বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান

উইকিসংকলন থেকে

সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান

 সুভাষচন্দ্র তাঁহার এলগিন রোডের বাসভবন হইতে কিরূপে অন্তর্ধান হইয়াছিলেন তাহা এখনও গভীর রহস্য জালে আবৃত। আকালী দলের বিশিষ্ট নেতা মাষ্টার তারাসিং তাঁহার মাসিক পত্র “সন্ত সিপাহী”তে যে বিবরণ দিয়াছেন তাহা হইতে জানা যায় যে শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ সালে একবার অন্তর্ধানের চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তখন তাঁহার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে অসুস্থতার জন্য মুক্তিলাভের পর নেতাজী কলিকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক সর্দ্দার নিরঞ্জন সিং তালিবের নিকট রূশিয়ায় গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তালিব পাঞ্জাব কম্যুনিষ্ট পার্টি এবং আকালীদের সহিত পরামর্শ করিয়া স্থির করেন যে কম্যুনিষ্টগণ শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসুকে রাশিয়ায় প্রেরণের ব্যবস্থা করিবেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কার্য্যে পরিণত হয় নাই। ইতিমধ্যে সুভাষচন্দ্র অন্তর্ধান হন।

 শ্রীযুত বসু কলিকাতা ত্যাগ করিবার ২৬ দিন পরে তাঁহার অন্তর্ধানের কাহিনী প্রচার করা হয়। তিনি ১৯৪০ সালের ১৩ই ডিসেম্বর মোটরে কলিকাতা ত্যাগ করেন, এবং বর্দ্ধমানে পাঞ্জাব মেলের দ্বিতীয় শ্রেণীর একখানি কামরায় আরোহণ করেন।[১] ঐ কামরা তাঁহার জন্য রিজার্ভ করা ছিল। ঐ সময়ে তাঁহার বড় বড় চুল ও শ্বশ্রু হইয়াছিল। পেশোয়ারে পৌঁছিবার পর তাঁহাকে পাঠানের ন্যায় দেখায়। তিনি ছয়দিন খান আব্বাজ খানের নিকট ছিলেন। পেশোয়ার হইতে একজন দেহরক্ষী সহ তাঁহাকে কাবুলে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। নেতাজী পেশোয়ার হইতে একখানি পেশোয়ারি টোঙ্গায় পাঁচ মাইল পথ গমন করেন। তাহার পর তিনি পদব্রজে যাত্রা আরম্ভ করেন। তিনি তৎকালে জিয়াউদ্দিন নামক ছদ্মনাম ধারণ করিয়াছিলেন।

 কাবুলে উপনীত হইয়া নেতাজী আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন। ঐ অবস্থায় তিনি একজন গোয়েন্দার হাতে পড়েন। কিন্তু তিনি একখানি দশটাকার নোট ও একটি ফাউণ্টেন পেন দিয়া তাহার কবল হইতে উদ্ধার লাভ করেন। তথা হইতে তিনি সোভিয়েট গভর্ণমেণ্টের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করেন। সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট তাঁহাকে জানান যে তাঁহারা এখন তাঁহাকে (শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসুকে) আশ্রয় দিতে পারেন না। কারণ রূষ-জার্ম্মাণ মৈত্রী-চুক্তি ভাঙ্গিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে এবং সোভিয়েট গভর্ণমেণ্টের সহিত ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের আলাপ আলোচনা চলিতেছে। সেইজন্য সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট ব্রিটিশকে আর বিরক্ত করিতে চাহেন না। ঘটনাক্রমে ঐ সময়ে একজন জার্ম্মাণ কাবুলে অবস্থান করিতেছিলেন। তিনি জানিতে পারেন যে শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ত্যাগ করিতে চাহেন। তিনি তৎক্ষণাৎ বার্লিনের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাহার পর রাশিয়ার উপর দিয়া বিমানে তাঁহাকে বার্লিনে লইয়া যাইবার ব্যবস্থা হয়।

 লাহোরের Daily Milap পত্রে লালা উত্তমচাঁদ নামক একজন রেডিও ব্যবসায়ী নেতাজীর সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়াছেন তাহা হইতে জানা যায় যে নেতাজী কাবুলে গিয়া প্রথমে এক লরিচালকের হোটেলে অবস্থান করেন। তিনি পাঠানের বেশে সজ্জিত ছিলেন। সে সময়ে তাঁহার শ্বশ্রু দীর্ঘ হইয়াছিল এবং পাঠানদিগের ন্যায় মস্তকে ফেজও পরিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে একজন পেশোয়ার বাসী দোভাষী ছিল। এই সময়ে আফগান ডিটেক্‌টিভ বিভাগের জনৈক কর্ম্মচারি সন্দেহক্রমে সুভাষ বাবুকে নানাবিধ প্রশ্ন করেন। দোভাষী পুলিশ-কর্ম্মচারিকে বুঝাইয়া দেন যে ইনি একজন পেশোয়ারি ভদ্রলোক, কিন্তু ‘কালা ও বোবা।’ গোয়েন্দা পুলিশ ইহাতেও সন্তুষ্ট না হওয়াতে নেতাজী তাঁহার রিষ্টওয়াচটি প্রদান করিয়া তাহার হস্ত হইতে উদ্ধারলাভ করেন।

 অতঃপর নেতাজী লালা উত্তমচাঁদের বিষয় অবগত হন, এবং তাঁহার আবাসে গিয়া কয়েকদিন অবস্থান করেন। তাহার পর তিনি বিমানযোগে বার্লিন যাত্রা করেন।

 নেতাজীকে আশ্রয় দেওয়াতে লালা উত্তমচাঁদ পুলিশ কর্ত্তৃক নানাপ্রকারে নির্য্যাতিত হইয়াছিলেন। প্রথমতঃ তাঁহাকে কাবুল হইতে পেশোয়ারে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। একরাত্রি গৃহবাস করিবার পরই সি, আই, ডি বিভাগ হইতে পুনরায় তাঁহাকে বন্দী করা হয় এবং সীমান্ত প্রদেশ, লাহোর এবং পাঞ্জাবের ভিন্ন ভিন্ন জেলে চারি বৎসর আটক রাখিবার পর সম্প্রতি তাঁহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে।

 অল্পদিন হইল ভারত সরকারের পররাষ্ট্রদপ্তরের সেক্রেটারি মিঃ এইচ, জি, ওয়েটম্যান নয়া দিল্লীর কেন্দ্রীয় পরিষদে যে বিবৃতি দিয়াছেন তাহা হইতে জানা যায় যে ১৯৪২ সালের মে মাস হইতে জুন মাসের মধ্যে লালা উত্তমচাঁদকে গ্রেপ্তার ও আফগানিস্থান হইতে বহিষ্কার করা হয়। পরে তাঁহার সম্পত্তি নীলামে বিক্রয় করিয়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ তাঁহার নামে ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হইয়াছে।

 এদিকে সুভাষ বাবু তাঁহার এলগিন রোডের বাটী হইতে নিরুদ্দিষ্ট হওয়ায়, কলিকাতা পুলিসকোর্টে তাঁহার বিরুদ্ধে যে মোকর্দ্দামা চলিতেছিল, দিনের পর দিন তাহা মুলতুবী রাখা হইতেছিল। তাঁহাকে আদালতে হাজির করান অসম্ভব হওয়ায় গভর্ণমেণ্ট তাঁহার এলগিন রোডের বাড়ীর অংশ ক্রোক দিলেন। ক্রোকের পর ছয় মাসের মধ্যেও তিনি আদালতে উপস্থিত না হওয়ায়, ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট তারিখে উহা নীলাম হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হয়। নির্দ্দিষ্ট দিবসে কোনও খরিদার উপস্থিত না হওয়ায়, পুনরায় অপর একটি দিন ধার্য্য করা হয়। দ্বিতীয় দিনেও কোন খরিদার উপস্থিত না হওয়াতে অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য নীলাম স্থগিত রাখিবার ব্যবস্থা হয়।

  1. ১৯৪১ সালের ২৬শে জানুয়ারি সুভাষ বাবুর অন্তর্ধানের সংবাদ প্রচারিত হয় এবং বৎসরাধিক কাল এই পলায়ন-কাহিনী রহস্যজালে আবৃত থাকে। প্রথমতঃ অনেকেই মনে করিয়াছিলেন, তিনি রাজনৈতিক জীবনে বীতশ্রদ্ধ হইয়া শ্রীঅরবিন্দের ন্যায় সন্ন্যাস-জীবন আরম্ভ করিয়াছেন। কেহ কেহ মনে করিয়াছিলেন, তিনি ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের নির্য্যাতন হইতে উদ্ধার লাভ করিবার জন্য বৈদেশিক রাজ্যে গিয়া আত্মগোপন করিয়াছেন। ভারত গভর্ণমেণ্টের Home Department এর সেক্রেটারি যখন বিবৃতি দেন যে সুভাষবাবু ইটালির রাজধানী নোম নগরীতে অথবা জার্ম্মাণ রাজধানী বার্লিনে অবস্থান করিতেছেন, তখন তাঁহার দেশবাসিগণ এ সংবাদে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারেন নাই। ইহার কিছুদিন পরে যখন আংলো ইণ্ডিয়ানদিগের মুখপত্র Statesman এ উপর্য্যুপরি কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং উহাতে বর্ণিত হয় যে সুভাষবাবু কংগ্রেসের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিবার কালিন চক্রশক্তির নির্দ্দেশক্রমে ‘পঞ্চম বাহিনী’ সৃষ্টি করিয়া আসিতেছেন এবং বর্ত্তমানে চক্রশক্তির সহিত সংযোগ স্থাপন করিয়া রোম অথবা বার্লিনে অবস্থান করিতেছেন তখনও অনেকে সংবাদটি সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে ইতঃস্তত করিতেছিলেন। তাহার অল্পদিন পরেই প্রচারিত হয়, তিনি বিমানযোগে টোকিও গমন কালে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। পরিশেষে Bombay Cronicleএ লণ্ডনের সংবাদদাতার পত্রে ইহার প্রতিবাদপাঠে অবগত হওয়া যায় যে সুভাষবাবুর মৃত্যু হয় নাই, পরন্তু তিনি অক্ষত শরীরে বার্লিনে অবস্থান করিতেছেন, এবং জার্ম্মাণ অধিনায়ক তাঁহাকে India's Fucherer and Excellency উপাধিতে ভূষিত করিয়াছেন। পরিশেষে এই সংবাদ নানাদিক হইতে সমর্থিত হয়। “Rebel President”