বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/কলেজ জীবন ও সন্ন্যাস গ্রহণের চেষ্টা

উইকিসংকলন থেকে

কলেজ জীবন ও সন্ন্যাস গ্রহণের চেষ্টা

 ম্যাট্রিকিউলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার পরে সুভাষচন্দ্র কলিকাতায় আসেন। এখানে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ইণ্টারমিডিয়েট কোর্স পড়িবার সময় তাঁহার অন্তরে সন্ন্যাসগ্রহণের প্রবল প্রেরণা আসে। তিনি ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছিলেন অনেক সাধুপুরুষ ধর্ম্মজীবন লাভ করিবার উদ্দেশ্যে সংসার পরিত্যাগ করিয়া হিমালয় প্রদেশে গমন করিয়াছেন এবং কঠোর তপস্যার ফলে সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। এই ধনীর দুলালও চতুর্দ্দশ বৎসর বয়সে সংসারের ভোগসুখে বীতস্পৃহ হইয়া সদ্গুরুর অন্বেষণে গৃহ পরিত্যাগ করিতে দৃঢ়সংকল্প হইলেন। আর্য্য ঋষিগণের প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করিয়া ধর্ম্মজীবন লাভ করিবার আশায় বালক সুভাষ দ্বিতীয় বুদ্ধের ন্যায় একদিন সত্য সত্যই মাতাপিতা আত্মীয়স্বজনের মায়া মোহ কাটাইয়া হিমালয় অভিমুখে ধাবিত হইলেন ৷

 বস্তুতঃ যে সময়ে মহাত্মা গান্ধী নবীন ব্যারিষ্টার রূপে ভারতের ধর্ম্মাধিকরণ অলঙ্কৃত করিয়া স্বীয় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয় চিন্তা করিতেছিলেন,। যে সময়ে যুবক নেহেরু হ্যারো ও কেম্ব্রিজের ক্রীড়া প্রাঙ্গণে বালস্বভাবসুলভ ক্রীড়ায় সময়াতিপাত করিতেছিলেন, সেই সময়ে এই তরুণ বালক সংসারসুখে জলাঞ্জলি দিয়া সন্ন্যাস জীবনের কৃচ্ছ্রসাধনে মনোনিবেশ করিলেন। গভীর তমসাবৃত রজনীতে যখন সমগ্র জগৎ সুষুপ্ত, যখন সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি হিংস্র জন্তুগণ অরণ্য প্রদেশে শিকারান্বেষণে ব্যস্ত, যখন বাত্যাবিক্ষুব্ধ নদী তরঙ্গরাশির ভীষণ গর্জ্জনে বীরপুরুষের হৃদয়ও কম্পমান, সেই সময়ে এই তরুণ সন্ন্যাসী হিমালয় প্রদেশের ভীষণ বনানী মধ্যে সদ্‌গুরুর অনুসন্ধানে নির্ভীকভাবে বিচরণ করিতেছিলেন।

 এইরূপ ধর্ম্মোন্মত্ততা লইয়া এই তরুণ সন্ন্যাসী হরিদ্বার, বারাণসী, গয়া, বৃন্দাবন প্রভৃতি প্রসিদ্ধ তীর্থস্থানের হিন্দু মন্দির সকল দর্শন করিয়া এবং তত্রত্য সাধু মোহান্ত ও ধর্ম্মার্থিগণের জীবন যাপন প্রণালী লক্ষ্য করিয়া ছয়মাস অতিবাহিত করিলেন। কিন্তু সেই সকল গৃহত্যাগী সাধু সন্ন্যাসীগণের মধ্যে ভোগলালসার আতিশয্য দেখিয়া এই নবীন সন্ন্যাসী হতাশ হইয়া গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন।

 ১৯১৫ সালে সুভাষচন্দ্র আই-এ পরীক্ষা দিয়া প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কলেজে পাঠ করিবার সময়ে সতীর্থগণের উপর তিনি তাঁহার অসামান্য প্রভাব বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ছাত্রজীবনে সুভাষচন্দ্র স্বামী বিবেকানন্দের অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন। এমন কি ভবিষ্যৎ জীবনে তিনি স্বামীজীকেই আদর্শরূপে গ্রহণ করিয়া তাঁহার প্রদর্শিত পথে গমন করিতে চেষ্টা করিতেন। তিনি বলিতেন “স্বামীজি ও আমি একই আদর্শ লইয়া কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছি। তবে তাঁহার বিষয়বস্তু—ধর্ম্ম এবং আমার বিষয়বস্তু—রাজনীতি।”

 ইহার পর প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক মিঃ ই, এফ, ওটেনকে প্রহার করার অপরাধে সুভাষচন্দ্র কলেজ হইতে বিতাড়িত হন। এই সময়ে কলেজের ছাত্রগণের মধ্যে ধর্ম্মঘট হয় এবং এই ধর্ম্মঘটের জন্য কর্তৃপক্ষগণ সুভাষচন্দ্রকেই দায়ী করেন। এইরূপে বাধাপ্রাপ্ত হইয়া সুভাষচন্দ্র কিছুদিন অধ্যয়ন কার্য্য হইতে বিরত থাকেন। এই ঘটনার ফলে শাসক জাতির ব্যবহারে তাঁহার জীবনে আমূল পরিবর্তন লক্ষিত হয়।

 ১৯১৭ সালে পরলোকগত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সহায়তায় তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনঃ প্রবেশ করিবার অনুমতি লাভ করেন, এবং স্কটিশ চার্চ্চ কলেজে চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে যোগদান করেন। ক্লাসের মধ্যে শেষ বেঞ্চে তাঁহার বসিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট ছিল। চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে পড়িবার সময় ছাত্রগণ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়াই একমাত্র কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র এই অল্প সময়ের মধ্যেও তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণকে লইয়া ময়দানে ফুটবল খেলা দেখিতে যাইতেন এবং খেলা শেষ হইলে পদব্রজে তাঁহার ভবানীপুরের বাটীতে ফিরিয়া আসিতেন।

 সুভাষচন্দ্র স্কটিশচার্চ্চ কলেজ হইতে বি-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর সম্মান লাভ করেন। এই সময়ে বাঙ্গালী ছাত্রদিগকে সামরিক শিক্ষা দিবার জন্য ইউনিভারসিটি ট্রেণিং কোর গঠিত হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র এই ট্রেণিং কোরে যোগদান করেন।

 ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করিবার জন্য সুভাষচন্দ্র বিলাত যাত্রা করেন। বিলাত যাত্রার আট মাস পরে তিনি আই-সি. এস পরীক্ষা দেন। ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া তিনি চতুর্থস্থান অধিকার করেন। তিনি মনোবিজ্ঞান ও নীতিবিজ্ঞানে ট্রাইপোজ সহ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ ডিগ্রীও লাভ করেন। ইংলণ্ডে শিক্ষালাভ করিবার সময়ে শ্রীযুক্ত দিলীপকুমার রায়, কলিকাতা করপোরেশনের ভূতপূর্ব্ব এডুকেশন অফিসার মিঃ কে. পি. চট্টোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক কে. সি চট্টোপাধ্যায় তাঁহার বন্ধু ছিলেন ৷

 একদিকে সিভিল সার্ভিসের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ—অপর দিকে মাতৃভূমির আকুল আহ্বান, সুভাষচন্দ্র কোন্ পথে যাইবেন! স্বদেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র মায়ের ডাকই শুনিলেন। তিনি সিভিল সার্ভিসের লোভনীয় পদ পরিত্যাগ করিয়া মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিবার সংকল্প করিলেন।

 সুভাষচন্দ্র সিভিল সার্ভিসে কৃতকার্য্য হওয়াতে আহ্লাদিত না হইয়া বরং দুঃখিত হইয়াছিলেন। এ বিষয়ে তিনি তাঁহার কলিকাতাস্থ বন্ধুগণকে এই মর্ম্মে পত্র লিখিলেন “আমি সিভিল সার্ভিসে কৃতকার্য্য হওয়া সত্ত্বেও এই লোভনীয় পদ পরিত্যাগ করিবার সংঙ্কল্প করিয়াছি। কেন না আমি স্থিরভাবে চিন্তা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে ইংরাজপ্রভু ও স্বদেশ এই উভয়কে একই সময়ে সেবা করা যখন আমার পক্ষে অসম্ভব, তখন সিভিল সার্ভিসের মোহ পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশ-সেবা ব্রতকেই জীবনের কর্ত্তব্য বলিয়া স্থির করিব।” এই সংকল্প কার্য্যে পরিণত করিবার জন্য তিনি ষ্টেটস্ সেক্রেটারী মিষ্টার মল্টেগুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন এবং তাঁহার বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র সিভিল সার্ভিসে ইস্তফা প্রদান করিলেন।