বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


অরাজকতা

 শৈলবংশীয় নরপতি কর্ত্তৃক পৌণ্ড্রদেশ বিজয়—কামরূপের হর্ষদেব কর্ত্তৃক গৌড় বিজয়—কান্যকুব্জরাজ যশোবর্ম্মার মগধবিজয়—ললিতাদিত্য ও যশোবর্ম্মা—গৌড়েশ্বর বধের উপাখ্যান—জয়াপীড়—জয়ন্ত—জয়ন্তের ঐতিহাসিকতা—আদিশূর ও জয়ন্ত—কুলশাস্ত্রের প্রমাণ—গুর্জ্জরজাতি—প্রাচীন সাহিত্য ও খোদিতলিপিতে গুর্জ্জরজাতির উল্লেখ—গুর্জ্জর ও প্রতীহারের একত্ব—ভিল্লমালের গুর্জ্জরপ্রতীহার বংশ—বৎসরাজ—রাষ্ট্রকূটরাজবংশ—দন্তিদুর্গ—ধ্রুবধারাবর্ষ—উত্তরাপথ বিজয়—বৎসরাজের পরাজয়—ইন্দ্রায়ুধ ও চক্রায়ুধ—ধ্রুবধারাবর্ষের দ্বিগ্বিজয়—গৌড়বঙ্গে অরাজকতা—রাজা নির্ব্বাচন।


 খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে ও অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভে মগধের গুপ্তবংশীয় রাজগণের অধঃপতনের সময়ে উত্তরাপথের পূর্ব্বভাগ বার বার ভারতের ভিন্ন ভিন্ন দেশের রাজগণ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া অতিশয় দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়াছিল। মধ্যপ্রদেশে রঘোলিগ্রামে আবিষ্কৃত শৈলবংশোদ্ভব দ্বিতীয় জয়বর্দ্ধন নামক নরপতির তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, দ্বিতীয় জয়বর্দ্ধনের পিতামহের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পৌণ্ড্রদেশের নরপতিকে নিহত করিয়া সমস্ত পৌণ্ড্রদেশ অধিকার করিয়াছিলেন[১]। এই তাম্রশাসনের অক্ষর দেখিয়া অনুমান হয় যে, ইহা খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ পাদে উৎকীর্ণ হইয়াছিল। অতএব অনুমান হয় যে, অষ্টম শতাব্দীর তৃতীয় বা চতুর্থ পাদে, পৌণ্ড্ররাজ শৈলবংশীয় দ্বিতীয় জয়বর্দ্ধনের জ্যেষ্ঠ পিতামহ কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন যে শৈলবংশ ও কোঙ্গোদের শৈলোদ্ভববংশ অভিন্ন, কিন্তু শব্দগত সাদৃশ্য ব্যতীত এই অনুমানের পক্ষে অন্য কোনও প্রমাণ নাই। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে কামরূপরাজ হর্ষদেব গৌড়, ওড্র, কলিঙ্গ ও কোশলদেশের অধিপতি ছিলেন। নেপালের লিচ্ছবীবংশীয় নরপতি শিবদেব, সম্রাট আদিত্যসেনের দৌহিত্রী ও মৌখরিরাজ ভোগবর্ম্মার দুহিতা বৎসদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। শিবদেব ও বৎসদেবীর পুত্র জয়দেব ভগদত্তবংশজাত কামরূপরাজ শ্রীহর্ষদেবের কন্যা রাজ্যমতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। নেপালে পশুপতিনাথ মন্দিরের পশ্চিম তোরণের পার্শ্বে সংলগ্ন জয়দেবের খোদিতলিপি হইতে অবগত হওয়া যায়, যে ১৫৬ শ্রীহর্ষাব্দে (৭৫৯ খৃষ্টাব্দে) এই খোদিতলিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল। এই খোদিতলিপি হইতে জয়দেবের বংশপরিচয় ও তাঁহার শ্বশুর বংশের বিবরণ জানিতে পার যায়। জয়দেবের খোদিতলিপিতে, হর্ষদেব গৌড়, ওড্র, কলিঙ্গ ও কোশলপতি উপাধিতে ভূষিত হইয়াছিলেন; অতএব ৭৫৯ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে গৌড়দেশে হর্ষদেব কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল[২]। হর্ষদেব কামরূপরাজ বলিয়া খোদিতলিপিতে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত নাই, তবে তাঁহার কন্যা রাজ্যমতীর “ভগদত্তরাজকুলজা” উপাধি দেখিয়া বোধ হয় যে, হর্ষদেব কামরূপাধিপতি ছিলেন। গৌড়দেশ হর্ষদেব কর্ত্তৃক বিজিত হইয়াছিল, অথবা তাঁহার পূর্ব্বেই জিত হইয়াছিল, তাহা নির্ণয় করিবার কোন উপায় নাই। অনুমান হয় যে, খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর প্রথম পাদে গৌড়, ওড্র, কলিঙ্গ ও কোশল কামরূপ-রাজগণের হস্তগত হইয়াছিল। এই সময়ে কান্যকুব্জরাজ যশোবর্ম্মা সমগ্র উত্তরাপথ অধিকার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহার সভাকবি বাকপতিরাজ বিরচিত “গউডবহো” নামক প্রাকৃতভাষায় রচিত কাব্যে যশোবর্ম্মার দিগ্বিজয়-কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে[৩]। “গউডবহো” কাব্যে দেখিতে পাওয়া যায় যে, যশোবর্ম্মা যখন বিন্ধ্যপর্ব্বত অতিক্রম করিতেছিলেন, তখন তাঁহার ভয়ে মগধনাথ যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিয়াছিলেন, কিন্তু মগধনাথের সামন্তগণ পলায়ন করিতে সম্মত হন নাই। তাঁহারা যশোবর্ম্মার সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন। যুদ্ধান্তে যশোবর্ম্মা পলায়নপর মগধনাথকে নিহত করিয়া সমুদ্রতীরস্থিত বঙ্গরাজ্যে গমন করিয়াছিলেন। অসংখ্য হস্তীর অধিপতি বঙ্গেশ্বর পরাজিত হইয়া যশোবর্ম্মার অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। যশোবর্ম্মা যে মগধেশ্বর ও বঙ্গেশ্বরকে পরাজিত করিয়াছিলেন “গউডবহো” কাব্যে তাঁহাদিগের নাম পাওয়া যায় না। যশোবর্ম্মাদেব কর্ত্তৃক পরাজিত মগধনাথ ও গুপ্তবংশীয় রাজা দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত একই ব্যক্তি[৪]। এই সময়ে বঙ্গদেশ যে কোন্ রাজার অধিকারভুক্ত ছিল, তাহা অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই। যশোবর্ম্মা নামধারী কান্যকুব্জের যে একজন প্রবল পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। ৭৩১ খৃষ্টাব্দে যশোবর্ম্মা চীন-সম্রাটের নিকট এক দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন, চীন দেশের ইতিহাসে ইহা উল্লিখিত হইয়াছে। ফরাসী দেশীয় পণ্ডিত শাবান (Edouard Chavannes) ও লেভি (Sylvain Levi) স্থির করিয়াছেন যে, যশোবর্ম্মা ৭৩৪ হইতে ৭৪৭ খৃষ্টার পর্য্যন্ত সময়ের মধ্যে চীন দেশে দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন[৫]। কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় যশোবর্ম্মাকে পরাজিত করিয়া অবশেষে তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়াছিলেন[৬]। যশোবর্ম্মা মগধদেশে যশোবর্ম্মপুর নামক একটি নগর স্থাপন করিয়াছিলেন; পালবংশীয় সম্রাট্ দেবপালদেবের খোদিতলিপিতে যশোবর্ম্মপুরের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়[৭]। যশোবর্ম্মা পরাজিত হইলে, গৌড়মগুলের অধিপতি, ললিতাদিত্যকে কতকগুলি হস্তী উপহার দিয়া তাঁহার সন্তোষবিধান করিয়াছিলেন। তাঁহার পরে কাশ্মীর-রাজের আদেশে গৌড়পতিকে বোধ হয় কাশ্মীরে যাইতে হইয়াছিল। ললিতাদিত্য স্বনির্ম্মিত পরিহাসপুর (বর্ত্তমান পরসপোর) নামক নগরে[৮] প্রতিষ্ঠিত “পরিহাসকেশব” নামক দেবতাকে মধ্যস্থ রাখিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, তিনি তাঁহার অতিথির অঙ্গে হস্তক্ষেপ করিবেন না। কিন্তু ললিতাদিত্য ত্রিগ্রামী নামক স্থানে অতিথি হত্যা করিয়া স্বপ্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছিলেন। গৌড়পতির ভৃত্যগণ প্রতিশোধ লইবার জন্য সারদাদেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রার ছলে কাশ্মীরদেশে প্রবেশ করিয়া “পরিহাসকেশবের” মন্দির অবরোধ করিয়াছিল। ললিতাদিত্য তখন কাশ্মীরে ছিলেন না। রাজার অনুপস্থিতিকালে গৌড়গণকে মন্দির-প্রবেশে উদ্যত দেখিয়া মন্দিরের পুরোহিতগণ দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন, গৌড়বাসিগণ তখন রজত-নির্ম্মিত রামস্বামীর মূর্ত্তিকে পরিহাসকেশবের মূর্ত্তিভ্রমে চূর্ণ করিতেছিল। ইতিমধ্যে শ্রীনগর হইতে সৈন্য আসিয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করিল, কিন্তু গৌড়ীয় বীরগণ সেদিকে দৃক্‌পাত না করিয়া মূর্ত্তিধ্বংসে ব্যাপৃত রহিল এবং একে একে সকলেই নিহত হইল। কহ্লনের সময়েও (খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে) রামস্বামীর মন্দির শূন্য ছিল এবং কাশ্মীরদেশ গৌড়বীরগণের যশে পরিপূর্ণ ছিল। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ, কহ্ললনমিশ্র কর্ত্তৃক লিপিবদ্ধ গৌড়ীয়গণের বীরত্বকাহিনী অমূলক মনে করেন না, এবং বলেন যে প্রচলিত জনশ্রুতি অবলম্বনেই কহ্লন এই বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া থাকিবেন।[৯]। কিন্তু কহ্ললন কর্ত্তৃক লিপিবদ্ধ ললিতাদিত্যের দক্ষিণাপথ বিজয়কাহিনী কিঞ্চিৎ পরিমাণে কল্পনাপ্রসূত বলিয়া মনে করিতে তিনি কোন দ্বিধাবোধ করেন নাই[১০]। একই গ্রন্থকার কর্ত্তৃক লিখিত, একই গ্রন্থে একই বিষয়ে, অন্য প্রমাণাভাবে এক অংশ অমূলক ও দ্বিতীয় অংশ সত্যরূপে গ্রহণ করা ইতিহাস-রচনার বিজ্ঞান-সম্মত প্রণালী নহে। রাজতরঙ্গিণীর অনুবাদকর্ত্তা সার অরেল ষ্টাইন (Sir Aural Stein), ললিতাদিত্য কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ বিজয় ব্যতীত, কহ্লন-বর্ণিত অন্য কোন ঘটনা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নহেন[১১]; এবং ইহাই বোধ হয় প্রকৃত ইতিহাস।

 কহ্লনমিশ্র ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড় কর্ততৃক কান্যকুব্জরাজ বজ্রায়ুধের পরাজয়-কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। জয়াপীড় বা বিনয়াদিত্য সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই বৃহৎ সেনাদল লইয়া দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি কাশ্মীর পরিত্যাগ করিবামাত্র তাঁহার শ্যালক জজ্জ বলপূর্ব্বক সিংহাসন অধিকার করেন। জয়াপীড়ের সৈন্যগণ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করে এবং অবশেষে তিনি সামন্তরাজগণকে বিদায় দিয়া, সামান্য সেনা লইয়া প্রয়াগে গমন করেন। কথিত আছে যে, জয়াপীড় প্রয়াগ হইতে ছদ্মবেশে পৌণ্ড্রবর্দ্ধন নগরে গমন করিয়াছিলেন। পৌণ্ড্রবর্দ্ধন তখন গৌড়রাজের অধিকারভুক্ত এবং জয়ন্ত নামক সামন্তরাজের শাসনাধীন ছিল। জয়াপীড়, পৌণ্ড্রবর্দ্ধন নগরে কমল নাম্নী এক নর্ত্তকীর গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং একটি সিংহ বধ করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। পৌণ্ড্রবর্দ্ধনরাজ জয়ন্ত তাঁহার কন্যা কল্যাণীদেবীকে জয়াপীড়ের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলেন। জয়াপীড় পাঁচজন গৌড়দেশীয় নরপতিকে পরাজিত করিয়া, জয়ন্তকে গৌড়দেশে সার্ব্বভৌম নরপতিপদে উন্নীত করিয়াছিলেন। অদ্যাবধি কোন সমসাময়িক লিপিতে, অথবা গ্রন্থে গৌড়েশ্বর জয়ন্তের নাম আবিষ্কৃত হয় নাই; সুতরাং কহ্লনমিশ্র-বর্ণিত জয়াপীড় কাহিনীর মূলে ঐতিহাসিক সত্য আছে বলিয়া বোধ হয় না। সুপ্রসিদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিৎ সার্ অরেল ষ্টাইন্ (Sir Aurel Stein) জয়াপীড়ের গৌড়বিজয় কাহিনী ইতিহাসমূলক বলিয়া স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহেন। তাঁহার মতে জয়াপীড় রাজ্যচ্যুত হইয়া গৌড়দেশে গিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার গৌড়বিজয়-কাহিনী বাল্পনিক[১২]। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ভিন্সেণ্ট স্মিথ (Vincent A. Smith) বলেন যে, জয়াপীড়ের গৌড়দেশ-গমনের কথা সম্পূর্ণরূপে কল্পনাপ্রসূত[১৩]। গৌড়রাজমালা-প্রণেতা কহ্লনের উক্তি বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহেন[১৪]। কেবল শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু ও ৺ব্যোমকেশ মুস্তফী জয়াপীড় ও জয়ন্তের কাহিনী ঐতিহাসিক ঘটনারূপে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ৺ব্যোমকেশ মুস্তফী মহাশয় বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদে “আদিশূর ও জয়ন্ত” নামক একটি প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন[১৫]। ইহাতে তিনি গৌড়াধিপ আদিশূর ও গৌড়রাজ জয়ন্তের একত্ব প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই প্রবন্ধটি কোন পত্রিকায় অথবা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নাই। মুস্তফী মহাশয় জানাইয়াছিলেন যে, ইহা “বিশ্বকোষের” জন্য লিখিত হইয়াছিল। ১৩০৫ বঙ্গাব্দে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু বলিয়াছিলেন:—

 “কুলাচার্য্য গ্রন্থে আদিশূর ‘পঞ্চগৌড়াধিপ’ এই মহোচ্চ উপাধিতে বিভূষিত হইয়াছেন। ধর্ম্মপালের পরে এখানে জয়ন্ত ব্যতীত আর কোনও হিন্দু রাজাকে ঐরূপ উচ্চ সম্মানে অলঙ্কৃত দেখি না। ইত্যাদি কারণে সহজেই বোধ হইতেছে, গৌড়াধিপ জয়ন্ত জামাতা কর্ত্তৃক পঞ্চগৌড়ের অধীশ্বর হইলে ‘আদিশূর’ উপাধি গ্রহণ করেন।”[১৬]

 মহারাজ আদিশূর বঙ্গদেশে কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চজন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ আনয়ন করিয়াছিলেন এবং এই পঞ্চ ব্রাহ্মণ ৬৫৪ শকাব্দে বঙ্গদেশে আগমন করিয়াছিলেন; কুলশাস্ত্রে এই প্রমাণের বলে মহারাজ আদিশূরকে ধর্ম্মপালের পূর্ব্ববর্ত্তী লোক মনে করিয়া বসুজ মহাশয় পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন। বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসের অন্য এক স্থানে বসুজ মহাশয় আদিশূর ও জয়ন্তের একত্ব সম্বন্ধে কুলশাস্ত্রোদ্ধৃত একটি প্রমাণের উল্লেখ করিয়াছেন। ব্রাহ্মণডাঙ্গা নিবাসী ৺বংশী বিদ্যারত্ন ঘটকের সংগৃহীত কুলপঞ্জিকায় তিনি নিম্নলিখিত শ্লোকটি আবিষ্কার করিয়াছিলেন:—

ভূশূরেণ চ রাজ্ঞাপি শ্রীজয়ন্তসুতেন চ।
নাম্নাপি দেশভেদৈস্তু রাঢ়ী-বারেন্দ্র-সাতশতী।

এই শ্লোকের টীকায় বসুজ মহাশয় লিখিয়াছেন:—

 “আদিশূর সুতেন চ—এইরূপ পাঠান্তর লক্ষিত হয়।”[১৭]

 ৺বংশী বিদ্যারত্ন কর্ত্তৃক সংগৃহীত কুলপঞ্জিকায় প্রাপ্ত পূর্ব্বোক্ত শ্লোক এবং তাহার পাঠান্তর অবলম্বন করিয়া বসুজ মহাশয় ও বঙ্গভাষার অন্যান্য বহু লেখক, আদিশূর ও জয়ন্ত একই ব্যক্তি ছিলেন, ইহা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। “গৌড়রাজমালা”য় শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ আদিশূর ও জয়ন্তের একত্ব সম্বন্ধে সর্ব্বপ্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন:—

 “জয়ন্ত ঐতিহাসিক ব্যক্তি হইলে ১১০০ বৎসর পূর্ব্বে জীবিত ছিলেন। আর ৺বংশীবিদ্যারত্ন ঘটক ঊনবিংশ শতাব্দীর লোক। বংশীবিদ্যারত্ন কোন্ মূল গ্রন্থ হইতে এই তথ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সেই মূলগ্রন্থ কোন্ সময়ে রচিত হইয়াছিল, এবং উহার ঐতিহাসিক মূল্যই বা কত, ইত্যাদি বিষয়ের সম্যক বিচার না করিয়া, এতবড় একটা কথা স্বীকার করা যায় না[১৮]।”

 শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দের উক্তির প্রত্যুত্তর স্বরূপ বসুজ মহাশয় অন্য একস্থানে লিখিয়াছেন:—

 “রাটীয় কুলপঞ্জিকা হইতে একটি বিশেষ কথা জানিতে পারি, শ্রীজয়ন্তপুত্র রাজা ভূশূর বিভিন্ন স্থানের নামানুসারে রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র ও সাতশতী এই শ্রেণী বিভাগ করিয়াছিলেন[১৯]।”

 “ব্রাহ্মণডাঙ্গা নিবাসী বংশীবদন বিদ্যারত্ন ঘটক মহাশয় সংগৃহীত বহু সংখ্যক কুলগ্রন্থের কথা রাঢ়ীয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ঘটক ও কুলীন ব্রাহ্মণ মাত্রেই অবগত আছেন। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ ২৮ বর্ষ পূর্ব্বে ‘গৌড়ে ব্রাহ্মণ’ রচয়িতা ৺মহিমচন্দ্র মজুমদার মহাশয় উক্ত বিদ্যারত্ন মহাশয়ের বহু কুলগ্রন্থের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার গ্রন্থে বিদ্যারত্ন মহাশয়ের নাম পাইয়াই আজ পঞ্চদশ বর্ষের অধিক হইল আমরা ব্রাহ্মণডাঙ্গায় উক্ত ঘটক মহাশয়ের গৃহে উপস্থিত হইয়াছিলাম। তৎকালে তাঁহার বৃদ্ধাকন্যা আমাদিগকে তাঁহার সংগৃহীত কুলগ্রন্থ দেখিতে দিয়াছিলেন,—এরূপ বহুসংখ্যক কুলগ্রন্থ আমি আর কোথাও দেখি নাই। বৃদ্ধা যক্ষের ধনের ন্যায় সেগুলি রক্ষা করিতেছিলেন, মূল গ্রন্থগুলি কুলগ্রন্থগুলি গৃহের বাহির করিবার কাহারও শক্তি ছিল না। বহুকষ্টে কয়েকখানি কুলগ্রন্থ স্বহস্তে নকল করিয়া আনিয়াছি। মূল গ্রন্থগুলি সেই গৃহেই রক্ষিত আছে। তন্মধ্যে ‘রাঢ়ীয় কুলমঞ্জরী’ নামক প্রায় দুইশত বর্ষের হস্তলিখিত পুঁথিতে শ্রেণীবিভাগ প্রসঙ্গে বর্ণিত হইয়াছে:—

“ভূশূরেণ চ রাজ্ঞাপি শ্রীজয়ন্তসুতেন চ।
নাম্নাপি দেশভেদৈস্তু রাঢ়ী-বারেন্দ্র-সাতশতী॥”

 এতদ্ভিন্ন উক্ত ঘটক মহাশয়ের সংগৃহীত ‘রাঢ়ীয় কুলপঞ্জী’ নামক একখানি পুঁথিতে ‘ভূশূরেণ চ রাজ্ঞাপি আদিশূর সুতেন চ’ এইরূপ পাঠ দেখিয়াছি, ইহাই পাঠান্তর বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি।”[২০]

 বসুজ মহাশয়ের পূর্ব্বোল্লিখিত উক্তি হইতে প্রমাণিত হইতেছে যে, ৺বংশীবদন বিদ্যারত্ন ঘটক সংগৃহীত “রাঢ়ীয় কুলমঞ্জরী” নামক গ্রন্থে জয়ন্তের সহিত শূরবংশের সম্বন্ধজ্ঞাপক শ্লোকটি বসুজ মহাশয় দেখিতে পাইয়াছিলেন। শ্লোকের দ্বিতীয় চরণের পাঠান্তর ৺বংশী বিদ্যারত্নের গৃহে “রাঢ়ীয় কুলপঞ্জী” নামক অপর একখানি কুলগ্রন্থে আবিষ্কৃত হইয়াছিল।

 সম্প্রতি বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির সহকারী পুস্তক-রক্ষক শ্রীযুক্ত পুরন্দর কাব্যতীর্থ মহাশয়, অনুসন্ধান-সমিতির কর্ত্তৃপক্ষগণের আদেশে ব্রাহ্মণডাঙ্গায় গমন করিয়াছিলেন। তিনি ৺বংশীবদন বিদ্যারত্নের পৌত্র শ্রীযুক্ত মণিমোহন ঘটকের সাহায্যে, বিদ্যারত্ন ঘটকের গৃহে তিন “বাণ্ডিল” কুলশাস্ত্রগ্রন্থ পরীক্ষা করিয়াছেন। বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির সম্পাদক কর্ত্তৃক লিপিবদ্ধ মন্তব্য পাঠ করিলে বোধ হয় যে, কাব্যতীর্থ মহাশয় ৺বংশীবদন বিদ্যারত্নের গৃহে “রাঢ়ীয় কুলমঞ্জরী” নামক কোন গ্রন্থ দেখিতে পান নাই। তিনি ঐস্থানে মিশ্রকৃত “রাঢ়ীয় কুলপঞ্জী” নামক কুলগ্রন্থ দেখিতে পাইয়াছিলেন। এই গ্রন্থখানির পত্রসংখ্যা ৪৩০, ইহা জীর্ণ ও কীটদষ্ট; তদ্ভিন্ন কোনও ঐতিহাসিক কথা এই গ্রন্থে নাই[২১] শ্রীযুক্ত পুরন্দর কাব্যতীর্থ মহাশয় বিদ্যারত্ন ঘটকের গৃহে ধ্রুবানন্দ মিশ্র প্রণীত দুইখানি “মহাবংশাবলী” দেখিতে পাইয়াছিলেন। ইহার একখানি গ্রন্থের মধ্যে “কুলদোষ” নামক একখানি নূতন কুল গ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ অনুমান করেন যে, এই “কুলদোষ” গ্রন্থই শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রণীত “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস” ব্রাহ্মণকাণ্ডে বংশী বিদ্যারত্ন সংগৃহীত “কুলপঞ্জিকা” বা “কুলকারিকা,” এবং রাজন্যকাণ্ডে “রাঢ়ীয় কুলমঞ্জরী” নামে অভিহিত; কারণ:—

 (১) “ব্রাহ্মণকাণ্ডের” ১১৭ পৃষ্ঠার পাদটীকায় বিদ্যারত্ন সংগৃহীত কুলপঞ্জিকা হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে—

ক্ষিতিশূরেণ রাজ্ঞাপি ভূশূরস্য সুতেন চ।
ক্রিয়ন্তে গাঞিসংজ্ঞানি তেষাং স্থানবিনির্ণয়াৎ॥

 “কুলদোষ” গ্রন্থের ২খ পত্রে এই বচন, বানান ভুল ছাড়িয়া দিলে, অবিকল দৃষ্ট হয়।

 (২) এই গ্রন্থে বসু মহাশয়ের উল্লিখিত সপ্তশতী ২৮ গাঞিরও নাম প্রদত্ত হইয়াছে।

 (৩) “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস” ব্রাহ্মণকাণ্ডে নিম্নলিখিত শ্লোকদ্বয় ১৮৬ পৃষ্ঠার পাদটীকায় উদ্ধৃত হইয়াছে:—

কামরূপে মহাপীঠে সর্ব্বসিদ্ধি প্রদায়কে।
তত্রগত্বা প্রযত্নেন দেবীবর বিশারদঃ॥
দ্বিখবেদেন্দুশাকে চ মেষে মার্ত্তণ্ডমাগতে।
ক্রিয়তে বাক্যসিদ্ধির্বা রাঢ়ী দ্বিজ কুলোপরি॥

এই শ্লোকদ্বয় “কুলদোষ” গ্রন্থে ৩ (খ) পৃষ্ঠায় দেখিতে পাওয়া যায়।

 (৪) ব্রাহ্মণকাণ্ডে ১৮৭ পৃষ্ঠায় তৃতীয় পাদটীকায় উদ্ধৃত ধ্রুবানন্দ মিশ্রের সময়জ্ঞাপক শ্লোকটিও “কুলদোষের” ৩ (খ) পৃষ্ঠায় দেখিতে পাওয়া যায়।

 (৫) বসুজ মহাশয় “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস” রাজন্যকাণ্ডে শূরবংশের সপ্ত নরপতির নাম-সম্বলিত যে শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহাও “কুলদোষে”র তৃতীয় পৃষ্ঠায় দেখিতে পাওয়া যায়।

 “কুলদোষ” গ্রন্থে আদিশূরের কালজ্ঞাপক ও বঙ্গে সাগ্নিক ব্রাহ্মণ-আগমনের কালজ্ঞাপক শ্লোকটি দেখিতে পাওয়া যায় না। এই শ্লোকের পরিবর্ত্তে ২ (ক) পৃষ্ঠায় নিম্নলিখিত শ্লোকটি দেখিতে পাওয়া যায়:—

ক্ষত্রিয় বংশে সমুৎপন্নো মাধবো কুলসম্ভবঃ।
বসু ধর্ম্মাষ্টকে শাকে নৃপ (বো) ভু (ভূ) চ্চাদিশূরকঃ[২২]

 যখন ৺বংশীবিদ্যারত্ন ঘটকের গৃহে “কুলমঞ্জরী” নামক গ্রন্থ খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই, তখন ইহার অস্তিত্ব সম্বন্ধে অনেকেরই সন্দেহ হইতে পারে এবং এই গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত বচন প্রমাণরূপে গ্রাহ্য হইতে পারে না। বিদ্যারত্ন ঘটকের গৃহে “কুলপঞ্জী” নামক একখানি গ্রন্থ আছে, কিন্তু তাহাতে “আদিশূর সুতেন চ” এই পাঠান্তর অথবা কোন ঐতিহাসিক কথা নাই। “কুলদোষ” নামক নূতন গ্রন্থে অনেক ঐতিহাসিক কথা আছে, কিন্তু তাহাতে আদিশূর ও জয়ন্তের কোনই প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায় না। অতএব আদিশূর ও জয়ন্ত যে অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন, ইহার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে না। বসুজ মহাশয় “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস” রাজন্যকাণ্ডে কর্কোট-বংশের অভ্যুদয়কাল হইতে কাশ্মীরের প্রকৃত ইতিহাস আরম্ভ, এই সম্বন্ধে (ডাক্তার) ভিন্সেণ্ট, এ, স্মিথ (Vincent A. Simth) ও সার অরেল ষ্টাইনের (Sir Aurel Stein) মত উল্লেখ করিয়া জয়াপীড়ের কাহিনীকে ঐতিহাসিক ঘটনারূপে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন[২৩]। কিন্তু কর্কোট-বংশের অভ্যুদয়কাল হইতে কাশ্মীরের প্রকৃত ইতিহাস আরম্ভ হইয়াছে, ইহা স্বীকার করিলেও সার অরেল ষ্টাইন্ ও ভিন্সেণ্ট স্মিথ যে, জয়াপীড় কাহিনী স্পষ্টাক্ষরে কাল্পনিক বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন, তাহা পূর্ব্বে দর্শিত হইয়াছে। খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর পূর্ব্বে গৌড়ে, মগধে বা বঙ্গে শূরবংশীয় রাজগণের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনই বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস” রাজন্যকাণ্ডে শূরবংশীয় কতকগুলি রাজার নাম সংগ্রহ করিয়াছেন। তাঁহার মতে ইঁহারা খৃষ্টীয় অষ্টম হইতে একাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন। যথাস্থানে এই সকল উক্তির ঐতিহাসিক প্রমাণ আলোচিত হইবে।

 খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সমগ্র পঞ্চনদ ও রাজপুতানা গুর্জ্জর নামক পরাক্রান্ত জাতির অধিকারভুক্ত হইয়াছিল। পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, হূণ জাতির ভারত-আক্রমণের অব্যবহিত পরে গুর্জ্জরগণ মধ্য-এশিয়া হইতে ভারতের উত্তর-পশ্চিমসীমান্তের পার্ব্বত্যপথে আর্য্যাবর্ত্তে প্রবেশ করিয়াছিলেন, এবং তাঁহারা হূণগণের ন্যায় মধ্য-এশিয়ার মরুবাসী যাযাবর জাতি বিশেষ[২৪]। বাণভট্ট-প্রণীত “হর্ষচরিতে” সর্ব্বপ্রথমে গুর্জ্জর জাতির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, হর্ষবর্দ্ধনের পিতা প্রভাকরবর্দ্ধন বা প্রতাপশীল, হূণহরিণের কেশরী, সিন্ধুরাজের জ্বর, গুর্জ্জরগণের নিদ্রাহর, গান্ধার রাজরূপী গন্ধহস্তীর কূটপাকল (সংক্রামক ব্যাধি বিশেষ), লাটদেশীয় দস্যুগণের দস্যু এবং মালব-বিজয়লক্ষ্মীর পরশু ছিলেন[২৫] হর্ষবর্দ্ধনের প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণাপথরাজ চালুক্যবংশীয় দ্বিতীয় পুলকেশীর একখানি শিলালিপি বোম্বাই প্রদেশে বিজাপুর জেলায়, ঐহোলী গ্রামে মেগুটি নামক মন্দিরে আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই শিলালিপিতে উক্ত আছে যে, পুলকেশীর বিক্রমে বশীভূত হইয়া লাট, মালব ও গুর্জ্জরগণ সচ্চরিত্র হইয়াছিল[২৬]। ৬৪১ বা ৬৪২ খৃষ্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক ইউয়ান্-চোয়াং তৎকালের গুর্জ্জর-রাজ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। কু-চে-লো বা গুর্জ্জর-রাজ্য বলভীরাজ্যের উত্তরে চারি শত ক্রোশ দূরে অবস্থিত এবং ইহার পরিধি সহস্র ক্রোশের অধিক। ইহার রাজধানীর নাম পি-লো-মো-লো বা ভিল্লমাল এবং এই দেশের রাজা ক্ষত্রিয়জাতীয়[২৭]। ভিল্লমাল বা ভিন্‌মাল রাজপুতানার আবু পর্ব্বতের পঞ্চবিংশ ক্রোশ উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত[২৮]। মান্যখেতের রাষ্ট্রকূটবংশীয় রাজগণের খোদিত লিপিসমূহে গুর্জ্জরগণের সহিত বহু যুদ্ধের উল্লেখ আছে। খৃষ্টীয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে উত্তরাপথের শিলালিপিসমূহে প্রতীহার নামধেয় পরাক্রান্ত রাজবংশের বহু উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। পরলোকগত A. M. T. Jackson ও শ্রীযুক্ত দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর সর্ব্বপ্রথমে প্রমাণ করেন যে, রাষ্ট্রকূটরাজগণের শিলালিপিসমূহের গুর্জ্জর নর-নারীগণ ও উত্তরাপথের প্রতীহার-বংশীয় রাজগণ অভিন্ন[২৯]। প্রতীহার-বংশীয় রাজগণের শিলালিপি ও তাম্রশাসনসমূহ হইতে প্রমাণ হইয়াছে যে, তাঁহারা ভিল্লমাল হইতে ধীরে ধীরে সমস্ত উত্তরাপথে অধিকার বিস্তার করিয়াছিলেন। খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীতে গুর্জ্জর-রাজধানী ভিল্লমাল হইতে কান্যকুব্জে স্থানান্তরিত হইয়াছিল। এক সময়ে গুর্জ্জরসাম্রাজ্য পূর্ব্বে গৌড় দেশ হইতে পশ্চিমে সিন্ধুতীর পর্য্যন্ত এবং উত্তরে হিমালয় হইতে দক্ষিণে নর্ম্মদাতীর পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। গুর্জ্জরবংশীয় প্রতীহার-রাজগণ, মান্যখেতের রাষ্ট্রকূটরাজগণ, গৌড়-বঙ্গের পালরাজগণ, মহোবার চন্দেল্লরাজগণ ও কান্যকুব্জ-রাজগণের সহিত বহু সন্ধি-বিগ্রহে লিপ্ত হইয়াছিলেন। প্রতীহার-বংশের একখানি খোদিতলিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, প্রতীহারগণ গুর্জ্জর জাতির একটি শাখা। এই শিলালিপি রাজপুতানার আলোয়ার রাজ্যে অবস্থিত রাজোর বা রাজোরগড়ের দক্ষিণস্থিত পারনগরের ধ্বংসাবশেষমধ্যে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এই শিলালিপির দ্বারা প্রতীহার-বংশীয় বিজয়পালদেবের মথনদেব নামক জনৈক সামন্ত একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[৩০]

 খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে গুজরাটে বর্ত্তমান ভরোচের (প্রাচীন ভৃগুকচ্ছ বা ভরুকচ্ছ) নিকটে একটি ক্ষুদ্র গুর্জ্জর-রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। নন্দোর (বর্ত্তমান নন্দোড্, ইহা রাজপিপলা-রাজ্যের রাজধানী) এই রাজ্যের রাজধানী ছিল। ভরোচের গুর্জ্জর-বংশীয় রাজগণ তাঁহাদিগের খোদিত লিপিসমূহে রাজোপাধি ব্যবহার করেন নাই। ৺পণ্ডিত ভগবান্‌লাল ইন্দ্রজী যখন ভরোচের গুর্জ্জর-বংশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, তখনও উত্তরাপথের গুর্জ্জর-প্রতীহার সাম্রাজ্যের ইতিহাস উদ্ধার হয় নাই। সেইজন্যই ভগবান্‌লাল ভরোচের গুর্জ্জর-রাজগণের স্বামিনির্ণয় করিতে পারেন নাই[৩১]। ভিল্লমাল ও কান্যকুব্জের গুর্জ্জর-প্রতীহার-সাম্রাজ্যের লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার হইলে নির্ণীত হইয়াছে যে, ভরোচের গুর্জ্জর-রাজগণ প্রতীহার-বংশীয় সম্রাট্‌গণের সামন্ত বা করদ নৃপতি ছিলেন। ভরোচের গুর্জ্জর-বংশের প্রথম রাজা প্রথম দদ্দ খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষপাদে এবং ষষ্ঠ নরপতি তৃতীয় জয়ভট খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে বিদ্যমান ছিলেন। ভিল্লমাল ও কান্যকুব্জের রাজবংশের আদিম নরপতিগণের নাম অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, ভিল্লমালের প্রথম নাগভট ভরোচের তৃতীয় জয়ভটের স্বামী। গোয়ালিয়র বা গোপাদ্রির গিরিশীর্ষে একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষমধ্যে আবিষ্কৃত প্রতীহারবংশীয় সম্রাট্ প্রথম ভোজদেবের একখানি শিলালিপি হইতে প্রথম নাগভটের পরিচয় অবগত হওয়া যায়। এই খোদিত লিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, নাগভট সূর্য্যবংশীয় ক্ষত্রিয় এবং প্রতীহারকুলজাত[৩২]। তিনি কোন সময়ে ম্লেচ্ছবাহিনী পরাজিত করিয়াছিলেন[৩৩]। ৭১২ খৃষ্টাব্দে মহম্মদ-বিন্-কাশিমের নেতৃত্বে মোয়াবিয়ার বংশজাত খলিফা অল্-ওয়ালিদের আদেশে মুসলমানগণ সর্ব্বপ্রথমে ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। সিন্ধুরাজ ডাহির পরাজিত ও নিহত হইলে সিন্ধুদেশ মহম্মদ-বিন্-কাশিম কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল[৩৪]। প্রথম নাগভট বোধ হয়, মুসলমানগণকে পরাজিত করিয়া গুর্জ্জরচক্রের স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছিলেন। নাগভটের পরে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র ককুস্থ বা কক্কুক সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। ককুস্থ বা কক্কুক সম্বন্ধে কোন কথাই অদ্যাবধি জানিতে পারা যায় নাই এবং তাঁহার পিতার নাম পর্য্যন্ত অজ্ঞাত রহিয়াছে। ককুস্থের পরে তাঁহার ভ্রাতা দেবরাজ বা দেবশক্তি ভিল্লমালের সিংহাসনারোহণ করিয়াছিলেন। দেবশক্তি সম্বন্ধে এই মাত্র জানিতে পারা গিয়াছে যে, তিনি বিষ্ণুভক্ত (পরম বৈষ্ণব) ছিলেন এবং তাঁহার পত্নীর নাম ভূয়িকাদেবী। দেবশক্তির পুত্র বৎসরাজ তাঁহার পরে ভিল্লমাল-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। বৎসরাজই গুর্জ্জর-প্রতীহার-রাজগণের মধ্যে উত্তরাপথ-আক্রমণে অগ্রণী হইয়াছিলেন। হর্ষবর্দ্ধনের মৃত্যুর পরে বোধ হয়, তাঁহার মাতুল-পুত্র ভণ্ডির বংশ কান্যকুব্জের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন। বৎসরাজ বলপূর্ব্বক ভণ্ডির বংশধরগণের নিকট হইতে সাম্রাজ্য অপহরণ করিয়াছিলেন[৩৫]। ভণ্ডি-বংশজাত কোন কান্যকুব্জরাজের নাম অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বৎসরাজ ৭০৫ শকাব্দে (অর্থাৎ ৭৮৩ খৃঃ অঃ) জীবিত ছিলেন। জৈন হরিবংশ পুরাণে দেখিতে পাওয়া যায় যে, ৭০৫ শকাব্দে ইন্দ্রায়ুধ উত্তরদিক, কৃষ্ণের পুত্র শ্রীবল্লভ দক্ষিণদিক, অবন্তীরাজ পূর্ব্বদিক এবং বৎসরাজ পশ্চিমদিক শাসন করিতেছিলেন এবং এই সময়ে বীর জয়বরাহ সৌর্য্যদিগের রাজত্বের অধিকারী ছিলেন[৩৬]। কান্যকুব্জ জয় করিয়াই বৎসরাজ ক্ষান্ত হন নাই। তিনি ভিল্লমাল হইতে আর্য্যাবর্ত্তের পূর্ব্বপ্রান্তে আসিয়া অনায়াসে গৌড়দেশ জয় করিয়া শরদিন্দুধবল গৌড়ীয় রাজচ্ছত্রদ্বয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। গুর্জ্জর-রাজের গৌড়-বিজয় অধিক কাল স্থায়ী হয় নাই। মান্যখেতের রাষ্ট্রকূটবংশজ ধ্রুবধারাবর্ষ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া তাঁহাকে অবিলম্বে মরুভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। ভিল্লমাল বা কান্যকুব্জের গুর্জ্জর প্রতীহারবংশ, গৌড়ের পালরাজবংশ এবং মান্যক্ষেতের রাষ্ট্রকূট-বংশ খৃষ্টীয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে উত্তরাপথের রঙ্গমঞ্চে রাষ্ট্রীয় নাট্যের প্রধান নায়ক এবং ইঁহাদিগের ইতিহাসই ভারতবর্ষের ইতিহাস।

 স্বর্গীয় পণ্ডিত ভগবান্‌লাল ইন্দ্রজী অনুমান করিয়াছিলেন যে, রাষ্ট্রকূটগণ দাক্ষিণাত্যবাসী অনার্য্য জাতি। তাঁহার মতানুসারে এই জাতির প্রাচীন নাম ‘রট্ট’। বহু খোদিত লিপিতে রট্টগণের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। বর্ত্তমান সময়ে দাক্ষিণাত্যে রট্টগণ ‘রেড্ডি’ নামে পরিচিত। চারণগণের কাব্যে কান্যকুব্জ ও মাড়ওয়ারের রাঠোরগণের ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়। রাঠোরগণের বংশাবলীতে তাঁহাদিগকে রামচন্দ্রের পুত্র কুশের বংশধররূপে বর্ণিত করা হইয়াছে। কিন্তু সূর্য্যবংশের চারণগণ রাঠোরগণকে হিরণ্যকশিপুর বংশধর বলিয়া থাকে[৩৭]। বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিৎ সার রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকরের মতানুসারে রাষ্ট্রকূটগণ রট্ট উপাধিধারী ক্ষত্রিয়-বংশজাত। ইঁহারাই মহারাষ্ট্রের প্রাচীন অধিবাসী এবং ইঁহাদিগের নামানুসারে মহারাষ্ট্রদেশের নামকরণ হইয়াছে। মৌর্য্যবংশীয় সম্রাট্ অশোকের সময়েও রট্ট বা রাষ্ট্রকূটগণ মহারাষ্ট্র দেশের অধিবাসী ছিল। রাষ্ট্রকূট-রাজগণের তাম্রশাসনসমূহে তাঁহারা আপনাদিগকে যদুবংশজাত বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন[৩৮]। দাক্ষিণাত্যে ইলুরা পর্ব্বত-গুহায় দশাবতার-মূর্ত্তির নিম্নে মান্যখেতের রাষ্ট্রকূট-রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দন্তিবর্ম্মার নাম পাওয়া গিয়াছে। ইনি সম্ভবতঃ খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে বিদ্যমান ছিলেন[৩৯]। ইহার পূর্ব্বেও দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূটগণের অধিকার ছিল; কারণ, চালুক্যরাজ প্রথম জয়সিংহ কৃষ্ণের পুত্র ইন্দ্র নামক অষ্টশত হস্তীর অধিপতি রাষ্ট্রকূটরাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৩৯]। মান্যখেতের রাষ্ট্রকূট-রাজবংশের অভ্যুদয়কাল নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তাঁহারা চালুক্যবংশীয় তৈলপ্প কর্ত্তৃক ৯৭২ খৃষ্টাব্দে রাজ্যচ্যুত হইয়াছিলেন[৪০]। দন্তিবর্ম্মার পৌত্র প্রথম গোবিন্দের পুত্রের নাম প্রথম কর্ক। তাঁহার পৌত্র দন্তিদুর্গ বা দ্বিতীয় দন্তিবর্ম্মা বাদামী বা বাতাপীপুরের চালুক্য-রাজগণকে পরাজিত করিয়া দক্ষিণাপথে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বোম্বাই প্রদেশে সমনগড় নামক স্থানে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, উত্তরাপথেশ্বর শ্রীহর্ষকে যে কর্ণাটদেশীয় সেনা পরাজিত করিয়াছিল, দন্তিদুর্গ বা দন্তিবর্ম্মা তাহাদিগকে পরাজিত করেন[৪১]। দন্তিদুর্গ অপুত্রক অবস্থায় পরলোকগমন করিলে, তাঁহার খুল্লতাত প্রথম কৃষ্ণ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। ইনি ৭০৫ শকাব্দে (৭৮৩ খৃষ্টাব্দে) দক্ষিণাপথ-রাজরূপে জৈন হরিবংশ পুরাণে উল্লিখিত হইয়াছেন। অতএব ৭৮৩ খৃষ্টাব্দে গুর্জ্জর-প্রতীহার-বংশীয় বৎসরাজ, কান্যকুব্জরাজ ইন্দ্রায়ুধ ও রাষ্ট্রকূটরাজ প্রথম কৃষ্ণ জীবিত ছিলেন। বৎসরাজ প্রথম কৃষ্ণের মৃত্যুর পরেও জীবিত ছিলেন; কারণ, তিনি কান্যকুব্জ এবং গৌড়-বঙ্গ অধিকার করিলে, প্রথম কৃষ্ণের দ্বিতীয় পুত্র ধ্রুবধারাবর্ষ তাঁহাকে পরাজিত করিয়া দুর্গম মরুভূমিতে পলায়ন করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। ধ্রুবধারাবর্ষের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ প্রভূতবর্ষের বহু তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তাঁহার পিতা ধ্রুবধারাবর্ষ অনায়াস-স্বীকৃতা গৌড়রাজ-লক্ষ্মীর অধিকারে উন্মত্ত বৎসরাজকে দুর্গম মরুপ্রদেশের কেন্দ্রে পলায়ন করিতে বাধ্য করিয়া তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার দিগন্তবিস্তৃত যশঃ ও গৌড়ীয় শরদিন্দুপাদধবল রাজচ্ছত্রদ্বয় হরণ করিয়াছিলেন[৪২]। বৎসরাজ বোধ হয়, গৌড় ও বঙ্গ, এই উভয় প্রদেশই অধিকার করিয়াছিলেন এবং প্রত্যেক প্রদেশের রাজচ্ছত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন। বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ কর্ত্তৃক পরাজিত হইলে, গোবিন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র কর্ক গুর্জ্জর-রাষ্ট্রের দ্বারে অর্গলস্বরূপ হইয়া তাঁহাকে তাঁহার অধিকারমধ্যে আবদ্ধ রাখিয়াছিলেন। বরোদায় আবিষ্কৃত কর্করাজের তাম্রশাসনে কথিত আছে যে, গুর্জ্জরপতি গৌড়-বঙ্গেশ্বরকে পরাজিত করিয়া মালবরাজকে আক্রমণ করিলে, তাঁহার স্বামীর (অর্থাৎ তৃতীয় গোবিন্দের) আদেশানুসারে কর্করাজ গুর্জ্জরেশ্বরকে তাঁহার স্বীয় অধিকারের সীমামধ্যে অবস্থান করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। এইস্থানে গৌড় ও বঙ্গের একত্র উল্লেখ দেখিয়া অনুমান হয় যে, বৎসরাজ কর্ত্তৃক জিত শ্বেতচ্ছত্রদ্বয়ের একটি গৌড়ের রাজচ্ছত্র, অপরটি বঙ্গদেশের[৪৩]

 বৎসরাজ খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষপাদে বিদ্যমান ছিলেন। ৭৮৩ খৃষ্টাব্দে রাষ্ট্রকূটরাজ কৃষ্ণরাজ জীবিত ছিলেন, সুতরাং তাঁহার পুত্র ধ্রুবধারাবর্ষ তখনও সিংহাসনে আরোহণ করেন নাই। অতএব ৭৮৩ খৃষ্টাব্দের পরে কোন সময়ে উত্তরাপথ-বিজেতা মহারাজ বৎসরাজ রাষ্ট্রকূটগণের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া মরুদেশে পলায়ন করিয়াছিলেন। বৎসরাজ কর্ত্তৃক ভণ্ডির-বংশের অধিকার লোপ এবং কান্যকুব্জ অধিকার, ধ্রুব কর্ত্তৃক তাঁহার পরাজয়ের পূর্ব্বে ঘটিয়াছিল। ধ্রুব ৭০৫ হইতে ৭১৬ শকাব্দের (৭৮৩-৭৯৪ খৃষ্টাব্দ) মধ্যে রাষ্ট্রকূট-সিংহাসনের অধিকার পাইয়াছিলেন। ৭৮৩ খৃষ্টাব্দে ইন্দ্রায়ুধ উত্তরদিকের (সম্ভবতঃ কান্যকুব্জের) রাজা ছিলেন। ইন্দ্রায়ুধ গুর্জ্জর-প্রতীহার-রাজগণের অনুগ্রহ-ভিখারী ছিলেন এবং গৌড়েশ্বর ধর্ম্মপালদেব কর্তৃক তিনি রাজ্যচ্যুত হইলে, বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট তাঁহার স্বপক্ষে ধর্ম্মপালের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিয়াছিলেন। পরে যথাস্থানে ধর্ম্মপালদেবের সহিত দ্বিতীয় নাগভটের যুদ্ধের বিবরণের মধ্যে ইন্দ্রায়ুধের পরিচয় প্রদত্ত হইবে। গুর্জ্জর-প্রতীহার-বংশের অনুগৃহীত ইন্দ্রায়ুধ যখন ৭৮৩ খৃষ্টাব্দে কান্যকুব্জের সিংহাসনে আসীন ছিলেন, তখন বৎসরাজ কর্ত্তৃক ভণ্ডির-বংশের অধিকার লোপ নিশ্চয়ই ঐ সময়ের পূর্ব্বে ঘটিয়াছিল। এই প্রমাণের উপরে নির্ভর করিয়া বলা যাইতে পারে যে, বৎসরাজ কর্ত্তৃক ৭৮৩ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে গৌড়বঙ্গ বিজিত হইয়াছিল। প্রথম কৃষ্ণরাজের দ্বিতীয় পুত্র রাষ্ট্রকূট-বংশীয় প্রথম সম্রাট্ ধ্রুবধারাবর্ষ ৭০৫ শকাব্দ হইতে ৭১৬ শকাব্দের মধ্যে কিয়ৎকাল মান্যখেতের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। অতএব এই একাদশ বর্ষের মধ্যে গুর্জ্জররাজ বৎসরাজ তৎকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। ধ্রুবধারাবর্ষের রাজ্যকাল হইতে রাষ্ট্রকূট-সাম্রাজ্যের উন্নতির সময় আরব্ধ হইয়াছিল। তিনি তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় গোবিন্দকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া রাষ্ট্রকূট-রাজ্যের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন[৪৪]। তিনি দক্ষিণাপথে গঙ্গবংশীয় রাজগণকে পরাজিত করিয়া কাঞ্চী নগরের অধিপতি পল্লব-বংশীয় রাজাকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৪৫]। কথিত আছে যে, ধ্রুব কোশল দেশের রাজচ্ছত্র অধিকার করিয়াছিলেন[৪৬]। দেউলি গ্রামে আবিষ্কৃত তৃতীয় কৃষ্ণের তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, ধ্রুবধারাবর্ষের তিনটি শ্বেতচ্ছত্র ছিল[৪৭]। ধ্রুবধারাবর্ষ বৎসরাজকে পরাজিত করিয়া, মরুভূমিতে পলায়ন করিতে বাধ্য করিয়া, স্বয়ং অধিক দিন উত্তরাপথে অবস্থান করেন নাই। তিনি বোধ হয়, দিগ্বিজয় শেষ করিয়া রাজধানী মান্যখেতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিলেন এবং উত্তরাপথের নরপতিগণ পুনর্ব্বার স্বাধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

 বিদেশীয় রাজগণ কর্ত্তৃক বারংবার আক্রান্ত হইয়া গৌড়ীয় প্রজাবৃন্দ অতিশয় বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। এতদ্ব্যতীত মগধের গুপ্তবংশীয় দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের মৃত্যুর পরে কোন রাজা বোধ হয়, গৌড়-মগধ-বঙ্গে স্বীয় অধিকার দৃঢ়ভিত্তির উপরে স্থাপন করিতে পারেন নাই এবং ক্ষুদ্র ক্ষুত্র ভূস্বামিগণ সতত যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকিতেন। ফলে, খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে উত্তরাপথের প্রাচ্যখণ্ডে ঘোরতর অরাজকতা উপস্থিত হইয়াছিল। অরাজকতার প্রাচীন নাম “মাৎস্যন্যায়।” খালিমপুরে আবিষ্কৃত ধর্ম্মপালদেবের তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া বায় যে, প্রকৃতিপুঞ্জ মাৎস্যন্যায় দূর করিবার জন্য বপ্যট নামক রণকুশল ব্যক্তির পুত্র গোপালদেবকে রাজা নির্ব্বাচিত করিয়াছিল। গোপালদেব পালবংশের প্রথম রাজা এবং তাঁহার রাজ্যকাল হইতেই গৌড়, মগধ ও বঙ্গের পাল-সাম্রাজ্যের ইতিহাস আরদ্ধ হইয়াছে।


পরিশিষ্ট (ঙ)

কুলশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণ

 গত তিন বৎসর যাবৎ ‘প্রবাসী’ ‘মানসী’ প্রভৃতি মাসিকপত্রে “আদিশূর ও কুলশাস্ত্র” “ভোজবর্ম্মার তাম্রশাসন” “দনুজমর্দ্দনদেব ও মহেন্দ্রদেব,” “কুলশাস্ত্রের ঐতিহাসিকতার দৃষ্টান্ত” প্রভৃতি প্রবন্ধে বঙ্গদেশীয় কুলশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণের অসারতা প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিয়াছি। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ বহুদিন যাবৎ বাঙ্গালাদেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতির কুলশাস্ত্র-সমূহ সংগ্রহ করিয়া তাহা হইতে ঐতিহাসিক প্রমাণ সঙ্কলন করিয়া আসিতেছেন এবং সুধীগণের নিকটে সেই সকল প্রমাণ ধ্রুবসত্যরূপে গৃহীত হইয়া আসিয়াছে। গত তিন বৎসরের মধ্যে দুইখানি তাম্রশাসন এবং কতকগুলি প্রাচীন মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় কুলশাস্ত্র-সমূহের ঐতিহাসিক প্রমাণের অসারতা প্রতিপন্ন হইয়াছে। নিম্নলিখিত তাম্রশাসন ও প্রাচীন মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় কুলশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণের সত্যতা সম্বন্ধে আমার সন্দেহ জন্মে:—

 (১) দনুজমর্দ্দনদেব ও মহেন্দ্রদেবের রজত মুদ্রা। মালদহে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলনের চতুর্থ অধিবেশনে স্বর্গগত রাধেশচন্দ্র শেঠ দুইটি রজত মুদ্রা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এই মুদ্রা দুইটি পাণ্ডুয়ার আঙ্গিনা মসজিদের উত্তর-পূর্ব্বাংশে ন্যূনাধিক দুই ক্রোশ মধ্যে জনৈক সাঁওতাল-কৃষক কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত হইয়াছিল। সেই কৃষক তাহা পুরাতন মালদহের জনৈক দোকানদারের নিকট বিক্রয় করিয়াছিল। মালহের “গৌড়দূত” নামক সাপ্তাহিক পত্রের কার্য্যাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত কৃষ্ণচন্দ্র আগরওয়ালা মুদ্রা দুইটি দোকানদারের নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়া ৺রাধেশচন্দ্র শেঠকে প্রদান করিয়াছিলেন। শেঠ মহাশয় রঙ্গপুর সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় এই দুইটি মুদ্রার বিবরণ প্রকাশ করিয়াছিলেন (রঙ্গপুর সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৫ম ভাগ, পৃঃ ৭০-৭৪)। এই মুদ্রাদ্বয় পাণ্ডুনগর নামক স্থানে মুদ্রাঙ্কিত ও প্রথম মুদ্রাটি শ্রীমহেন্দ্রদেবের এবং দ্বিতীয় মুদ্রাটি দনুজমর্দ্দনদেবের নামাঙ্কিত। ইতিপূর্ব্বে দনুজমর্দ্দন বা মহেন্দ্রদেবের কোন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় নাই। উভয় মুদ্রাতেই শকাব্দের তারিখ ছিল, কিন্তু মুদ্রাদ্বয়ের পার্শ্ব কাটিয়া যাওয়ায় রাজদ্বয়ের কালনির্ণয় হয় নাই।

 কিছুকাল পূর্ব্বে খুলনা জেলার বাসুদেবপুর গ্রামনিবাসী জনৈক মুসলমান কবরখননকালে একটি রজতমুদ্রা আবিষ্কার করিয়াছিল। সে ঐ মুদ্রাটি উক্ত গ্রামনিবাসী শ্রীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়কে দিয়াছিল। খুলনা দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় এই মুদ্রাটি সংগ্রহ করিয়া আনিয়া আমাকে দেখাইয়াছিলেন। এই মুদ্রাটি দনুজমর্দ্দনদেবের এবং ইহা ১৩৩৯ শকাব্দে মুদ্রিত হইয়াছিল। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মিত্র ও আমি মুদ্রার পাঠোদ্ধার করিয়া উহা চন্দ্রদ্বীপে মুদ্রাঙ্কিত স্থির করিয়াছিলাম, কিন্তু সম্প্রতি পূর্ব্ববঙ্গে দনুজমর্দ্দনদেবের বহু রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় সেই মতের পরিবর্ত্তনের আবশ্যক হইয়াছে। বাসুদেবপুরে দনুজমর্দ্দনদেবের মুদ্রা আবিষ্কৃত হইলে আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, বাসুদেবপুরের মুদ্রা ও পাণ্ডুয়ার নিকটে আবিষ্কৃত মুদ্রা একই রাজার এবং দনুজমর্দ্দনদেবের প্রকৃত তারিখ ১৩৩৯ শকাব্দ অর্থাৎ ১৪১৭ খৃষ্টাব্দ। বাসুদেবপুরের মুদ্রার সহিত ৺রাধেশচন্দ্র শেঠ কর্ত্তৃক প্রদর্শিত পাণ্ডুয়ায় আবিষ্কৃত দনুজমর্দ্দনদেবের মুদ্রার চিত্রের তুলনা করিয়া অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্র এবং আমি স্থির করিয়াছিলাম যে, পাণ্ডুনগর ও চন্দ্রদ্বীপ উভয় টাঁকশালের মুদ্রাই দনুজমর্দ্দনদেব কর্ত্তৃক ১৩৩৯ শকাব্দে মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল। দনুজমর্দ্দনদেবের প্রকৃত কাল নির্ণীত হইলে চন্দ্রদ্বীপের কায়স্থ রাজবংশের ইতিহাসের কিছু পরিবর্ত্তন আবশ্যক হইয়াছিল। ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু এসিয়াটীক্ সোসাইটীর পত্রিকায় বাঙ্গালার সেন রাজবংশ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছিলেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলিয়াছেন যে, কেশবসেনের পরে সদাসেন নামক একজন রাজা অষ্টাদশ বর্ষকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং সদাসেনের পরে নৌজা নামক একজন রাজা সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন, এই কথা আবুল-ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায়। হরিমিশ্র ঘটক-প্রণীত কারিকায় দনোজামাধব নামক জনৈক পরাক্রান্ত রাজার নাম দেখিতে পাওয়া যায়। এই দনোজামাধবই যে আইন-ই-আকবরীতে নৌজা নামে উল্লিখিত হইয়াছেন, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। এড়ুমিশ্র, হরিমিশ্র, ধ্রুবানন্দ মিশ্র, মহেশ্বর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ কুলশাস্ত্রকারগণের কারিকাসমূহে এবং ইদিলপুরের পাশ্চাত্য বৈদিক কুলাচার্য্যগণের গ্রন্থসমূহে দেখিতে পাওয়া যায় যে, দনোজামাধব বঙ্গজ কায়স্থ ও ব্রাহ্মণগণের কৌলীন্যপ্রথা সংস্কার করিয়াছিলেন। এই সকল কুলাচার্য্যগণের কোন কোন গ্রন্থে দনোজামাধবদেবের নাম কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তিত হইয়া দনুজমাধবদেব অথবা দনুজমর্দ্দনদেব আকার ধারণ করিয়াছে।

 “Some of these Karikas give the name of Danouja-Madhava-Deva slightly altered, such as Danuja-Madhava-Deva, Danuja-Marddana-Deva.”—Chronology of the Sena Kings of Bengal,—Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1896. Pt. I, p. 32.

 কোন কোন কুলগ্রন্থে দনৌজামাধব দনুজমর্দ্দনরূপে উল্লিখিত হইয়াছেন বলিয়া শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু লক্ষ্মণসেনের পৌত্র দনৌজামাধব ও চন্দ্রদ্বীপ-রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা অভিন্ন সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন। মালদহ জেলায় ও খুলনা জেলায় দনুজমর্দ্দনদেবের রজতমুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রমাণ হইল যে, দনৌজামাধব ও দনুজমির্দ্দন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি; কারণ, দনৌজামাধব ১২৮০ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট্ গিয়াসুদ্দিন বল্‌বনের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন (Elliot’s Muhammadan Historians of India, Vol. III, p. 116)। যিনি ১২৮০ খৃষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন, তিনি কখনই ১৪১৭ খৃষ্টাব্দে জীবিত থাকিতে পারেন না। দনুজমর্দ্দনদেবের মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রমাণ হইয়াছে যে, এড়ুমিশ্র, হরিমিশ্র, ধ্রুবানন্দ ও মহেশ্বর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ কুলশাস্ত্রকারগণের কারিকাগুলি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসযোগ্য নহে, কারণ, তাঁহারা দনৌজমাধবের পরিবর্ত্তে দনুজমর্দ্দনের নাম কোন কোন স্থানে ব্যবহার করিয়াছেন।

 দনুজমর্দ্দন ও মহেন্দ্রদেবের মুদ্রা-আবিষ্কারবার্ত্তা প্রচারিত হইবার অল্পদিন পরে মৈমনসিংহ জেলার পুড্যা গ্রামে বটুভট্ট-রচিত একখানি প্রাচীন কুলগ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে।

 গ্রন্থখানি খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে লিখিত, কিন্তু ইহার অক্ষর দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর ন্যায়। অক্ষর দেখিয়া সন্দেহ উপস্থিত হওয়ায় এবং মহেন্দ্রদেবের মুদ্রা আবিষ্কারের অব্যবহিত পরে উক্ত গ্রন্থের বিবরণ প্রকাশিত হওয়ায় আমার সন্দেহ হইয়াছিল যে, উক্ত কুলগ্রন্থ অকৃত্রিম নহে। উক্ত গ্রন্থের স্বত্বাধিকারী, মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দ্বারা মূল পুথি পরীক্ষা করাইয়াছিলেন। শাস্ত্রী মহাশয় আজীবন প্রাচীন সংস্কৃত পুথি সংগ্রহ ও পাঠোদ্ধার করিতেছেন এবং এই বিষয়ে তাঁহার মত পৃথিবীর সর্ব্বত্র আদৃত ও সম্মানিত হইয়া থাকে। তিনি যখন মূল পুথি পরীক্ষা করিয়া উহা অকৃত্রিম বলিয়াছেন, তখন তৎসম্বন্ধে আমার কোন কথাই বলা উচিত নহে। কিন্তু মূল গ্রন্থ অকৃত্রিম হইলেও গত তিন বৎসর মধ্যে আবিষ্কৃত কতকগুলি প্রাচীন মুদ্রার দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে যে, বটুভট্টের “দেববংশ” নামক কুলগ্রন্থের ঐতিহাসিক অংশ বিশ্বাসযোগ্য নহে। দনুজমর্দ্দন ও মহেন্দ্রদেবের রজতমুদ্রা আবিষ্কারের পরে “দেববংশের” বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু “দেববংশ” অবলম্বন করিয়া তাঁহার “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসের” রাঢ়ের দেববংশের বে বিবরণ সঙ্কলন করিয়াছেন, তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়, “দনুজারিদেবের সহিত গৌড়াধিপ লক্ষ্মণসেনের সৌহৃদ্য ও সম্পর্ক ছিল। যখন লক্ষ্মণসেন মুসলমান কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া রাঢ় পরিত্যাগ করেন, তখন দনুজারিও তাঁহার সহিত গিয়াছিলেন। তৎপুত্র হরিদেব পাণ্ডুনগরে গিয়া বাস করেন। হরিদেবের পুত্র নারায়ণদেব এবং নারায়ণদেবের দুই পুত্র—পুরন্দর ও পুরুজিৎ। পুরুজিতের পুত্র আদিত্য, আদিত্যের দুই পুত্র—দেবেন্দ্র ও ক্ষিতীন্দ্র। রণচণ্ডীর প্রসাদে দেবেন্দ্র পাণ্ডুনগরের অধিপতি হইয়াছিলেন। দেবেন্দ্রদেবের ঔরসে মহেন্দ্রদেব জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুসলমানদিগকে দূরীভূত করিয়া এবং কংস্যকুল নিহত করিয়া পাণ্ডুনগরের আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। তৎপুত্র মহাশাক্ত মহাবীর দনুজমর্দ্দনদেব গৌড়রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া ভার্য্যা পুত্রসহ গুরুর আদেশে সমুদ্রকুলে চন্দ্রদ্বীপে আসিয়া রাজধানী করেন, (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ৩৬৬-৩৬৭)। স্বর্গীয় রাধেশচন্দ্র শেঠ কর্ত্তৃক প্রকাশিত মহেন্দ্রদেবের মুদ্রার চিত্র দেখিয়া আমি অনুমান করিয়াছিলাম যে, উক্ত মুদ্রা ১৩৩৬ শকাব্দা অর্থাৎ ১৪১৪ খৃষ্টাব্দে মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল। ঢাকা-বিভাগের স্কুল-সমূহের ইনস্পেক্টর শ্রীযুক্ত ষ্টেপলটন্ (H. E. Stapleton) বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত খুলনা জেলায় আবিষ্কৃত দনুজমর্দ্দনদেবের মুদ্রাদর্শন করিতে আসিয়া আমাকে মহেন্দ্রদেবের অনেকগুলি রজতমুদ্রা দেখাইয়াছিলেন। এই সমস্ত মুদ্রা ১৩৪০-১৩৪৯ শকাব্দের (১৪১৮-১৪২৭ খৃষ্টাব্দের) মধ্যে কোন সময়ে মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল। কারণ, এই সকল মুদ্রার সহস্রাঙ্কের স্থানে ১, শতাঙ্কের স্থানে ৩, দশাঙ্কের স্থানে ৪ অঙ্কিত আছে। প্রায় সকল মুদ্রাতেই একাঙ্কের স্থান কাটিয়া গিয়াছে। ইতিপূর্ব্বে পাণ্ডুয়ায় আবিষ্কৃত মহেন্দ্রদেবের মুদ্রায় “শকাব্দা ১৩৩৬” পাঠ করিয়াছিলাম, কিন্তু মহেন্দ্রদেবের নবাবিষ্কৃত মুদ্রাসমূহ দেখিয়া স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, পাণ্ডুয়ার মুদ্রার তারিখের প্রকৃত পাঠোদ্ধার হয় নাই। ৺রাধেশচন্দ্র শেঠ যে মুদ্রার চিত্র প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা এখন কোথায় আছে, বলিতে পারা যায় না। মূল মুদ্রা পরীক্ষা না করিয়া পাঠোদ্ধার সম্বন্ধে কোন মত প্রকাশ করা উচিত নহে। বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদে দনুজমর্দ্দনদেবের যে মুদ্রা রক্ষিত আছে, তাহাতে স্পষ্ট শকাব্দা ১৩৩৯ লিখিত আছে। শ্রীযুক্ত ষ্টেপলটন্ মহেন্দ্রদেবের যে সমস্ত মুদ্রা সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহার তারিখের পাঠোদ্ধার সম্বন্ধে তিনি এবং আমি একমত হইয়াছি। এই সকল মুদ্রা যে ১৪১৮ হইতে ১৪২৭ খৃষ্টাব্দমধ্যে মুদ্রাঙ্কিত হইয়াছিল, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। এই সকল নবাবিষ্কৃত প্রাচীন মুদ্রার প্রমাণ হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে যে, মহেন্দ্রদেব দনুজমর্দ্দনের পরবর্ত্তী, পূর্ব্ববর্ত্তী নহেন; সুতরাং মহেন্দ্রদেবের সহিত যদি দনুজমর্দ্দনদেবের কোন সম্বন্ধ থাকে, তাহা হইলেও তিনি দনুজমর্দ্দনের পিতা হইতে পারেন না। বটুভট্টের “দেববংশে” মহেন্দ্রদেব দনুজমর্দ্দনের পিতা বলিয়া পরিচিত, কিন্তু বিজ্ঞান-সম্মত ঐতিহাসিক প্রমাণের বলে মহেন্দ্রদেব, দনুজমর্দ্দনের পুত্র অথবা উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হইতে পারেন। সুতরাং বটুভট্টের “দেববংশে”র ঐতিহাসিক অংশগুলি বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে রচিত ইতিহাসে গৃহীত হইতে পারে না।

 (২) ভোজবর্ম্মদেবের তাম্রশাসন:—এই তাম্রশাসনখানি ১৯১২ খৃষ্টাব্দে ঢাকা জেলায় বেলাবো গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী, শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক ও আমি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই তাম্রশাসনখানির পাঠ উদ্ধার করিয়াছি। উদ্ধৃত পাঠে দুই একটি নাম ব্যতীত বিশেষ কোন মতভেদ নাই। ভোজবর্ম্মার পিতার নাম শ্যামলবর্ম্মা। বঙ্গদেশীয় পাশ্চাত্য বৈদিকগণের মুখে শুনিতে পাওয়া যায় যে, তাঁহারা রাজা শ্যামলবর্ম্মার রাজত্বকালে শাকুণ-সত্র নামক যজ্ঞ সম্পন্ন করিতে কর্ণাবতী নগর হইতে বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন। ভোজবর্ম্মার তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইবার বহু পূর্ব্বে শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস” দ্বিতীয় ভাগে পাশ্চাত্য বৈদিকগণের কুলশাস্ত্র হইতে শ্যামলবর্ম্মার নিম্নলিখিত পরিচয় সংগ্রহ করিয়াছিলেন:—

 (ক) চন্দ্রবংশে ত্রিবিক্রম নামে এক নরপতি জন্মগ্রহণ করেন। * * * ইনি বিজয়সেন নামে এক পুত্র উৎপাদন করেন। * * অনন্তর রাজা বিজয়সেন তাঁহার মালতী নাম্নী গুণবতী মহিষীর গর্ভে মল্ল ও শ্যামল নামক দুইটি পুত্র উৎপাদন করেন। * * শ্রীমান্ শ্যামলবর্ম্মা অগ্রজ মল্লবর্ম্মাকে পিতৃসিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখিয়া স্বয়ং দিগ্বিজয় করিতে মনোযোগী হইলেন। * * * দেশবিদেশবাসী বহুসংখ্যক প্রবলপ্রতাপান্বিত নরপতি তাঁহার তীব্র পরাক্রমে পরাভূত হইলে তিনি স্বদেশে প্রত্যাগত হইয়া গৌড়ান্তর্গত বিক্রমপুরের উপান্তভাগে স্বীয় বাসার্থ একটি পুরী নির্ম্মাণ করিলেন।—রামদেব বিদ্যাভূষণের বৈদিক কুলমঞ্জরী।

 (খ) মহারাজ পরমধর্ম্মজ্ঞ ত্রিবিক্রম কাশিপুরীসমীপে বাস করিতেন * * * মহীপাল ত্রিবিক্রম সেই স্থানে অবস্থান করিয়া তাঁহার মহিষী মালতীর গর্ভে বিজয়সেন নামক এক পুত্র উৎপাদন করেন। * * * বিজয়সেনের পত্নীর নাম ছিল বিলোলা। * * এই বিলোলার গর্ভে রাজা বিজয়সেন দুইটি পুত্র উৎপাদন করেন। পুত্রদ্বয়ের মধ্যে একজনের নাম মল্লবর্ম্মা ও অপরজনের নাম শ্যামলবর্ম্মা। * * শ্যামলবর্ম্মা গৌড়দেশবাসী শত্রুগণকে জয় করিবার জন্য এখানে সমাগত হন। এইস্থানে আসিয়া তাঁহার বঙ্গদেশীয় প্রধান শত্রকে জয় করিয়া অতিধর্ম্মজ্ঞ শ্যামলবর্ম্মা রাজা হইয়াছিলেন।—ঈশ্বরকৃত বৈদিক কুলপঞ্জী।

 (গ) গঙ্গার পূর্ব্বে মেঘনার পশ্চিমে লবণসমুদ্রের উত্তরে ও বরেন্দ্রের দক্ষিণে স্বধর্ম্মশীল শ্যামলবর্ম্মা সেনবংশীয় নৃপতির আশ্রয়ে করদরূপে রাজ্য শাসন করিতেন—সামন্তসারের বৈদিক-কুলার্ণব।

 এতদ্ব্যতীত বসুজ মহাশয় অপর একখানি অজ্ঞাতনামা কুলগ্রন্থে শ্যামলবর্ম্মার একখানি তাম্রশাসনের কিয়দংশের প্রতিলিপি আবিষ্কার করিয়াছিলেন;—

 “দুই শত বৎসরের হস্তলিখিত অপর বৈদিক কুলপঞ্জিকায় শ্যামলবর্ম্মার তাম্রশাসনের অনুলিপি যেরূপ গৃহীত হইয়াছে আমরা নিম্নে তাহাই উদ্ধৃত করিলাম,—এই উদ্ধৃত পাঠ ও সেনবংশীয় বিশ্বরূপের তাম্রশাসনের পাঠ, উভয়ে মিলাইয়া দেখিলে সহজেই সকলে জানিতে পারিবেন যে, উভয়েই যেন এক ছাঁচে ঢালা।

 ইহ খলু বিক্রমপুরনিবাসি-কটকপতেঃ শ্রীশ্রীমতঃ জয়স্কন্ধাবারাৎ স্বস্তি সমস্ত-সুপ্রশস্ত্যপেতসততবিরাজমানাশ্বপতিগজপতিনরপতিরাজত্রয়াধি-পতি বর্ম্মবংশকুলকমলপ্রকাশভাস্করসোমবংশপ্রদীপপ্রতিপন্নকর্ণগাঙ্গেয় শরণাগত বজ্রপঞ্জর-পরমেশ্বর-পরমভট্টারকপরমসৌর-মহারাজাধিরাজ অরিরাজ বৃষভশঙ্কর-গৌড়েশ্বর শ্যামলবর্ম্ম-দেবপাদবিজয়িনঃ

—বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, দ্বিতীয় ভাগ, পৃঃ ২২।

 পূর্ব্বোক্ত গ্রন্থের আর একস্থানে বসু মহাশয় বলিয়াছেন,—“তিনি (শ্যামলবর্ম্মা) সেনবংশীয় নৃপতির আশ্রয়ে করদরূপে রাজ্য শাসন করিতেন। কিন্তু সেই সেনবংশীয় অধীশ্বরের নাম পাশ্চাত্য কুলগ্রন্থে স্পষ্ট পাওয়া যায় না। এদিকে শ্যামলবর্ম্মা কোন কুলগ্রন্থে ‘শূরান্বয়’, আবার কোন কোন কুলগ্রন্থে ‘সেনান্বয়’ বলিয়াই বর্ণিত।”

—বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, দ্বিতীয় ভাগ, পৃঃ ১৯।

 পূর্ব্বোক্ত প্রমাণসমূহের উপর নির্ভর করিয়া, বেলাবো তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইবার পূর্ব্বে, শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু স্থির করিয়াছিলেন যে, শ্যামলবর্ম্মা সেনবংশীয় হেমন্তসেনের পৌত্র, বিজয়সেনের কনিষ্ঠ পুত্র ও বল্লালসেনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। ভোজবর্ম্মার বেলাবো তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইলে প্রমাণ হইল যে, বসুজ মহাশয়ের পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্ত অসার এবং যে প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া তিনি এই সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন, সেই কুলশাস্ত্রের সিদ্ধান্তগুলি মিথ্যা কবিকল্পনা, তাহা প্রমাণস্বরূপ গণ্য হইতে পারে না। ভোজবর্ম্মার তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, শ্যামলবর্ম্মা সেনবংশীয় নহেন, তিনি যদুবংশজাত, তাঁহার পিতার নাম বিজয়সেন অথবা তাঁহার মাতার নাম বিলোলা নহে। দুঃখের বিষয় এই যে, বেলাবো তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইবার পরেও শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু “ভারতবর্ষ” পত্রিকায় “কুলগ্রন্থের ঐতিহাসিকতা ও ভোজের নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসন” নামে একটি প্রবন্ধ লিখিয়া কুলশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণের মর্য্যাদা রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই প্রবন্ধে বসুজ মহাশয় বলিয়াছেন যে, পূর্ব্বে তিনি কুলশাস্ত্রের যে সমস্ত পুথি পাইয়াছিলেন, তাহা ভ্রমে পরিপূর্ণ, “সাত নকলে আসল খাস্তা হইয়াছিল।” সম্প্রতি তিনি টালানিবাসী ৺গুরুচরণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাটী হইতে একখানি তালপত্রে লিখিত প্রাচীন পুথি পাইয়াছেন। ইহা ঈশ্বরকৃত বৈদিক-কুলপঞ্জিকা। “ভারতবর্ষ” পত্রিকায় বসুজ মহাশয় এই নূতন পুথি হইতে শ্যামলবর্ম্মার যে নূতন পরিচয় সংগ্রহ করিয়াছেন তাহা অতীব আশ্চর্য্য। ১৩১১ বঙ্গাব্দে বসুজ মহাশয় ঈশ্বর বৈদিককৃত কুলপঞ্জিকা হইতে শ্যামলবর্ম্মার যে বংশ-পরিচয় সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহার সহিত ১৩২০ বঙ্গাব্দে ঈশ্বর বৈদিকের কুলপঞ্জিকা হইতে বসুজ মহাশয় কর্ত্তৃক সংগৃহীত শ্যামলবর্ম্মার দ্বিতীয় বংশ-পরিচয় তুলিত হওয়া উচিত;—

শ্যামলবর্ম্মার প্রথম বংশ-পরিচয়;—


ত্রিবিক্রম মহারাজ সেনবংশ-সমুদ্ভবঃ।
আসীৎ পরমধর্ম্মজ্ঞঃ কাশীপুরসমীপতঃ॥
স্বর্ণরেখা নদী যত্র স্বর্ণযন্ত্রময়ী শুভা।
স্বর্গঙ্গাসলিলৈঃ পূতা সল্লোকজনতারিণী॥
অসৌ তত্র মহীপালো মালত্যাং নামতঃ স্ত্রিয়াং।
আত্মজং জনয়ামাস নাম্না বিজয়সেনকং॥
আসীৎ স এব-রাজা চ তত্র পুর্য্যাং মহামতিঃ।
পত্নী তস্য বিলোলা চ পূর্ণচন্দ্রসমদ্যুতিঃ॥
স্ত্রিয়াং তস্যাং হি পুত্রৌ দ্বৌ মল্লশ্যামলবর্ম্মকৌ।
স এব জনয়ামাস ক্ষৌণীরক্ষকরাবুভৌ॥
মল্লস্তত্রৈব প্রথিতঃ শ্যামলোঽত্র সমাগতঃ।
জেতুং শত্রুগণাং সর্ব্বান্ গৌড়দেশ-নিবাসিনঃ॥
বিজিত্য রিপুশার্দ্দূলং বঙ্গদেশ নিবাসিনং।
রাজাসীৎ পরমধর্ম্মজ্ঞো নাম্না শ্যামলবর্ম্মকঃ॥
—বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, দ্বিতীয় ভাগ, পৃঃ ১৪, পাদটীকা ২। 

শ্যামলবর্ম্মার দ্বিতীয় বংশ-পরিচয়।


ত্রিবিক্রম মহারাজ শূরবংশ-সমুদ্ভবঃ।
আসীৎ পরম ধর্ম্মজ্ঞো দেশে কাশীসমীপতঃ॥
স্বর্ণরেখা-পুরী যত্র স্বর্ণযন্ত্রময়ী শুভা।
স্বর্গঙ্গা-সলিলৈঃ পূতা সল্লোকজনতোষিণী॥

অসৌ তত্র মহীপালো মালত্যাং নামতঃ স্ত্রিয়াং।
আত্মজং জনয়ামাস নাম্না * কর্ণসেনকং॥
আসীৎ স এব রাজা চ তত্র পুর্য্যাং মহামতিঃ।
কন্যা তস্য বিলোলাচ পূর্ণচন্দ্রসমদ্যুতিঃ॥
শ্রিয়াং তস্যাং হি দ্বৌ পুত্রৌ মল্ল-শ্যামলবর্ম্মকৌ।
সা এব জনয়ামাস ক্ষৌণী-রক্ষকরা বুভৌ॥
মল্লস্তত্রৈব প্রথিতঃ শ্যামলোঽত্র সমাগতঃ।
জেতুং শত্রুগণান্ সর্ব্বান্ গৌড়দেশনিবাসিনঃ॥
বিজিত্য রিপুশার্দ্দূলং বঙ্গদেশনিবাসিনঃ।
রাজাসীৎ পরমধর্ম্মজ্ঞো নাম্না শ্যামলবর্ম্মকঃ॥
জিত্বা সর্ব্বমহীপতিং ভুজবলৈঃ পঞ্চাস্যতুল্যো বলী।
শ্রীমদ্বিক্রমপুরনামনগরে রাজাভবন্নিশ্চিতং॥
—ভারতবর্ষ, ১ম বর্ষ, পৃঃ ৩১।

 তুলনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, ঈশ্বর বৈদিকের কুলপঞ্জিকার দ্বিতীয় পুথিতে “কাশীপুর” স্থানে “দেশে কাশী,” “স্বর্ণরেখা নদী” স্থানে “স্বর্ণরেখা পুরী,” “বিজয়সেনকং” স্থানে “কর্ণসেনকং,” “পত্নী তস্য বিলোলা” স্থানে “কন্যা তস্য বিলোলা,” “স্ত্রিয়াং” স্থানে “শ্রিয়াং” পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। এই সকল পরিবর্ত্তন সমেত দ্বিতীয় পুথিখানি বেলাবো তাম্রশাসন আবিষ্কারের অল্পদিন পরেই বসুজ মহাশয়ের হস্তগত হইয়াছিল। বেলাবো তাম্রশাসনে শ্যামলবর্ম্মার মাতামহ চেদিরাজ কর্ণদেবের নাম আছে, সুতরাং উক্ত তাম্রশাসন আবিষ্কারের পরে ঈশ্বর বৈদিককৃত দ্বিতীয় পুথি আবিষ্কার হওয়ায় সন্দেহ হইতেছে যে, কোন দুষ্ট ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্ব্বক কতকগুলি কুলশাস্ত্র রচনা করিয়া বারংবার বসুজ মহাশয়কে প্রতারিত করিয়াছে। অল্পদিন পূর্ব্বে মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলিয়াছেন যে, সন্ধ্যাকরনন্দী-রচিত “রামচরিত” প্রকাশিত হইবার পরেই তাহার পূর্বপুরুষগণের নামাবলী আবিষ্কৃত হইল, কিন্তু তাহার পূর্ব্বে কেহ সন্ধ্যাকরনন্দীর বংশ-পরিচয় দিতে পারিলেন না, ইহা অত্যন্ত আশ্চর্য্যের বিষয়।

 (৩) বিজয়সেনের তাম্রশাসন—কয়েক বৎসর পূর্ব্বে জনৈক ভদ্রলোক আমার নিকটে বিজয়সেনের একখানি নূতন তাম্রশাসন আনিয়াছিলেন, ইহা বল্লালসেনের পিতা বিজয়সেনের ৩১ বা ৩৬ রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত হইয়াছিল। এই তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বল্লালসেনের মাতা বিলাসদেবী শূরবংশের কন্যা এবং বল্লালসেন স্বয়ং শূরবংশের দৌহিত্র। আদিশূর সম্বন্ধে কুলগ্রন্থের যে সমস্ত বচন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা পর্য্যালোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, সেনরাজগণ আদিশূরের দৌহিত্র-বংশজাত—

(ক)  জাতো বল্লালসেনো গুণিগণগণিতস্তস্য দৌহিত্রবংশে
(খ)  আদিশূরাৎ কুলে জাতা পুরুষাৎ সপ্তমাৎ পরম্।
কন্যকা সুন্দরী সাধ্বী নাম্না শ্রীঃ শ্রীরিব শুভা॥
(গ)  আসীৎ গৌড়ে মহারাজ আদিশূরঃ প্রতাপবান্।
তদাত্মজা-কুলে জাতো বল্লালাখ্যো মহীপতিঃ॥
(ঘ)  যতী জগদ্রাজজয়ীশবর্য্য ঐশ্বর্য্যশৌর্য্যার্জ্জববীর্য্যভাজী।
অপূর্ব্বভক্তির্ভবদেবদেবেষ্ববেদ শশাঙ্কস্মররন্ধ্রশাকে॥
জাতো বিজয়সেনো গুণিগণগণিতস্তস্য দৌহিত্রবংশে।
পুণ্যাত্মা দ্বেষশূন্যো ধরণীপতিগণৈঃ পূজ্যমানপ্রধানঃ॥

 বিজয়সেনের তাম্রশাসনে যখন দেখিতে পাইতেছি যে, বল্লালসেন স্বয়ং শূরবংশের দৌহিত্র ছিলেন, তখন—

 (ক) তিনি কখনই আদিশূরের দৌহিত্র-বংশজাত হইতে পারেন না।

 (খ) তাঁহার মাতার নাম শ্রী নহে, কিন্তু তাঁহার মাতা বিলাসদেবীই শূরবংশের কন্যা।

 পূর্ব্বোক্ত প্রমাণানুসারে সাধারণতঃ কুলশাস্ত্রের প্রমাণগুলি অসত্য বলিয়া বোধ হয়। অনুমান হয় যে, প্রাচীন জনপ্রবাদ লইয়া কুলশাস্ত্র রচিত হইয়াছিল। শ্যামলবর্ম্মার সময়ে বঙ্গে বৈদিক ব্রাহ্মণগণ আগমন করিয়াছিলেন। দনুজমর্দ্দনদেব চন্দ্রদ্বীপ-রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। আদিশূরের সময়ে বঙ্গে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ আগমন করিয়াছিলেন। এই সকল জনপ্রবাদ ব্যতীত কুলশাস্ত্রে প্রাচীনকালে বংশপরম্পরা ও বিবাহ-সম্বন্ধ ব্যতীত অন্য কোন বিষয় বর্ণিত হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয় না। বর্ত্তমান সময়ে কুলশাস্ত্রসমূহে রাশি রাশি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু নূতন ঐতিহাসিক আবিষ্কারের আলোকে তৎসমুদয় “প্রক্ষিপ্ত” প্রমাণ হইতেছে। এইজন্য গ্রন্থমধ্যে কুলশাস্ত্রোদ্ধৃত কোন বচন প্রমাণস্বরূপ গৃহীত হইল না।

  1. তেষামুর্জ্জিতবৈরি-বিদারণ-পটুং পৌণ্ড্রাধিপং ক্ষ্মাপতিং
    হত্বৈকো বিষয়ং তমেব সকলং জগ্রাহ শৌর্য্যান্বিতঃ॥
    —Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 44.
  2. Indian Antiquary, Vol. IX, p. 178.
  3. শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গ পণ্ডিত সম্পাদিত, বাকপতিরাজ প্রণীত, গউডবহো, শ্লোক ৩৬৫-৪১৭।
  4. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ১৫
  5. Journal Asiatique, 1895, p. 353.
  6. Stein’s Chronicles of the Kings of Kashmir, Introduction, р. 89.
  7. Indian Antiquary, Vol. XVII, p. 811.
  8. Chronicles of the Kings of Kashmir, Vol. II, Note F, pp. 300-303.
  9. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ১৭।
  10. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ১৬।
  11. After Yasovarman’s defeat Kalhana makes Lalitaditya start on a march of triumphal conquest round the whole of India, which is manifestly legendary.—Stein’s Chronicles of the Kings of Kashmir, Vol. I, p. 90.
  12. It is impossible in the absence of other records to ascertain the exact elements of historic truth underlying Kalhana’s romantic story.........The King’s wanderings during his exile seem to have taken him to Bengal, and to have subsequently been embellished by popular imagination.—Chronicles of the Kings of Kashmir, Vol. I, p. 94.
  13. But the romantic tale of his visit incognito in the capital of Paundravardhana in Bengal, the modern Rajshahi District, then the seat of Government, of a King named Jayanta, unknown to sober history, seems to be purely imaginary.—V. A. Smith, Early History of India, 3rd edition, pp. 375-376.
  14. “যতদিন না সমসাময়িক লিপিতে বা সাহিত্যে জয়ন্তের নামোল্লেখ দৃষ্ট হয়, ততদিন জয়ন্ত প্রকৃত ঐতিহাসিক ব্যক্তি, কিম্বা জয়াপীড়ের অজ্ঞাতবাস উপন্যাসের উপনায়ক মাত্র, তাহা বলা কঠিন।”—গৌড়রাজমালা, পৃঃ ১৮।
  15. বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ্ পত্রিকা, ষষ্ঠভাগ,—কার্য্যবিবরণ, পৃঃ ৷৹।
  16. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, প্রথম ভাগ, প্রথম অংশ, পৃঃ ১০১।
  17. গৌড়রাজমালা পৃঃ ১১৪, পাদটীকা ২।
  18. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ১৯, পাদটীকা।
  19. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, (কায়স্থ কাণ্ডের প্রথমাংশ), পৃঃ ৯৮।
  20. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্যকাণ্ড, কায়স্থকাণ্ডের প্রথমাংশ), পৃঃ ৯৯-১০০ পাদটীকা।
  21. মানসী, মাঘ ১৩২১। উপরিলিখিত বৃত্তান্ত শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ লিখিত ‘আদিশূর’ নামক প্রবন্ধ হইতে সঙ্কলিত হইল।
  22. মানসী, মাঘ ১৩২১, পৃঃ ৬৮১।
  23. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ৯৮, পাদটীকা ১৯।
  24. Convincing, if not absolutely conclusive proof can also be given that the Gurjaras, originally, were an Asiatic horde of nomads, who forced their way into India along with or soon after the White Huns in either the 5th or 6th Century.—The Gurjaras of Rajputana and Kanauj,—Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 54.
  25. তেষু চৈবমুৎপদ্যমানেষু ক্রমেনোদপাদি হূণহরিণকেসরী সিন্ধুরাজোজ্বর গুর্জ্জরপ্রজাগরঃ গান্ধারাধিপগন্ধদ্বিপকূটপাকলঃ লাটপাটবপাটচ্চরঃ মালবলক্ষ্মীলতাপরশুঃ প্রতাপশীল ইতি প্রথিতাপরনামা প্রভাকরবর্দ্ধনোনামরাজাধিরাজঃ।—হর্ষচরিত, ৪র্থ উচ্ছ্বাস (৺ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পাদিত) পৃঃ ৯২। Cowell & Thomas, Bana’s Harsacarita, p. 101.
  26. প্রতাপোপনতা যস্য লাটমালবগূর্জ্জরাঃ।
    দণ্ডোপনতসামন্তচর্য্যা বর্য্যা ইবাভবন্॥
    —Indian Antiquary Vol. VIII, p.242.
  27. Watters’s On-Yuan-Chwang, Vol. II, p. 249.
  28. Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 55.
  29. Epigraphia notes and questions, iii. Journal of the Bombay Branch of the Royal Asiatic Society, Vol XXI, pp. 405-12; “Gurjaras,” Ibid, pp. 413-33.
  30. শ্রীমথনদেবোমহারাজাধিরাজ ...... গুর্জ্জরপ্রতীহারান্বয়ঃ।—Epigraphia Indica, Vol. III, p. 266.
  31. Bombay Gazetteer, Vol. I, pt. I, p. 113.
  32. আত্মারামফলাদুপার্জ্য বিজরং দেবেন দৈত্যদ্বিষা জ্যোতির্ব্বীজমকৃত্রিমে গুণবতি ক্ষেত্রে যদুপ্তং পুরা [।] শ্রেয়ঃ কন্দবপুস্ততস্সমভবদ্ভাস্বানতশ্চাপরে মন্বিক্ষ্বাকুককুস্থমূলপৃথবঃ ক্ষ্মাপালকল্পদ্রুমাঃ॥২॥ তেষাং বংশে সুজন্মা ক্রমনিহিতপদে ধাম্নি বজ্রেষু ঘোরং রামঃ পৌলস্ত্যহিন্শ্রং ক্ষতবিহতিসমিৎকর্ম্ম চক্রে পলাশৈঃ শ্লাঘ্যস্তস্যানুজোসৌ মঘবমদমুষো মেঘনাদস্য সংখ্যে সৌমিত্রিস্তীব্রদণ্ডঃ প্রতিহরণবিধের্যঃ প্রতীহার আসীৎ॥৩॥—Annual Report of the Archæological Survey of India, 1903-4, p. 280, verse 2 and 3.
  33. তদ্বন্শে প্রতিহারকেতনভৃতি ত্রৈলোক্যরক্ষাস্পদে
    দেবো নাগভটঃ পুরাতনমুনের্মূতির্ব্বভূবাদ্ভুতং।
    যেনাসৌ সুকৃতপ্রমাথিবলনম্লেচ্ছাধিপাক্ষৌহিণীঃ
    ক্ষুন্দানস্ফুরদুগ্রহেতিরুচিরের্দ্দোর্ভিশ্চতুর্ভির্ব্বভৌ॥৪॥
    —Ibid.

  34. Sir H. Elliot’s History of India, Vol. I, Note B, p. 495.
  35. খ্যা (তাদ্) ভণ্ডিকুলান্মদোৎকটকরিপ্রাকারদুর্ল্লঙ্ঘতো
    যঃ সাম্রাজ্যমধিজ্যকার্ম্মুকসখা সংখ্যে হঠাদগ্রহীৎ।
    একঃ ক্ষত্রিয়পুঙ্গবেষু চ যশোগুর্ব্বীন্ধুরং প্রোদ্বহ-
    ন্নিক্ষ্বাকোঃ কুলমুন্নতং সুচরিতৈশ্চক্রে স্বনামাঙ্কিতং॥৭॥
    —Annual Report, Archæological Survey of India, 1903-4, pp. 280-81, verse 7. 

  36. শাকেষ্বব্দশতেষু সপ্তসু দিশং পঞ্চোত্তরেষূত্তরাং
    পাতীন্দ্রায়ুধনাম্নি কৃষ্ণনৃপজে শ্রীবল্লভে দক্ষিণাম্।
    পূর্বাং শ্রীমদবন্তিভূভৃতি নৃপে বৎসাদি() রাজেঽপরাং
    সোর্যা(রা) ণামধিমণ্ডলে(লং) জয়যুতে বীরে বরাহেঽবতি॥
     —Journal of the Royal Asiatic Society, 1909, p. 253.

  37. If the name Ratta was strange, it might be pronounced Ratta, Ratha or Raddi. This last form almost coincides with the modern Kanarese caste-name Reddi, which, so far as information goes, would place the Rastrakutas among the tribes of pre-sanskrit southern origin......the Bardic accounts of the origin of the Rathods of Kanauj, and Marwar vary greatly......the Rathod genealogies trace their origin to Kusa son of Rama of the solar race. The Bards of solar race hold them to be descendants of Hiranya Kasipu by a demon or Daitya mother.—Bombay Gazetteer, Vol. I, part I, pp. 119-20.
  38. The Rashtrakutas are represented to have belonged to the race of Yadu......The Rashtrakuta family was in all likelihood the main branch of the race of Kshtriyas, named Ratthas, who gave their name to the country of Maharashtra, and were found in it even in the times of Asoka, the Maurya—Bhandarkar’s Early History of the Dekkan, 2nd edition, p. 62.
  39. ৩৯.০ ৩৯.১ Bombay Gazetteer, Vol. I, part I, p. 120.
  40. Bhandarkar’s Early History of the Dekkan, 2nd edition, р. 76.
  41. কাঞ্চীশকেরলনরাধিপচোলপাংড্যশ্রীহর্ষবজ্রটবিভেদবিধানদক্ষং।
    কর্ণ্ণাটকং বলমনন্তমজেয়রথ্যৈর্ভৃত্যৈঃ কিয়দ্ভিরপি যঃ সহসা জিগায়॥
    —Samangad grant of Dantidurga—Indian Antiquary, Vol. XI, p. 112. 

  42. হেলাস্বীকৃতগৌড়রাজ্যকমলামত্তম্ প্রবেশ্যাচিরা-
    দ্দুর্মার্গং মরুমধ্যমপ্রতিবলৈ র্যো বৎসরাজং বলৈঃ।
    গৌড়ীয়ং শরদিন্দুপাদধবলং ছত্রদ্বয়ং কেবলং
    তস্মান্নাহৃত তদ্‌যশোপি ককুভাং প্রান্তে স্থিতং তৎক্ষণাৎ॥
    Wani grant—Indian Antiquary, Vol XI, p. 157;
    Radhanpur grant—Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 243. 

  43. গৌড়েন্দ্রবঙ্গপতিনির্জ্জয়দুর্ব্বিদগ্ধসদ্‌গুর্জ্জরেশ্বরদিগর্গলতাং চ যস্য।
    নীত্বা ভুজং বিহিতমালবরক্ষণার্থং স্বামী তথান্যমপি রাজ্যফলানি ভুংক্তে॥
    Baroda grant of Karkaraja—Indian Antiquary, Vol. XII, p. 160. 

  44. জ্যেষ্ঠোল্লংঘনজাতয়াপ্যমলয়ালক্ষ্ম্যা সমেতোপি সং
    যোভূন্নির্ম্মলমণ্ডলস্থিতিযুতো দোষাকরো ন ক্বচিৎ।
    কর্ণ্ণাধস্থিতদানসন্ততিভৃতো যস্যান্যদানাধিকং
    দানং বীক্ষ্য সুলজ্জিতা ইব দিশাং প্রান্তে স্থিতা দিগ্‌গজাঃ॥৫
    Radhanpur grant of Govinda III—Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 243.

  45. অন্যৈর্ন জাতু বিজিতং গুরুশক্তিসারমাক্রান্তভূতলমনন্য সমানমানং।
    যেনেহ বদ্ধমবলোক্য চিরায় গঙ্গং দূরম্ স্বনিগ্রহভিয়েব কলিঃ প্রয়াতঃ॥৬
    একত্রাত্মবলেন বারিনিধিনাপ্যন্যত্র রুধ্বা ঘনং
    নিষ্কৃষ্টাসিভটোদ্ধতেন বিহারদ্‌গ্রাহাতিভীমেন চ।
    মাতঙ্গান্ মদবারিনির্ঝরমুচঃ প্রাপ্যানতাৎ পল্লবাৎ
    তচ্চিত্রং মদলেশমপ্যনুদিনং য স্পৃষ্টবান্ ন ক্বচিৎ॥৭
    —Radhanpur Grant of Govinda III; Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 243. 

  46. Bhandarkar’s Early History of the Dekkan, p. 65.
  47. শ্বেতাতপত্রত্রিতয়েন্দুবিম্বলীলোদয়াদ্রেঃ কলিবল্লভাখ্যাৎ।
    ততঃ কৃতারাতিমদেভভঙ্গো জাতো জগতুঙ্গমৃগাধিরাজঃ॥১১
    —Deoli Plates of Krishna III, Epigraphia Indica, Vol. V, p. 193.