছে।

 শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয়ের মতানুসারে এই জাতীয় মুদ্রায়, অন্ততঃ এই জাতীয় কতকগুলি মুদ্রায় “শ্রীসুধন্যাদিত্য” লিখিত আছে, কিন্তু তাঁহার এ অনুমান সম্পূর্ণ অমূলক[৯৪]

পরিশিষ্ট (ঘ)

দ্বিতীয় গুপ্তরাজবংশ (অফ্‌সড় ও দেওবরনার্কের খোদিত লিপি হইতে):–
 
 
 
 
 
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
প্রথম কুমারগুপ্ত
 
 
 
গোবিন্দগুপ্ত
অথবা
কৃষ্ণগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
হর্ষগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
১ম জীবিতগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
৩য় কুমারগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
দামোদরগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
মহাসেনগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্তমাধবগুপ্ত
 
শ্রীমতীদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
আদিত্যসেন
 
কোণদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
দেবগুপ্ত
 
কমলাদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
২য় জীবিতগুপ্ত

 ১৯০৩ খৃষ্টাব্দে ডাক্তার ব্লক বৈশালীর ধ্বংসাবশেষ খননকালে একটি মৃন্ময় মুদ্রা আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই মুদ্রা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পত্নী ধ্রুবস্বামিনীর গোবিন্দগুপ্ত নামক আর একটি পুত্র ছিল। ডাক্তার ব্লক অনুমান করেন যে, এই গোবিন্দগুপ্ত ও মগধের গুপ্তরাজবংশের আদিপুরুষ কৃষ্ণগুপ্ত একই ব্যক্তি।

 মৌখরি রাজবংশ:—

 
 
 
 
 
হরিবর্ম্মা
 
জয়স্বামিনী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
আদিত্যবর্ম্মা
 
হর্ষগুপ্তা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
ঈশ্বরবর্ম্মা
 
উপগুপ্তা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
ঈশানবর্ম্মা
 
লক্ষ্মীবতী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
শর্ব্ববর্ম্মা
 
অবন্তীবর্ম্মাযজ্ঞবর্ম্মা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
গ্রহবর্ম্মাশার্দ্দূলবর্ম্মা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
ভোগবর্ম্মাঅনন্তবর্ম্মা
 

 আদিত্যসেনের দৌহিত্রী বৎসদেবীর সহিত নেপালের লিচ্ছবীবংশজাত শিবদেবের বিবাহ হইয়াছিল। শিবদেবের পুত্র জয়দেবের সহিত কামরূপরাজ হর্ষদেবের কন্যা রাজমতীর বিবাহ হইয়াছিল।

 
 
মাধবগুপ্ত
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
আদিত্যসেন
 
 
উদয়দেব
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
দেবগুপ্ত
 
কন্যা
 
(মৌখরিরাজ)
ভোগবর্ম্মা
নরেন্দ্রদেব
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
বৎসদেবী
 
শিবদেবহর্ষদেব (কামরূপরাজ)
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
জয়দেব
 
রাজ্যমতী
 
 
 
 
 
 
 
 
(৭৫৯ খৃষ্টাব্দে)
 
 

 নিধানপুরে আবিষ্কৃত কামরূপরাজ ভাস্করবর্ম্মার তাম্রশাসনে ভগদত্তবংশীয় রাজগণের বংশপরিচয় পাওয়া গিয়াছে:—

 
 
 
 
 
পুষ্যবর্ম্মা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
সমুদ্রবর্ম্মা
 
দত্তদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
বলবর্ম্মা
 
রত্নবতী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
কল্যাণবর্ম্মা
 
গন্ধর্ব্ববতী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
গণপতিবর্ম্মা
 
যজ্ঞবতী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
মহেন্দ্রবর্ম্মা
 
সুব্রতা
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
নারায়ণবর্ম্মা
 
দেববতী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
মহাভূতবর্ম্মা
 
বিজ্ঞানবতী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
চন্দ্রমুখবর্ম্মা
 
ভোগবতী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
স্থিতবর্ম্মা
 
নয়নদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
সুস্থিতবর্ম্মা, নামান্তর মৃগাঙ্ক
 
শ্যামাদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
সুপ্রতিষ্ঠিতবর্ম্মা
 
ভাস্করবর্ম্মা

 ১৯১৫ খৃষ্টাব্দের মার্চ্চ মাসে যুক্ত প্রদেশের বড়বাঁকী জেলায় হড়াহাগ্রামে একখানি শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইহা মৌখরিবংশীয় ঈশানবর্ম্মার রাজ্যকালে ৬১১ বিক্রমাব্দে উৎকীর্ণ হইয়াছিল। এই শিলালিপিতে হরিবর্ম্মা, তৎপুত্র আদিত্যবর্ম্মা, তৎপুত্র ঈশ্বরবর্ম্মা, তৎপুত্র ঈশানবর্ম্মা এবং তৎপুত্র সূর্য্যবর্ম্মার উল্লেখ আছে। এই শিলালিপির ত্রয়োদশ শ্লোক হইতে জানিতে পারা যায় যে, ঈশানবর্ম্মা অন্ধ্র, শূলিক এবং সমুদ্রতীরবাসী গৌড়গণকে পরাজিত করিয়াছিলেন।[৯৫]

 বাঙ্গালার ইতিহাস প্রথমভাগের প্রথম সংস্করণের ৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত সমতটের পূর্ব্বদিকে অবস্থিত শ্রীক্ষেত্র, কামলঙ্কা বা কমলাঙ্ক, দ্বারাবতী, মহাচম্পা, ঈশানপুর ও যবদ্বীপ এই ছয়টি প্রদেশের বর্ত্তমান অবস্থান সম্বন্ধে মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদ মহাশয় বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন[৯৬]। এই প্রবন্ধে লেখক বাঙ্গালার ইতিহাসে এই ছয়টি দেশের যথোপযুক্ত অবস্থান নির্ণীত হয় নাই ইহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। বিদ্যাবিনোদ মহাশয় তাঁহার বাঙ্গালা প্রবন্ধ কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তিত করিয়া বিলাতের Royal Asiatic Society পত্রিকায় দ্বিতীয়বার মুদ্রিত করিয়াছেন[৯৭]। ইংরাজী প্রবন্ধে বাঙ্গালার ইতিহাসের উল্লেখ নাই তবে উভয় প্রবন্ধের নাম একই: “সমতটের পূর্ব্বে” “To the East of Samatata”। এই প্রবন্ধে বিদ্যাবিনোদ মহাশয় প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন যে শ্রীক্ষেত্র বর্ত্তমান কুমিল্লা, ঈশানপুর মণিপুর রাজ্যে অবস্থিত, বিষ্ণুপুর এবং মহাচম্পা ব্রহ্মদেশে ভামোনগরের নিকটে অবস্থিত সম্পেনাগো। বিদ্যাবিনোদ মহাশয়ের ইংরাজী প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবার পরে ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ্ লুই ফিনো (Louis Finot) স্পষ্ট প্রমাণ করিয়াছেন যে, মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ মহাশয় এ সম্বন্ধে নূতন কথা কিছুই বলিতে পারেন নাই (In conclusion, I am bound to say that the paper of Mr. P. B. V. leaves the question unchanged, and that the identifications previously accepted are just as firmly established as ever)[৯৮] শ্রীযুক্ত ফিনো প্রমাণ করিয়াছেন যে, মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদ মহাশয় মাত্র শব্দসাদৃশ্যের উপর নির্ভর করিয়া এবং গত অর্দ্ধশতাব্দীর মধ্যে ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌গণ এই সকল দেশের অবস্থান সম্বন্ধে যে সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহা না পড়িয়াই নূতন করিয়া অবস্থান নির্ণয় কার্য্যে ব্রতী হইয়াছিলেন[৯৯]:—

 It may be seen at once that Mr. P. B. V. has taken no notice whatever of the laws of phonetic correspondence which rule the transcription of Indian words into Chinese, and that he allows himself to be guided in his parallels by the vaguest analogies of sound. Such a process takes us back to sixty years ago, before Stanislas Julien had published his Methode pour dechiffrer et transcrire les noms sanscrits qui se rencontrent dans les livres chinois (Paris 1861). Still less does he take into account the improvements which Julien’s method has received at the hands of such scholars as Professors Sylvain Levi and Paul Pelliot. It is quite unnecessary to insist on the fact—evident to any informed reader—that the above equivalents do not conform in any way to the present conditions of philology and are phonetically untenable.

 From an historical point of view the innovation does not look more successful. Generally speaking, a theory which pretends to overthrow an admitted one is based either on the discovery of new evidence or on a new interpretation of the older one. But, as to Mr. P. B. V’s theory, we suspect that it has no other foundation than an insuffiient knowledge of existing documents. It would be long and unnecessary task to discuss its arguments in detail; we should be obliged to refer to several elementary principles of method and to some notorious facts with which the distinguished Professor does not seem thoroughly conversant. A few observations will show to what extent the ground of this bold fabric is unsafe[১০০].


  1. Fleet’s Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III, p. 203.
  2. কৃত্বা চায়তি মৌচিত স্থলভুবো গৌড়ান্ সমুদ্রাশ্রয়া-
    নধ্যাসিষ্ট নতক্ষিতীশচরণঃ সিংহাসনং যোজিতী॥—

    —Epigraphia Indica, Vol. XIV, p. 117.

  3. Ibid, p. 118.
  4. Indian Antiquary, Vol. XXXIX, 1910, p. 193 ff.
  5. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. VII, pp. 289-308; Vol. X, pp. 425-37.
  6. Indian Antiquary, Vol. XXXIX, pp. 193-98.
  7. Ibid. pp. 199-202.
  8. Ibid. pp. 203-05.
  9. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. VII, pp. 476-87.
  10. Ibid. Vol. VI, pp. 429-36; Dacca Review, 1920, p. 87.
  11. Catalogue of coins in the Indian Museum, Vol. I, P. 120, uncertain No. 1, p 122; uncertain No. 1; Catalogue of coins, Gupta dynasties, pp. 149-50.
  12. Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1913-14. p. 260, pl. LXIX. 33-34.
  13. Dacca Review, 1920, pp. 47-49.
  14. Fleet’s Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III, p. 203.
  15. Ibid, pp. 222-23.
  16. Ibid, pp. 224-25.
  17. Ibid. p. 227.
  18. হর্ষচরিত, ৪র্থ উচ্ছ্বাস।
  19. Harsa-carita of Bana, Trans, by Cowell and Thomas, p. xii, note 1.
  20. Epigraphia Indica, Vol. VIII, App, p. 12.
  21. Ibid, Vol. I. p. 72.
  22. Fleet’s Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. p. 203.
  23. Epigraphia Indica, Vol. VI, pp. 144-145.
  24. Fleet’s Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III. p. 284.
  25. Catalogue of Coins in the Indian Museum, [[Vol. I. p. 120, nos. 2-6.
  26. Watter's On-Yuan-Chwang. Vol. I. p. 343; Beal's Buddhist Records of the Western World, Vol. I, p. 210 ff.
  27. তস্মাচ্চ হেলানির্জিতমালবানীকমপি গৌড়াধিপেন মিথ্যোপচারোপচিতবিশ্বাসং মুক্তশস্ত্রম্ একাকিনং বিশ্রদ্ধং স্বভবন এব ভ্রাতরং ব্যাপাদিতমশ্রৌষীৎ।—হর্ষচরিতম্, ষষ্ঠ উচ্ছ্বাস। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্করণ—পৃঃ ১৬১।
  28. “অবাদীচ্চ গৌড়াধিপমপহায় কস্তাদৃশং মহাপুরুষং......ঈদৃশেন সর্ব্বলোক বিগর্হিতেন মৃত্যুনা শময়েদার্য্যম্”—হর্ষচরিত, পৃঃ ১৬২।
  29. “নিজগৃহদূষণং জালমার্গপ্রদীপকেন কজ্জলমিবাতিমলিনং কেবলমযশঃ সঞ্চিতং গৌড়াধমেন”—Ibid.
  30. “দেব দেবভূয়ং গতে নরেন্দ্রে দুষ্টগৌড়ভুজঙ্গজগ্ধজীবিতে চ রাজ্যবর্দ্ধনে বৃত্তেঽস্মিন্ মহাপ্রলয়ে ধরণীধারণায়াধুনাত্বং শেষঃ”—হর্ষচরিত, পৃঃ ১৬১।
  31. Beal's Buddhist Record of the Western World, Vol. I, p. 210. শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দের বঙ্গানুবাদ,—গৌড়রাজমালা— পৃঃ ৮।
  32. Epigraphia Indica, Vol. I. p. 70.
  33. হর্ষচরিত—টীকা।
  34. দেবভূয়ং গতে দেবে রাজ্যবর্দ্ধনে গুপ্তনাম্না চ গৃহীতে কুশস্থলে।—হর্ষচরিত, পৃঃ ১৯৯।
  35. Fitz-Edward-Hall’s ‘Vasavadatta’, p. 52.
  36. Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. XXI, p. 401, pl. XII, fig. 12.
  37. পরে যথাস্থানে ইহার বিবরণ প্রদত্ত হইল।
  38. Indian Museum Catalogue of coins, Vol. I, p. 122, pl. XVI, no. 13.
  39. Ibid, p. 120.
  40. British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. lxiv.
  41. শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায়-প্রণীত মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃঃ ৮৪-১০৩
  42. Indian Antiquary, Vol, VII. 1878, p, 197.
  43. British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, pp. 147-48.
  44. Ibid, p. liii.
  45. হর্ষচরিত, ৪র্থ উচ্ছ্বাস, পৃঃ ১০০।
  46. হর্ষচরিত, ষষ্ঠ উচ্ছ্বাস, পৃঃ ১৫৭।
  47. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ১০।
  48. রাজানো যুধি দুষ্টবাজিন ইব শ্রীদেবগুপ্তাদয়ঃ।
    কৃতা যেন কশাপ্রহারবিমুখাঃ সর্ব্বে সমং সংযতাঃ॥
    উৎখায় দ্বিষতো বিজিত্য বসুধাং কৃত্বা প্রজানাং প্রিয়ং
    প্রাণানুজ্ঝিতবানরাতিভবনে সত্যানুরোধেন যঃ॥
    —Epigraphia Indica, Vol, I, p. 72, Vol, VI, p. 210.

  49. Beal’s Buddhist Records of the Western World, Vol. I, р. 213.
  50. হর্ষচরিত, ৭ম উচ্ছ্বাস।
  51. Watters’ On-Yuan-Chwang, Vol, II, p, 335.
  52. Ibid, p. 191.
  53. অপরিমিতবিভূতিস্ফীতসামন্তসেনা
    মকুটমণিময়ূখাক্রান্তপাদারবিন্দঃ।
    যুধি পতিতগজেন্দ্রানীকবীভৎসভূতো
    ভয়বিগলিতহর্ষো যেন চাকারি হর্ষঃ॥২৩৷
    —Epigraphia Indica. Vol. VI, p. 6.

  54. V. A. Smith. Early History of India. 3rd. Edition, p. 340.
  55. গৃহিণাং স্ব স্বগুণৈস্ত্রিবর্গতুঙ্গা বিহিতান্যক্ষিতিপাল মানভঙ্গাঃ।
    অভবন্নুপজাতভীতিলিঙ্গা যদনীকেন সকোশলাঃ কলিঙ্গাঃ॥২৬।
     —Epigraphia Indica, Vol, VI, p. 6.
  56. Watters’ On-Yuan-Chwang, Vol. II, pp. 194-201.
  57. Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 3.
  58. Watters’ On-Yuan-Chwang, Vol. I, p. 349.
  59. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ১৩
  60. Epigraphia Indica, Vol. XII, p. 73.
  61. বিজয়া, আষাঢ়, ১৩২০ পৃঃ ৬২৭।
  62. V. A. Smith, Early History of India, 3rd. Edition, p. 356.
  63. Epigraphia Indica, Vol. VII, p. 98.
  64. Fleet’s Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III, p. 204.
  65. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1889, part I, p. 89.
  66. British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. cxxxvi.
  67. Epigraphia Indica, Vol. XII, p. 73-74.
  68. Epigraphia Indica, Vol. I, p. 72; Vol. IV, р. 210.
  69. উইকিসংকলন টীকা: বর্তমানে চতুর্থ গোপাল হিসেবে গণ্য। Furui, Ryosuke, Rajibpur Copperplate Inscriptions of Gopāla IV and Madanapāla, প্রত্ন সমীক্ষা (Journal of the Centre for Archaeological Studies and Training, Eastern India), New Series, Vol 6, 2015, p. 39.
  70. শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সঙ্কলিত গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৫২
  71. Annual Report of Archaeological Survey of India, 1903-4, p. 81.
  72. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. II, pp. 77-83.
  73. Catalogue of the Chinese Translation of the Buddhist Tripitaka, by Bunyiu Nanjio, p. 275, No. 1253; p. 278, No. 1243.
  74. Ibid, p. 249, No. 1127.
  75. Watters’ On-Yuan-Chwang, Vol. II, pp. 63-193.
  76. Epigraphia Indica, Vol. VIII, App. p. 10.
  77. V. A. Smith, Early History of India, 3rd. Edition, p. 352.
  78. Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol III, p. 202 5.Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol III, p. 202-5.
  79. Ibid, p. 210.
  80. Ibid, p. 212.
  81. Ibid, p, 213.
  82. Indian Antiquary, Vol. IX, p. 178.
  83. Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III, pp. 225-26.
  84. Ibid, p. 220.
  85. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1852, p. 401, pl. xii. 10.
  86. Ibid, New Series, Vol. VI, p. 141.
  87. Ibid, p. 141.
  88. Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1913-14, p. 258., pl. LXIX, 29-30.
  89. British Museum Catalogue of Indian coins, Gupta dynasties, pp. cvii, 154; pl. xxiv. 17-19.
  90. Ariana Antiqua, pl. xviii, 20.
  91. Journal of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. VI, p. 143.
  92. Ibid, note. 1.
  93. British Museum Catalogue of Indian Coins, Gupta dynasties, p. cvii.
  94. Dacca Review, 1920, pp. 78-82.
  95. Epigraphia India, Vol. XIV, pp. 110-20.
  96. বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা ১৬শ ভাগ, পৃঃ ১-১৮।
  97. Journal of the Royal Asiatic Society 1920, pp. 1-19.
  98. Ibid. p. 452.।
  99. Ibid. pp. 449-52.
  100. Ibid, pp. 448-49.