বাঙ্গালার ইতিহাস (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)/তৃতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় অধ্যায়।

মীরজাফরের প্রভুত্ব এককালে বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা তিন প্রদেশে অব্যাহতরূপে অঙ্গীকৃত হইল। কিন্তু অতি অল্প কালেই প্রকাশ পাইল তাঁহার কিছুমাত্র বিষয়বুদ্ধি নাই। তিনি স্বভাবতঃ নির্ব্বোধ, নিষ্ঠুর ও অর্থলোভী ছিলেন। রাজ্যের প্রধান প্রধান হিন্দু কর্ম্মকরেরা, পূর্ব্ব পূর্ব্ব নবাবদিগের অধিকার কালে, অনেক ধন সঞ্চয় করিয়াছিলেন; তিনি, প্রথমতঃ, তাঁহাদিগের সর্ব্বস্ব হরণ মনস্থ করিলেন। প্রধান মন্ত্রী রাজা রায়দুর্লভ কেবল অত্যন্ত ধনবান ছিলেন, এমত নহে; তাঁহার নিজের ছয় সহস্র সৈন্যও ছিল। মীরজাফর সর্ব্বাগ্রে তাঁহাকেই লক্ষ্য করিলেন।

 মীরজাফরকে সিংহাসনে নিবিষ্ট করিবার বিষয়ে রাজা রায়দুর্লভই প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। যখন সিরাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নিমিত্ত চক্রান্ত হয়, তখন রায় দুর্লভই চক্রান্তকারিদিগের নিকট প্রস্তাব করেন যে মীরজাফরকে নবাব করা উচিত। তথাপি, মীরজাফর এক্ষণে রায়দুর্লভের সর্ব্বনাশের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলেন। ফলতঃ, তাঁহার উপর মীরজাফরের এমত বিষম বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল যে তাঁহার সহিত সিরাজউদ্দৌলার কনিষ্ঠ ভ্রাতার বন্ধুতা আছে, এই সন্দেহ করিয়া, সেই অল্পবয়স্ক নিরপরাধ রাজকুমারের প্রাণবধ করিলেন। রায়দুর্লভও কেবল ইঙ্গরেজদিগের শরণাগত হইয়া সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলেন।

 রাজা রামনারায়ণ বহুকালাবধি বিহারের ডেপুটী গবর্ণর ছিলেন। নবাব মনস্থ করিলেন, তাঁহাকে পদচ্যুত করিয়া তদীয় সমুদায় সম্পত্তি অপহরণ করিবেন, ও ' আপন ভ্রাতাকে গবর্নরী পদ দিবেন। ক্লাইবের মতে, মীরজাফরের ভ্রাতা মীরজাফর অপেক্ষাও নির্ব্বোধ। নবাব মেদিনীপুরের গবর্ণর রাজা রামসিংহের ভ্রাতাকে কারাগারে রুদ্ধ করিলেন; তাহাতে রামসিংহও তাঁহার প্রতি ভগ্নম্নেহ হইলেন। পূর্ণিয়ার ডেপুটী গবর্ণর অদল সিংহ মন্ত্রিদিগের কুমন্ত্রণা অনুসারে রাজবিদ্রোহে অভ্যুত্থান করিলেন।

 এইরূপে, মীরজাফরের সিংহাসনারোহণের পর পাঁচ মাসের মধ্যে, তিন প্রদেশে তিন বিদ্রোহ ঘটে। তখন তিনি ব্যাকুল হইয়া, বিদ্রোহ শান্তির নিমিত্ত, ক্লাইবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। তৎকালে ক্লাইব বাঙ্গালাতে সকলেরি বিশ্বাসভূমি ছিলেন। এই বিশ্বাস অপাত্রে বিন্যস্ত হয় নাই। যেহেতু তিনি উপস্থিত তিন বিদ্রোহের শান্তি করিলেন, অথচ এক বিন্দুও রক্তপাত হইল না।  নবাব বিনয়বাক্যে প্রার্থনা করতে ক্লাইব পাটনা যাইবার সময় মুরশিদাবাদ হইয়া যান। নবাব ইঙ্গরেজদিগকে যত টাকা দিতে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, এপর্য্যন্ত তাহার অধিকাংশই পরিশোধ করেন নাই। অতএব, ক্লাই রাজধানীতে উত্তীর্ণ হইয়া নবাবকে জানাইলেন যে সে সকল পরিশোধ করিবার কোন বন্দোবস্ত অবশ্য করিতে হইবেক। নবাব তদনুসারে, দেয় পরিশোধ স্বরূপ, বর্দ্ধমান, নদীয়া ও হুগলী এই তিন প্রদেশের রাজস্ব তাঁহাকে নির্দ্ধারিত করিয়া দিলেন।

 এই বিষয় নিষ্পত্তি হইলে পর, ক্লাইব ও নবাব স্ব স্ব সৈন্য লইয়া পাটনা যাত্রা করিলেন। তাঁহারা তথায় উপস্থিত হইলে, রামনারায়ণ ক্লাইবের শরণাগত হইয়া কহিলেন যদি ইঙ্গরেজেরা আমাকে অভয়দান করেন, তাহা হইলে আমি আপন প্রভুর আজ্ঞানুবর্তী থাকিতে পারি। ক্লাইব বিস্তর বুঝাইলে পর, নবাব রামনারায়ণের প্রতি অক্রোধ হইলেন। অনন্তর রামনারায়ণ অবিলম্বে মীরজাফরের শিবিরে গিয়া তাঁহার সমুচিত সম্মান করিলেন। মীরজাফর এ যাত্রা তাঁহাকে পদচ্যুত করিলেন না। পরে ক্লাইব ও নবাব একত্র হইয়া মুরশিদাবাদ প্রত্যাগমন করিলেন। রাজা রায়দুর্লভ পূর্ব্বাপর তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে ছিলেন। তিনি মনে মনে নিশ্চয় করিয়াছিলেন, ইঙ্গরেজেরা যাবৎ উপস্থিত আছেন, তত দিনই রক্ষার সম্ভাবনা।

 পাটনার ব্যাপার এইরূপে নিষ্পন্ন হওয়াতে, জাফরের পুত্র মীরন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন। তাঁহাদের পিতাপুত্রের এই অভিপ্রায় ছিল পরাক্রান্ত হিন্দুদিগের দমন ও সর্ব্বস্বহরণ করিবেন। কিন্তু এ যাত্রায় তাহা না হইয়া, বরং তাহাদিগের পরাক্রমের দৃঢ়ীকরণই হইল। সুতরাং তাঁহারা উভয়েই ক্লাইকের এইরূপ ক্ষমতা দর্শনে অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। মীরজাফর শুনিতে তিন প্রদেশের নবাব ছিলেন বটে; কিন্তু বাস্তবিক তিনি কিছুই ছিলেন না; ক্লাইবই সকল ছিলেন।

 দুই বৎসর পুর্ব্বে ইঙ্গরেজদিগকে, নবাবের নিকট স্বপক্ষে একটি অনুকুল কথা বলাইবার নিমিত্ত, টাকা দিয়া যে সকল প্রধান লোকের উপাসনা করিতে হইত; এক্ষণে সেই সকল ব্যক্তিকে ইঙ্গরেজদিগের উপাসনা করিতে হইল। মুসলমানেরা দেখিতে লাগিলেন, চতুর হিন্দুরা অকর্মণ্য নবাবের আনুগত্য পরিত্যাগ করিয়া, ক্লাইবের নিকটেই সকল বিষয়ের প্রার্থনা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু ক্লাইব সেই সকল বিষয়ে এমত বিজ্ঞতা ও বিবেচনা পূর্ব্বক কার্য্য করিতেন যে যাবৎ তাঁহার হস্তে সকল বিষয়ের কর্তৃত্ব ভার ছিল তাবৎ কোন বিষয়েই গোলযোগ উপস্থিত হয় নাই।

 হতভাগ্য দিল্লীশ্বরের পুত্র, শাহ আলম, প্রয়াগ ও অষধ্যার সুবাদারের সহিত সন্ধি করিয়া, বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া, বিহারদেশ আক্রমণ করিতে উদ্যত হই লেন। ঐ দুই সুবাদারের,এই সুযোগে বাঙ্গালা রাজ্যের কোন অংশ আত্মসাৎ করিতে পারা যায় কি না, এই চেষ্টা দেখা যেরূপ অভিপ্রেত ছিল, উক্ত রাজকুমারের সাহায্য করা সেরূপছিলনা। শাহআলম ক্লাইকে পত্র লিখিলেন, যদি আপনি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধি বিষয়ে সহায়তা করেন, তাহা হইলে আমি আপনাকে ক্রমে ক্রমে এক এক প্রদেশের আধিপত্য প্রদান করি। কিন্তু ক্লাইব উত্তর দিলেন, আমি মীরজাফরের বিপক্ষতাচরণ করিতে পারিব না। শাহআলম, সম্রাটের সহিত বিবাদ করিয়া, তদীয় সম্মতি ব্যতিরেকেই বিহারদেশ আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন; এই নিমিত্ত, সম্রাটও ক্লাইবকে এই আজ্ঞা পত্র লিখিলেন আপনি আমার বিদ্রোহি পুত্রকে, দেখিতে পাইলেই, রুদ্ধ করিয়া আমার নিকট পাঠাইবেন।

 মীরজাফরের সৈন্য সকল, বেতন না পাওয়াতে, অত্যন্ত অবাধ্য হইয়াছিল; সুতরাং, তদ্বারা এই আক্রমণ নিবারণের কোন সম্ভাবনা ছিল না। অতএব তাঁহাকে, উপস্থিত বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইবার নিমিত্ত, পুনৰ্বার ক্লাইবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিতে হইল। তদনুসারে ক্লাইব সত্ত্বর হইয়া, ১৭৫৮ খৃঃ অব্দে, পাটনা যাত্রা করিলেন। কিন্তু, ক্লাইবের উপস্থিতির পূর্ব্বেই, এই ব্যাপার এক প্রকার নিষ্পন্ন হইয়া ছিল। রাজকুমার ও প্রয়াগের সুবাদার নয় দিবস পাটনা অবরোধ করিয়াছিলেন। বোধ হয় ঐ স্থান তাঁহাদের হস্তগত হইতে পারিত। কিন্তু তাঁহারা শুনিলেন ইঙ্গরেজেরা আসিতেছেন, এবং অযোধ্যার সুবাদার, প্রয়াগের সুবাদারের অনুপস্থিতি রূপ সুযোগ পাইয়া, বিশ্বাসঘাতকতা পূর্ব্বক হার রাজধানী অধিকার করিয়াছেন। এই সংবাদ পাইয়া, প্রয়াগের সুবাদার, আপন উপায় আপনি চিন্তা করুন এই বলিয়া, রাজকুমারের নিকট বিদায় লইয়া, স্বীয় রাজ্য রক্ষার্থে সত্বর হইলেন। কিন্তু তদুপলক্ষে যে যুদ্ধ উপস্থিত হইল তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হইল। রাজকুমারের সৈন্যের অতি শীঘ্র তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল; কেবল তিন শত ব্যক্তি মাত্র তাঁহার অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিয়া রহিল। পরিশেষে তাঁহার এমত দুরবস্থা ঘটিয়াছিল যে তিনি ক্লাইবের নিকট ভিক্ষার্থে লোক প্রেরণ করেন। ক্লাইব বদান্যতা প্রদর্শন পূর্ব্বক রাজকুমারকে সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা পাঠাইয়া দেন।

 মীরজাফর, এইরূপে উপস্থিত বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাইয়া, কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ ক্লাইবকে ওমরা উপাধি দিলেন; এবং কোম্পানিকে নবাব সরকারে কলিকাতার জমীদারীর যে রাজস্ব দিতে হইত, তাহা তাঁহাকে জায়গীর স্বরূপ দান করিলেন। নির্দিষ্ট আছে ঐ রাজস্ব বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা ছিল।

 এই সকল ঘটনার কিছু দিন পরে, মীরজাফর কলিকাতায় আসিয়া ক্লাইবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; এবং তিনিও যৎপরোনাস্তি সমাদর পূর্ব্বক তাঁহার সম্বর্ধনা করিলেন। তিনি তথায় থাকিতে থাকিতেই, ওলন্দাজদিগের সাত খান যুদ্ধজাহাজ নদী মূখে আসিয়া নঙ্গর করিল। ঐ সাত জাহাজে পঞ্চদশ শত সৈন্য ছিল। অতি ত্বরায় ব্যক্ত হইল, ঐ সকল জাহাজ নবাবের সম্মতি ব্যতিরেকে আইসে নাই। ইঙ্গরেজদিগকে দমনে রাখিতে পারে, এমত এক দল ইউরোপীয় সৈন্য আনাইবার নিমিত্ত, তিনি কিয়ৎকালাবধি চুঁচুড়াবাসি ওলন্দাজদিগের সহিত মন্ত্রণ করিতেছিলেন। খোজাবাজীদ নামক এক কাশ্মীরদেশীয় বণিক্ এই সকল কুমন্ত্রণার সাধক হইয়াছিলেন।

 খোজাবাজীদ আলিবর্দি খাঁর অত্যন্ত অনুগ্রহপত্র ছিলেন। লবণব্যবসায় তাঁহার একচাটিয়া ছিল। তিনি এমত ঐশ্বর্যশালী ছিলেন যে সহস্র মুদ্রা তাঁহার দৈনন্দিন ব্যয় ছিল; এবং এক বার তিনি নবাবকে পঞ্চদশ লক্ষ টাকা উপহার দিয়াছিলেন। পূর্ব্বে তিনি মুরশিদাবাদে ফরাসিদিগের এজেণ্ট ছিলেন। পরে, চন্দননগর পরাজয় দ্বারা তাঁহাদিগের অধিকার উচ্ছিন্ন হইলে, ইঙ্গরেজদিগের পক্ষে আইসেন।

 সিরাজউদ্দৌলা তাঁহাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু উক্ত নবাবকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নিমিত্ত, ইঙ্গরেজদিগকে আহ্বান করিবার বিষয়ে, তিনিই প্রধান উদ্যোগ হইয়াছিলেন। রাজবিপ্লবের পর তিনি দেখিলেন যে ইঙ্গরেজদিগের নিকট যে সকল আশা করিয়াছিলেন, তাহা পূর্ণ হইল না। অতএব ইঙ্গরেজদিগের দমন করিবার নিমিত্ত, বহুসংখ্যক ওলন্দাজী সৈন্য আনয়ন বিষয়ে যত্নবান হইয়াছিলেন।

 তৎকালে চুঁচুড়ার কৌন্সিলে দুই পক্ষ ছিল। তন্মধ্যে এক পক্ষের প্রধান গবর্ণর বিসদম সাহেব। ইনি ক্লাইবের বন্ধু ছিলেন। তাহার নিতান্ত বাসনা, কোন রূপে সন্ধি ভঙ্গ না হয়। আর রর্ণেট নামক এক ব্যক্তি অন্য পক্ষের প্রধান ছিলেন। এই পক্ষের লোকেরা অত্যন্ত উদ্ধত ছিলেন; এবং তাঁহাদিগের মতানুসারেই চুঁচুড়ার সমুদায় কার্য্য সম্পন্ন হইত। ইতিপূর্বে ইঙ্গরেজেরা, আপনাদের মঙ্গলের নিমিত্ত, ওলন্দাজদিগকে নিষেধ করিয়াছিলেন, যে আপনারা এই নদীতে সজাতীয় নাবিক রাখিতে পরিবেন না। অতএব ওলন্দাজেরী, বহুসংখ্যক সৈন্য পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, বটেবিয়াতে পত্র লিখিয়াছিলেন। তাঁহারা মনে মনে আশা করিয়াছিলেন এতদ্দেশে এক্ষণে নানা বিশৃঙ্খলতা ঘটিয়াছে; এই সুযোগে আপনাদিগের অনেক ইষ্টসাধন করিতে পারা যাইবেক।

 এই সৈন্যের উপস্থিতিতে, ক্লাইব অত্যন্ত ব্যাকুল হইলেন। তৎকালে ওলন্দাজদিগের সহিত ইঙ্গরেজদিগের সন্ধি ছিল। এবং তাঁহাদিগের যত ইউরোপীয় সৈন্য থাকে, ইঙ্গরেজদিগের তাহার তৃতীয়াংশের অধিক ছিল না। যাহা হউক, তিনি স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ পরাক্রম ও অকুতোভয়তা সহকারে কার্য্য করিতে লাগিলেন।

  ক্লাইব, বাঙ্গালাতে ফরাসিদিগের প্রাধান্য লোপ করিয়া, মনে মনে নিশ্চয় করিয়াছিলেন ওলন্দাজদিগকেও প্রবল হইতে দিব না। অতএব তিনি মীরজাফরকে কহিলেন আপনি, ওলন্দাজী সৈন্য সকলকে প্রস্থান করিতে, অবিলম্বে আজ্ঞা প্রদান করুন। নবাব কহিলেন আমি স্বয়ং হুগলীতে গিয়া এ বিষয়ের শেষ করিব। কিন্তু, তথায় উপস্থিত হইয়া, তিনি ক্লাইবকে পত্র লিখিলেন, আমি ওলন্দাজদিগের সহিত বন্দোবস্ত করিয়াছি; প্রস্থানের উপযুক্ত কাল উপস্থিত হইলেই তাহাদিগের সমুদায় জাহাজ চলিয়া যাইবেক।

 ক্লাইব, এই চাতুরীর মর্ম্ম বুঝিতে পারিয়া, স্থির করিলেন ওলন্দাজী জাহাজ সকল আর অগ্রসর হইতে দেওয়া উচিত নহে। অতএব, কলিকাতার দক্ষিণবর্ত্তি টানা নামক স্থানে যে গড় ছিল তাহা দৃঢ়ীভূত করিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয় করিয়াছিলেন অগ্রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না। ওলন্দাজরা, দুর্গের নিকটবর্ত্তী হইয়া, অবিলম্বে আক্রমণ করিল, কিন্তু পরাস্ত হইল। অনন্তর তাহারা, কিঞ্চিৎ অপসৃত হইয়া, সাত শত ইউরোপীয়, ও আট শত মালাই, সৈন্য ভূমিতে অবতীর্ণ করিল। ঐ সকল সৈন্য, স্থলপথে, গঙ্গার পশ্চিম পার দিয়া, চুঁচুড়া অভিমুখে চলিল। ক্লাইব, তাহাদিগের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, চুঁচুড়া ও চন্দন নগরের মধ্য স্থানে অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত, পূর্ব্বেই কর্ণেল ফোর্ড সাহেবকে স্বল্প সৈন্য সহিত পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।

 ওলন্দাজী সৈন্য, ক্রমে অগ্রসর হইয়া, চুঁচুড়ার এক ক্রোশ দক্ষিণে ছাউনি করিল। কর্ণেল ফোর্ড অবগত ছিলেন উভয় জাতির পরস্পর সন্ধি আছে। অতএব, তাহাদিগকে সহসা আক্রমণ না করিয়া, স্পষ্ট অনুমতির নিমিত্ত, কলিকাতার কৌন্সিলে পত্র লিখিলেন। ক্লাইব তাস খেলিতেছেন এমত সময়ে ফোর্ড সাহেবের পত্র উপস্থিত হইল। তিনি খেলা হইতে না উঠিয়াই, পেনসিল দিয়া এই উত্তর লিখিলেন,প্রিয়তম! অবিলম্বে তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ কর, কল্য আমি কৌন্সিলের অনুমতি পাঠাইব। ফোর্ড, এই আদেশ প্রাপ্তিমাত্র, আক্রমণ করিয়া,আধ ঘণ্টার মধ্যেই ওলন্দাজদিগকে পরাজয় করিলেন। তাহাদিগের যে সকল জাহাজ নদী মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, ঐ সময়ে, তাহাও ইঙ্গরেজদিগের হস্তে পতিত হইল। এইরূপে ওলন্দাজদিগের এই মহোদ্যোগ পরিশেষে ধূমশেষ হইয়া গেল।

 এই যুদ্ধের অব্যবহিত পর ক্ষণেই, রাজকুমার মীরন ছয় সাত সহ অশ্বারোহ সৈন্যসহিত চুঁচুড়ায় উপস্থিত হইলেন। ওলন্দাজেরা জয়ী হইলে, তাহাদিগের সহিত যোগ দিতেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু এক্ষণে, অগত্যা ইঙ্গরেজদিগের সহিত মিলিত হইয়া, ওলন্দাজদিগকে আক্রমণ করিলেন। কর্ণেল ফোর্ড, যুদ্ধ সমাপ্তির অব্যবহিত পরেই, চুঁচুড়া অবরোধ করিলেন। ঐ নগর ত্বরায় ইঙ্গরেজদিগের হস্তগত হইত। কিন্তু, ওলন্দাজেরা সত্বর হইয়া ক্লাইবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাতে, তিনি উক্ত নগর অধিকার করিলেন না। অনন্তর, তাহারা যুদ্ধের সমুদায় ব্যয় ধরিয়া দিতে স্বীকার করাতে, ক্লাইব তাহাদিগের জাহাজ সকলও ছাড়িয়া দিলেন।

  ক্লাইব, ক্রমাগত তিন বৎসর গুরুতর পরিশ্রম করিয়া, শারীরিক অত্যন্ত অপটু হইয়াছিলেন। অতএব, এই সকল ঘটনার অবসানেই, ১৭৬০ খৃঃঅব্দের ফেব্রুয়ারিতে, ধনে মানে পরিপূর্ণ হইয়া, ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন। গবর্ণমেণ্টের ভার বান্সিটার্ট সাহেবের হস্তে সমর্পিত হইল।

 বাঙ্গালা দেশ যে একবারে নিরুপদ্রব হইবেক, তাহার কোন সম্ভাবনা ছিল না। বৃদ্ধ নবাব মীরজাফর নিজপুত্র মীরনের হস্তে রাজ্যশাসনের ভার সমৰ্পণ করিলেন। যুবরাজ রাজপুরুষদিগের সহিতু অত্যন্ত সাহঙ্কার ব্যবহার, ও প্রজাগণের উপরি অসহ্য অত্যাচার, আরম্ভ করাতে, সকলেই তাঁহার শাসনে অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। তিনি এরূপ নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতে লাগিলেন, যে সকলে সিরাজউদ্দৌলার কুক্রিয়া সকল বিস্মৃত হইয়া গেল।

 দিল্লীর সম্রাটের পুত্র শাহআলম, সর্ব্ব সাধারণের এই রূপ অসন্তোষ দর্শনে সাহসী হইয়া, দ্বিতীয় বার বিহার আক্রমণের উদ্যোগ করিলেন। পূর্ণিয়ার গবর্ণর, কাদিম হোসেন খাঁ, স্বীয় সৈন্য লইয়া তাঁহার সহিত যোগ দিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। শাহআলম, কর্ম্মনাশা পার হইয়া বিহারের সীমায় পাদার্পণ মাত্র, সংবাদ পাইলেন যে সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী, প্রসিদ্ধ ক্রূর, ইমাদউল্মুলুক, সম্রাটের প্রাণবধ করিয়াছে। এই ঘটনা হওয়াতে, শাহআলম ভারতবর্ষের সম্রাট হইলেন, এবং অযোধ্যার সুবাদারকে সাম্রাজ্যের অমাত্য পদে নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু তিনি নামমাত্র সম্রাট হইলেন; তাঁহার পরাক্রমও ছিল না, প্রজাও ছিল না; তৎকালে তাঁহার রাজধানী পর্য্যন্ত শত্রুদিগের হস্তগত ছিল; এবং তিনি নিজেও নিজরাজ্যে এক প্রকার পলাতক স্বরূপ ছিলেন।

 অনন্তর তিনি পাটনা অভিমুখে যাত্রা করিলে, পরাক্রান্ত রামনারায়ণ, ঐ নগর রক্ষার এক প্রকার উদ্যোগ করিয়া সাহায্য প্রাপ্তির নিমিত্ত, অতি নিয়ে মুরশিদাবাদে পত্র লিখিলেন। কর্ণেল কালিয়ড তৎকালে সৈন্যের অধ্যক্ষ ছিলেন; তিনি ইংলণ্ডীয় সৈন্য লইয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলেন; এবং মীরনও আপন সৈন্য সহিত তাঁহার অনুগামী হইলেন।  এই নরাধম ইতিপূর্ব্বে দুই জন নিজ কর্ম্মকারকের প্রাণদণ্ড করিয়াছিল, এবং স্বহস্তে দুই ভোগ্যা কামিনীর মস্তকচ্ছেদন করে। আলিবর্দ্দি খাঁর দুই কন্যা, ঘেসিতিবেগম ও আমানবেগম, আপন আপন স্বামী নিবাইশ মহমদ ও সায়দ অহমদের মৃত্যুর পর, গুপ্তভাবে ঢাকায় বাস করিতেছিলেন। মীরন, এই যুদ্ধ যাত্রাকালে, তাঁহাদের দুই জনের প্রাণবধ করিতে আজ্ঞা প্রেরণ করিলেন। ঢাকার গবর্ণর এই নিষ্ঠুর ব্যাপার সমাধানে অসম্মত হওয়াতে, পরিশেষে এক ভৃত্যকে এই আজ্ঞা দিয়া পাঠাইলেন যে তাহাদিগকে, মুরশিদাবাদ আনয়নচ্ছলে নৌকায় আরোহণ করাইয়া, পথের মধ্যে নৌকা সমেত জলমগ্ন করিবে।

 এই নির্দেশ প্রকৃতরূপেই প্রতিপালিত হইল। হত্যা কারিয়া, ডুবাইয়া দিবার নিমিত্ত, নৌকার ছিপী খুলিতে উপক্রম করিলে, কনিষ্ঠা ভগিনী করুণস্বরে কহিলেন হে সর্ব্বশক্তিমন্ জগদীশ্বর! আমরা উভয়েই পাপীয়সী ও অপরাধিনী বটি; কিন্তু মীরনের কখন কোন অপরাধ করি নাই; প্রত্যুত, আমরাই তাহার এই সমুদায় আধিপত্যের মূল।

 মীরন, প্রস্থান কালে, স্বীয় স্মরণপুস্তকে এই অতিপ্রায়ে তিন শত ব্যক্তির নাম লিখিয়াছিলেন, যে প্রত্যাগমন করিয়া ইহাদের প্রাণ দণ্ড করিব। কিন্তু আর তাঁহাকে প্রত্যাগমন করিতে হইল না।

 কর্ণেল কালিয়ড রামনারায়ণকে এই অনুরোধ করিয়াছিলেন, যাবৎ জামি উপস্থিত না হই, আপনি কোন ক্রমে সম্রাটের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন না। কিন্তু তিনি, এই উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়া, নগর হইতে বহির্গমন পূর্ব্বক, সম্রাটের সহিত যুদ্ধারম্ভ করিয়া সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইলেন। তখন পাটনা নিতান্ত অশরণ হইল। এক্ষণে সম্রাট এক উদ্যমেই ঐ নগর অধিকার করিতে পারিতেন; কিন্তু, অগ্রে তাহার চেষ্টা না করিয়া, দেশ লণ্ঠনেই সকল সময় নষ্ট করিলেন। ঐ সময় মধ্যে,কালিয়ড স্বীয় সমুদায় সৈন্য সহিত উপস্থিত হইলেন এবং অবিলম্বে শত্রুপক্ষ আক্রমণের প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু মীরন, ফেব্রুয়ারির দ্বাবিংশ দিবসের পূর্ব্বে গ্রহসকল অনুকুল নহেন এই বলিয়া, আপত্তি উত্থাপিত করাতে, প্রস্তাবিত আক্রমণ স্থগিত রহিল।

 ২০এ, সম্রাট আঁহাদের উভয়েরি সৈন্য এককালে আক্রমণ করিলেন। মীরনের পঞ্চদশ সহস্র অশ্বারোহ সহসা তঙ্গ দিয়া পলায়ন করিল। কিন্তু কর্ণেল কালিয়ড,দৃঢ়তা ও অকুতোভয়তা সহকারে সম্রাটের সৈন্য আক্রমণ করিয়া, অবিলম্বে পরাজিত করিলেন। শাহআলম, সেই রাত্রিতেই,শিবির ভঙ্গ করিয়া, রণক্ষেত্রের পাঁচ ক্রোশ অন্তরে গিয়া অবস্থিতি করিলেন। অনন্তর, তিনি স্বীয় সেনাপতির পরামর্শ অনুসারে, গিরিমার্গ দ্বারা অতর্কিত রূপে গমন করিয়া, সহসা মুরশিদাবাদ অধিকার করিবার আশয়ে প্রস্থান করিলেন।

 এই প্রয়াণ অতিত্বরাপূর্ব্বক সম্পাদিত হইল। কিন্তু মীরনও সন্ধান পাইয়া, দ্রুতগতি পোত দ্বারা, আপন পিতার নিকট এই সম্ভাবিত বিপদের সংবাদ প্রেরণ . করিলেন। অল্পকাল পরেই,সম্রাট, মুরশিদাবাদের পঞ্চ-' দশ ক্রোশ দূরে, পর্ব্বত হইতে অবতীর্ণ হইলেন; কিন্তু সত্বর আক্রমণ না করিয়া, জনপদ মধ্যে অনর্থক কালহরণ করিতে লাগিলেন। এই অবকাশে কর্ণেল কালিয়ভও আসিয়া পহুছিলেন। উভয় সৈন্য পরস্পর দৃষ্টিগোচর স্থানে শিবির সন্নিবেশন করিল। ইঙ্গরেজেরা যুদ্ধ দানে উদ্যত হইলেন। কিন্তু সম্রাট, সহসা অসম্ভব ত্রাসযুক্ত হইয়া পাটনা প্রত্যাগমন পূর্ব্বক, ঐ নগর দৃঢ় রূপে অবরোধ করিলেন। ঐ সময়ে, পূর্ণিয়ার গবীর কাদিমহোসেন খাঁও,তাঁহার সাহায্য করিবার নিমিত্ত,স্বীয় সৈন্য সহিত যাত্রা করিলেন।

 সম্রাট ক্রমাগত নয় দিবস পাটনা আক্রমণ করিলেন। ইহা নিশ্চিত বোধ হইয়াছিল, উক্তনগর অবশ্যই তাঁহার হস্তগত হইবেক। কিন্তু কাপ্তেন নক্ল অত্যল্প সৈন্য সহিত সহসা পাটনায় উপস্থিত হওয়াতে সে আশঙ্কা দূর হইল। তিনি, কর্ণেল কালিয়ড কতৃক প্রেরিত হইয়া, বর্দ্ধমান হইতে এয়োদশ দিবসে তথায় উপস্থিত হন। তিনি, সেই দিবস রাত্রিতে বিপক্ষের শিবির পরীক্ষা করিয়া, পর দিন, তাহাদিগের মধ্যাহ্নকালীন নিদ্রার সময়, আক্রমণ করিলেন। সম্রাটের সেনা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইল। তখন তিনি, আপন শিবিরে অগ্নিপ্রদান করিয়া, পলায়ন করিলেন।

 দুই এক দিন পরে, কাদিমহোসেন খাঁ, ঘোড়শ সহস্র সৈন্য সমভিব্যাহারে হাজীপুরে পহুছিয়া, পাটনা আক্রমণের উপক্রম করিলেন। কিন্তু কাপ্তেন নক্ল, সহস্রের অবধিক সৈন্য মাত্র সহিত গঙ্গা পার হইয়া, তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন। উক্ত জয়লাভকে অসা-ধারণ সাহসের কার্য্য বলিতে হইবেক। এই জয়লাভ দেখিয়া এদেশীয় লোকেরা ইঙ্গরেজদিগকে মহাপ-রাক্রান্ত নিশ্চয় করিলেন। এই যুদ্ধে রাজা সিতাব রায় এমত অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শন করেন যে তদ্দর্শনে ইঙ্গরেজের। তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন।

 পরাজয়ের পর, পূর্ণিয়ার গবর্ণর, সম্রাটের সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত, প্রস্থান করিলেন। কর্ণেল কালি-য়ড ও মীরন উভয়ে একত্র হইয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। বর্ষা আরম্ভ হইল; তথাপি তাঁহারা তাঁহার অনুসরণে বিরত হইলেন না। ১৭৬০ খৃঃ অব্দের ২রা জুলাই রজনীতে অতিশয় দুর্যোগ হয়। মীরন আপন পটমণ্ডপে উপবিষ্ট হইয়া গল্প শুনিতেছিলেন। দৈবাৎ ঐ সময়ে বিদ্যুৎপাত দ্বারা তাঁহার ও তাঁহার দুই জন পরিচারকের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হইল। কর্ণেল কালিয়ড, এই দুর্ঘটনাপ্রযুক্ত, উক্ত কাদিমহোসেনের অনুসরণে বিরত হইলেন, এবং, পাটনা প্রত্যাগমন পুর্ব্বক, বর্ষার অনু-রোধে, তথায় শিবির সন্নিবেশন করিলেন।

 মীরন অত্যন্ত দুরাচার, কিন্তু নিজ পিতার রাজত্বের প্রধান অবলম্বন স্বরূপ, ছিলেন। তৎকালের মুসলমান ইতিহাস লেখক কহেন নির্বোধ ইন্দ্রিয়পরায়ণ বৃদ্ধ নবা-বের পূর্ব্বে যে কিছু বুদ্ধি বা বিবেচনা ছিল, এক্ষণে তাহা একবারেই লোপ পাইল। অতঃপর রাজকার্যে অত্যন্ত গোলযোগ ঘটিতে লাগিল। সেনাগণ পূর্ব্বতন বেতন নিমিত্ত রাজভবন অবরোধ করিয়া বিসম্বাদে উদ্যত হইল। তখন নবাবের জামাতা মীরকাসিম তাহাদের পুরোবর্ত্তী হইয়া কহিলেন আমি অঙ্গীকার করিতেছি, স্বধন দ্বারা তোমাদিগকে সন্তুষ্ট করিব। এই বলিয়া তিনি তাহাদিগকে আপাততঃ ক্ষান্ত করিলেন।

 নবাব মীরকাসিমকে,দৌত্যকার্য্যে নিযুক্ত করিয়া, কলিকাতায় পাঠাইয়াছিলেন। তথায় বান্সিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেবের নিকটে তাঁহার বিশেষ রূপে বুদ্ধি ও ক্ষমতা প্রকাশ হয়। তৎকালে এই দুই সাহেবের মতেই কোম্পানির এতদ্দেশীয় সমুদায় বিষয় কর্ম্ম নির্ব্বাহ হইত। দ্বিতীয় বার দূত প্রেরণ আবশ্যক হওয়াতে, মীরকাসিম পুনর্ব্বার প্রেরিত হয়েন। এইরূপে দুই বার মীরকাসিমের বুদ্ধি ও ক্ষমতা দেখিয়া, গবর্ণর সাহেবের অন্তঃকরণে এই দৃঢ় প্রত্যয় জমে যে কেবল এই ব্যক্তিই অধুনা বাঙ্গালার রাজকীয় কার্য্য নির্ব্বাহে সমর্থ। তদনুসারে তিনি মীরকাসিমকে তিন প্রদেশের ডেপুটী নাজিমী পদ প্রদানের প্রস্তাব করিলেন। মীরকাসিম সম্মত হইলেন। অনন্তর বান্সিটার্ট ও হেষ্টিংস উভয়ে,এক দল সৈন্য সহিত মুরশিদাবাদ গমন করিয়া, মীরজাফরের নিকট ঐ প্রস্তাব করিলে, তিনি তদ্বিষয়ে অত্যন্ত অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন, এরূপ হইলে সমুদায় ক্ষমতাই অবিলম্বে জামাতার হস্তে যাইবেক; আমি কেবল আপন সভামণ্ডপে পুত্তলিকা প্রায় হইব।

 বান্সিটার্ট সাহেব নবাবের অনিচ্ছা দেখিয়া দোলায়মানচিত্ত হইলেন। তখন মীরকাসিম এই বলিয়া ভয় দেখাইলেন, তবে আমি সম্রাটের পক্ষে যাইব। কারণ তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন যে এত কাণ্ড করিয়া আমি কখনই মুরশিদাবাদে নিরাপদে থাকিতে পারিব না। তখন বানসিটার্ট সাহেব, দৃঢ়তা সহকারে কার্য্য করা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, ইংলণ্ডীয় সৈন্যদিগকে রাজভবন অধিকার করিতে আদেশ দিলেন। তদ্দর্শনে শঙ্কিত হইয়া মীরজাফর অগত্যা সম্মত হইলেন।

 অনন্তর মুরশিদাবাদ ও কলিকাতা এই উভয়ের অন্যতর স্থানে বৃদ্ধ নবাবকে এক বাসস্থান দিবার প্রস্তাব হইল। তাহাতে তিনি বিবেচনা করিলেন যদি আমি মুরশিদাবাদে থাকি, তাহা হইলে, যেখানে এতকাল আধিপত্য করিলাম, তথায় কেবল সাক্ষিগোপাল হইয়া থাকিতে হইবেক; এবং নিজ জামাতৃকৃত পরিভব সহ করিতে হইবেক। অতএব আমার কলিকাতা যাওয়াই শ্রেয়। তিনি এক সামান্য নর্ত্তকীকে আপন প্রণয়িনী করিয়া ছিলেন এবং তাহারি আজ্ঞাকারী ছিলেন। ঐ কামিনী পরে মণিবেগম নামে সবিশেষ প্রসিদ্ধ হন। মুসলমান পুরাবৃত্ত লেখক কহেন, ঐ রমণী ও মীরজাফর, প্রস্থানের পূর্ব্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ পূর্ব্বক, পূর্ব্ব পূর্ব্ব নবদিগের সঞ্চিত অতুল্য রত্ন সকল হস্তগত করিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করিলেন।